অনেকসময়েই বিজ্ঞানের একাধিক শাখা একে অপরের সাথে জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু আজকের স্পেশালাইজেশনের যুগে দেখা যায় ক্রস-ডিসিপ্লিন নলেজ বা একাধিক শাখায় দক্ষ লোকের সংখ্যা কমেই চলেছে। তবে যখনকার কথা বলছি, তখন এই সমস্যাটা এত গভীর ছিল না। তাই জ্ঞান বিনিময়ের জন্য বিজ্ঞানীদের অভাব হত না। তাও কিছু কিছু বিজ্ঞানী এদের মধ্যে আলাদা করে জায়গা করে নিতে পারেন। আর কেউ কেউ পারেন এক শাখার বিজ্ঞানীদের অন্য শাখায় উৎসাহিত করে তুলতে। শেষোক্ত কাজটিই করেছিলেন অস্ট্রিয়ান নোবেলজয়ী পদার্থবিদ এরুইন শ্রোডিংগার।
শ্রোডিংগার কিন্তু সম্পূর্ণরূপে একজন নিবেদিতপ্রাণ পদার্থবিদই ছিলেন। ১৯৪৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে উনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে জানালেন যে বিষয়বস্তু পদার্থবিদ-দের অতি পরিচিত গাণিতিক সমীকরণের খুব একটা ধার ধারে না। এই বক্তৃতাটিতেই উনি প্রথম জীবন ও তার অর্থ বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার কথা বলেন। এরপরে, ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত "হোয়াট ইস লাইফ" নামক তার বইতে তিনি লিখেছিলেন যে জীবনের উদ্দেশ্য হল কিছু তথ্য গ্রহণ, সংরক্ষণ আর প্রবাহ। এভাবে ক্রোমোসম হল এই তথ্যের ধারক। বংশানুক্রমিক ভাবে আসা এই তথ্য ক্রোমোসমের জটিল অণুদের বিন্যাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। তাই জীবন কি সেটা বুঝতে গেলে আগে ওই বিন্যাস বুঝতে হবে। এটাই ছিল তার মূল বক্তব্য।
এদিকে একই সময়ে পদার্থবিদেরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের মত জটিল তত্ত্ব দিয়ে পরমাণুর গঠন ও তাদের আচার আচরণ নিয়ে গবেষণা করছেন। অথচ, যা পরমাণুর চেয়েও অনেক বেশী জরুরী তা হল আমাদের জীবন-কে বোঝা। তা নিয়ে গবেষকের আকাল। ট্র্যাডিশনাল জীববিজ্ঞানীরা অধিকাংশই পর্যবেক্ষণ নিয়েই মগ্ন থাকেন, গাণিতিক হিসাবনিকেশ করে দেখেন না বা পরিসংখ্যানেও ততটা দক্ষ নন। শ্রোডিংগারের বই অনেক পদার্থবিদ ও রসায়ন-বিজ্ঞানীকেই এই জীবনের তথ্য উদ্ঘাটনের পথে আনতে সক্ষম হল। মজার কথা, ডি-এন-এ আবিষ্কারের নাটকের কুশীলবদের অধিকাংশই এই বই পড়েই জীবন নিয়ে গবেষণার পথে আসেন।
যেমন ধরা যাক মরিস উইল্কিন্সের কথা। এই পদার্থবিদ পরমাণু বোমা তৈরীতে ম্যানহাটান প্রজেক্টের সাথে জড়িত ছিলেন। বোমার আসল রূপ হিরোশিমা-নাগাসাকিতে দেখে তার বোধোদয় হল। তিনি একরকম পাগল হয়েই প্যারিসে চলে যাবেন ভাবছিলেন - চিত্রকর হবার শখে। এই সময়েই তার হাতে এসে পড়ে শ্রোডিংগারের বইটি। বই পড়ে উনি উৎসাহিত হন জীবন সংক্রান্ত গবেষণায় আসতে। তিনিই সর্বপ্রথম এক্স-রে ডিফ্রাকশন টেকনলজি ব্যবহার করে ডি-এন-এর গঠন পর্যবেক্ষণ করার কথা বলেন। একজন পদার্থবিদ ছাড়া এই চিন্তা মাথায় আসা সাধারণ জীববিজ্ঞানীদের কাছে অসম্ভব। আরেকজন ছিলেন ফ্রান্সিস ক্রিক। যিনি মূলত ছিলেন পদার্থবিদ্যার ছাত্র কিন্তু তার পদার্থবিদ্যার মত যুক্তিনির্ভর ও মডেল-ভিত্তিক গবেষণার অভ্যাসও এই ডি-এন-এর গঠন আবিষ্কারে বড় ভূমিকা রাখে।
এবার আবার ফিরে যাওয়া যাক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে। জীবনের ধারক ও বাহক ডি-এন-এর গঠন কাঠামো জানার জন্য তখন বিজ্ঞানীরা মরিয়া হয়ে ঊঠছেন। এই সময়েই আরো এক বিজ্ঞানী, হয়ত শ্রোডিংগারের বই না পড়েই রসায়ন থেকে সরে এসে জীববিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। তিনি হলেন লিনাস পাউলিং। এই পাউলিং হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি একাধিকবার নোবেল পুরষ্কার পান, মারি কুরীর পরে। আর পাউলিং হলেন একমাত্র - যিনি উভয়ক্ষেত্রেই এককভাবে পুরষ্কারটা পান। প্রথমবার রসায়নে, দ্বিতীয়বার শান্তিতে। যাহোক, পাউলিং জীববিজ্ঞানে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির যুগান্তকারী ব্যবহার শুরু করেন। যে কোনো অণুর গঠন-প্রকৃতি জানার জন্য তার ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে এক্স-রে প্রবাহ পাঠানো হত। এর ফলে কিছুটা এক্স-রে চারদিকে বিচ্ছুরিত হত, বাকিটা নির্বিঘ্নে অণু অতিক্রম করে যেত। এই বিচ্ছুরণের প্রকৃতি থেকে সরল যে কোনো অণুর গঠন আঁচ করা যেত। কিন্তু জটিল অণুর ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা ভাল কাজ করত না। তা সত্ত্বেও উনি রক্তে উপস্থিত প্রোটিন হিমোগ্লোবিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখালেন অক্সিজেনের উপস্থিতির কারণে হিমোগ্লোবিনের গঠনের পরিবর্তন ঘটে। এর পরে উনি সামগ্রিক ভাবে প্রোটিনের গঠন নিয়ে গবেষণায় এলেন। দীর্ঘ এগার বছরের প্রচেষ্টায় উনি সমর্থ হলেন প্রোটিনের রাসায়নিক গঠন নির্ধারণে। ১৯৫১ সালে, তার হিমোগ্লোবিন নিয়ে গবেষণার শেষ ফলাফল হিসাবে উনি দেখান যে প্রোটিন অণুতে অ্যামাইনো অ্যাসিড মূলকগুলো আলফা হেলিক্স বা বিটা শিটের আকারে সজ্জিত থাকে। এই আবিষ্কার জৈব যৌগের গঠন সংক্রান্ত গবেষণাকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।
ঠিক কিভাবে উনি এই আবিষ্কারটি করলেন? পাউলিং-এর নিজের কথায় -
"১৯৪৮ সালে আমি যখন লন্ডনে অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ছিলাম, একদিন আমার খুব ঠান্ডা লেগেছিল। এখনকার মত তো ভিটামিন সি খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভব ছিল না, তাই দুয়েকদিন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে সায়েন্স ফিকশন আর ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ে সময় কাটালাম। তারপরে বিরক্ত হয়ে ভাবলাম আলফা হেলিক্সটা এবার আবিষ্কার করেই ফেলা যাক। ... যাহোক আমি একটা কাগজের টুকরো নিলাম আর তাতে ভেবেচিন্তে পলিপেপ্টাইড শৃঙ্খলার একটা ছবি আঁকলাম - যাতে দূরত্ব আর কোণগুলো মোটামুটি ঠিকঠাক। একটা মাত্র কোণের মাপ সঠিক ছিল না। আমার কাছে এই কাগজের টুকরোটা এখনও আছে। ... আমি কাগজটা ভাঁজ করে মেলাতে চেষ্টা করলাম। কয়েকবারের চেষ্টায় কয়েকটা বিফল ভাঁজের পর দেখলাম ১১০ ডিগ্রিতে ব্যাপারটার একটা সমাধান আছে। এর ফলে সব ভাঁজগুলো জুড়লে N-C-H-O বন্ধনী গঠিত হয় N-H বন্ধনী আর C=O বন্ধনী দিয়ে।"
এতটাই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছিলেন পাউলিং যে তার অবসর সময়ে সমাধান করা ধাঁধাও আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু এই পাউলিং-এর প্রস্তাবিত ডি-এন-এর গঠন ধোপে টেঁকে নি। উনি একই ভাবে ধাঁধার সমাধানের মত করে গঠনের মডেল তৈরীর চেষ্টা করেন। আগেই বলেছি বিজ্ঞানে অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব বলে কেউ হয় না। তাই এই দুবার নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকেও তার প্রস্তাবিত গঠনের ভুল সংশোধনে ব্যস্ত থাকতে হল। ১৯৫৩ সালে তার প্রস্তাবিত ডি-এন-এর গঠনে উনি বলেন যে A,T,C,G - এই মূল উপাদানগুলো একে অপরের সাথে হাইড্রোজেন বন্ধনে জড়িত। কিন্তু সেক্ষেত্রে ডি-এন-এ কে তো আর অ্যাসিডই বলা চলে না, আর কোষের মধ্যে টিঁকে থাকতে গেলে কোষকে সামগ্রিকভাবে অ্যাসিডিক হতে হয়। তাই তার প্রস্তাব গৃহীত হল না। কিন্তু ডি-এন-এ বিষয়ে তার এই উৎসাহ আটলান্টিকের উল্টোদিকে একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিল। ওরা আগে পারে না আমরা আগে - এই প্রতিযোগিতা থেকেই ডি-এন-এ আবিষ্কারের জন্য মরিয়া বিজ্ঞানীরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন।
আটলান্টিকের উল্টোদিকে বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে ছিলেন স্যার লরেন্স ব্র্যাগ - ১৯১৫ সালের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ও এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির আবিষ্কারক। প্রোটিনের গঠনের আবিষ্কারের সময় তারই বের করা প্রযুক্তি দিয়ে তার চেয়ে আগে গঠন কাঠামো বের করে ফেলল একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী - এই ব্যাপারটা তার যেন সহ্য হয় নি। তার ওপর তিনি নিজেও ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে ওই একই বিষয়ে গবেষণা করছিলেন - আর তার পেপারটা একটুর জন্য মূল আবিষ্কারের শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তিনি এবার কোমর বেঁধে শুরু করলেন ডি-এন-এর গঠন কাঠামো আবিষ্কারে প্রচেষ্টা। তার এই উৎসাহে সঙ্গী ছিলেন আরো কিছু বিজ্ঞানী - যেমন মরিস উইল্কিন্স, জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ও রোজেলিন্ড ফ্রাঙ্কলিন।
মন্তব্য
একদিকে ভালোই হয়েছে
এতে অন্তত এরিস্টটলের মতো সব বিষয়ে পণ্ডিতি এবং সব বিষয়ে ঘুটু পাকানো লোকের সংখ্যা কমবে
খুব সহজ আর সুন্দর করে লিখছেন।
দারুণ লাগছে।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
এর্ভিন শ্র্যোডিঙারের "হোয়াট ইজ লাইফ" বইটির কোন বঙ্গানুবাদ হয়েছে কি? না হলে আমি এটা অনুবাদ করতে চাই। আর অনুবাদ করে এই সচলায়তনেই প্রকাশ করতে চাই। কোন বাংলা অনুবাদ হয়েছে কি-না জানালে ভাল হয়। আমি অচিরেই অনুবাদ শুরু করতে চাচ্ছি। শিরোনামও একটা ঠিক করেছি -- "জীবন কী?"। সোজাসাপ্টা শিরোনাম। কেউ জানালে আমার উপকার হয়।
পদার্থবিজ্ঞান আর জীববিজ্ঞানের এ ধরণের সমন্বয় আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছে। শ্র্যোডিঙারকে তো পৃথিবীর প্রথম জৈব-পদার্থবিজ্ঞানী বলা হয়। আমি অবশ্য জগদীশচন্দ্র বসু কেই প্রথম জৈব-পদার্থবিজ্ঞানী বলে মানি। জগদীশ আর শ্র্যোডিঙার সবাই জীবনকে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
আমার তো মনে হয় না কোনো অনুবাদের কথা শুনেছি বলে। কিন্তু সমস্যা হল, তার সময়ে জানা অনেক তথ্যই এখন্ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে আপনি ভুল তথ্য দিলে আলাদা করে লিখে দেবেনযে এটা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল আর আসল্ তথ্য এই ...
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
হ্যা, একটু পুরনো বই অনুবাদ করতে গেলে এ ধরণের সমস্যা বেশ প্রকট হয়ে উঠার কথা। কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন অগ্রগতি হয়েছে তা উল্লেখ করে দেয়ার চেষ্টা করবো। যতটুকু পারি। প্রকাশের পর অন্যরাও এ বিষয়ক আলোচনায় অংশ নিতে পারেন। আজ-কালের মধ্যেই তাহলে শুরু করছি।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
একদম, শুরু করে দিন।
---------------------------------
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দিগন্ত,
আসলে একটা অনুবাদ বাংলায় আছে । অনুবাদ করেছেন দেবল দেব এবং প্রতিভামন্ডল । কলকাতার বাউল মন থেকে প্রকাশিত এ বইটা ১০৩ পৃষ্ঠার। অনুবাদ আহামরি কিছু নয়। আমার তেমন ভাল লাগে নি। এর চেয়ে শিক্ষানবিসের অনুবাদ অনেক ঝরঝরে।
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আপনাদের দু'জনের লেখা পড়ছি।
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)
তাহলে অনুবাদ চালিয়ে যাচ্ছি। সবার সহযোগিতা পেলে আশা করি অনুবাদটা সার্থক হয়ে উঠবে।
— বিদ্যাকল্পদ্রুম
রোজেলিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের নোবেল প্রাইজ না পাওয়া খুবই অনুচিত কাজ হয়েছে।
নতুন মন্তব্য করুন