অতিবুদ্ধিমান বোকাদের কথা

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: রবি, ১৫/০৬/২০০৮ - ২:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাধারণভাবে ব্যঙ্গার্থে ছাড়া 'অতিবুদ্ধিমান' আর 'বোকা' শব্দদুটো একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, কারণ শব্দদুটো বিপরীতার্থক। কিন্তু বুদ্ধি কি? আমার যে বন্ধু তাড়াতাড়ি অঙ্ক করতে পারে তাকেও বুদ্ধিমান বলি, আবার চটপটে স্মার্ট মার্কেটিং প্রফেশনালকেও তাই বলি। তবে কিছু কিছু গুণকে আমরা সাধারণ বলেই ধরে নিই, যেমন ভাষায় সাধারণ দখল থাকা বা লোকজনের সাথে সামাজিকভাবে মিশতে পারা। এগুলোর ওপর আমাদের বুদ্ধিমান বা বোকার সংজ্ঞা নির্ভর করে না, চারপাশের অধিকাংশ মানুষই এগুলো কমবেশী করেই থাকেন। যারা এগুলোও পারে না, তাদের তো আমরা সাধারণভাবে এতটাই বোকা বলে ধরে নিই যে তারাও যে বুদ্ধিমান হতে পারে সে কথা ভেবেও দেখি না।

কিন্তু জগতে আরো অনেক কিছুর মত আমাদের এই ধারণারও ব্যতিক্রম ঘটে। বৈচিত্র্যর অভাব মানবজাতির মধ্যে নেই, তাই এই অতিবুদ্ধিমান বোকাদেরও দেখা মেলে। এরকমই একজন হলেন আমেরকার কলরাডোর বাসিন্দা আলোন্সো ক্লেমেন্স। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি মাটির দলা থেকে যে কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি তৈরী করে ফেলতে পারেন। কিন্তু এর জন্য তিনি কোনো বিশেষ ট্রেনিং নেননি, আর নিলেও হয়ত এত তাড়াতাড়ি করে উঠতে পারতেন না। একটা আস্তাবলে নিয়ে তাকে বসিয়ে দিলে সহজেই তার হাত থেকে বেরিয়ে আসবে ঘোড়ার নিখুঁত প্রতিকৃতি, আর তার জন্য ঘোড়াটাকে কয়েক পলক দেখাই যথেষ্ট। অথচ এই আলোন্সোই একটা সম্পূর্ণ ঠিকঠাক বাক্যও গঠন করে কথা বলতে হিমশিম খেয়ে যান। মাত্র দু'বছর বয়েসে একটা দুর্ঘটনায় তার বাম-মস্তিষ্কে চোট লাগে। তার পর থেকেই তার এই অবস্থা - পড়তে, লিখতে বা হিসাব করতে পারেন না। কিন্তু একই সময় থেকে এই অবিশ্বাস্য ক্ষমতাও তার মধ্যে চলে এসেছে।

কিম্বা ধরা যাক হালফিলের নাদিয়ার কথা। ছোটবেলায় দুবছর বয়স অবধি সে তার মা কেই চিনে উঠতে পারে নি। সাধারণ বাচ্চাদের মত কথা বলার সহজাত ক্ষমতাতেও তার সমস্যা ছিল। সাড়ে তিন বছর বয়সে একটা পেন তুলে নিয়ে কাগজে আঁকা শুরু করে নাদিয়া, আঁকিবুকি নয়, সোজা ছবি আঁকা। autoছোটবেলায় আমরা যেমন প্রথম ঘোড়া আঁকার চেষ্টা করলে প্রথমে একটা বাউন্ডারি খাড়া করার চেষ্টা করি, তারপরে ধীরে ধীরে তার ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে সঠিক মাত্রা দিই, নাদিয়া কিন্তু সেই দলে নেই। সে সোজাসাপটা নিখুঁতভাবে ঘোড়ার লেজ বা মাথা এঁকেই শুরু করে, আর সেই আঁকা দেখলে কেউ বলতেই পারবে না যে সেটা কোনো বাচ্চার হাতের আঁকা।

(ডিসকভারি ম্যাগাজিন থেকে নাদিয়ার আঁকা ছবি)

আর ডাস্টিন হফম্যানের ছবি রেইনম্যান তো অনেকেই দেখেছেন। ছবিতে হফম্যান যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন সেটার অনুপ্রেরণা এসেছে কিম পিক নামে এক আমেরিকান অতিবুদ্ধিমান বোকার থেকে। কিম ছোটোবেলায় নিজের জামাটাও পরতে পারতেন না। অথচ, এখন তার মস্তিষ্কে ১২০০০ বইয়ের প্রতিটি পাতা জমা আছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকার যেকোনো জিপ কোড থেকে উনি বলে দিতে পারেন জায়গাটা কোথায়। বছরের কোন দিনটা কোন বার ছিল, সেটাও তার জানা। এই অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী কিম দিনের অধিকাংশ সময়েই কাটিয়ে দেন সল্টলেক সিটির লাইব্রেরীতে। তাকে নিয়েও অনেক তথ্যচিত্রও হয়েছে।

তবে সবথেকে আশ্চর্যজনক ক্ষমতার অধিকারী হলেন ব্রিটেনের স্টেফান উইল্টশায়ার। তাকে বলা হয় 'হিউম্যান ক্যামেরা'। বিবিসির একটা অনুষ্ঠানের জন্য কিমকে আনা হয়েছিল রোম শহরে। স্টেফান আগে কখনও রোম দেখেননি। তাকে একটা হেলিকপ্টারে করে আকাশে ঘুরিয়ে দেখানো হল গোটা রোম শহর - প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে। তারপরে দেওয়া হল প্রায় পাঁচ মিটারের একটা ক্যানভাস। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে ধৈর্য্য ধরে স্টেফান এঁকে ফেলল বিহঙ্গ-দৃষ্টিতে দেখা রোম শহর। সেই ছবি এতটাই নিখুঁত যে রাস্তায় দেখা গাড়ি থেকে আরম্ভ করে সব বাড়ির জানালা পর্যন্ত প্রায় হুবহু মিলে যায়। স্টেফানও অন্য অতিবুদ্ধিমানদের মত বোকাও বটে - সহজে তার সাথেও কথাবার্তা চালান যায় না।

কিন্তু কেন এরকম ঘটে? কিমের মস্তিষ্কের গঠন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে তার কোনো বাম ও ডান মস্তিষ্ক সংযোগকারী নিউরোনগুলো অনুপস্থিত। এ থেকে ধারণা করা হয় এই নিউরোনগুলোই আদপে তার স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজে জানা যায় না। এর জন্য সাহায্য নিতে হয় অন্য আরেক ধরণের মানুষের কাছে। সব অতিবুদ্ধিমানই যে বোকাও, সেরকম তো নয় - কিছু অতিবুদ্ধিমানকে পাওয়া গেছে যারা কিন্তু সমাজে মিলেমিশেই আছেন। এরকমই একজন হলেন ড্যানিয়েল টেমেট। উনি মুহূর্তের মধ্যে বড়বড় গুণ-ভাগ করে ফেলতে পারেন, তাও কারও সাহায্য ছাড়াই। আর সবার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দুর্ভাগ্যবশত ঠিকঠাক জেনেই উঠতে না পারলেও ড্যানিয়েলের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে - ড্যানিয়েলের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায়।

ড্যানিয়েলের মস্তিষ্ক কিন্তু হিসাব করে না, শুধু উত্তরটা বের করে আনে। সে 'পাই' এর মান পাঁচ ঘন্টা ধরে প্রথম বাইশ হাজার স্থান অবধি গড়গড় করে কবিতা আবৃত্তির মত বলে যেতে পারে, কারণ এ জন্য তাকে কোনো হিসাব করতে হয় না। কিন্তু কি ভাবে? চার বছর বয়সে এক মৃগীরোগের পর থেকেই তার এই ধরণের ক্ষমতা। তার দাবী সে প্রতিটি সংখ্যাকে ছবির বা প্রতিকৃতির আকারে দেখতে পায়। ছোটোবেলা থেকেই তিনি একের পর এক জিনিস দেখে তার সাথে সংখ্যাকে মিশিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন - কোন ফুটবল যদি ১৩১ এর মত হয় তবে ক্রিকেট ব্যাট হবে ৯০৪। তার কাছে এটাই ছিল স্বাভাবিক।

ড্যানিয়েল তার এই অতিমানবিক ক্ষমতার যা ব্যাখ্যা দেন তা সবাইকে একরকম স্তম্ভিত করে দেয়। তার বক্তব্য হল -


"আমি সংখ্যাগুলোকে লেখার হরফে, আকারে, প্রতিকৃতিতে বা তাদের রঙ দিয়ে অনুভব করি। সংখ্যাগুলো আমার মনের মধ্যে যেন এক উপত্যকার অনুভূতির সৃষ্টি করে। এটা কিভাবে যেন হয়ে যায় ... চতুর্থ মাত্রার মতই। যেমন ১ সংখ্যাটা হল খুব উজ্জ্বল ... কেউ আমার চোখের মধ্যে আলো ফেললে আমি সেরকম অনুভূতি পাই। ২ হল এমন এক চলমান প্রতিকৃতি যা সবসময় বাঁয়ে চলতে থাকে। ... ৫ হল পাথরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। ৬ আমি ঠিকঠাক অনুভব করতে পারি না, সবকিছুর অনুপস্থিতিকেই আমি ৬ বলে ধরে নিই। বড় বড় সংখ্যাগুলো অনেক উঁচু ... আমি ভয় পেয়ে যাই দেখে।"

ড্যানিয়েলের দাবীমত, সে দশহাজার অবধি সংখ্যাগুলোকে এভাবেই দেখে। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। আমাদের মস্তিষ্কের একেকটা অংশ একেক কাজের ক্ষেত্রে পারদর্শী। কোনো অংশ যদি লেখার হরফ চেনার কাজে আসে, তবে অন্য কোনো অংশ আসবে সংখ্যা গোণার কাজে। যদি এরকম কয়েকটা অংশের মধ্যে যোগাযগের কোনো অদ্ভুত পথ তৈরী হয় কিছু অতিরিক্ত নিউরোণের উপস্থিতিতে, তবে এরকম সংখ্যা থেকে ছবির অনুভূতি আসা সম্ভব। বা শব্দ শুনলে কোনো রং-এর কথা মাথায় আসবে। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'সিনস্থেসিয়া'। বিজ্ঞানীদের মতে, ড্যানিয়েল এরকম এক সিনস্থেশিয়ায় তৈরী বড় এক প্রতিকৃতির বর্ণনা করেই বলতে পারছে পাই-এর বাইশ হাজার ঘর অবধি মান - কোনো হিসাব ছাড়াই।

তাতেও তো সব সমস্যার সমাধান হয় না। হিসাবটা আদপে হচ্ছে কি করে, সেটা কে বলতে পারবে? আরো বড় কথা, যদি কোনো দুর্ঘটনায় এরকম অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা-প্রাপ্তি ঘটে, তাহলে কি এরকম এক অতিমানব আমাদের সবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে?

(পরের পর্বে বাকিটা)


মন্তব্য

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বিষয়টা অদ্ভুত ও মনকাড়া।
পড়ে তো ভয়ই লেগে গেল ছোটোবেলায় আমি মানুষ আঁকা শুরু করতাম চোখ থেকে আর গাছ আঁকতাম ডগা থেকে। মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে নাম-ধাম মনে থাকে না, তার ব্যাপারে একটা অনুভূতিই থেকে যায় শুধু। পরে আঁকাই ভুলে গেছি আর মানুষ সম্পর্কে অনুভতিও ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। অতএব আমি সুস্থ।
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা রইল।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

আজকে সচলে নামকরণের এ কী দশা! ও দিকে ধূগো দা লিখেছেন আণবিক মহাকাব্য, আপনি লিখলেন - অতিবুদ্ধিমান বোকাদের কথা! কেম্নে কী!
তবে লেখা দারুণ ভাল্লাগছে। নেটের অবস্থা খারাপ থাকায় ভিডিওগুলো দেখতে পারি নাই। বাসায় গিয়ে দেখবো।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ইন্টারেস্টিং !
ওগুলো আমিও দেখতে পাচ্ছি না।
কি মুশকিল...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

দুর্দান্ত এর ছবি

জোশ! গার্ডেনার এর বহুবুদ্ধিতত্বকে আরো কাছ থেকে দেখা গেল। দুনিয়া আজতক শুধু কথার আর সংখ্যার বুদ্ধির কদর করে এসেছে। সময় এসেছে অন্যান্য বুদ্ধিকে বোঝার।

হিমু এর ছবি

দারুণ লাগলো পড়ে আর দেখে! পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় আছি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দিগন্ত এর ছবি

দেখার সৌভাগ্য হওয়ায় আপনি পুরোটা বুঝবেন। ইউটিউবের ভিডিওগুলো বাস্তবেই অসাধারণ - বিবিসি আর ডিসকভারির তোলা।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দারুণ
পরের পর্বের অপেক্ষা করছি

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍অবিশ্বাস্য সব ভিডিও!

ধন্যবাদ, দিগন্ত।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সিরাত এর ছবি

পাঁচ দিয়ে কম দেয়া হয়ে গেল। মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।