সময়টা ২০০৮ সাল নাগাদ হবে। গুগলের স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নিয়ে গবেষণার কথা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু সত্যি ভিডিওতে দেখা চালক-বিহীন গাড়ির অভিজ্ঞতাই আলাদা। লেসার-রাডারে নিজের মত করে গাড়ি চারপাশের সব কিছু “দেখে” সেইমত চলছে। নিউস রিপোর্টটা দেখে এত চমৎকৃত হয়েছিলাম যে মনে হয় এই গাড়ি বাজারে এলে আমি প্রথম যুগের খরিদ্দার হবার জন্য ঝাঁপাবো। আমার এমনিতেই ড্রাইভিং খুব একটা ভাল লাগে না। আমার হয়ে মেশিন গাড়ি চালিয়ে দিলে আমি মেশিনদের কাছে চির-কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।
শুধু গাড়ি চালানো বলে না, গত কয়েক শতকে মানুষের অনেক কাজই জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে অটোমেশন বা ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্র-চালিত সিস্টেম। সেই শিল্প-বিপ্লবের যুগ থেকে একের পর এক যন্ত্রের ঘাড়ে চড়ে আমাদের সভ্যতা একটু একটু করে এগোচ্ছে। নতুন যন্ত্র আনছে নতুন পণ্য, নতুন পণ্য বাড়ায় সমৃদ্ধি, আবার সমৃদ্ধির মানে আরও চাহিদা - অর্থাৎ উৎপাদন বাড়ে আরও অটোমেশনের হাত ধরে। চক্রের হাতে পড়ে উন্নয়ন। কেউ আগে বা কেউ পড়ে এই চক্রে ঢুকে পড়ছে। সেইমত তৈরী হচ্ছে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিশ্ব। পরে চতুর্থ ও পঞ্চম বিশ্ব তৈরী হলেও অবাক হব না। উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত এই অটোমেশনের চাকার দক্ষতা।
গত দশকে এই চাকা একেবারে বিদ্যুতগতিতে ছোটা শুরু করল। কম্পিউটারে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়েছে, তথ্য-সঞ্চয়ও আগের থেকে সহজতর হয়েছে। এই দুয়ের সমন্বয়ে “বিগ-ডেটা” প্রসেসিং অর্থাৎ অনেক তথ্য-ভান্ডার থেকে খুঁজে প্যাটার্ণ বের করার কাজও মেশিন অনায়াসেই করে ফেলছে। অন্য দিকে সব যন্ত্রের নির্ভুল-ভাবে কাজ করার দক্ষতা এতটাই বেড়ে গেছে যে নিখুঁত পণ্য উৎপাদনে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং-এর ভবিষ্যত কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। একই ভাবে রোবট অনায়াসেই করে দিচ্ছে গাড়ির চালকের কাজ, গুদামে মাল ওঠা-নামানোর কাজ বা দোকানে সার্ভারের কাজ। এর কোনোটাই কয়েক দশক আগেও মানুষ ছাড়া ভাবাই যেত না। যন্ত্র একসাথে অনেক তথ্য প্রক্রিয়া করছে, আআব্র আগের থেকে নিখুঁতও কাজ করছে। তাই যেসব কাজে মানুষের মত ক্রিয়েটিভিটি লাগে না, তাতে মানুষের রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে যন্ত্রের আগমন অবশ্যম্ভাবী। নিকট ভবিষ্যতে, কলসেন্টার বা সাধারণ ম্যানুফ্যাকচারিং এর চাকরি পাওয়া দুষ্কর হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
অটোমেশনের হাত ধরে মানুষের সভ্যতা এগোবে - এটা মনে হয় এখন পরিবর্তন করা সম্ভব না। কিন্তু কিভাবে বদলে যাচ্ছে আমাদের সমাজ বা অর্থনীতি অটোমেশনের হাত ধরে? ভাল দিকটা সবাই বলতে পারবেন। খারাপ দিকটা ততটা চোখে পড়বে না। ভোগ্যপণ্য থেকে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য - সব খাতেই অটোমেশন কিছু না কিছু ভাল প্রভাব রেখে গেছে। আমি আলোচনা করব উলটো - অর্থাৎ বিতর্কিত দিকটা নিয়ে। অটোমেশনের সবথেকে বড় সুবিধা হল কাজের জন্য মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেওয়া। এটাই আবার সামাজিক অসুবিধাও বটে।
ষাট ও সত্তরের দশকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই কম্পিউটার বা অটোমেশন বিরোধী অনেক শ্রমিক-আন্দোলন হয়েছে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের মূলে গেলে দেখা যায় মালিকের মূলধন আর শ্রমিকের শ্রম - এই দুয়ের সমন্বয়ে লাভ বা প্রফিট তৈরী হয়। মালিক-শ্রমিক দরাদরির পথও আসে এই সম্পর্কের ওপর দিয়ে। কিন্তু যদি শুধু মূলধনের ভিত্তিতেই লভ্যাংশ তৈরী হতে পারে তাহলে শ্রমিকের প্রয়োজন থাকেনা, লভ্যাংশের পুরোটাই মালিকের পকেটস্থ হতে পারে। শ্রমিকের দরাদরির খাত হল চাকুরীজনিত সুবিধা, আর বেতন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে যথেষ্ট কড়াকড়ি শুরু হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা একটু চাপে ছিল। প্রথম ধাপে, গ্লোবালাইজেশনের নাম ধরে শ্রমঘন কাজ গুলো পাঠিয়ে দেওয়া হল তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে - যারা বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপে শ্রমঘন শিল্প ছাড়া উন্নয়নের কোনো রাস্তা দেখে নি। বিনিয়োগের বাজার খুলে যাওয়ায় মেড ইন চায়না পণ্য ছেয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। প্রথম বিশ্বের বিনিয়োগ-কারীরা স্বস্তির শ্বাস ফেলল - ঘরের কাছে আর শ্রমিক অসন্তোষের ধাক্কা সহ্য করতে হবে না। তাদের কাজ দাঁড়াল বিনিয়োগ করা আর লভ্যাংশ বুঝে নেওয়া। অবস্থা খারাপ হল প্রথম বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের। আমেরিকার প্রফিট মারজিন বনাম এমপ্লয়ী শেয়ারের গ্রাফ থেকেই বিষয়টা বোঝা যায়। সত্তরের দশক থেকে কর্মীদের বেতনের খরচা কমেছে, বেড়েছে মূলধনের লভ্যাংশ।
কিন্তু চীনারাও মানুষ। মিডিয়াও থেমে নেই। চিনের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা সংবাদে আসতে থাকে এখন। এইবারে মালিকেরা কি করবে? ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবী তো এখন বিরাট গ্লোবাল ভিলেজ। আজ চিনে ফক্সকনের কারখানায় চিনে শ্রমিকদের দুর্দশা তো কাল বাংলাদেশে ওয়ালমার্টের সাপ্লায়ারের কারখানায় আগুন। শ্রমিক যেখানে আছে তার বক্তব্যও আছে। মিডিয়াও আছে। কাজেই এতদিনের প্রচেষ্টা এবার ইন্টারনেটের হাত ধরে বিকল হতে আরম্ভ করল। এদিকে আবার এসে গেছে সোসাল মিডিয়া - মানুষে নিজেই মিডিয়া হয়ে গেছে। যা দেখে তাই লিখে ফেলে। প্রেসকে টাকা খাইয়ে রিপোর্ট “ম্যানেজ” করার উপায়ও কমে আসছে।
এই সময়েই মূলধনীরা আবার আঘাত হানল। এইবারে অস্ত্র অটোমেশন। অবশ্য বলে রাখা ভাল অটোমেশন শিল্পবিপ্লবের পর থেকে নতুন কিছু না। ভিন্ন ভিন্ন শিল্পে, বিভিন্ন খাতে ধীরে ধীরে অটোমেশনের হাত ধরে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা পুরোই অন্যরকম। প্রথম বিশ্বের মেশিনের প্রতিযোগী তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক। তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক যদি বলে বেতন বাড়াও, প্রথম বিশ্বের মালিক বলে আরও দশটা মেশিন এসে তোর কাজ করে দেবে - তোকে পয়সা দেব কেন? তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিক যদি বলে কাজের পরিবেশ ভাল না, মালিক ভাববে মেশিন বসাবো - নাহলে প্রেসের সামনে শ্রমিকের মুখ বন্ধ রাখতে যে খরচা পড়ছে তা লভ্যাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। গতবছরেই আমি দু-দুটো এরকম ঘটনা দেখলাম চোখের সামনে। অ্যাপেলের আইফোন থেকে অধিকাংশ ইলেকট্রনিক্সের দ্রব্য যারা নিজেদের কারখানায় বানায় (আইফোন পিছু ফক্সকনের আয় ৭ ডলার, শ্রমিকের বেতনের পেছনে খরচা আরও ৭ ডলার) - সেই ফক্সকনের চিনা কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিল। তখনকার মত অ্যাপেল সহ ফক্সকনের তুলোধোনা চলল। মাসখানেকের মধ্যেই দেখলাম ফক্সকন এক মিলিয়ন রোবোট আনছে নিজেদের কারখানায়। আমাজনের গুদামের কর্মীদের কাজের পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ ও ল’স্যুট। অচিরেই আমাজন কিভা সিস্টেমস নামে এক কোম্পানীর হাত ধরে গুদাম অটোমেশনের কাজ শুরু করল - যার হাত ধরে অচিরেই প্রতি দশজন গুদাম-কর্মীর আট-জনকেই গোলাপী-পাতা ধরিয়ে দেবে তারা। ফলাফল - প্রফিটেবিলিটি বৃদ্ধি। কর্পোরেট দুনিয়ায় আজকের হারে প্রফিটেবিলিটি আগে কোনো যুগে ছিল না।
দেখে মনে হবে যেন মূলধনীদের টার্গেট যেন শুধু শ্রমঘন শিল্পেই। কার্যত গত কয়েক বছরে কিন্তু এই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। মধ্য-আয়ের সেবাধর্মী কাজও কিন্তু এখন টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ব্যাঙ্কের টেলারদের চাকরি এ-টি-এম পরবর্তী যুগে এমনিতেই নিচের দিকে, নেট-ব্যাঙ্কিং এর যুগে মানুষ-বিহীন ব্যাঙ্ক বানানোও আওতার মধ্যেই চলে এসেছে। প্রেস রিপোর্ট লিখতে হবে? তথ্য দিয়ে দিলে কম্পিউটার প্রোগ্রাম নিজেই লিখে দেবে। রেসিউমে দেখে প্রার্থী বাছাই করতে হবে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে তাও করে দিতে পারে প্রোগ্রাম। মধ্য-আয়ের এই সব চাকরির মূল্য তো কমছেই তার সাথে পরের টার্গেট হিসাবে আসছে রেডিওলজিস্ট, অ্যাকাউন্টেন্ট এমনকি আইনজীবী বা ট্রাক-ড্রাইভার। মূলধনীদের লভ্যাংশ বাড়ার সাথে সাথে বেতন কমছে সব খাতেই। ফলশ্রুতিতে উৎপাদনশীলতা বেড়েই চলেছে, কিন্তু বেতন আটকে গেছে আগের জায়গাতেই।
এতো গেল মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক আর প্রফিটেবিলিটির কথা। সামগ্রিক অর্থনীতির কি অবস্থা হচ্ছে? এটা বুঝতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগে। আমাদের দেশগুলোতে যেমন কম্পিউটার বিরোধী একটা হাওয়া ছিল সেইরকম শিল্পবিপ্লবের যুগের ইংল্যান্ডেও একদল কারিগর ছিলেন টেক্সটাইল মেশিন এসে যাদের কর্মসংস্থানে ভাগ বসিয়েছিল। বিপ্লবের আগে তারা যে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের তারা মিলে বিদ্রোহ করেছিলেন মেশিন-রাজের বিরুদ্ধে, অনেকগুলো টেক্সটাইল-মিলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের আক্রমণে। এদের ইতিহাসে বলা হয় লাডাইট। ব্রিটিশ-রাজ সেনা পাঠিয়ে এদের কড়া হাতে দমন করে সেই যাত্রা। এর পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদেরা এই বিদ্রোহ ও তার প্রাসঙ্গিক যৌক্তিকতাকে লাডাইট ফ্যালাসি নাম দিয়ে থাকেন। মেশিনের হাত ধরে ব্রিটিশ অর্থনীতির পরবর্তী উত্থানও তাদের পক্ষেই কথা বলে। কিন্তু যে কথাটা বলা হয়ে থাকে না, সেটা হল সারা পৃথিবীতে অসংখ্য দেশের অসংখ্য মানুষ জীবিকাচ্যুত হয়ে গিয়েছিল ইংলন্ডে ও ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের ফলে। সমকালীন ভারতের বিপুলসংখ্যক তাঁতি ও হস্ত-শিল্পী সরাসরি এর প্রকোপে পড়েন ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। ফলশ্রুতিতে শিল্পবিপ্লবের পরে গ্রেট-ডাইভার্জান্স দেখা দেয় ও ইউরোপের গড় আয় পাকাপাকি-ভাবে এশিয়দের থেকে আলাদা কক্ষপথে চলে যায়। বিশ্বজুড়ে আজ যে আয়-বৈষম্য, তার সূত্রপাত কিন্তু ওই অটোমেশনের প্রথম যুগেই।
ব্রিটেনের স্থানীয় অর্থনীতিতেও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত কেউ না কেউ আছেই। ফেয়ারওয়েল টু আমস বইতে দেখি -
“শিল্পবিপ্লবের যুগে দলে দলে ঘোড়ারা জীবিকাচ্যুত হয়েছিল। ১৯০১ সালে - শিল্পবিপ্লবের অনেক কাল পরে, ইংলন্ডে ঘোড়ার সংখ্যা সর্বোচ্চ ছিল। তার আগে থেকেই দীর্ঘ পথের যাত্রায় স্টিম-ইঞ্জিন রেলগাড়ি এসে গিয়েছিল কিন্তু তাও ঘোড়ারা তখনও মাঠে চাষ করার কাজে, স্বল্প-পথের যাত্রায় বা সৈন্য-বহনের কাজে আসত। কিন্তু ঊনিশ শতকে ইন্টারনাল কমবাসন ইঞ্জিন এসে তাদের শেষ জীবিকাও কেড়ে নিল।” ঘোড়াদের ব্রিটেনে বসেই যেই দশা হয়েছিল, ব্রিটেনের বাইরে লাখ-লাখ মানুষের একই দশা হয়েছে শিল্প এসে যাওয়ায়।
সাম্প্রতিক বিশ্বেও এই অর্থনীতির কেন্দ্রীয়করণের কোনো ব্যতিক্রম দেখি না। খুব সম্প্রতি আমেরিকার রিশেসনের পরে উৎপাদনশীলতা মোটামুটি আগের জায়গায় ফিরে এসেছে কিন্তু বেকারত্বের হার কিছুতেই কমছে না। আমেরিকার ধনীতম ১% মানুষের আয় রকেটের মত বেড়ে চলেছে কিন্তু সাধারণের আয় বাড়ছে কাছিমের গতিতে। এমনকি, যদি ১% এর জায়গায় ১/১০% এর কথা ভাবা যায়, তাদের আয় বাড়ছে আরও দ্রুতগতিতে। আগে সারা-বিশ্বে যে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিশ্ব ছিল, এখন শুধু আমেরিকাতেই তাদের প্রতিরূপ সৃষ্টি হচ্ছে। আমেরিকায় অর্থের কেন্দ্রীয়করণের আরও কারণ অবশ্যই আছে কিন্তু অটোমেশন অবশ্যই একটা প্রধান কারণ। অটোমেশনের মূল ধর্মই হল মূলধনের উপযোগিতা বাড়ানো। আর মূলধনের উপযোগিতা বাড়ানো ক্যাপিটালিস্ট দেশের ধর্মের মতই সমাদৃত। তার হাত ধরেই আসবে সামাজিক অসাম্য - কারণ আজকে যার জীবিকা থাকবে না, সে তো কালই অন্য কাজ শিখে সেই কাজে নিয়োগ পাবে না। তাই এই ব্যবস্থায় সমাজ সামগ্রিক-ভাবে অগ্রসর হলেও দারিদ্র্যও বাড়তে থাকবে।
রাজনীতির অবস্থা এই অর্থনীতির মতই। দ্বিতীয় বিশযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে গেরিলা যুদ্ধ ব্যাপারটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রথম বিশ্বের শক্তিগুলো ভিয়েতনামে বা লাতিন আমেরিকায় লড়াই চালাতে গিয়ে প্রায়ই মরিয়া গেরিলাদের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে। কনভেনশনাল যুদ্ধ হয় সমানে সমানে বা সমধর্মী দুই বাহিনীর মধ্যে। প্রথম বিশ্বের সেনার সাথে তৃতীয় বিশ্বের সাধারণের যুদ্ধে তাই তৃতীয়ের হাতে গেরিলা যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই। এখন চালক-বিহীন ড্রোন যুগে যুদ্ধ করার জন্য মানুষের দরকার পড়ছে না। মানুষে শুধু ভিডিও গেম খেলে বোমা ফেললেই হবে, অথবা স্বয়ংক্রিয় ড্রোন নিজেই খুঁজে নেবে তার টার্গেট - জটিল অ্যালগোরিদম চালিয়ে। কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রিসম প্রজেক্টের কথা জানা গেল। জানা গেল অর্থে জানা আগেই ছিল, তবে ব্যাপারটা একজন হুইসল-ব্লোয়ারের মারফৎ নিশ্চয়তা এল। মার্কিন মুলুকে বসে সকলের টুইট, ইমেল এমনকি ফেসবুক আপডেট অবধি সবকিছুর ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কোথাও মার্কিন-বিরোধী সেন্টিমেন্ট দানা বাঁধলে সেখানের ফেসবুক স্টেটাসের সেন্টিমেন্ট অ্যানালিসিস করে আঙ্কেল স্যাম আগে থেকেই স্ট্র্যাটেজি কষতে থাকে। উল্টোদিকে, আজকের গেরিলা বাহিনীর হাতে আর সেই বিপক্ষকে “চমকে” দেবার ক্ষমতা নেই, তাই পৃথিবী থেকে গেরিলা যুদ্ধও উঠে যাচ্ছে। অর্থনীতির মত রাজনীতিও কয়েক হাতেই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে সমাজের এই একমুখী বিবর্তন নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত। একদিকে আমাদের উন্নয়নে অটোমেশন ও টেকনলজির প্রয়োজন অস্বীকার করতে পারি না। আবার অন্যদিকে এই অসম পৃথিবীও আমার কাম্য না। কিন্তু কার্যত গত কয়েক বছরে উন্নয়ন বা জিডিপির যা বৃদ্ধি হচ্ছে, তার সুফল আরও বেশী করেই মূলধনীদের হাতে গিয়েই জমা হচ্ছে। যারা উলটো রাস্তায় হাঁটতে যাচ্ছে, তাদের সার্বিক উন্নয়নই থমকে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে হয়ত টেকনলজির উন্নয়ন থেকে সবারই লাভ হচ্ছে কিন্তু ততদিনে আর্লি এডপ্টার-রা কয়েক কদম এগিয়ে যাবে। ফলে বাড়বে তফাৎ। বাড়বে অসাম্য। রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে আরও নেতিবাচক। এই সময়ে এটাই হয়ত বাস্তব।
দেখুন -
১) কিভা সিস্টেমসের রোবোট কিভাবে কাজ করে
২) ডারপার অটোমেটিক সিউইং মেশিন সমগ্র গারমেন্টস শিল্পকেই তুলে দিতে পারে।
৩) টেকনলজিকাল আন-এমপ্লয়মেন্ট নিয়ে সিবি-এস এর প্রতিবেদন।
৪) টেড টক - অ্যান্ড্রু ম্যাকাফি
৫) ভিন্নধর্মী টেড টক - পিস্তোনো
মন্তব্য
দ্বিতীয় গ্রাফটায় কি মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে?
লেখা ভাল লেগেছে।
--------------------------------
বানান ভুল থাকলে ধরিয়ে দিন!
হ্যাঁ। মাথাপিছু আয় কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে গ্রেট ডাইভার্জেন্সের সময়ে। এর আগে দেখলে বুঝবেন সবসময়েই কাছাকাছি মাত্রায় ছিল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
লেখা ভালো লেগেছে আর এই অটোমেশিন নিয়ে চিন্তা আমাদের ও আছে ,আমি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেখানেও বারবার শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে নিটিং অটোমেশিন কেনার চিন্তা চলতেছে ,সেটা হলে আমাদের ৮০ শতাংশ শ্রমিকের চাকরী চলে যাবে যা খুবই বেদনাদায়ক , অন্যদেশের বিনিয়োগ কারীরা আমাদের দেশে বসে আমাদের নাগরিক কে বেকার করবে কিন্তু সরকার কিছু বলবে না
ইন্টারেস্টিং, আপনার কি মনে হয় - এই অবস্থার সমাধান কি ভাবে পাওয়া যেতে পারে? আর যদি শ্রমিক না-ই লাগে, তাহলে সেই শিল্প কি আর বাংলাদেশে থাকবে?
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
দারুণ পোস্ট। অটোমেশন এড়ানোর উপায় নেই। গার্মেন্ট্স থেকে শুরু করে জাহাজ ভাঙ্গার কারখানা সব যায়গাতেই যেসব শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাদের পরিবর্তে ওসব কাজ রোবট দিয়ে করানো অনেক বেশী মানবীয়।
তাহলে এই উধৃত জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে কী করা হবে? তাদের জীবিকা, শিক্ষা, জীবনমান এগুলো নিশ্চিত করা হবে কীভাবে? খেয়াল করুণ, এই মানুষগুলোর জীবন মান কিন্তু স্রেফ "শ্রমদাস" এর জীবন মানেই আছে। এই তথাকথিত "চাকরিচুত্যি" বরং তাদের শৃংখল মুক্তি ঘটাবে। ঠিক যেমন, কৃত্রিম নীল আবিষ্কার হবার পরে নীলচাষিরা কিন্তু না খেয়ে মরে নি, তাদের মুক্তিমিলেছে নীল চাষের বিভিষিকা থেকে।
এখন, এই মানুষগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে পরিকল্পনা করাটা একটা ভিন্ন সমস্যা। অটোমেশনকে দোষারোপ বাদ দিয়ে, বরং ঐ সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করাটাই কাম্য।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
অটোমেশন এড়ানোর উপায় নেই, অটোমেশনকে ঠিক দোষারোপও করা হচ্ছে না। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে।
“শ্রমদাস" থেকে শৃংখল মুক্তি ঘটাবে – ব্যাপারটা বোধহয় এত সরল সমীকরণে পরে না। আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলতে চাচ্ছি – অটোমেশন আসছে ফরম্যাল সেক্টারে, ‘শ্রমদাসেরা’ যাচ্ছে ইনফরম্যাল সেক্টারে। ফরম্যাল সেক্টারে তাওতো শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে কথাবার্তা হয়, কিছুটা হলেও একাউন্টিবিলিটির চেষ্টা করা হয়, ইনফরম্যাল সেক্টারে অবস্থা আরও খারাপ। উদাহরণ দেয়া যায় –ধরুন কিছু কিছু ইনফরম্যাল কৃষি/শিল্পে শ্রম আগেই কেনা হয়ে যায় (মন্দার সময়), পরবর্তিতে শ্রমিকের ইচ্ছা/অনিচ্ছার কোন মূল্যই থাকে না। সমুদ্রে নিম্নচাপের সময় আমরা মাছ ধরার নৌকাডুবিতে মানুষের মৃত্যুর খবর পড়েছি, সরকারকে গালি দিয়েছি ঠিকমত প্রচার করা হয়নি দেখে। কিন্তু আমি এমন ঘটনার কথা জানি যেখানে শ্রমিককে সমুদ্রে যেতে হয়েছে, নিম্নচাপের কথা শোনার পরও, কারণ তার শ্রম আগেই কেনা হয়েছে। কিংবা ধরুন বাসায় কাজের লোক।
ইদানিং ঢাকায় দেখি ‘অটোমেটেড রিক্সা’ – চার্জ করা ব্যাটারিতে চলে (অটোঃ আমার ধারনা এক্সিডেন্টের আরেকটা নতুন উপাদান আমদানি)। নিশ্চিতভাবেই রিক্সাচালকের আয়ের একটা অংশ মালিককে দিয়ে দিতে হচ্ছে ব্যাটারি চার্জের জন্য.... আমি জানিনা এই অটোমেশনের দরকার আছে কিনা।
দারুণ ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে লেখা, এতে মন্তব্য এত কম কেন?
এই লেখাগুলা আসলে চানাচুর ভাজার মতো না বলে অনেকে পড়েন না।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
লেখায় উপস্থিত গ্রাফের সংখ্যার সাথে পাঠক সংখ্যার এক ধরনের বিপরীত বর্গীয় সম্পর্ক আছে মনে হয়! আর কোনো সমীকরণ থাকলে তো কথাই নেই!
ব্যাপারটা একটা জনগোষ্ঠির গড় আগ্রহ উদ্দিপনার গতিপ্রকৃতিরও একটা নির্দেশক।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
আমার ধারণা একই সময়ে অনেকগুলো ভাল লেখা আসায় কমেন্ট কমে হয়েছে। আমি পরেও এ নিয়ে আবার লিখব।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
অসাম লেখা হইছে
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আমার মত কিছু লোক থাকতে পারে, যারা বিষয়ের গভীরতা অনুযায়ী মন্তব্য করতে অক্ষম বলে চুপেচাপে মন্তব্যের ঘরে এসে ঘুরে যাচ্ছে, মূল্যবান আলোচনার লোভে। এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সেটা হয়নি, এটা আফসোস জাগানিয়া
এরকম একটি লেখা সচলায়তনের সাথে অন্য অনেকের পার্থক্য গড়ে দেয়। অসাধারণ লেখা, চিন্তা।
স্যাচুরেশন পয়েন্ট কি হতে পারে এর?
এটুকু ছাড়া বাকিটা পুরোই বুঝতে পেরেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।
টপ ১% ধনীদের আয় যদি বছরে ১ লাখ টাকা করে বাড়ে, টপ ০.১% লোকেদের আয় বছরে ৫ লাখ টাকা করে বাড়ছে। এইরকম ব্যাপার।
ওহ! এইটাই মনে হয়েছিল - কনফার্মেশনের অপেক্ষায় ছিলাম
২০১০ সালের আমেরিকার আয়-বৃদ্ধি নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটা ইনফোগ্রাফিক বানিয়েছিল -
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আরো একটা আছে - এটাতে আরও বিস্তারে ভেঙে দেখানো হয়েছে ২০০৯-২০১০ সালের পরিসংখ্যান।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আবার অটোমেশন এর কাজেও কিন্তু অনেক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। যদি ম্যাসিভ স্কেলে অটোমেশন শুরু হয়, তখন এটা ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য অনেক লোক লাগবে। (যদিও, সেটা অটোমশনের দরুন কাজ হারনো লোকের সংখ্যার তুলনার ক্ষুদ্র)
একটা উদাহরণ দেখতে পারি:
একসময় শুধু 'এখানে মোবাইল টু মোবাইল কল করা হয়' বা "টিএন্ডটি টেলিফোন করা যায়" এরকম অনেক দোকান ছিল, অনেকেই এসব দোকান চালাত। তখন, কানেকশন (সিম) নিতে ২০-২৫ হাজার টাকা লাগত। মিনিটে কোথাও ১০ টাকা, কোথাও ৭ টাকা। এরপর, দিন বদলের পালায় সবার হাতে মোবাইল ফোন উঠল। তখন অনেকেই দোকান গুটিয়ে নিল, আর কেউ কেউ অন্য পণ্য সামগ্রী এনে দোকান সাজাল, যার এক কোণায় এখনও মোবাইলে কল করার ব্যবস্থা আছে।
শ্রমঘন কাজটা কমে গেলে, তখন অন্য যে কাজটার সূচনা হবে, সেটা পাকড়াও করার প্রয়াস থাকতে হবে, কারণ অটোমেশন আটকানো যাবে না; এটা আজ বা কাল হবেই। এর সাথে তাল মিলিয়ে কাজ খুঁজে নিতে হবে।
ইন্ডিয়া কল সেন্টার থেকে অনেক আয় করে। অটোমশনের কারণে কলসেন্টার গুলো মার খেতে পারে; কিন্তু তখন যে অটোমেশন ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য যে সফটওয়্যার থাকবে, দেখা যাবে ইন্ডিয়ায় বসেই কিছু লোক সেটা বানাচ্ছে (বা বানিয়ে ফেলে এখন বিক্রি করছে)।
- এইখানেই সমস্যাটা। আপনার দেওয়া উদাহরণ থেকেই দেখা যাক। কলসেন্টারে হাজারে হাজারে লোকে চাকরী করে কিন্তু এই ধরণের সফটওয়ার বানাতে বড়জোর কয়েকশো লোকের একটা কোম্পানীই যথেষ্ট। সুতরাং, প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে, কিন্তু বর্ধিত প্রোডাক্টিভিটির সুফল যাবে মূলত মুষ্টিমেয় হাতে। সমাজে অসাম্য আরো বাড়বে।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আগেই পড়া হয়েছিল, সবসময়ের মতই, মন্তব্য করা হয়নি। চমৎকার লেখা এটা বলার জন্যই লগ-ইন করলাম।
নতুন মন্তব্য করুন