টাকা ঢাললেই উন্নতি হয় না

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ১০/১১/২০০৮ - ৩:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[ আগের লেখায় লিখেছিলাম ক্যামেরুনের গ্রন্থাগারের কথা - যে খানে কোনো বই নেই। আজকের লেখা তৃতীয় কারণ নিয়ে - সামাজিক সম্পদ ও তার ব্যবহার। এই লেখাটাও টিম হারফোর্ডের The Undercover Economist বইএর একটা অধ্যায় থেকে সার সংক্ষেপিত।]

ক্যামেরুন থেকে এবার ফিরে আসি ঘরের কাছে - নেপালে। নেপালের জলসেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের পথে আরেক শিক্ষা দিতে পারে আমাদের। নেপালে সেচব্যবস্থায় পুরোনো প্রথাগত বাঁধ আর আধুনিক কংক্রিটের বাঁধ - দুইই দেখতে পাওয়া যায়। এলিনর অস্ট্রম গবেষণা চালিয়েছিলেন নেপালে এরকম ১৫০ টি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন সেচব্যবস্থার ওপর। কোন ব্যবস্থা ভাল চলে - পুরোনো না নতুন? আধুনিক কংক্রিটের বাঁধগুলো সবই প্রায় উন্নত দাতা দেশগুলোর টাকায় তৈরী হয়েছে। অস্ট্রমের গবেষণায় ধরা পড়ে, এই নতুন বাঁধগুলো শুধু সেচব্যবস্থার দক্ষতা কিভাবে কমিয়ে দিয়েছে। তবে কি আধুনিক প্রযুক্তি নেপালে কাজ করে না? নাকি দুর্নীতির ফলে দাতা দেশগুলোর টাকা পুরোটাই মারা চলে গেছে? এর কোনোটাই ঠিক নয়।। দেখে নেওয়া যাক তাহলে কেন টাকা ঢাললেই প্রকল্প সফল করা যায় না।

শুরুতে বলে রাখা ভাল যে একটা প্রকল্প যত মানুষকে লাভ পৌঁছে দেবে তাদেরকেই যদি এর চালিকাশক্তি বানানো যায় তবেই প্রকল্প সফল হয়। এ থেকেই বোঝা যায় কেন প্রথাগত সেচব্যবস্থা এখনও টিঁকে আছে নেপালে। কারণ, এই ব্যবস্থার সব বাঁধ আর খালগুলো চাষীরা নিজেরাই দেখাশোনা করে। আবার তারাই সেই সেচব্যবস্থার সুফল ভোগ করে। আর আধুনিক বাঁধগুলো যে ইঞ্জিনিয়ার বা আমলাদের নির্দেশে তৈরী হয়, তাদের প্রকল্পের সাফল্যে কিছু আসে যায় না। এই মূল তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বলে দেওয়া সম্ভব কেন আধুনিক ব্যবস্থার তুলনায় প্রথাগত ব্যবস্থার একটা সুবিধা আছে।

নেপালে সেচবিভাগের আমলাদের পদোন্নতি হয় দুভাবে - বয়সের হিসাবে আর বড় বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের সাথে জড়িত থাকার সুবাদে। যে কোনো সেচব্যবস্থা চালু রাখতে গেলে তার নিয়মিত দেখাশোনা করতে হবে। কিন্তু সেই ছোটো মেরামতের কাজ পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো পাত্তা পায় না - কারণ তা সহজে সবার চোখে পড়ে না। তাছাড়া, কাঠমান্ডুর আমলারা গ্রামের চাষাদের সেচব্যবস্থা নিয়ে অল্পই মাথা ঘামান। তাই সবে মিলে, নেপালের আমলাদের বড় কোনো বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করতে পছন্দ করাই স্বাভাবিক।

মুদ্রার অপর পিঠেও গল্প একই। নেপালের অধিকাংশ বাঁধ তৈরীর টাকা আসে USAID নামে দাতা সংস্থার কাছ থেকে, যারা আবার প্রকল্পের সব যন্ত্রপাতি আমেরিকায় কিনতে বাধ্য। অথচ, আমেরিকা আর নেপালের প্রকৃতি বা প্রয়োজন কোনোটাই এক রকম নয়। আমেরিকায় সব বড় ও ভারি যন্ত্রের প্রচলন বেশী। তাই এই দাতা সংস্থাও স্বাভাবিক ভাবে বাধ্য হয়েই বড় নির্মাণ কাজেই টাকা ঢেলে থাকে। সবে মিলে দাঁড়ায় যে দাতা টাকা দিচ্ছে নিজের কথা ভেবে, টাকা নিচ্ছে আমলারা পদোন্নতির কথা ভেবে, আর যে চাষীদের জন্য এত উদ্যোগ এই প্রকল্পে তাদের না আছে মতামত না আছে আগ্রহ। তাই কার্যক্ষেত্রে যেখানে সুফল পাওয়া যেত প্রথাগত সেচব্যবস্থার ফাঁকগুলো দূর করার মাধ্যমে, তার পরিবর্তে অনেক টাকা ব্যয় করে বড় বড় বাঁধ তৈরী করে প্রথাগত সিস্টেমকেই ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হল।

এ তো গেল তত্ত্বের কথা। বাস্তবে কিভাবে নেপালের প্রথাগত সেচব্যবস্থা ভেঙে পড়ল বড় বাঁধ বানানোর ফলে? সে ঘটনাও বেশ ইন্টারেস্টিং। একটা ব্যাপার এতক্ষণের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে নিশ্চয় যে নেপালের চাষীরা নিজেরাই নিজেদের খাল আর বাঁধের দেখাশোনা করে। প্রথাগত বাঁধগুলো যদি তারা দেখে শুনে এতকাল চালাতে পারে, নতুন আধুনিক প্রযুক্তির বাঁধ কেন তারা দেখভাল করতে পারবে না? এটা বোঝার আগে দেখাশোনার ব্যাপারটার একটু গভীরে যাওয়া যাক। দেখাশোনার কাজটা মূলত দুভাবে করা হয় - প্রথমত খালগুলো সংস্কার করার কাজ, আর দ্বিতীয়ত বাঁধ সংস্কারের কাজ। বাঁধ বিগড়ে গেলে সবারই সমস্যা, কিন্তু খালগুলো ঠিকমত কাজ না করলে শুধু যারা নদী থেকে দূরে চাষ করে সেই চাষীদেরই সমস্যা। তাই নেপালে চাষীদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার একটা অলিখিত বোঝাপড়া ছিল। যারা নদীর কাছাকাছি থাকে, তারা সেচের খাল দেখভাল করত। বিনিময়ে দূরের চাষীরা এসে বাঁধ মেরামত করে দিয়ে যায় বর্ষার আগে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় বাঁধ বানানোর ফলে সেই মেরামতের আর দরকার পড়ল না। যার ফলে নদীর পাড়ের চাষীদের তো আর কোনো সমস্যাই রইল না। যত সমস্যা রইল দূরের চাষীদের। তাদের খাল সংষ্কার করার কেউ নেই। বাঁধ সংষ্কারের কাজ যেমন বছরে একবার হলেই চলে, খালের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না, খাল সবসময়েই আটকে যাবার সমস্যা থাকে, বিশেষত গরমকালে। স্বাভাবিকভাবেই, কিছুদিনের মধ্যেই এই অলিখিত চুক্তি ভেঙে পড়ে এবং নেপালে চাষীদের মধ্যে দলগত বিবাদ শুরু হয়। টাকা এল, প্রযুক্তি এল, কিন্তু উন্নয়নের জায়গায় শুরু হল বিবাদ।

অস্ট্রমের গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে প্রাকৃতিক আর মানবসম্পদের মত সামাজিক সম্পদও মানব-উন্নয়নে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক সম্পদ হল সামাজিক রীতি-নীতি সহ অলিখিত এক কাঠামো যা সব সমাজেরই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের একচোখা নীতি যদি শুধু প্রথম দুই সম্পদের উন্নয়ন ঘটানোর প্রয়াস করে সমাজ বা সামাজিক বোঝাপড়াকে অগ্রাহ্য করে - তবে সেই নীতি কোনোভাবেই সফল হবার নয়। নেপালের সেচব্যবস্থার উন্নয়নের পরিকল্পনা করার আগে কেউ সেই চাষীদের প্রথাগত ব্যবস্থা কি ভাবে চলে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধও করে নি। এই সামাজিক সম্পদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ অনেক উন্নয়নশীল দেশের সবথেকে বড় সমস্যা - সমাজকে পরোয়া না করে, শুধু টাকা আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা রাতারাতি উন্নত হয়ে উঠতে চায়। তাই, দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘদিনের প্রাচীন সমাজব্যবস্থায় উন্নতি করতে গেলে সেই সমাজকে মাথায় রেখেই উন্নয়নের ফর্মুলা তৈরী করতে হবে।


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

আর আধুনিক বাঁধগুলো যে ইঞ্জিনিয়ার বা আমলাদের নির্দেশে তৈরী হয়, তাদের প্রকল্পের সাফল্যে কিছু আসে যায় না।

খাঁটি কথা ... ইঞ্জিনিয়ার বা আমলা'র সাথে পরে মহান দাতাদের যোগ করে দিলেন ... ষোলআনা পূর্ণ হলো চলুক
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

শামীম এর ছবি

দেশের এন.জি.ওগুলোর চাকুরীর বাজারে কিন্তু সোশাল সায়েন্স গ্রাজুয়েটদের খুবই চাহিদা। ওদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাটা চিন্তাভাবনাকেও সমৃদ্ধ করেছে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

হিমু এর ছবি

কোল্যাপ্স-এ পড়েছিলাম, রুয়ান্ডায় গণহত্যাগুলি ঘটেছিলো হুটুদের ভূমি-উত্তরাধিকার ব্যবস্থার বিচিত্র ত্রুটির কারণে। হুটুদের সামাজিক রীতি অনুযায়ী জমির একটা বড় অংশ পায় বড় ছেলে, কিন্তু বৃদ্ধ বাবা এবং তার স্ত্রীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয় ছোট ছেলেকে। ফলে তার হাতে থাকে কম রিসোর্স এবং দায়িত্ব থাকে বেশি। এ নিয়ে নিরন্তর বাকবিতন্ডা নাকি চলতে থাকে। টুটসিদের সেই ঝামেলা নেই। পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে তখন পৌঁছেছিলো যে একই গ্রামে টুটসি পরিবারগুলি সচ্ছল ছিলো, আর হুটু পরিবারগুলি জমি নিয়ে হট্টগোলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো। ফলে যাবতীয় রোষকে অপরাজনৈতিক শক্তি জাতিগত দাঙ্গার দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলো।

আমার মনে হয় বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতির স্ট্যাবিলিটি সিম্যুলেশন করে দেখা উচিত। এই মূহুর্তে নতুন একটা ইস্যুই চোখে পড়ছে, সেটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমলিঙ্গ বিবাহ ব্যবস্থার অনুমোদন। সমাজে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে, তা সিম্যুলেট করে দেখা যেতে পারে।

ছোট্ট একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলি। কমিউনিটি ব্লগে সদস্যদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে হালকা একটা সিম্যুলেশন করেছিলাম। সেটির কিছু তাত্ত্বিক ত্রুটি সারিয়ে পরে তা নিয়ে লিখবো ভেবেছিলাম, কালাভাবে আর করা হয়নি। নতুন করে আইডিয়াটা আবার ঢুকলো মাথায়।


হাঁটুপানির জলদস্যু

জিজ্ঞাসু এর ছবি

জ্যারেড ডায়মন্ডের লেখা কল্যাপ্স বইটি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের পড়া উচিত। কী কারণে একটা জাতি ধ্বংস হয় তা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর উদাহরণসহ আলোচিত হয়েছে বইটিতে। আমরা যাতে ধ্বংসের দারপ্রান্তে না পৌঁছি তার জন্য আগাম সতর্কতা নেয়া খুবই প্রয়োজন। প্রযুক্তি ধার করার আগে টেকসই হবে কিনা তা যাচাই করা প্রয়োজন। যা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের আমলাতন্ত্র থোড়াই কেয়ার করে।

নিজস্ব (indigenous) প্রযুক্তি টেকসই হলে অন্যের টাকা ও প্রযুক্তি ধার না করাই ভাল।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

অভিজিৎ এর ছবি

...শুধু বলতে এলাম দিগন্তের এ গুরুত্বপূর্ণ সিরিজটির মনোযোগী পাঠক আমি।
দিগন্তের লেখা সবসময়ই আমায় মুগ্ধ করে ... বিজ্ঞানের উপর আগেকার লেখাগুলোও যেমনি, অর্থনীতির উপর এখনকার লেখাগুলোও তেমনি...



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, অনুবাদকর্মের জন্য ধন্যবাদ। আমার মনে হয় শ্রীযুক্ত টিম হারফোর্ড কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারেই স্পর্শ করার চেষ্টা করেন নি ফলে বিশ্লেষনটি যথার্থ হয়নি। নেপালে উন্নয়ন পরিকল্পনা, উন্নয়নকর্ম সম্পাদন, উন্নয়ন কার্যসূচীতে জনগণের অংশগ্রহন ইত্যাদিতে স্থানীয় রাজনীতি ও শক্তিশালী প্রতিবেশীর ভূমিকা কি? নেপাল সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান যার আছে তিনি জানেন এগুলো কত বড় নিয়ামক। নদীতে বাঁধ সংক্রান্ত ব্যাপারে নেপালের ভারতের সাথে যে প্রকার দাসখতমূলক চুক্তি আছে সারা বিশ্বে তার নজীর নেই। শ্রী টিম কি জানেন না কেন নেপাল উত্তরের পথে চীনের সাথে অধিকতর সুবিধাজনক বাণিজ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না? কেন তাকে মূলতঃ কোলকাতা বন্দরের ওপর নির্ভর করতে হয়? কেন বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যের জন্য ট্রানজিট সুবিধা পায় না?

নেপালের বিদ্যমান সমাজ কাঠামো আর সেখানে স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলির প্রভাব জানা থাকলে নেপালের আমলা আর কৃষকদের গয়রহ অপবাদ দেয়া যায়না।

শ্রীযুক্ত টিম হারফোর্ড-কে আমি দোষারোপ করতে চাইনা। প্রকৃতপক্ষে এমন বিপুল সংখ্যক মহারথী আছেন যারা বিদ্যমান মোটাদাগের নিয়ামকগুলোকে অন্ধকারে রেখে "তৈলাধার পাত্র নাকি পাত্রাধার তৈল" ধরনের বিশ্লেষন উপস্থাপণ করেন। এগুলো ভুল বা অজ্ঞানতা নয়, এগুলো সচেতন প্রয়াস।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

প্রথমে বলে রাখি যে হারফোর্ডের চেষ্টাটা হল গরিবির কারণগুলো অনুসন্ধান করা। কেন তারা উন্নত হচ্ছে না দিনে দিনে তার মধ্যে একটা কারণ উনি এখানে দেখিয়েছেন। এর মানেই যে নেপাল গরিব থাকবে আরো ৫০ বছর, তা নয়।

নেপালের সাথে ভারতের চুক্তিটা পড়ে বলুন তো এতে অর্থনৈতিক সমস্যাটা কোথায় (যদিও আমি সমর্থন করি না চুক্তিটা)? এর থেকেও দাসখতমূলক চুক্তি নিয়ে ভুটান তো অনেক বড়লোক (মাথাপিছু গড় আয় ভারতের দেড়গুণ আর প্রবৃদ্ধির হার ২২%)। অর্থনীতির হিসাবে কি ভাবে এটা মেলানো যায়? জাপানে আর কোরিয়াতে তো আমেরিকার সেনাও বসে থাকে, তাতে কি তাদের অর্থনীতি থেমে আছে?

ট্রানসিট না দেবার জন্য কতটা লোকসান হয় নেপালের যে তাতে দেশটা গরিব হয়ে যায়? চট্টগ্রাম বন্দর কি নেপালের মাল-বহন করার মত জায়গায় আছে? থাকলে তো আগে ত্রিপুরার মাল রপ্তানী করা যেত।

আর চিনের সাথে নেপালের বাণিজ্য কিভাবে ভারত বন্ধ করতে পারে!! চিনের নিজের ক্ষমতা কি কম? নেপাল সীমান্ত পেরোলে চিনের তিব্বত পড়ে, যেখানে বাণিজ্যের সুযোগ অনেক কম। স্বাভাবিক ভাবে চিন সীমান্তে বাণিজ্য কম চলে।

সারা দক্ষিণ এশিয়াই একই কারণে পিছিয়ে - সেটা হল অশিক্ষা আর দুর্নীতি। কোনো ব্যতিক্রম নেই ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, শ্রীযুক্ত টিম হারফোর্ড-এর বক্তব্যর ব্যাপারে আমার আপত্তির জায়গাটি লক্ষ্য করুন। আমি বলেছিলাম বিদ্যমান মোটাদাগের নিয়ামকগুলো যেমন, নেপালে উন্নয়ন পরিকল্পনা, উন্নয়নকর্ম সম্পাদন, উন্নয়ন কার্যসূচীতে জনগণের অংশগ্রহন ইত্যাদিতে স্থানীয় রাজনীতি ও শক্তিশালী প্রতিবেশীর ভূমিকার কথা। নেপাল নিয়ে, তার উন্নতি নিয়ে, তার দুরবস্থা নিয়ে কথা বলব কিন্তু এই নিয়ামকগুলোকে স্পর্শ করবো না, তাতো হয় না।

আমি কিন্তু ভারতের সাথে নেপালের ১৯৫০ সালে সম্পাদিত “শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি”র কথা বলিনি। আমি বলেছিলাম নদীতে বাঁধ সংক্রান্ত ব্যাপারে নেপালের ভারতের সাথে যে দাসখতমূলক চুক্তি অর্থাৎ ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালে কোশী নদীতে নির্মিত বাঁধ সংক্রান্ত ১৯৫৪ সালে সম্পাদিত চুক্তিকে বুঝিয়েছি। চুক্তিটির পদে পদে ভারতকে সুবিধা বা খবরদারী করার যে সুযোগগুলো দেয়া হয়েছে তাতে বাঁধটি নেপালের জন্য শুধু বোঝা নয়, অভিশাপে পরিনত হয়েছে। এই অভিশাপে নেপালের জমি-জমা, লোকালয় বা বন তলিয়ে গেলেও কী নেপালের অর্থনীতিতে কোন ছোঁয়া লাগে না? একটু কষ্ট করে গুগলে এই চুক্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে একটু সার্চ করুন। সেখানে নেপালের সাধারণ মানুষদের লেখা ব্লগগুলোতে এর ভয়াবহ চিত্র পাবেন। নেপালী পত্রিকাগুলোর সাইটও দেখতে পারেন।

জাপান আর কোরিয়াতে আমেরিকান সেনা বসে থাকা আর নেপালে ভারতের দাদাগিরি কেন এক নয় তা আপনার বোঝার কথা। এখানে সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা করতে চাইছিনা কারন তাতে নেপাল প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যাবে।

ল্যাণ্ডলকড দেশের জন্য ট্রানজিট যে কত বড় ব্যাপার তা একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। কারন আকাশ পথে খুব কম জিনিষই আমদানী বা রপ্তানী করা যায়। আকাশ পথের ফ্রেইট দিলে কোন জিনিষ আর সাধারণের ক্রয়সীমায় থাকে না।

বাংলাদেশের সাথে নেপালকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে চট্টগ্রাম নয়, মংলা বন্দর ব্যবহার করা হবে। কারন দূরত্বের কারনে চট্টগ্রাম বন্দর নেপালের জন্য feasible নয়। বাংলাদেশ সে সুযোগ পেলে মংলা বন্দরের অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় উন্নয়ন আপনা থেকেই হবে।

ত্রিপুরা বা উত্তর-পূর্ব ভারতের আরো ছয়টি রাজ্য কেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাবহারের সুবিধা পায় না এর উত্তর বাংলাদেশের কাছে নয় ভারতের কাছে আছে। নানা প্রকার বিদ্রোহী গ্রুপের অস্তিত্বসম্পন্ন স্পর্শকাতর এই রাজ্যগুলোর ব্যাপারে ভারত সরকারের নিজস্ব নীতি আছে যা অর্থনীতির সাধারণ হিসাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

একথা ঠিক যে নেপালের সাথে চীনের স্থল যোগাযোগ ব্যবস্থাটা খুব ভালো নয়। তবে তারপরও যদি নেপালে ভালো ব্যবসা করার সুযোগ থাকত তাহলে চীন এখাতে ব্যয় করত। কারন, এরচেয়ে আরো অনেক দূর্গম জায়গায় চীন রেলপথ বসিয়েছে বা হাইওয়ে তৈরি করেছে। চীনের সাথে নেপালের স্থল বাণিজ্য বাড়তে গেলেই নানা কায়দায় নেপালের উপর ভারতের নানা প্রকার চাপ বাড়তে থাকে। এটি ভুতের কিলের মত, দেখা যায়না কিন্তু হজম করতে হয়।

অতীতে একবার নেপাল চীন থেকে স্থল পথে পেট্রোলিয়াম কেনায় ভারত সাথে সাথে নেপালের সাথে বর্ডার ট্রেড বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতে তখন নেপাল বাধ্য হয় চীনের সাথে স্থল পথে পেট্রোলিয়াম কেনা বন্ধ করতে। এই খবরটির কোন লিঙ্ক দিতে পারছি না। তবে অনেকেরই মনে থাকার কথা। তাই চীন আপাত দৃষ্টিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও নেপাল ইস্যুতে অসুবিধাজনক অবস্থায় আছে।

সারা দক্ষিণ এশিয়া পিছিয়ে থাকার কারনগুলোর মধ্যে অশিক্ষা আর দুর্নীতি অবশ্যই আছে, তবে এগুলো রোগের উপসর্গ। মূল রোগ নিহিত আছে স্থানীয়, আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে, আছে নানা পর্যায়ে শোষনের মধ্যে। শ্রীযুক্ত টিম হারফোর্ড সেগুলোকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন। শ্রী টিমের বক্তব্যর দায়ভার শ্রী দিগন্ত কেন নিবেন?

ভালো থাকবেন।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

কোশি নদীর ওপর বাঁধ তৈরী একটা বড় ভুল। এমনিতেই বড় বাঁধ তৈরীর প্রকল্পগুলো অনেকগুলোই ভাল কাজ করেনি ভারতে, সেটার ফল ভারতীয়রা সমানভাবেই ভোগ করেছে, নেপাল সেখানে আলাদা কিছু নয়। কোশি নদীর বাঁধ ভেঙে শেষ বন্যায় নেপাল ও বিহারে অনেক লোক মারা গেছে। প্রকল্পটাই নিশ্চিতরূপে ভুল। ওটা ভারতের জায়গায় নেপালের হাতে খবরদারি থাকলেও আলাদা কোনো ফল আনত না। চুক্তিটা নিশ্চিতরূপে অন্যায্য কিন্তু এর ফলে অর্থনীতির খুব কিছু হেরফের হয় বলে মনে হয় না কারণ গলদ পরিকল্পনাতেই।

মংলা বন্দর নেপাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে, কলকাতা বা হলদিয়া বন্দরের তুলনায়। শুধু তাই নয়, মংলা বন্দরের পরিবহনক্ষমতাও (কলকাতা ৫০+ মিলিয়ন টন কার্গো, হলদিয়া ২৫+ মিলিয়ন টন আর মংলা ০.৬৫ মিলিয়ন টন) অনেক কম - অর্থনীতির হিসাবেই তাই প্রতি টনের খরচায় তুলনা চলে না।

চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার জন্য অনুমতি অনেককাল আগে থেকেই ভারত চেয়ে আসছে বলে মনে হয় (একটা লিঙ্ক ২০০৫)। অসুবিধাটা ভারতের দিক থেকে তো মনে হয় না। ভারত সরকার তো এখন চট্টগ্রাম বন্দর পাওয়া যাচ্ছেনা ধরে নিয়ে মায়ানমারে আরেকটা বন্দর বানানোর কাজে হাত দিয়েছে। বন্দর যদি না-ই লাগত তাহলে মায়ানমারেও সেটার দরকার ছিল না।

নেপালের সাথে চিনের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালই, সুতরাং ভৌগোলিক ছাড়া আর কোনো অসুবিধা আমি তো দেখি না চিন-নেপাল সম্পর্কে। নেপাল-চিন সীমান্ত হল পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম অঞ্চল।

ভারত বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে না, করলে তার বিরুদ্ধে ডাব্লিউ-টি-ওতে মামলা করে ক্ষতিপূরণ চাওয়া সম্ভব। আপনার বর্ণনামত ঘটনা ঘটলে নেপাল চিনের সাহায্য নিয়ে সেই কাজটা করতেই পারত।

আঞ্চলিক দলাদলি নিশ্চিতরূপে দক্ষিণ এশিয়ার একটা সমস্যা, কিন্তু এই একই সমস্যা থেকে আমার মনে হয়না পৃথিবীর কোনো অঞ্চলই মুক্ত - সে আমেরিকা-মেক্সিকো, জাপান-চিন-তাইওয়ান-ভিয়েতনাম বলুন বা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-চিলি-পেরু।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, আপনার আমার আলোচনাটি কিন্তু টিম হারফোর্ড-নেপাল থেকে বহুদূরে চলে গেছে। আমার মনে হয় এই পোস্টে এই আলোচনাটি এখানেই ক্ষান্ত দেই। নয়তো এর পাঠকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। তবে আপনি চাইলে আপনার সাথে ই-মেইলে আলোচনাটি চালিয়ে যেতে পারি।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

একমত। আমার ইমেল আইডি সচলে পেয়ে যাবেন। উত্তর দিন। আমি আলোচনায় আছি।

হারফোর্ডের পরের টপিক উন্নত বিশ্বের গরিবদের নিয়ে। সেটাও জলদিই সচলে নামাবো ভাবছি।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হিমু এর ছবি

সে কী!

পাঠকদের বঞ্চিত করে কী লাভ? রক্তক্ষয় যখন হচ্ছে না, তখন আলোচনা সচলেই চলুক।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আলোচনা চলুক।



অজ্ঞাতবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, হিমু এবং সুমন চৌধুরীর দাবীর ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাইছি। আমি অবশ্য আলোচনা প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিল বলে অমন অনুরোধ করেছিলাম।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

চলেন তাহলে, আলোচনা এখানেই হোক।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, প্রথমে আপনার আগের মন্তব্যে করা ভুটান প্রসঙ্গে বলে নেই। এই প্রসঙ্গটি আমি এর আগে ইচ্ছে করে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। মাথাপিছু গড় আয় আর প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে কী একটি দেশের মানুষ গরীব কি ধনী তা বলা যায়? জাপানের প্রবৃদ্ধির হারতো ভারতের চেয়ে আড়াই পয়েন্ট কম। তাহলে কী ভারতীয়রা জাপানীদের চেয়ে বেশি ধনী? অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিমাপক জিনি রেশিও (gini ratio) দিয়ে হিসাব করলে ভুটানের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? অবকাঠামোগত সুবিধাবিহীন, মানবিক জরুরী বিষয়গুলিতে রাষ্ট্রিয় উদ্যোগবিহীন ভুটানের সম্পদ বাড়ছে ঠিকই। তবে তা ওয়াংচুক পরিবার আর তাদের ধামাধরাদের, সাধারণ ভুটানীদের না। দেশের ২০% মানুষকে গলাধাক্কা দিয়ে দেশের বাইরে বের করে দেয়া দেশের নাম ভুটান। ভারত থেকে ২০% মানুষ আজ বের করে দিন, দেখবেন ভারতের অর্থনীতিও এক রাতে বিরাট উল্লম্ফন দিবে।

প্রিয় দিগন্ত, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে কোশি বাঁধকে হয়তো ভুল বলা যায়, তবে পঞ্চাশের দশকের কনটেক্সটে তা ঠিক ছিল, অন্ততঃ ভারতের স্বার্থরক্ষার কনটেক্সটে। “বিহারের দুঃখ” কোশি নদী তখন “বিহারের গর্বে” পরিনত হয়েছিল। কোশি বাঁধ তৈরির সময় মাথায় রাখা হয়নি এটি পৃথিবীর একমাত্র নদী যা গত আড়াইশো বৎসরে তার গতিপথ ১২০ কিলোমিটার বদলেছে (ট্রান্সভার্স ডিরেকশনে)। নদীর গতি প্রকৃতি বিবেচনায় না এনে, উজানে পলি জমে রিভার-বেড দুইপাশের জমির চেয়ে উঁচু হয়ে যাবার কথা না ভেবে তড়িঘড়ি করে যে বাঁধ বানানো হয়েছে তাতে টেকনিক্যাল নির্বুদ্ধিতা নয়, রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধি কাজ করেছে। ভারতীয় বা নেপালী পানি বিজ্ঞানীদের দোষ না দিয়ে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী নেহেরু সরকারের আঞ্চলিক নীতির কথা ভাবুন। উন্নয়নে রাজনীতির এই ভূমিকাটির কথাই আমি বারবার আপনাকে বোঝাতে চেয়েছি, যা শ্রী টিম পাত্তা দেবারই চেষ্টা করেন নি। এক ১৯৭৮ সালেই কোশির পূর্ব তীর ভেসে গিয়ে বিরাটনগর পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে বসেছিল, তখন কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ৭০০ কোটি নেপালী রূপী ধার করে এমব্যাংকমেন্ট সারাতে হয়েছে নেপাল সরকারকেই। ভারত সরকার কিন্তু তখন এক পয়সাও ছোঁয়ায় নি। আন্তর্জাতিক মহাজন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে এই বিপুল পরিমান দেনার দায় শোধ করতে হয়েছে কিন্তু নেপালের সাধারণ নাগরিকদের। ধুঁকতে হয়েছে নেপালের জাতীয় অর্থনীতিকে। তারপরও তাদের দুরবস্থার জন্য মেরুদণ্ডহীন স্থানীয় রাজনীতি আর সুবিধাবাদী আঞ্চলিক রাজনীতিকে দায়ী করবো না?

আমি কিন্তু মংলা বন্দরের ভৌগলিক অবস্থানকে চট্টগ্রামের সাথে তুলনা করেছিলাম, কলকাতা বা হলদিয়ার সাথে নয়। নেপালের জন্য কলকাতা বা হলদিয়া ভৌগলিক দিক দিয়ে অবশ্যই সুবিধাজনক, তবে স্ট্র্যাটেজিক দিক বিবেচনায় আনলে তার সাথে মংলার মত বিকল্প থাকাও জরুরী হয়। মংলা বন্দর কেন মরার মত পড়ে আছে, এমনকি বাংলাদেশীরাও কেন তা ব্যবহারের উৎসাহ পায় না তার উত্তর আছে স্থানীয় রাজনীতিতে। মংলার ত্রাস এরশাদ শিকদাররা দুষ্ট রাজনীতিরই ফসল। তাই মংলার কোন উন্নতিও হয়না।

ভারত সরকার বাংলাদেশের কাছে যখন চট্টগ্রাম বন্দর চায় তখন তার সাথে সাথে আরো দশটা সুবিধাও চায় (ট্রানজিট, গ্যাস, আন্তঃনদী সংযোগ খাল, রেল সুবিধা, নদী পথে চলাচল, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া, ছিটমহলে আধিপত্য ইত্যাদি)। এর কিছু উক্ত, আর কিছু অনুক্ত। এ যেন লম্পট পুরুষের মত, যখন নারীর হৃদয় দাবী করে তখন তার পূর্ব শর্ত হিসাবে তার শরীরটাও দাবী করে বসে। তাই বাংলাদেশের সাথে ভারতের অধিকাংশ সমস্যাই ঝুলে থাকে, সমাধান হয়না। স্পর্শকাতর উত্তর-পূর্ব ভারতে, ভারত সরকার বাংলাদেশের মাখামাখি যৌক্তিক কারনেই চায় না। তাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, নিজের সমস্যায় জর্জরিত, সামরিক শাসকদের দেশ মায়ানমারের সাথেই মাখামাখি করা ভাল। তাতে দাদাগিরি নিরাপদ হয়।

নেপালের সাথে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির ফলে ভারত যদি নানা অজুহাতে নেপালের সাথে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় তাহলে তা পৃথিবীর কোন আদালতে কত দিনে প্রমাণ করা সম্ভব? যদি সম্ভবও হয় সেই ক্ষতিপূরণের টাকা নেপালের কে পাবে? কারন, তার বহু আগেই জরুরী সরবরাহের অভাবে নেপালীদের স্বগযাত্রা নিশ্চিত হয়ে যাবে। আর দেঙ-এর দেশ দুই কোটি নব্বই লাখের বাজার নেপালের চেয়ে একশত তের কোটির ভারতের বাজারের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। নেপাল মরলেও যদি একশত তের কোটির বাজার পাওয়া যায় মন্দ কি?

আঞ্চলিক দলাদলির ব্যাপারে আপনার বক্তব্য সঠিক। তবে এই দলাদলি যদি একতরফা হয় (অর্থাৎ একজনের শক্তি আরেকজনের সাথে তুলনীয় না হয়) তাহলে তা দুর্বল দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতেও মস্ত ভূমিকা রাখতে শুরু করে। আর অর্থনীতি কোন কালে রাজনীতির প্রভাবের বাইরে ছিল? শোষনের রাজনীতির যদি অর্থনীতির সাথে কোন সম্পর্কই না থাকে তাহলে রাজনীতি এবং অর্থনীতির পাঠ নতুন করে লেখা জরুরী হয়ে পরবে।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

ভুটান দেশের ২০% লোককে বের করে দিচ্ছে এরকম খবর আমি তো জানি না। ভুটানে অনেক নেপালি বাস করত তাদের সাথে ভুটানিদের ঝামেলা হওয়ায় তাদের তাড়ানো হচ্ছে (যদিও একে আমি সমর্থন করি না)। ভুটানের অর্থনীতিতে টাকা আসছে জলবিদ্যুত বিক্রি করে। নেপালের সাথে সেইজন্যই তুলনা করেছি। ভুটানের গিনি কোয়েফ ৪১, ভারতের ৩৬, বাংলাদেশের ৩৩, চিনের ৪৬ (সংখ্যা বেশী মানে বেশী অসাম্য)। সুতরাং, ভুটানের এমন কিছু বেশী না গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট।

কোশির ওপর বাঁধ হয়েছে ১৯৫০এর দশকে, কিন্তু তার আগেও কোশির বন্যার ইতিহাস রয়েছে, এবং অনেক জায়গা ভাসানোর ইতিহাস রয়েছে। এ বছরেরটা (২০০৮) ছাড়াও ১৯৮৭ সালেও বন্যায় বিহারে প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। (কোশির কিছু বন্যার কথা এখানে পাবেন) সুতরাং, ক্ষতি নেপালের একার হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। কারণটা আপনি বলেইছেন - কোশির প্রবাহ পরিবর্তনকে মাথায় রাখা হয়নি বাঁধ বানানোর সময়। সেটা কি রাজনৈতিক কারণ না পরিকল্পনার অভাব?

মংলা নিয়ে অর্থনৈতিক কোনো কথা হয়নি, তাই এ নিয়ে আর কথা লিখছি না।

ভারত বাংলাদেশের কাছে যা চাইবে তাই বাংলাদেশকে না দিলে কথা ঝুলে থাক্কবে এরকম ভাবার তো কোনো কারণ দেখি না। বাংলাদেশ কি কোথাও বলেছে ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু বাকিগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেবে? বাংলাদেশের স্বার্থ আছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার না করতে দেবার বিরুদ্ধে। ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানীর অনেকটা অংশ উত্তর-পূর্ব ভারতে। চট্টগ্রাম বন্দর ভারত ব্যবহার করলে ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে উত্তর-পূর্বের বাজারে। (সূত্র - ডেইলি স্টার) সুতরাং, নিজের স্বার্থরক্ষার্থেই ভারতকে মায়ানমারে বন্দর বানাতে হবে। অর্থনীতির নিয়মই তাই - বাজারে একটাই অপশন থাকলে যতটা দরাদরি করা যায়, দুটো থাকলে দরাদরি বেশী হয়। তবে এর মধ্যে কারও গোলমেলে কিছু নেই। বাজারে দরাদরি হবেই।

ভারত নেপালে বাণিজ্য বন্ধ করবে কি ভাবে? বাণিজ্য থেকে কি শুধু নেপালের স্বার্থে? ভারতের আয়টা কি হবে? আর সেরকম হলে ভারত বাণিজ্য বন্ধ করলেই চিন নেপালের বাজার ধরে ফেলবে। আখেরে ভারতের লোকসান, চিনের লাভ। আমি তো এরকম বাণিজ্য বন্ধ করার যুক্তি কোনোদিন শুনি নি। আর ভারতের বাজার যদি চিনের কাছে লোভনীয় হয়, চিনের বাজার কি ভারতের কাছে কম লোভনীয়? চিন যদি নেপালের সাথে ঝামেলার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাথে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়? (আপনার পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে এরকম কিছু অবাস্তব মনে করি)


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় দিগন্ত, ভুটান থেকে লোক বের করে দেবার কথাটা এমন ভাবে বললেন যেন আট-দশ জন নেপালী ভুটানে বেড়াতে গিয়ে ঝামেলা পাকিয়ে ছিল তাই ভুটান সরকার তাদের ডিপোর্ট করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে ভুটান সরকার নব্বই-এর দশকে Lhotshampa (আমি এর বাঙলা উচ্চারন লিখতে অক্ষম) সম্প্রদায়ের এক লক্ষাধিক মানুষকে বলপূর্বক ভুটান থেকে বের করে দিয়েছে। Lhotshampa রা উনবিংশ শতাব্দী থেকে ভুটানে বসবাস করছে। ১৯৫৮ সালের আগে পরের কথা বলে ওয়াংচুক সরকার কেবল একটা ধূঁয়া তুলেছে। প্রকৃতপক্ষে বহিষ্কার হয়েছে নির্বিচারে। এ সংক্রান্ত ইউএনএইচসিআর-এর রিপোর্ট পড়ুন এখানে। আমার জন্য কষ্টের বিষয় হচ্ছে এই যে, Lhotshampa দের ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গী ভারত সরকারের অনুরূপ। ভুটানের সাথে নেপালের কমন বর্ডার নেই। তাই Lhotshampa দের ভুটান থেকে পুশ-ইন করতে হয়েছে ভারতে। সদাশয় ভারত সরকার তাদেরকে ভুটানে পুশ-ব্যাক করার পরিবর্তে অনেকটা পথ উজিয়ে নিয়ে নেপালে পুশ-ইন করেছে। অর্থাৎ বর্ণবাদী রাজতান্ত্রিক ভুটান সরকারের মনোভাব আর গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের মনোভাব এক্ষেত্রে একই - “হলই বা দেড়শ বৎসর ধরে আছিস, আসলে তো তোরা নেপালী। যা এবার নিজের দেশে যা”। তাহলে ১৯৪৭ সালের পর পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে ভারতে যাওয়া কয়েক কোটি মানুষকেও কী ভারত সরকার বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবে?

আপনার এই কথা ঠিক যে, আজকের ভুটানের টাকা আসছে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করে। “টালা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প”র সুফল সুফল কিন্তু ভুটানের মানুষ ভোগ করে না। ভারতে রপ্তানী করা বিদ্যুৎ -এর টাকা ওয়াংচুক পরিবার আর তাদের ধামাধরাদের পকেটে যায়। এদিয়ে যে ভুটানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয় না সেকথা আমি আগেই বলেছি। অর্থনীতির হিসাবে Gini Coefficient ৩৬ আর ৪১-এর পার্থক্য অনেক। সেই অহেতুক বিতর্কে যাব না। যাব না এই জন্য যে, বাস্তবে সার্বিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে ভুটান ভারতের চেয়ে পাঁচ পয়েন্ট নয়, কম করে হলেও পাঁচ দশক পিছিয়ে আছে।

কোশি নদীতে পঞ্চাশের দশকের আগে বন্যা হয়েছে বলেই না বাঁধ দেবার ব্যাপারটা সামনে এসেছে। খামাখা তো আর কোশির নাম “বিহারের দুঃখ” ছিলনা (আমার আগের মন্তব্য দেখুন)। ১৯৮৭ সাল কেন ১৯৭৮ সালেও কোশিতে বিরাট বন্যা হবার কথা আমিই আগে বলেছি। বাঁধ যখন ফেল করতে শুরু করল, তখন প্রথম দিকে পূর্ব তীর ভাসাত। পশ্চিম তীরের ভারতীয়দের ধারণা ছিল বোধ হয় কোশি তার পশ্চিম তীর ভাসাবে না। তাই ১৯৭৮ সালে এমব্যাঙ্কমেন্ট মেরামতে ভারত কোন টাকা দেয় নি। পরে যখন পশ্চিম তীরও ভাসতে লাগল তখন থেকেই ভারতের হৈ-চৈ শুরু হল। বাঁধ নির্মানে পরিকল্পনাগত ত্রুটির কথা আমিই উল্লেখ করেছিলাম। আমি আরো বলেছিলাম

“তড়িঘড়ি করে যে বাঁধ বানানো হয়েছে তাতে টেকনিক্যাল নির্বুদ্ধিতা নয়, রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধি কাজ করেছে। ভারতীয় বা নেপালী পানি বিজ্ঞানীদের দোষ না দিয়ে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী নেহেরু সরকারের আঞ্চলিক নীতির কথা ভাবুন। উন্নয়নে রাজনীতির এই ভূমিকাটির কথাই আমি বারবার আপনাকে বোঝাতে চেয়েছি”

আমার মনে হয় আমার এই বক্তব্য বোঝার জন্য যথেষ্ঠ পরিষ্কার।

মংলা নিয়ে কথাটা শুরু হয়েছিল নেপালের অর্থনীতির প্রসঙ্গেই। পরে সেখানে রাজনীতি অবধারিত ভাবেই চলে আসে। অর্থনীতি-রাজনীতির সম্পর্কটাই এমন। আপনি না চাইলে এব্যাপারে আর কথা বলব না।

ভারত কেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করবে তার একটা অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা আপনি দিয়েছেন, আমি তা মানছি। আর এর পেছনের রাজনৈতিক-স্ট্র্যাটেজিক কারনের কথা আমি আগেই বলেছি। বিষয়গুলি একটি আরেকটির সাথে গভীরভাবে জড়িত। কোনটাকে আলাদা ভাবার কোন সুযোগ নেই।

ভারত নেপালে বাণিজ্য বন্ধ করলে ভারতের আয় কমে (বন্ধ হয় না), আর তাতে নেপালের মানুষের আয়ু কমে। ভারত নেপাল দড়ি টানাটানিতে দেঙ-এর দেশ কোন পক্ষে যাবে, কী করবে, কেন করবে তা আমি আমার আগের মন্তব্যে বলেছি।

প্রিয় দিগন্ত, এই পর্যায়ে আমি দেখতে পাচ্ছি আমাদের আলোচনাটা একটা জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যেখানে আলোচনা নতুন কোন ডাইমেনশন পাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আপনার নতুন ডাইমেনশনের বক্তব্য না থাকলে আলোচনা অদরকারী হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে আপনার ভাবনা জানাবেন।

এই পর্যন্ত আলোচনায় আপনি আমার কোন বক্তব্যে ব্যক্তিগত ভাবে আহত বোধ করলে ক্ষমা চাইছি। আপনার প্রতি আমার কোন দ্বেষ বা ক্ষোভ নেই।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

আমি কিন্তু ভুটানের শরণার্থী সমস্যায় ভুটান, নেপাল বা ভারত সরকার- কাউকেই নির্দোষ বলিনি, আমার বক্তব্য ছিল - এই ঘটনা অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলবে না।

তবে, আমারো মনে হচ্ছে অদরকারী বিষয়ে বেশী জলঘোলা হচ্ছে। ইতিহাস বেশী ঘাঁটা হচ্ছে আর ভবিষ্যতে কি হওয়া উচিত তা নিয়ে আলোচনা কম হচ্ছে। তাই আলোচনায় ক্ষান্তি হাসি ... আর আমি কোনোভাবেই ব্যক্তিগতভাবে আহত হইনি, আপনার সাথে আলোচনা করে বরং ভাল লেগেছে কারণ আপনি তথ্যসমৃদ্ধ ও বিশ্লেষণধর্মী ভাবে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ আলোচনা করার জন্য। আপনার প্রতিশ্রুত শ্রী টিম হারফোর্ডের পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।