অন্ধবিশ্বাস না সহজাত তত্ত্বীয়করণ?

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: সোম, ২০/০৮/২০০৭ - ১:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেককাল হল শুনছি যে অন্ধবিশ্বাস হল বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু। অনেকসময় ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থকে দায়ী করা হয় অন্ধবিশ্বাস ছড়ানোর জন্য। কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ব্যাপারটা ঠিক কি? সাধারণভাবে, পরীক্ষা না করেই বিশ্বাস করাকে সাধারণভাবে অন্ধবিশ্বাস বলা হয়। এই বিষয়ে আমার ছোটোবেলা থেকেই একটা প্রশ্ন ছিল, যা আমি কিছুটা উত্তর পেলাম সম্প্রতি কয়েকটা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে। খুব সহজ একটা প্রশ্ন হল, যদি সবাই নিজের নিজের মত বিশ্বাস করতে থাকেন তাহলে পৃথিবীতে সব মানুষের অন্ধবিশ্বাস আলাদা আলাদা নয় কেন? কিভাবে সারা পৃথিবীর লোক একসময় বিশ্বাস করত পৃথিবী চ্যাপ্টা? যদি অন্ধবিশ্বাস যদি র‌্যান্ডম হয়, তাহলে তো অন্তত, সংখ্যালঘু কিছু গোষ্ঠী পাওয়া যাবার কথা যারা বিশ্বাস করবে পৃথিবী গোল বা নিদেনপক্ষে পৃথিবী ঘনক-আকৃতির। কেন তা হয় না?

আসলে অন্ধবিশ্বাসকে আমরা যতটা অন্ধ ভাবি, ততটা অন্ধ এই বিশ্বাস নয়। এও কিছু একটা ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ও কোনো নির্দিষ্ট ভাবে গঠিত হয় – যার ফলে সারা পৃথিবীর মানবজাতির বিভিন্ন তথাকথিত অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে অদ্ভূত সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অন্ধবিশ্বাস কি তাহলে মানবমনে প্রোথিত কিছু নিয়মের থেকে সৃষ্টি? অথবা আমাদের মানসিকতার কোনো দুর্বল প্রান্তে এর উৎপত্তি?

আংশিক উত্তর পাওয়া যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষকদের মতামতে। তাদের মতে শিশুদের বিজ্ঞানশিক্ষার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল শিশু-মানসিকতা। বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানশিক্ষা পাবার আগেই শিশুরা প্রকৃতি ও সমাজ সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা পেতে শুরু করে। সামাজিক ধারণার মধ্যে পড়ে তাদের বাবা-মা ও নিকটাত্মীয়দের চিনে ফেলা। আর প্রাকৃতিক ধারণার মধ্যে পড়ে সাধারণ অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা - “বস্তু ওপর থেকে নিচে পড়ে” বা “ওপর থেকে নিচে পড়লে ব্যাথা লাগে”। তাই শিশুদের বিজ্ঞান শেখাতে গেলে তারা যা জেনে বসে আছে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে, তার বিরুদ্ধে যেতে হয় অনেকসময়। যেমন ধরা যাক, বাচ্চারা দেখেছে যে “বস্তু ওপর থেকে নিচে পড়ে”। তাই তাদের যদি বলা হয় যে পৃথিবী গোল, তাহলে তারা প্রতিবাদ করবে। জিজ্ঞাসা করবে – তাহলে নিচের দিকে থাকা মানুষেরা পড়ে যায়না কেন? স্বভাবতই, সংগঠিত বিজ্ঞানশিক্ষা না পেলে শিশুমস্তিষ্কে চ্যাপ্টা পৃথিবীর ধারণাই স্বাভাবিক বলে মনে হবে।

মাইকেল ম্যাকলস্কি নামে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কগনিটিভ সায়েন্স-এর অধ্যাপক সম্প্রতি আমেরিকায় সাধারণ ছাত্রদের ওপর কিছু সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। তার সমীক্ষার ক্ষেত্র ছিল বস্তুর গতির নিয়মাবলী – যার পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা সাধারণ সারাজীবন ধরে সংগৃহিত হয় আবার তত্ত্বগত ভাবেও এর সাথে সকলে সাধারণভাবে পরিচিত। তার মূল আগ্রহ ছিল – এই তত্ত্বগত ব্যাখ্যা মানুষ কতটা আত্মস্থ করতে পারে – নাকি তত্ত্বের শিক্ষা বইয়ের পাতাতেই থেকে যায়। তাই তিনি, কিছু ছবি এঁকে বিভিন্ন অবস্থায় বস্তুর গতিরেখা কেমন হবে তা জানতে চাইলেন। যেমন ধরা যাক, গতিশীল একটা উড়োজাহাজ থেকে ফেলা একটা বল কি ভাবে মাটিতে পড়বে? অধিকাংশ ছাত্রের মতে সেটা পড়বে সোজা – সরলরৈখিক গতিতে। একটা চক্রাকারে বাঁকানো নল থেকে একটা গতিশীল বল বেরিয়ে এলে তার গতিরেখা কি হবে? আবার অধিকাংশ ছাত্রের মতে সেটা চক্রাকারে বেরোবে। বলাই বাহুল্য যে সাধারণ ছাত্ররা এই ধরণের গতিপথ দৈনন্দিন জীবনে চোখে দেখেনি। কিন্তু অন্যদিকে, যেখানে সরাসরি পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা উপস্থিত, সেখানে ছাত্ররা সঠিক উত্তর দিয়েছে। যেমন, একটা চক্রাকারে বাঁকানো হোসপাইপ থেকে জল যে চক্রাকারে বেরোয় না – বেরোয় সরলরৈখিক গতিতে – তা প্রায় সকলেই সঠিকভাবে বলেছে। তাহলে মোটকথা হল, যা আমাদের সরাসরি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের মধ্যে আসে তা আমরা স্মৃতির মাধ্যমে ধরে রাখি। আর যা আসে না, সেই ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সাধারণ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। কয়েকটি সাধারণ পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও ধারণাকে একত্রিত করে সরলীকরণের প্রচেষ্টা করি। অন্ধবিশ্বাসের উৎপত্তি এই অতি-সরলীকরণের চেষ্টা থেকেই।

সাধারণ মানুষের কাছে দুভাবে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা আসে – প্রথমত, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে, দ্বিতীয়ত বইতে পড়া বিজ্ঞান থেকে। উভয়ের সংমিশ্রণে ও মিলিত প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান-মানসিকতার জন্ম মানবমনে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব অনেকসময়েই ভুল, তাই বিজ্ঞানশিক্ষার একটা অন্যতম অঙ্গ হল বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে চিন্তা করতে শেখানো। যাতে এই সহজাত তত্ত্ব বিকশিত হবার আগেই তার বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রশ্ন জেগে উঠতে পারে ও সঠিক তত্ত্ব মস্তিষ্কে স্থান পেতে পারে। আমাদের অন্ধবিশ্বাস হল একেকটি সহজাত তত্ত্ব। সাধারণভাবে, হোমো সেপিয়েন্সরূপী মানুষে-মানুষে খুব একটা পার্থক্য তো নেই, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মনে একই ধরণের তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে – আদি গণতান্ত্রিক সমাজ সেই সহজাত প্রাকৃতিক তত্ত্বকেই গ্রহণ করেছে – সৃষ্টি হয়েছে অন্ধবিশ্বাস।

এতো গেল সহজাত প্রাকৃতিক তত্ত্বের কথা। একইভাবে সহজাত সামাজিক তত্ত্বের সংখ্যা কম নয়। শিশুরা খুব দ্রুত বুঝে নেয় (বা শিশু-মানসিকতায় জিনগতভাবে প্রোথিত থাকে) যে তাদের সমবয়সীদের তুলনায় বড়দের জ্ঞান বেশী। তাই কোনো ক্লাসমেট তাদের যদি নতুন কোনো বিষয়ে তথ্য দেয়, তারা চেষ্টা করে সেটা বড়দের কাছে মিলিয়ে নিয়ে নিশ্চিত হতে। শুধু তাই নয়, বড়দের মধ্যেও তারা শ্রেণীবিভাগ করে নেয় – শিক্ষক বা বাবা-মা তার কাছে যতটা গুরুত্ব পায়, এক নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীও হয়ত ততটা পায় না। আবার স্কুলে যদি বিবর্তনতত্ত্ব পড়ানো হয়, আর বাড়িতে বাবা-মা তার বিরোধিতা করেন, তাহলে অধিকাংশ শিশু বিবর্তনবাদে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এরকম সামাজিক অপরীক্ষিত তত্ত্ব মানবমনে দিনের পর দিন বেড়ে চলে – দখল করে রাজনৈতিক বা দার্শনিক মানসিকতার ক্ষেত্রও। ছোটোবেলায় যেমন তথ্যের উৎস হিসাবে তারা বাবা-মায়ের ওপর ভরসা করে, বড় হলে সংবাদ-পত্র বা টিভি শো-কে সেই একইভাবে বিশ্বাসী উৎস হিসাবে গণ্য করে। এগুলোও একইরকম অন্ধবিশ্বাস। এর পেছনেও আছে আমাদের জটিল সমাজের কার্যকারণের সরলীকরণের প্রচেষ্টা।

মানুষের এই সহজাত সরলীকরণের বা তত্ত্বীয়করণের প্রচেষ্টা ব্যাখ্যা করা যায় মানব-বিবর্তনের ধাপগুলোর সাহায্যে। চিন্তাশক্তি বিকশিত হবার পরে, এই সরলীকরণের ক্ষমতাই মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করেছিল। আর সব প্রাণী যেখানে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে অচল, সেখানে মানুষ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তত্ত্ব গঠনে সক্ষম ছিল। মানুষ চিন্তা করতে পারত উচ্চতর মাত্রায়। সাধারণ একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। টোপ ফেলে শিকার ধরা ছিল শিকারী আদিম মানুষের অন্যতম বিশেষত্ব। মানুষ দেখেছে যে পশুরাও তাদের মতই খাবার দেখলে এগিয়ে যায়। তা থেকে তত্ত্বীয়করণ হয়েছে যে - যেকোনো পশুই খাবার দেখলে খাবারের দিকে ছুটে আসবে। তখন শিকার করাও সহজ হবে। সহজাত তত্ত্বীয়করণের ক্ষমতা এক মানুষকে অন্যের থেকে বাঁচার সুবিধা দিয়েছে বেশী করে, তার ফলে এই ক্ষমতা বর্তমান মানবজাতির মধ্যে সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে।

দেরীতে হলেও আমার ধারণা মানবসমাজ তত্ত্বীয়করণের সীমাবদ্ধতা বুঝেছে। মূল সীমাবদ্ধতা হল, তত্ত্ব নির্ভর করে পর্যবেক্ষণের বিস্তারের ওপর। তত্ত্বের বিস্তার যে পর্যবেক্ষণের বিস্তারের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল তার খুব ভাল একটা সামাজিক উদাহরণ হল রেসিজম বা জাতিবিদ্দ্বেষ – যার মূলে আছে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি গোষ্ঠীর একে অপরের ক্ষেত্রে অজ্ঞানতা। গত কয়েক শতকে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির মূলেও আছে পর্যবেক্ষণের বিস্তারে উন্নতি – একের পরে এক যন্ত্রের আবিষ্কার। আর সেখানেই শুরু হয় অন্ধবিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের লড়াই। অন্ধবিশ্বাস যেখানে সাধারণ মানুষকে সাধারণ বিস্তারের পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত সহজাত তত্ত্বে আবিষ্ট রাখে, সেখানে বিজ্ঞান সেই বিস্তার ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে। যেহেতু মানব-প্রবৃত্তির মধ্যে এই তত্ত্বীয়করণের প্রবণতা সহজাত, তাই ভবিষ্যতেও এই লড়াই থামার নয়। হয়ত ধর্মের জায়গা নেবে আরো অন্য কোনো সরলীকৃত তত্ত্ব, যার সাথে লড়াই হবে প্রকৃত বিজ্ঞানের। আজকের বিজ্ঞান আর অন্ধবিশ্বাসের লড়াই তাই আসলে সহজাত তত্ত্ব বনাম বিস্তৃত পর্যবেক্ষণলব্ধ তত্ত্বের যুদ্ধ – এর কোনো শেষ নেই।


মন্তব্য

অতিথি এর ছবি

utsor other nick.

lekha bhalo.

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

চমৎকার লেখা
তবে আমার মনে হয়, পৃথিবী সমতল টাইপের ভুল জ্ঞানগুলো ঠিক শিশুদের পারসেপশন টাইপের ব্যাপারগুলোর জন্য ছড়ায়নি ,,, বরং, কোন এক জ্ঞানী লোক ভুল ব্যাখ্যা করেছেন, রাজ্য/সভ্যতার বিস্তারের সাথেসাথে সেগুলো ছড়িয়েছে ,, সেই অবস্থাতেও এগুলো অন্ধ বিশৃাসছিলনা
অন্ধবিশৃাস হওয়া শুরু করেছে তখন, যখন মানুষ নিজেদের এতদিনকার প্র্যাকটিস করা ভুল জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে সঠিকটাকে গ্রহন করার মতো উদার হতে পারেনি ,,, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভুল থাকবেই ,,,সেটাকে আলটিমেইট সঠিক অনেকসময় মানুষ ভেবে নেয় ,,,এক্ষেত্রে ধর্মের ভুমিকা আছে, ফিকশাস বিজ্ঞানলেখকদের ভুমিকা আছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

"বরং, কোন এক জ্ঞানী লোক ভুল ব্যাখ্যা করেছেন"

- আমি সেটাই বলেছি। দেখুন, পৃথিবীতে জ্ঞানী লোক বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদা আলদা ছিল - ভারতে, গ্রীসে, আরবে, চিনে, ইনকা বা আজটেকদের আলাদা আলাদা ছিল। তারা সবাই একইভাবে কেন পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বলে দাবী করবে? কারণ, সহজ পর্যবেক্ষণে পৃথিবীকে চ্যাপ্টা বলেই মনে হয়। সেই ব্যাপারটাই শিশুদের মধ্যে দিয়ে দেখা যায় ... আমি পর্যবেক্ষণের বিস্তারের সাথে বিজ্ঞানচিন্তার সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছি এখানে।

দ্বিতীয়ত, জ্ঞানী লোকের ভুল ব্যাখ্যা অনেকটা দ্বিতীয় ক্যাটেগরির সহজাত তত্ত্বের মধ্যে পড়ে। সেটাও পর্যবেক্ষণের বিস্তার কমিয়ে দেয় ... যেহেতু অমুকে বলেছে তাই ... এটা বাবা-মায়ের কথা শিশুরা যেভাবে বিশ্বাস করে - একইভাবে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অনিকেত এর ছবি

দারুন লাগল।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।