বাংলাদেশে কোনো বিকল্প শক্তির সৌরবিদ্যুতের মত সম্ভাবনা তাত্বিকভাবে অন্তত নেই। বাংলাদেশে গড়ে বছরে ২৫০-৩০০ দিন সূর্যালোক আসে, বর্ষার তিনমাস বাদ দিয়ে বাকি সময়ে সূর্যালোক যথেষ্ট নিরবিচ্ছিন্ন ও প্রখর। প্রতিদিনে গড়ে ৫ কিলোওয়াট-ঘন্টা শক্তি বাংলাদেশের প্রতি বর্গমিটার জমিতে আছড়ে পড়ে।(সূত্র) ভূপতিত এই সৌরশক্তির মাত্র ০.০৭% বিদ্যুতশক্তিতে রূপান্তর করা গেলেই বাংলাদেশের সব বিদ্যুতের চাহিদা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে। (সূত্র) সৌরবিদ্যুত পরিবেশ-বান্ধব ও একবার বিনিয়োগ করে বিদ্যুত উৎপাদন শুরু করা গেলে রক্ষণাবেক্ষণের ন্যূনতম কিছু খরচা ছাড়া বিদ্যুত উৎপাদনের আলাদা কোনো খরচা নেই।
বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের কথা আলোচনা করতে গেলেই প্রথমে সবাই জিজ্ঞাসা করবেন - কেন সৌরবিদ্যুত? তাদের প্রশ্নটাও সঙ্গত, কারণ সৌরবিদ্যুত উৎপাদক প্লান্ট বসানোর প্রাথমিক বিনিয়োগ অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির তুলনায় অনেকটাই বেশী। বায়ুশক্তির তুলনায় এই খরচা প্রায় দ্বিগুণ। সৌরবিদ্যুত বলতেই একটা ল্যাম্পপোস্টের মাথায় পাতের মত লাগানো ফোটোভোল্টেইক কোষের ছবি ভেসে ওঠে। সৌরশক্তিকে আহরণ করার প্রচলিত পদ্ধতি হল সিলিকন নির্মিত ফোটোভোল্টেইক কোষ ব্যবহার করা। মূল উপাদান সিলিকন উৎপাদনে যতটা বিদ্যুত খরচা হয়, ততটা বিদ্যুত এই সিলিকন দিয়ে নির্মিত কোষ এক থেকে দু'বছরে উৎপাদন করে। তাহলে সৌরবিদ্যুত কেন? এই উত্তরটা লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের বিদ্যুত ব্যবহারের ধারায়। বাংলাদেশের বিদ্যুত ব্যবহার সর্বোচ্চ হল মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে। (সূত্র) এর মধ্যে মার্চ থেকে মে মাসে সেচের কাজেও বিদ্যুত ব্যবহার হয়। এই কারণে বিদ্যুত ঘাটতি এই তিন মাসেই সর্বোচ্চ হয় - যার ফলশ্রুতিতে লোডশেডিং আর দুর্বিষহ কষ্ট। সেচের জন্য বিদ্যুতও পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না।
জলবিদ্যুত ও বায়ুশক্তি উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বর্ষাকালই হল পিক সিজন - এই সময়েই কাপ্তাই বাঁধে সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন হয়, বায়ুশক্তি-চালিত টারবাইন বসানো হলে তা-ও এ সময়ে সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদন করবে। অন্যদিকে শীতকালে চাহিদা যথেষ্ট কম আর দিনের বেলায় লোডশেডিং-এর প্রভাব ততটা দুর্বিষহ হয় না, তবে সেচের কাজ যথেষ্টই মার খায়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গরমকালের তিনমাসে বিদ্যুত ঘাটতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ থাকে। সৌরবিদ্যুতের সুবিধা হল এর পিক সিজন হল গরমকালেই, কারণ গরমকালেই সূর্যের বিকিরণ সর্বোচ্চ হয় (ছবি) - এই সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন-ভাবে বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব সৌরবিদ্যুত। আবার দিনের ২৪ ঘন্টার বিদ্যুত ব্যবহারের মধ্যেও অন্য একটা প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। সৌরবিদ্যুত যদি সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা না-ও করা হয় তাহলেও তা দিনের বেলাতেই সর্বোচ্চ হারে সরবরাহ করা যেতে পারে - যা সরাসরি সেচের কাজে ও কলকারখানা চালানোর কাজে লাগানো যেতে পারে। একইভাবে শীতকালে সেচের কাজের জন্য বিদ্যুত উৎপাদন সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়েই করা সম্ভব।
ফটোভোল্টেইক কোষ নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে - এর সুবিধা অসুবিধা অনেকেই জানেন। এর মূল অসুবিধা হল প্রাথমিক খরচা। আর সুবিধা হল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেখানে বিদ্যুত দরকার সেখানেই উৎপাদন করা সম্ভব বলে বিদ্যুত পরিবহণ-জনিত খরচা ও লিকেজ বাঁচানো সম্ভব। তাই এ নিয়ে আমি আর বিস্তারে কিছু না লিখে সৌরবিদ্যুতের অন্য আরেকটি দিক নিয়ে লিখতে চাই। একে বলা হয় সৌরতাপ শক্তি - এর প্রাথমিক বিনিয়োগ বায়ুশক্তির তুলনায় বেশী হলেও ফটোভোল্টেইক কোষ থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের তুলনায় এটি অনেক সস্তা পড়ে (চার্ট দ্রষ্টব্য)। তাহলে এই সৌরতাপ শক্তি বস্তুটা কি?
ছোটোবেলায় অনেকেই আমরা আতস কাঁচ দিয়ে সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে কাগজে ফেলে কাগজ পুড়িয়েছি। আর্কিমিডিস বড় আতস কাঁচ দিয়ে শত্রুজাহাজ পুড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন জানা যায়। এই সৌরতাপ শক্তির মূলনীতি সেই পোড়ানোর থেকে কোনো অংশে আলাদা নয় - কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তিই এতেও ব্যবহার হয়। তবে সৌরশক্তি কেন্দ্রীভবনের জন্য এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় প্যারাবোলিক প্রতিফলক (ছবি)। আর তার কেন্দ্রীয় অংশ দিয়ে একটি নলের মাধ্যমে জল যায়। কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তি জলকে গরম করে তোলে, জল থেকে বাষ্প হয় - আর সেই বাষ্পে টারবাইন ঘুরিয়ে উৎপাদন হয় বিদ্যুত। পদ্ধতিগতভাবে খবই সহজ। এই ছবিটা দেখলে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হতে পারে। ভিন্ন নকশার উৎপাদক অবশ্য সৌরবিদ্যুতকে একটা স্তম্ভের ওপর কেন্দ্রীভূত করে ও সেই স্তম্ভেই জল গরম করার ব্যবস্থা থাকে। সৌরবিদ্যুতের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে সৌরতাপ পদ্ধতির বিদ্যুত উৎপাদন দক্ষতা সর্বোচ্চ। (সূত্র)
বর্তমান বিশ্বে ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমিতে অবস্থিত একটি বড় সৌরতাপ শক্তি উৎপাদক প্ল্যান্ট আছে। ইউরোপ থেকে ভূমধ্যসাগর পেরোলেই সাহারা মরুভূমি। ইউরোপের ইতিহাসের পাতায় সাহারা মরুভূমি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হত। কিন্তু সম্প্রতি এই কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তির সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এখানে বিশ্বের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুত প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। হিসাবে দেখা গেছে, ইউরোপের পুরো জনসংখ্যার জন্য বিদ্যুত উৎপাদনের সাহারা মরুভূমির ১% এলাকাই যথেষ্ট। আর ৩৫,০০০ বর্গমাইল এলাকায় প্রকল্প করা গেলে তা থেকে পৃথিবীর বর্তমান বিদ্যুত উৎপাদনের সম-পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ডেসার্টেক। খরচা ধরা হয়েছে ৫৯ বিলিয়ন ডলার - উৎপাদিত হবে ১৮০ গিগাওয়াট বিদ্যুত। (সূত্র ১, সূত্র ২, প্রস্তাবিত ম্যাপ) একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিন গোবি মরুভূমিতে ও ভারত রাজস্থানে বিদ্যুত উৎপাদন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ভারতীয় প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা ২০ গিগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন। (সূত্র)
বাংলাদেশে মরুভূমি নেই, তবে সূর্য আছে - সূর্যের তেজও আছে। তাই প্রতিফলক বসিয়ে কিছু বিদ্যুত উৎপাদন করা খুব একটা শক্ত কাজ নয়। তবে এই পদ্ধতিতে বিদ্যুত উৎপাদনের আরো একটা সুবিধা আছে। একে সহজেই প্রচলিত তাপবিদ্যুত ব্যবস্থার হাইব্রিডের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। এই ব্যাপারটা কেমন? বর্তমানেও তাপবিদ্যুত কেন্দ্রে বয়লারে জল ফুটিয়ে বাষ্পশক্তি বানানো হয়। জল গরম করার পুরো শক্তিটাই আসে কয়লা বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। কিন্তু এই জলকে যদি কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তির মধ্যে দিয়ে আনা যায় তাহলে এর উষ্ণতা আগেই বৃদ্ধি পাবে, ফলে বিদ্যুত উৎপাদনে কয়লা বা গ্যাস কম পোড়াতে হবে। অথবা, কিছু পরিমাণ জলের বাষ্পীভবন সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করা হবে, বাকিটা জ্বালানী পুড়িয়ে (ছবি)। বাংলাদেশে বর্তমানে যে তাপবিদ্যুত প্রকল্পগুলো আছে সেগুলোকে প্রয়োজনে এইভাবে হাইব্রিডে রূপান্তর করা সম্ভব। ভারতেও অনেক তাপবিদ্যুত-কেন্দ্রকে সৌর-তাপ বিদ্যুত-কেন্দ্রে পরিবর্তিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে সৌরশক্তি ২০-৫০% অবদান রাখতে পারে। বর্ষায় সূর্যের তেজ কমে গেলে বেশী জ্বালানী ব্যবহার হবে বিদ্যুতকেন্দ্রে, গরমকালে বা শীতকালে জ্বালানীর প্রয়োজন কমবে। একই ভাবে, সৌরশক্তি ধরে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, জ্বালানীর যোগাণ সন্ধ্যার পরে বাড়িয়ে দিলেই হবে, আপনা হতেই বিদ্যুত উৎপাদন অপরিবর্তিত থাকবে।
সম্প্রতি ইউরোপের পরমাণু-গবেষণাগারের প্রধান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্টেনবার্জার দাবী জানিয়েছেন বায়ুশক্তির তুলনায় সৌরতাপশক্তি অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ও ভবিষ্যতে দ্বিতীয়টির সাফল্যের সম্ভাবনাই বেশী। সৌরতাপ-সম্ভাবনার ম্যাপে বাংলাদেশকে ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলের মত "সম্ভাবনাময়" হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত মতেও সৌরতাপ শক্তিই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে। সরাসরি না হলেও হাইব্রিড আকারে বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা সম্ভব। অনেকেই বলে থাকেন সৌরশক্তি আহরণের জন্য প্রয়োজনীয় ফাঁকা জায়গা বাংলাদেশে তেমনভাবে নেই। আমার বক্তব্য প্রতিফলক গুলো তো জায়গা নিয়ে নেয় না - প্রতিফলক তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের ছাদেও বসানো সম্ভব। যদি আরো বেশী সৌরশক্তি আহরণের প্রয়োজন হয়, তাহলে জনবহুল অঞ্চলের বাড়ির সারি-সারি বাড়ির ছাদেও প্রতিফলক বসানো সম্ভব। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও মানুষ ফ্ল্যাটবাড়ির ধারণা বুঝতই না - জমির মালিকানা ছাড়াও যে সম্পত্তির মালিক হওয়া যায় তা জনসংখ্যার চাপে সম্ভব হয়েছে। স্থানাভাব দূর করার জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এমনিতেই অনেক কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। সারি-সারি বাড়ির ছাদে প্রতিফলক জল গরম করছে - এখন এই চিন্তা কষ্টকল্পিত মনে হলেও ভবিষ্যতে সত্যি হয়ে দেখা যেতেই পারে।
অতিরিক্ত কিছু লিঙ্ক -
১) ভারতের সৌর-তাপ প্রকল্প নিয়ে
২) ভারতের বিদ্যুত উৎপাদনের বর্তমান অবস্থা
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন