যে গ্রন্থাগারে কোনো বই নেই

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/১০/২০০৮ - ২:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[ আগের লেখায় লিখেছিলাম কেন গরিব দেশ গরিব থেকে যায় - তার একটা কারণ নিয়ে। আজকের লেখা দ্বিতীয় কারণ নিয়ে - যদিও আজকের কারণ দুর্নীতির মত সর্বব্যাপী নয়। এই লেখাটাও টিম হারফোর্ডের The Undercover Economist বইএর একটা অধ্যায় থেকে সার সংক্ষেপিত।]

ক্যামেরুনের সবথেকে বড় কলেজটিতে চোখে পড়ার মত স্থাপত্য দুটোই – একটা অধ্যক্ষের নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি আর অন্যটা অট্টালিকাসম গ্রন্থাগার। একতলা হলেও গ্রন্থাগারের ছাদটা সিডনি অপেরার মতই খাঁজওয়ালা – ধার থেকে অনেকটা ইংরেজী ভি আকৃতির মত দেখতে লাগে। আসলে ছাদটা আধখোলা বইয়ের মত আকারের। মাঝখানে নিচু উপত্যকার মত, আর দুপাশ উঁচু। এমনিতে সাধারণ কোনো দর্শক এরকম গরিব দেশে এই অপূর্ব স্থাপত্য দেখে বাহবা দেবে – এটাই স্বাভাবিক। অথচ, এই গ্রন্থাগারে কোনো বই রাখা হয় না। কারণ কি?

ক্যামেরুনের কোনো রোদ ঝলমলে সকালে সেই কারণ বোঝা সম্ভবও নয়। কারণটা প্রকৃতি। ক্যামেরুনে বর্ষাকালে টানা পাঁচ মাস বৃষ্টি হয়। আর সেই বর্ষণপুষ্ট “রেন-ফরেস্ট”-এর কল্যাণেই পৃথিবীতে মানুষ ক্যামেরুনকে চেনে। যাহোক, কাজের কথায় আসা যাক। এই বর্ষায় এই অদ্ভূতদর্শন স্থাপত্যের ছাদে জল জমে যায় – মাঝখানের অংশে। সেই জল কিছুদিনের মধ্যেই চুঁইয়ে চুঁইয়ে সারা গ্রন্থাগারে। এমনিতে ক্যামেরুনের বাসিন্দারা জল মাথায় নিয়েই বাঁচেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় – বইগুলো তো তাদের মত করে তৈরী হয়না। তাই নিট ফল – ফাঁকা গ্রন্থাগার। পুরোনো গ্রন্থাগারে বইগুলো সযত্নে আগলে বসে আছেন গ্রন্থাগারিক। অধ্যক্ষের নরম-গরম আদেশ-নির্দেশেও যিনি তার অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার – পুরোনো গ্রথাগারে বইগুলো আছে বলে ছাত্রেরা তবু কিছু বই পায়, নতুনটাতে গেলে তাও পাবে না। তার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এই প্রকল্পের উদ্যোক্তা অধ্যক্ষ মহাশয় এই অবস্থাকে “সাময়িক” বলে উড়িয়ে দেন। অথচ, গ্রন্থাগার বানানো হয়েছে চার বছর হয়ে গেছে।

ক্যামেরুনের মত গরিব দেশে এরকম একটা অপরিকল্পিত স্থাপত্য বানানো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই গ্রন্থাগার না বানিয়ে এর জায়গায় চল্লিশ হাজার নতুন বই কেনা সম্ভব ছিল। অথবা পাঁচ হাজার নতুন কম্পিউটার কেনা যেত, যা ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকত। তাও না হলে, অসংখ্য গরিব ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার কাজে ব্যবহার হতে পারত – বৃত্তি হিসাবে তাদের মধ্যে বিতরণ করা যেত। এর যে কোনোওটিই এই গ্রন্থাগার নির্মাণের থেকে বেশী ভাল কাজে আসত। তাহলে ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন আসে – এই ক্ষতির জন্য দায়ী কে?

অনেকেই হয়ত বলবেন ক্যামেরুনের লোকজনে বোকা বলে এরকম খারাপ পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু গ্রন্থাগারিকের বিচক্ষণতা জানার পরে আর সে বিশ্বাসে দৃঢ়তা থাকে না। তাছাড়া, বিবর্তনের বিজ্ঞান অনুসারে আমরা সকলেই মাত্র দু-হাজার প্রজন্মে বিচ্ছিন্ন। তাই আমাদের তুলনায় ক্যামেরুনের মানুষ বুদ্ধিতে মোটেও আলাদা কিছু নয়। এই অপরিকল্পিত উদ্যোগের পেছনে আসলে কাজ করেছে আর কারও ব্যক্তিস্বার্থ। সেটা কিরকম একটু খতিয়ে দেখা যাক।

অধ্যক্ষের পরিকল্পনা ছিল এই কলেজকে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার। কিন্তু তার জন্য আরো অনেক কিছুর মত বানাতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের একটি গ্রন্থাগার। বর্তমানের গ্রন্থাগারে সব বই স্বাভাবিকভাবে রাখা যায় – সেটা এখানে তার বিচার্য বিষয় নয়, তার উদ্দেশ্য যে কোনো উপায়ে একটি বড়সড় গ্রন্থাগার দাঁড় করানো।

সমস্যার আরো একটু গভীরে যাওয়া যাক। অধ্যক্ষের কাজের সমালোচনা করার কেউ নেই। ক্যামেরুনের উচ্চমহলে অনেকেই তার বন্ধুস্থানীয় বলেই উনি এরকম এক গ্রন্থাগারের বরাদ্দের টাকা আনতে পেরেছেন। নিজের কলেজে সবাই তার অনুগত – কারণ তাদের পদোন্নতি হয় অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত ইচ্ছায়। ব্যতিক্রম একমাত্র গ্রন্থাগারিক – তার মাইনে হয় ব্রিটেনে অবস্থিত এক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার মাধ্যমে। তাই তিনি অধ্যক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এতটা সাহস দেখাতে পেরেছেন। অধ্যক্ষ নিজে হয় অত্যন্ত বোকা – বোঝেনওনি যে এর ফলে বইগুলোর ক্ষতি হতে পারে, অথবা, বইগুলোর কি হল তাতে তার কিছু এসে যায় না।

অধ্যক্ষের হাতে প্রকল্পের সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব ছিল। তিনি কলেজের ছাত্রদের দিয়েই স্থাপত্যের পরিকল্পনা করান। হয়ত, তিনি কলেজের শিক্ষার মান সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণাও সবাইকে দিতে চেয়েছিলেন। তারাও তাদের কলাকৌশল দেখানোর কাজেই মেতে ছিল – বাহবা কুড়োনোর কাজে। ক্ষমতায় থাকা মানুষজনের স্বার্থ ছিল কোনোমতে একটা দর্শনীয় স্থাপত্য বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার – যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়া সহজ হয়।

তাহলে সমগ্র পরিস্থিতি দাঁড়ালো এরকম – টাকা দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনে নয় অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত চেনাশোনার মাধ্যমে; প্রকল্প রূপায়নের উদ্দেশ্যও “লোকদেখানো”, প্রকল্পের সাফল্য পরিমাপের কোনো পদ্ধতি নেই, প্রকল্পের ব্যর্থতার কারণে কারোকে দায়ী করা সম্ভব নয়। এবার কি মনে হয় প্রকল্পের ফলাফল খুবই আশ্চর্যজনক? নাকি এটা ক্যামেরুনবাসীদের নির্বুদ্ধিতার ফল?

গরিব দেশে এরকম কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তির স্বার্থ ও উচ্চাভিলাষ দেশগুলোর অপরিসীম ক্ষতি করে দেয়। তবে সত্যিটা আরো একটু নিষ্ঠুর। এরকম স্বার্থান্বেষী ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির সংখ্যা উন্নত বিশ্বেও কম কিছু না। অনেক সময়েই এরাও সমগ্র দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি ডেকে আনে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনের চাপে পড়ে, মিডিয়ার চাপে বা গণতন্ত্রের প্রকোপে তাদের অভিলাষ সিদ্ধ হয় না। ক্যামেরুনবাসীদের দুর্ভাগ্য যে তারা এদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে নি।

[লেখক লেখার সময় উন্নত বিশ্বের কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের প্রভাব খাটো করে দেখেছিলেন। হয়ত ক্যামেরুনের তুলনায় উন্নত বিশ্বে এদের ক্ষমতা অনেক কম, কিন্তু উন্নত বিশ্বের কিছু লোভী মানুষের প্রভাবেই আজকের অর্থনৈতিক মন্দা। আশা করি আজকে উনি এই লেখাটা লিখলে এত সহজে উন্নত বিশ্বের সিস্টেমের গুণগান করতে পারতেন না।]


মন্তব্য

শিক্ষানবিস এর ছবি

এই পয়েন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই অনেক ফালতু জিনিস বেড়ে উঠে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যথেষ্ট শিক্ষিত লোক না থাকায় একক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা যায় না। অন্যদিকে উন্নত দেশে কিছুটা হলেও প্রতিবাদ আসে। যার ফলে ভারসাম্য জিনিসটা অনুন্নত দেশগুলোতে প্রায়ই থাকে না।
অর্থনীতি নিয়ে আরও লিখুন।

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

ছোট্ট উদাহরন দিয়ে দেখালেন অনুন্নত দেশগুলি কিভাবে কিছু মুষ্টিমেয় লোকের দ্বারা শোষিত হচ্ছে। আরো লিখুন প্লিজ।
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

হিমু এর ছবি

এটা সিরিজ আকারে চলুক।


হাঁটুপানির জলদস্যু

রণদীপম বসু এর ছবি

আসলেই দুঃখজনক !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সবজান্তা এর ছবি

ভাববার মত ব্যাপার। এই মূহুর্তে কিছুটা ব্যস্ত। একটু সময় পেলে, এ ব্যাপারে নিজের কিছু কথাও হয়তো যোগ করতে পারবো।

সিরিজ ভালো হচ্ছে, চলুক।


অলমিতি বিস্তারেণ

শেখ জলিল এর ছবি

চলুক সিরিজ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

রানা মেহের এর ছবি

একে ধারাবাহিক করা হোক
এবং চালিয়ে নেয়া হোক
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

সিরাত এর ছবি

সেটাই। এই সিরিজ চালানো হল না কেন আরো?

আবারো পাঁচ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।