বিবাদী আর আগ্রাসী নীতি ছাড়াও অনেকরকম কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছেন স্মিথ আর প্রাইস। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রতি-আক্রমণের কৌশল। এই কৌশলে জীব প্রথমে বিবাদীর মত আচরণ করে, কিন্তু আক্রান্ত হলে প্রতি-আক্রমণও করে, বিবাদীদের মত পালিয়ে যায় না। এছাড়াও কোনো কোনো জীব শুরুতে আগ্রাসীদের মত ব্যবহার করে আক্রান্ত হলে পালিয়ে যেতে পারে – সেটাও একটা কৌশল। আর আছে শুরুতে পরীক্ষা করে যাচাই করে দেখে নেবার কৌশল। স্মিথ আর প্রাইস দেখিয়েছেন, এসবের মধ্যে প্রতি-আক্রমণের কৌশল বা টিট-ফর-ট্যাটই হল একমাত্র স্থিতিশীল কৌশল, অর্থাৎ, জীবগোষ্ঠীতে শুধু এই কৌশলই চালু থাকলে, বাকি কৌশল অবলম্বন করে জীবেরা অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে উঠতে পারেনা। শুরুতে পরীক্ষা করে নেবার কৌশলও প্রায় স্থিতিশীল, তবে এই কৌশল অবলম্বনকারী জীবগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রতি-আক্রমণকারীরা সামান্য সুবিধায় থাকেন। উৎসাহী পাঠকেরা নিজেরা একই পয়েন্ট সিস্টেমে হিসাব করে দেখতে পারেন কোন ক্ষেত্রে কিভাবে কারা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। প্রকৃতিতে এই পয়েন্ট সিস্টেমের কিছু হেরফের হলেও মূলনীতি প্রায় একই থাকে। মেরু অঞ্চলের পাখীদের ক্ষেত্রে দিনের আলো যেটুকু সময় থাকে তা শিকার না করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে সময় নষ্ট করার জন্য অনেক বেশী খেসারত দিতে হবে, তাই তাদের ক্ষেত্রে সময় নষ্ট করার পেনাল্টি -১০ এর জায়গায় -৩০ ভাবা যেতে পারে। তাই সাধারণ কিছু গাণিতিক হিসাবে সমগ্র প্রকৃতির হিসাবকে মাপতে গেলে অনেক সতর্কভাবে হিসাব করতে হবে।
এবার আসা যাক আরো একধরণের লড়াইতে – যাকে পরিভাষায় বলা যায় “পলায়নের লড়াই”(War of attrition)। এর মানে, যতক্ষণ না একজন পলায়ন করে, ততক্ষণ এই লড়াই চলে। প্রকৃতিতে এধরণের লড়াই বহুল প্রচলিত – সাধারণত খুব সহজে কাবু হয়না এরকম প্রজাতির (যেমন গণ্ডার) মধ্যে চলে। দুটো জীব একে অন্যের দিকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী আর তর্জন-গর্জন করতে থাকে, যতক্ষণ না একজন ‘রণক্ষেত্র’ থেকে পালিয়ে যায়। জেতার জন্য শুধু অপরের থেকে বেশী সময় ব্যয় করতে হয়, সময়ই একমাত্র শক্তি এই যুদ্ধে। এটা অনেকটা দুজনের মধ্যে নিলাম, যেখানে সময় হল কারেন্সীর সমতুল্য। উদাহরণ দেখতে হলে আমার মনে হয় কোনো জঙ্গলে যাবার দরকার নেই, মানবসমাজে এই পলায়নের লড়াই সর্বত্র চলে, বিশেষত বিশ্বাসের প্রশ্নে। অরকুটে বা অনেক ফোরামে (সচলায়তনেও) প্রায়ই দেখা যায় দুপক্ষ নিজের নিজের মতামত একতরফা বলে চলেছে। তারা উভয়েই আলাদা আলাদা মাপকাঠি দিয়ে অপরের মত ভুল আর নিজের মত ঠিক বলে দাবী জানাচ্ছে। লড়াই চলে ততক্ষণ, যতক্ষণ না একপক্ষ ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায় বা ভাবে এই বিষয়ে আর সময় ‘নষ্ট’ করা ঠিক হবে না।
ধরা যাক সবাই যদি নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেয় যে তারা একেকটি বিষয়ে সর্বাধিক এতগুলো পোস্ট দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রেও কোনো চালাক ব্যক্তি নিয়ম ভেঙ্গে আরো একটা বেশী পোস্ট দিয়ে বাজিমাত করবে (বাস্তবে থাকলেও প্রকৃতির নিয়মে পোস্টের ঊর্দ্ধসীমা নেই)। তাই এই কৌশল ধোপে টিঁকবে না। আবার যে লড়াইতে হেরে যাচ্ছে, সে যদি আগে থেকেই হিসাব করে নিতে পারে যে সে হেরে যাবে, তাহলে সে ওই বিষয়ে কোনো পোস্টই করবেনা, সময়ের অপব্যবহার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবে। সেক্ষেত্রে আবার যারা শুধু কয়েকটি পোস্ট দিয়ে বাজার ‘যাচাই’ করে নিতে চায় ক’জন তার সাথে থাকতে পারে, তারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। কারণ তার সমমতে কয়েকটি পোস্ট আসা-মাত্রই সংখ্যালঘুরা আর বিরুদ্ধে পোস্ট দিয়ে সময় নষ্ট না করার কথা ভাববে। গল্প পড়ে আবার মনে হতে পারে যে কিছুদিন পড়ে অন্যেরা এই কৌশল ধরে ফেলবে আর তারা কয়েকটা বেশী পোস্ট অবধি ধৈর্য ধরবে। আবার আমরা ঘুরেফিরে সেই গল্পের শুরুতে হাজির। তাহলে স্থিতিশীলতা আসবে কি করে? গাণিতিক বা তার্কিকভাবে দেখানো যায় যে প্রতি ব্যক্তি তার নিজের নিজের মত করে লড়াইতে তার নিজের লাভ-ক্ষতির মূল্য যা ভাবে, সেই অনুপাতেই সময় ব্যয় করবে। অরকুটে বা ফোরামে যার বিশ্বাস দৃঢ়তর (অবশ্যবিশ্বাস দৃঢ়তর বলে সেই ঠিক এমন কোনো মানে নেই), সেই জেতে – কারণ তার কাছে জেতার ‘মূল্য’ও বেশী। এটাই স্থিতিশীল কৌশল।
এ বিষয়ে কৌশলের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল প্রতিদ্বন্দীকে বুঝতে না দেওয়া যে সে কখন পলায়ন করতে চায়। অনেকসময়েই, ফোরাম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে একপক্ষের লেখার দৈর্ঘ্য ছোটো হতে থাকে, যুক্তির তীব্রতা কমতে থাকে - যা থেকে প্রতিদ্বন্দী বুঝে যায় যে এবার প্রতিপক্ষ হার-স্বীকার করতে চলেছে। হিসাবের থেকে সামান্য বেশী হলেও সে তখন সেই অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে লড়াইতে জেতার জন্য। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যাদের পলায়ন আগে থেকেই বোঝা যায়, তারা সুবিধা পায় না। শেষ অবধি যারা একইভাবে লড়াই করতে পারে, তারাই নির্বাচিত হয়, তাই এই কৌশলই স্থিতিশীল।
এখন অবধি যা আলোচনা হয়েছে সব ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়েছে লড়াইতে উভয়পক্ষ সমান বা প্রায় সমমাপের। বাস্তব প্রকৃতিতে কিন্তু তার উল্টোটাও প্রচুর দেখা যায়। মেনার্ড আর প্রাইস এই তত্ত্ব অসম লড়াই-এর ক্ষেত্রেও সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন সেখানেও স্থিতিশীল কৌশলে পৌঁছন সম্ভব। তাদের হিসাবমত, অসাম্য প্রধানত তিনপ্রকারের –
১) আকার বা গঠনগত (বাঘ বনাম হরিণ)
২) যুদ্ধে প্রাপ্তি অনুসারে (তৃণভূমি নিয়ে মাংসাশী প্রাণী কেন লড়াই করবে?)
৩) অবস্থান নিয়ে (‘হোম গ্রাউন্ড’ বনাম ‘অ্যাওয়ে গ্রাউন্ড’)। এর মানে হল যুযুধান দুই পক্ষের এক পক্ষ আগে থেকেই সেখানকার বাসিন্দা আর অন্যপক্ষ অনুপ্রবেশকারী।
এবার দেখা যাক তৃতীয় প্রকারের অসাম্যের (হোম আর অ্যাওয়ে) সাপেক্ষে স্থিতিশীলতা কিভাবে আসতে পারে। সাধারণ হিসাবে বোঝা যায় যে “বাসিন্দা জেতে আর অনুপ্রবেশকারী পালায়” – এরকম কৌশল স্থিতিশীল। কারণ কোনো এক জীব যদি সর্বদা আক্রমণের কৌশল অবলম্বন করে, তাহলে সে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ভাল ফল করলেও বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে জড়িয়ে পড়ে অর্ধেক লড়াইতে আহত হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলবে। অপরদিকে, জীবগোষ্ঠীর বাকি জীবেরা কোনো লড়াইতেই যাচ্ছেনা, কেউ না কেউ পালিয়েই যাচ্ছে। তাই তারা ওই আগ্রাসী জীবের তুলনায় সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। একই ভাবে দেখা যেতে পারে “বাসিন্দা পালায় আর অনুপ্রবেশকারী জেতে” – এটাও একটা স্থিতিশীল কৌশল – যদিও প্রকৃতিতে এর উদাহরণ খুবই কম। কারণ, সাধারণত বাসিন্দারা নিজেদের অবস্থানগত সুবিধার কারণে সেই জায়গা সম্পর্কে বেশী ভাল ধারণা রাখে, যা তাদের লড়াইতে সাহায্য করে। স্মিথের মতে, এই দ্বিতীয়টি একরকম বিভ্রান্তিকর কৌশল। কারণ, এর ফলে, বাসিন্দ বলে আর কিছু থাকে না – যে অনুপ্রবেশ করে সেই অন্যেকে একরকম তাড়িয়ে দেয়। আর প্রথমটি প্রকৃতিতে সর্বত্র দেখা যায় – যাকে বলে আঞ্চলিক আচরণ (Territotorial behaviour)।
এই আঞ্চলিক আচরণের একটা ভাল নিদর্শন দেখা যায় নিকো টিনবার্জেন-এর পরীক্ষায়। তিনি একটি অ্যাকোরিয়ামের দুপাশে দুটো যুদ্ধবাজ মাছ ছেড়ে দিলেন। তারা দুপাশে দুটো বাসাও বানিয়ে ফেলল এবং নিজেদের বাসার প্রতিরক্ষাও করতে থাকল। এবার উনি দুটো টেস্ট-টিউবে মাছদুটোকে আলাদা করলেন। এবার তাদের পাশাপাশি আনলেই দেখা যায় তারা কাঁচের ওপারে থাকা প্রতিদ্বন্দীর সাথে মারামারি করতে উদ্যত হচ্ছে। মজার ব্যাপার হল, যদি টেস্ট-টিউব দুটোকে যদি একজনের বাসার কাছে বসিয়ে পাশাপাশি আনা যায় তাহলে দেখা যাবে যার বাসার কাছে সে মারমুখী, আর অপরজন পালাতে ব্যস্ত। বিবর্তনের পথে “বাসিন্দা জেতে আর অনুপ্রবেশকারী পালায়” - এই স্থিতিশীল কৌশল মাছগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছে।
কিন্তু মেক্সিকোর সামাজিক মাকড়সা আচরণে ভিন্ন। কোনো মাকড়সা নিজের জালে বসে আক্রান্ত হলে সে পাথরের অপরদিকে চলে যায়, অনেকসময়ে সেখানকার মাকড়সাটাকে উৎখাত করে। এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না কোনো এক মাকড়সা নতুন জায়গা পেয়ে যায়। এদের আচরণ দ্বিতীয় স্থিতিশীল কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিবর্তনের পথে “বাসিন্দা পালায় আর অনুপ্রবেশকারী জেতে” - এই স্থিতিশীল কৌশল মাকড়সারা নির্বাচনের মাধ্যমে আয়ত্ত করে ফেলেছে। (চলবে)
মন্তব্য
পড়লাম। যথারীতি ভাল লাগলো।
পড়লাম আবারো। ভাল লাগছে।
...............................
আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।
নতুন মন্তব্য করুন