সচলায়াতনে পাকিস্তানী হিউম্যানিস্ট কোনো লেখকের লেখা প্রকাশিত হয় নি। আমি পারভেজ হুদভয়ের একটা সময়পোযোগী সাক্ষাৎকার বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম। এম-এই-টি থেকে পি-এইচ-ডি করা পারভেজ হুদভয় ১৯৭৩ সাল থেকে পাকিস্তানের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ইনি পাকিস্তানে মশাল নামে একটি সংগঠনেরও পরিচালক। এই সংগঠনের কাজ হল নারীশিক্ষার প্রসার ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি। বিজ্ঞান-সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত ওনার ১৩ পর্বের ডকুমেন্টরিও পাকিস্তান টিভিতে প্রচারিত হয়েছে। ২০০৩ সালে বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারের ওপর কাজ করার জন্য ইউনেস্কো থেকে উনি বিশেষ পুরষ্কার পান।
নিচের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ক্রিশ্চিনা ওটেন, জার্মান ফোকাস পত্রিকার জন্য। এটা প্রকাশিত হয়েছে কাউন্টারকারেন্টসে, গত ১৫ই ডিসেম্বর।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক মুম্বই হামলার পরে ক্রমাগত খারাপ হয়েই চলেছে। যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা কতটা?
জনগণের দাবী সত্ত্বেও মনমোহন সরকার সীমান্ত পেরিয়ে কোনো আক্রমণ করেনি। দেশে অনেকের সমালোচনা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার লস্কর-ই-তৈবার বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে। হয়ত এখন আর কিছু হবে না, তবে এখনকার মত কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও আরো একবার একই রকমের হামলা হলে ব্যাপারটা যুদ্ধের আকার ধারণ করতেই পারে।
লস্কর-ই-তৈবার সাথে আর সন্ত্রাসী দলগুলোর তফাৎ কোথায়? পাকিস্তান কি সত্যিই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে?
আজ থেকে বছর পনের আগে আই-এস-আই আর আর্মির হাত ধরে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য লস্করের গোড়াপত্তন। আজকের দিনে এরা খুব বিরল প্রজাতির সন্ত্রাসী দল যাদের পাকিস্তানী রাষ্ট্র বা সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু বাকি সকলেই এদের শত্রু হয়ে গেছে। এখন শুনছি পাকিস্তান কিছু লস্কর সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। সময়ই বলে দেবে এটা আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর চেষ্টা না সত্যিকারের সন্ত্রাসদমন প্রচেষ্টা। যদি সত্যিকারের প্রচেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে কিছু সময়ের মধ্যেই আর্মি আর আই-এস-আই এর সাথে এদের শত্রুতা দেখা দেবে, যেমনটা হয়েছিল জৈশ-ই-মহম্মদের ক্ষেত্রে।
মুম্বাই গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানের জনগণের প্রতিক্রিয়া কি?
৯/১১ এর পরে যেমন আনন্দোৎসব দেখা গিয়েছিল, সে জায়গায় মুম্বই হামলার পরে পাকিস্তানি জনগণ প্রাথমিকভাবে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যখনই পাকিস্তানকে দোষ দেওয়া শুরু করল, তখন প্রথমে ক্রোধ ও পরে অস্বীকারের রাস্তায় হাঁটতে থাকে সবাই। পাকিস্তানের মাটি থেকেই আক্রমণের ছক কষা হয়েছে – এ দাবী তারা মানতে নারাজ। জনপ্রিয় টিভি-নিউজ ব্যক্তিত্বরা সবাই টিভিতে এসে একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বছর কয়েক আগে এই ব্যক্তিত্বরাই কান্দাহার বিমান ছিনতাই মামলায় র’-এর ছায়া দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিল, যার কোনোটাই ধোপে টেঁকেনি। পাকিস্তান যে কারগিলের ঘটনায় জড়িত, তা-ও এরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। সমঝোতা এক্সপ্রেসের বোমা হামলার উল্লেখ করে এখন তারা একে একে হিন্দু জঙ্গী গোষ্ঠী, আমেরিকা বা ইহুদীদের দোষারোপ করে।
পাকিস্তান অনেককাল ধরেই বলে আসছে যে ভারতের দিক থেকে হামলার আশঙ্কা করলে তারাই প্রথম নিউক্লিয়ার হামলা করবে। পাকিস্তানে সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছেন আপনি?
মুম্বাই হামলার সপ্তাহখানেক আগে জারদারি আশ্বস্ত করেছেন যে পাকিস্তান কখনই প্রথমে নিউক্লিয়ার আক্রমণ করবে না। ভারতও বছর দশেক আগেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে জারদারির এই দাবী ভিত্তিহীন কারণ পাকিস্তান আর্মির পক্ষ থেকে এরকম কোনো বক্তব্য রাখা হয় নি। সবাই জানে, পাকিস্তানে আর্মির হাতেই নিউক্লিয়ার বোমা আছে। অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সিমুলেশন করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কোনোভাবে যুদ্ধ শুরু হলে নিউক্লিয়ার বোমাতে গিয়েই যুদ্ধ শেষ হবে।
সন্ত্রাসীরা আফগানিস্থান আর সেখানের পশ্চিমি সেনাদের ছেড়ে কেন ভারতকে লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিল?
লস্করের মূল ঘাঁটি হল লাহোরের কাছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত মুর্দিকে শহরে। এই শহরে এদের আছে একটা বড় ট্রেনিং ক্যাম্প আর সমাজসেবক সংস্থা। লস্করের অধিকাংশ সদস্যই পাঞ্জাবী, তাই এরা আফগানিস্থানে লড়াই করার পক্ষে অনুপযুক্ত, কারণ এরা সহজে পাশতুন বা আফগানদের সাথে মিশে যেতে পারে না। লস্কর হল ভারতমুখী ও কাশ্মীরমুখী একটি সন্ত্রাসী দল। কিন্তু, পাকিস্তানের অন্যান্য জঙ্গীগোষ্ঠীদের মতই এরাও ভারত, আমেরিকা আর ইসরায়েলের মধ্যে বোঝাপড়া আছে বলে মনে করে। তাই, এরা সবাই এই দেশগুলোর শত্রু।
মুম্বই-সন্ত্রাসীদের হামলার দাবী কি ছিল?
সব জিম্মিদের হত্যা করা হয়েছে আর কোনো দাবী সরকারীভাবে প্রকাশিত হয় নি। লস্কর বা সমধর্মী পাকিস্তানি জঙ্গীগোষ্ঠীদের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। এই ক্ষেত্রে, ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কেন্দ্রস্থল হিসাবে মুম্বইকে আক্রমণ করা হয়েছে, হয়ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল। ভারত-সীমান্তে পাকিস্তানী সেনা সরালে তাদের দলের তালিবানদের সুবিধা হবে। ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের হাত শক্ত করাও এদের লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, কারণ এর ফলে এদের দলে আরো নতুন মুখ পাওয়া সোজা হবে। সবেশেষে, অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের উদ্গিরণও ঘটেছে এই আক্রমণে।
পশ্চিমা সাংবাদিকেরা বলছেন আল-কায়দা আর লস্কর-ই-তৈবা এখন যৌথ কার্যক্রম চালাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনার মত কি?
এদের উদ্দেশ্য একই রকম হলেও সামান্য কিছু মতাদর্শগত তফাৎ থাকতেই পারে। সন্ত্রাসীদের দুনিয়ায় সামান্য মতাদর্শের পার্থক্যই দুই দলের মিলিত কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিতে পারে। এখনও অবধি এদের যৌথ কার্যক্রমের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নি, তাই এই ধারণাকে আমি এখনও সন্দেহাতীত বলে মনে করি না।
এই সন্ত্রাসে কাশ্মীরের ভূমিকা কতটা?
কাশ্মীরে ১৯৮৭ থেকেই বিপ্লব চলছে। ১৯৮৭ সালের ভোটে ব্যাপক আকারে কারচুপির ফলে এক গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয় যা ভারত সেনা পাঠিয়ে বলপূর্বক দমন করে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই সুযোগে এক গোপন যুদ্ধ শুরু করে ভারতের বিরুদ্ধে। ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল বলে এক ২২টি পাকিস্তানী সংগঠনের সমবায় সংস্থা সেনা ও আই-এস-আই-এর সহায়তায় তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। এদের সহায়তায় জেনারেল মুশারফ ১৯৯৯ সালে কারগিলে যুদ্ধ শুরু করেন। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষতি হলেও পাকিস্তানও শেষমেষ সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। জেনারেল মুশারফ যুদ্ধে বিজয়ীর মর্যাদা পান, আর ভীরু বলে চিহ্ণিত হন নওয়াজ শরিফ। এর পরের ঘটনা সবারই জানা।
পাকিস্তানি সমাজের কোন অংশ আল কায়দা আর ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন করে?
বালুচিস্তান আর সিন্ধে ওসামার প্রতি সমর্থন পাঞ্জাব আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তুলনায় অনেক কম। মজার কথা হল পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেরা পশ্চিম-ঘেঁষা জীবনযাপণ করেন আবার ওসামার প্রতি সমর্থন বা পশ্চিম-বিদ্বেষও তাদের মধ্যেই বেশী। আমি খুবই অবাক হই যখন তালিবান আত্মঘাতী ঘাতকেরা দেশের মসজিদ, শোকসভা, হাসপাতাল, মেয়েদের স্কুল আক্রমণ করে বা নিরীহ পুলিশদের মেরে ফেলে অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিছু শোনা যায় না। জনগণ এতটাই আমেরিকা-বিরোধী যে এই ঘটনাগুলোও তাদের মনে দাগ কাটে না। অনেক সময় পাকিস্তানী বামপন্থীরাও তালিবানদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তি বলে ভুল ভেবে বসে।
এ বিষয়ে আপনার মতামত কি? এই তালিবানদের কি সত্যিই পাকিস্তান-সমাজে কিছু অবদান আছে?
পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ যা চায় পাকিস্তানীদেরও তাই দাবী। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, চাকরি-বাকরি, উন্নত বিচারব্যবস্থা ও উন্নয়নমুখী সরকার আর সুরক্ষা। এর সাথে আছে শিক্ষা ও চিন্তা ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা যা ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস ডিক্লারেশনে আছে। এর পরে আসে দেশের সার্বভৌমত্ব, বিদেশনীতি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু। এ কারণে, পাকিস্তানে এই তালিবান-গোত্রীয়রা কোনো অবদান রেখেছে বলে মনে হয় না। তারা পরিবার-পরিকল্পনা-বিরোধী, সংখ্যালঘু-বিরোধী, নারীশিক্ষার বিরোধী। বহির্বিশ্ব সম্পর্কে এদের কোনো জ্ঞান নেই, জানার কোনো ইচ্ছাও নেই। তারা শুধু যুদ্ধের মাধ্যমেই সমাধান খোঁজে। পাকিস্তানে এবারের ভোটে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে জনগণ এদের পছন্দ করে না।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য - দ্বিতীয় পর্ব)
মন্তব্য
ওই ঘটনার সময় এনডিটিভিতে একটা কথা বারবার শোনা যাচ্ছিল : দিস ইস নো টাইম টু বি রেসিলিয়েন্ট। এনডিটিভির প্রোগ্রাম হেডিং ছিল "ওয়ারজোন" - শোভা দে আপত্তি তুলেছিলেন। বলেছিলেন 'দিস ইস নট ওয়ার, দিস ইস নট ফট বিটইউন টু নেশনস'।
--------------------------------------------------------------------------
The philosophers have only interpreted the world in various ways; the point, however, is to change it.
[MARX : Theses on Feuerbach]
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
দেশের সব নিউস চ্যানেলও একই কথা বলেছিল। তবে এখানে পারভেজ হুদভয় যেগুলোর বলছিলেন ... সেগুলো এখানে পাবেন।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
পারভেজ হুদভয়-এর সাক্ষাতকারটির চমৎকার অনুবাদ করার জন্য দিগন্তকে অনেক ধন্যবাদ।
মুম্বাই-ম্যাসাকার, কাশ্মির, তালেবান ও অন্যান্য যেসব প্রসঙ্গ সাক্ষাতকারে এসেছে, তা একজন মুক্তবুদ্ধির পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীর ভাষ্যে জানাটা খুব দরকার ছিলো। নতুন এই দিকটিতে ফোকাস করার জন্য (বিপ্লব)
জলদি পরের পর্ব চাই। ...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...
অনুবাদ
___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে
নতুন মন্তব্য করুন