মন্দার পরে আমেরিকা ও বিকল্প অর্থনীতি

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ১৬/০৩/২০০৯ - ১২:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(লেখাটা স্বামীনাথন আয়ারের স্বামীনমিক্স সিরিজের একটা প্রবন্ধ। স্বামীনাথন আয়ার টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকার এক জনপ্রিয় কলামিস্ট। তার স্বামীনমিক্স সিরিজের প্রবন্ধগুলো ব্যতিক্রমী চিন্তাধারায় লেখা। এগুলো পড়তে পারেন এখানে বা এখানে। )

১৯৩০ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের পরে আবার এক পৃথিবীব্যাপি মন্দা সারা পৃথিবীর অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে। মন্দার প্রকৃত কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও একটা ব্যাপারে সবাই একমত, বর্তমান ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা চূড়ান্ত ব্যর্থ অবস্থা সামাল দিতে - এবং সাধের বিশ্বায়ন, যা কিনা এই পুঁজিবাদেরই ফল - তাও এক দেশের ব্যর্থতায় বাকি সব দেশের পতন ডেকে এনেছে। পৃথিবীর সবথেকে বড় ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে পাঁচটি রাতারাতি গায়েব হয়ে গেছে। সবথেকে বড় দুটো মর্টগেজ কোম্পানীরও অকালমৃত্যু হয়েছে - তারা সরকারি আশ্রয়ে এখন। পৃথিবীর সবথেকে বড় ইন্সুরেন্স কোম্পানী এআইজি সরকারের ছায়ায় ধুঁকছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব্যাঙ্ক - সিটিব্যাঙ্ক - সরকারি টাকা নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। গত শতকের সবথেকে আলোচিত মোটর কোম্পানী জেনারেল মোটরস সরকারি স্যালাইন নিয়ে টিঁকে আছে। আমেরিকার পুঁজিবাদের সবথেকে বড় আইকনগুলোই আজ ক্লাচে ভর করে হাঁটছে।

কিন্তু মজার কথা, আমেরিকার সবথেকে বড় সমালোচক দেশগোষ্ঠীর অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ। আমেরিকার পুঁজিবাদের কট্টর সমালোচক ছিল দক্ষিণ আমেরিকার তিন দেশ (ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর আর বলিভিয়া), রাশিয়া আর ইরান। এদের এই প্রতিদ্বন্দী
অর্থনীতিও কিন্তু মন্দার ঝড়ঝাপটা থেকে বেঁচে নেই। অর্থনীতির হিসাবে তেলের দাম ব্যারেলপিছু ৯০-৯৫ ডলার হলে ভেনেজুয়েলা বা ইরানের বাজেট ঘাটতিশূন্য হয়। গতবছর তেলের দাম ব্যারেলপিছু ১৪৭ ডলার হবার পরে এরা অনেক বড় পরিকল্পনা করেছিল। ভেনেজুয়েলার হুগো শেভেজ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য হ্রস্বমূল্যে তেল দেবার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু এখন ভেনেজুয়েলা শুধু জমানো বিদেশী মুদ্রায় ভর করে অর্থনীতি চালাচ্ছে।

ইরান আবার সেখানেও একটা ভুল করে রেখেছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজেদ আমেরিকাকে "শিক্ষা" দেবার জন্য তার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ ডলার থেকে ইউরোতে রূপান্তর করেছেন। ২০০৮ এর এপ্রিলে ইরান ঘোষণা করে যে তারা এবার থেকে তেল বিক্রির টাকা ইয়েন আর ইউরোতে নেবে আর এভাবে তাদের ডলার সঞ্চয় ধীরে ধীরে "দুর্বল" ডলার থেকে "শক্তিশালী" ইউরো বা ইয়েনে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে ইরান আমেরিকাকে দুর্বল করার পরিবর্তে নিজেদেরই দুর্বল করে ফেলেছে। ডলার গত অয়েক মাসে শক্তিশালী হয়েছে - ইউরোপিছু ডলারের দাম ১.৬ থেকে নেমে ১.২৬ হয়েছে। যারা ডলার থেকে ইউরোতে সঞ্চয় নিয়ে গিয়েছিল, তারা প্রচুর লোকসান করেছে। তাই, ইরানের তেল বিক্রির টাকা দুই তৃতীয়াংশ কমে যাবার পরে দেশের মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশে। আসন্ন নির্বাচনে, আহমেদিনেজাদের পরাজয় মনে হচ্ছে শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমেরিকা ভয় দেখিয়ে যা পেরে ওঠেনি, অর্থনীতির ধাক্কায় তা-ই সম্ভব হতে চলেছে - মধ্যপন্থী মহম্মদ খাতামি ইরানের প্রেসিডেন্ট পদ পেয়ে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়ায় পুতিন তার প্রিয় কিছু স্তাবকের মধ্যে রাশিয়ার তেলসম্পদ বিলিয়ে দিয়েছেন এই শর্তে যে তারা পার্টি তথা তার নিজের স্বার্থ দেখবে। এই পদ্ধতিতে রাতারাতি তৈরী করেছেন অসংখ্য বিলিয়নেয়ার - চেলসির মালিক রোমান আব্রাহামোভিচ যেমন। কিন্তু মন্দায় রাশিয়ার স্টক মার্কেট ৮০% পড়েছে, রাশিয়া বৈদেশিক মুদ্রার অনেক বড় অংশই এখন দেশের কারেন্সী রুবলকে বাঁচাতে ব্যয় করছে - তাও রুবল ডলারে ২৫ থেকে ৩৫-এ নেমে গেছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা পুঁজিবাদের সবথেকে বড় সমালোচক রাষ্ট্রনেতাদের পেছনের সমর্থক দেশের বড় তেলের খনি। বাজার অর্থনীতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পুরষ্কার হিসাবে অর্থনৈতিক সাফল্য আসে। এই কারণে এই ব্যবস্থায় সম্পদের সঠিক বন্টন সম্ভব নয়। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সমস্যা হল যে এই ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতার উন্নতির সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। তাই এই ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতা চট করে বাড়ে না। রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সমর্থকেরা মনে করে পুঁজিবাদীরা লাভ আর প্রবৃদ্ধি নিয়ে এতটাই মজে থাকে যে তাদের পক্ষে সম্পদের ন্যায্য বন্টন নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব নয়। টাকা যদি আকাশ থেকে পড়ত তাহলে এই বক্তব্য মেনে নেবার যথেষ্ট যুক্তি থাকত। কিন্তু সেই সম্পদ যদি উৎপাদন করতে হয় তাহলে তা উৎপাদনশীলতার সাথে জড়িত থাকে - সেখানেই বাজার অর্থনীতি অনেক ভাল কাজ করে।

এই তথাকথিত পেট্রো-স্টেটদের আয় কিন্তু একরকম আকাশ থেকে টাকা পড়ার মতই। কোনো এক ভৌগোলিক ঘটনাচক্রে দেশের মাটির তলায় তেল (বা অন্য খনিজ সম্পদ) ছিল - তা রপ্তানী করেই টাকা আসে। তাই রাষ্ট্রনেতারা উৎপাদনশীলতার কথা ভুলেই সম্পদ পুনর্বিন্যাস নিয়ে মেতে থাকতে পারেন। শেভেজের শাসনকালে ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন ১৯৯৮ সালের ৩.২ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে নেমে ২.৪ ব্যারেলে গিয়ে ঠেকে। উৎপাদনশীলতার নিরিখে এটা একধরনের সমস্যা। কিন্তু এই দক্ষতার অভাবও পার পেয়ে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশী থাকায়। ইরানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। এই অর্থে, আমেরিকার সিস্টেমের সবথেকে বড় সমালোচকেরা নিজেদের কোনো বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিকল্পক নন, তারা বর্তমান ব্যবস্থাতেই পরজীবীর মত টিঁকে থাকতে পারেন। মূল পুঁজিবাদের মন্দা চললে তাদের অবস্থা বরং আরো খারাপ হয়।

দুর্দিনেই সিস্টেমের শক্তি যাচাই হয়। আজ মন্দার সময় সারা পৃথিবী এখনও ডলারকে অন্য মুদ্রার পরিবর্তে নিরাপদ বলে মনে করছে, তাই ডলারের দাম বাড়ছে। আমেরিকার সিস্টেমে অসংখ্য ভুল ছিল, আছে ও থাকবে। সামগ্রিক পুঁজিবাদী পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো দরকার। এই পুনর্গঠনের লক্ষ্য হওয়া উচিত আরো নিয়ন্ত্রিত পুঁজীবাদ - বন্টনমুখী খনিজ-অর্থনীতি নয়।


মন্তব্য

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

চলুক
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

s-s এর ছবি

চমৎকার লাগলো লেখাটা। কিন্তু কথা হচ্ছে বিকল্প অর্থনীতি ক্লাসের লেকচার নোটে যত সহজে আঁকা সম্ভব, ততটাই অলীক আজকের বাস্তবতায়। পৃথিবীর সবচাইতে সমপদশালী দেশ হবার কথা ছিলো ভেনিজুয়েলার অথবা নিদেনপক্ষে রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের। শেষ পর্যন্ত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ যার/ যাদের হাতে তাদের যা হবে/হয়, সারা পৃথিবীরও তাই হবে/ হয়। এই লেখকের আরও ক'টা কলাম পড়েছি, ভদ্রলোকের লেখা খুব সুখপাঠ্য, ধন্যবাদ আপনাকে!

আদৌ কি পরিপাটি হয় কোনো ক্লেদ?ঋণ শুধু শরীরেরই, মন ঋণহীন??

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

যারা ডলার থেকে ইউরো বা ইয়েনে সঞ্চয় নিয়ে গিয়েছিল, তারা প্রচুর লোকসান করেছে।

এখানে একটা ভুল আছে ... ইয়েন গত কয়েকমাসে বেশ ভালো লেভেলের স্ট্রং হয়ে গেছে ... মাঝেখানে এক ডলার সমান ৮৯ ইয়েনের ঘরে নেমে এসেছিলো ... এখন দাম কমিয়ে ৯৮ এর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

দুঃখিত, ভুলটা অনুবাদে। আমি ঠিক করে নিলাম। ইয়েন সত্যি অনেক স্ট্রং হয়েছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ডলারের মূল্য ধরে রাখায় এমনকি বাংলাদেশের মতো গরিব দেশেরই স্বার্থ রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশই তাদের সঞ্চয়টা ডলারে করে অনেকসময় মার্কিন ব্যাংকেই খাটায়। ফলে ডলার পড়লে তাদের ক্ষতি। সেকারণে কৃত্রিমভাবে তারাও ডলারকে ঠেলে তুলে রাখে। অন্যদিকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পাল্টাবার পর ডলারকে অনেকটা জোর করে বিশ্বজনীন বিনিময় মুদ্রা করা হয়েছে। ডলার এখন আর মুদ্রা নয়- পণ্য। পণ্যের মতোই বিনিময় মূল্যের মাধ্যমে নয়, জোর করে এর দাম ঠিক রাখা হয় এবং বিভিন্ন দেশ ডলারে কেনাবেচা করতে বাধ্য হয়। এভাবে ডলারকে শ্রেষ্ঠ রাখা পুঁজিবাদেরই কীর্তি। পুঁজিবাদের ডিলেমা হলো সুষম হলে সেটা আর পুঁজিবাদ থাকে না, আর বিষম হলে সেটা একসময় নিজেই নিজের কবর খোঁড়ে।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

আপনার অনুবাদটা সত্যিই ভালো লেগেছে
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

হযবরল এর ছবি

খুব সহজপাঠ্য হয়েছে। ধন্যবাদ।

অফট্র্যাকঃ

এখন বলা হচ্ছে সারা পৃথিবীর তেলের লেভেল নিম্নগামী, সৌদি থেকে শুরু করে গালফ অফ মেক্সিকো সব বড় খনিগুলোতেই তেলের লেভেল নেমে গেছে এবং ধীরে ধীরে উত্তোলন খরচ বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে সহজে উত্তোলনযোগ্য তেলের খনির সন্ধান আর পাওয়া যাবে না। সুতরাং এই সবগুলো সূচকই তেলের বেইস প্রাইস বৃদ্ধির দিকেই ইঙ্গিত করে। বিকল্প শক্তির ব্যবহারে ইউরোপ এগিয়ে আছে এবং আমেরিকা শুরু করেছে ইঁদুর দৌড়। প্রশ্ন হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের কি অবস্থা, তৃতীয় বিশ্ব কি আবার তেলের মতোই অলটারনেট এনার্জির জিম্মি হতে যাচ্ছে ?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

শুভ জন্মদিন!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।