গত কয়েকদিন ধরে আমাকে অনেক প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে যে রসায়নাগারে নাকি জীবন সৃষ্টি করা যায় নি। আর যেহেতু জীবন সৃষ্টি করা যাচ্ছেনা, তাই আমাকে মেনে নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে যে জীবনের উতপত্তি সম্পর্কে মানুষ নাকি এখনো কিছুই জানে না। ঘটনা হল, জীবন যে জড় থেকে উতপন্ন, সে বিষয়ে এখন বিজ্ঞানীদের কোনো সংশয় নেই, সংশয় আছে পদ্ধতি নিয়ে। আদি পৃথিবীতে ঠিক কি ধরণের পরিবেশ ছিল, যা থেকে ঠিক কোন পথ ধরে জীবন সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়েই দ্বিমত।
রসায়নাগারে পরীক্ষায় জীবন সৃষ্টির কথাই যদি বলতে হয় তাহলে আগে জীবন কি সেটা সংজ্ঞায়িত করে নিতে হয়। ব্যাক্টেরিয়া জীবিত প্রাণী বলে ধরা হয়। আরো সরলতর জীবের কথা ভাবলে, আসে ভাইরাস। ভাইরাস এমনিতে মৃত, কিন্তু বেঁচে ওঠে উপযুক্ত পোষক পেলেই। উদাহরণ কুখ্যাত এইডস ভাইরাস। আরো সহজতর জীবনের কথা ভাবা যেতে পারে – তা হল ভিরইড। এরা ভাইরাসের থেকেও সরল, শুধু জেনেটিক কিছু পদার্থ দিয়ে তৈরী। পোষকের দেহ ছাড়া এরাও মৃত। এদের প্রভাবেও অনেক রোগ হয় – যেমন 'কোকোণাট ক্যাডাং'। যারা ভাবছেন এতে জড় বস্তুর সাথে জীবের অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে, তারা দেখতে পারেন প্রিয়ন, পরবর্তী সরলতর জীব। এরা শুধু জটিল প্রোটিন দিয়ে গঠিত, যে শুধু পোষকের দেহে জীবন্ত। ‘ম্যাড কাউ’ রোগের মূল কারণ একধরণের প্রিয়ন। এদের মধ্যে জেনেটিক কোনো বস্তু নেই, না আছে নিউক্লিক অ্যাসিড। খুব সহজেই বোঝা যায় প্রাণের সাথে জড় বস্তুর সীমারেখাটি খুবই দুর্বল। যারা বলে থাকেন যে বিজ্ঞান এখনো ‘জীবন’-কে সংজ্ঞায়িত করতে পারেনি, তাদের জানা উচিত যে বিজ্ঞান জীবনকে জড় থেকে আলাদা করতে চায় না, কারণ এদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই কোনো।
এবার আসা যাক রসায়নাগারে পরীক্ষার কথায়। এবিষয়ে প্রথম আলোকপাত ঘটে স্ট্যানলি-মিলারের বিখ্যাত পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় দেখা যায়, মিথেন, অ্যামোনিয়া আর জলীয় বাষ্পের মিশ্রণে বিদ্যুতচমকের মত তড়িত-প্রবাহ ঘটালে অ্যামিনো অ্যাসিড ও শর্করা জাতীয় পদার্থ উতপন্ন হয়। আর এই দুটি উপাদানই জীবের অন্যতম গঠনমূলক উপাদান। আদি পৃথিবীতে যেহেতু পরীক্ষায় ব্যবহৃত উপাদানগুলোর কোনো অভাব ছিল না, এবং উদ্ভূত উপাদানের কোনো গ্রাহক ছিল না, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে এই অ্যামিনো অ্যাসিড ও শর্করা রাসায়নিক মিশ্র-তরলের (Chemical Soup) আকারে পৃথিবীতে অবস্থান করত।
এবার আসা যাক পরবর্তী ধাপে। কিভাবে ওই পরীক্ষায় তৈরি অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে প্রাণের কোনো একটি ধাপে অন্তত পৌছনো যাবে? সে উত্তর পাওয়া যায় সিডনী ফক্সের পরীক্ষায়। তিনি এই অ্যামিনো অ্যাসিড ও কিছু জৈব অ্যাসিড নিয়ে ৭০-৮০ ডিগ্রিতে গরম করলেন। পাওয়া গেল প্রোটিনয়েড – অনেকটা প্রিয়নের প্রোটিনের মত পদার্থ। এদের ফ্যাটি অ্যাসিডে সেদ্ধ করে পাওয়া যায় আদি কোষের মত প্রোটিনয়েড মাইক্রোস্ফিয়ার। এই পদ্ধতিতে অ্যামিডিনিয়াম কার্বোডিমাইড নামে একটি অনুঘটক ব্যবহার হয়, যা প্রাচীন পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত।
এই প্রোটিনয়েড মাইক্রোস্ফিয়ার গুলো একরকম জীবন্ত – এদের জীবকোষসদৃশ অনেক বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন –
• শক্ত আবরক
• অভিস্রবণের মাধ্যমে ফুলে ওঠা ও সংকুচিত হওয়া।
• অঙ্কুরোদ্গম
• বিভাজন
• চলাফেরা করা
সবথেকে মজার কথা, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে আগ্নেয়গিরিতে লাভার মধ্যে এই ধরণের ‘জীব’-এর অস্ত্বিত্ত্ব পাওয়া গেছে – যা প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত – আগ্নেয়গিরির গ্যাসের অ্যামিনো অ্যাসিড আর পরিবেশের অ্যাসিড থেকে। প্রাচীন পৃথিবীর জীবাশ্মের মধ্যেও একই ধরণের জীবের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। আজকের দিনে এগুলো চিকিতসা বিজ্ঞানে খুবই কার্যকর – বিশেষত রোগীর দেহের কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গে ওষুধ পৌছে দিতে।
সাম্প্রতিককালে, রসায়নাগারে ভাইরাসও তৈরী হয়েছে, এক ব্যাক্টেরিয়া থেকে অন্য ব্যাক্টেরিয়াতে রূপান্তরিত করাও হয়েছে। প্রশ্ন হল তাহলে কেন বলা হয় যে রসায়নাগারে জীবন তৈরী সম্ভব হয় নি? শুধু তাই নয়, সেই তৈরির পথে পাওয়া গেছে এমন কিছু তথ্য যা আমাদের চিকিৎসা-শাস্ত্রে যুগান্তর এনেছে।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন