চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারত ইত্যাদি দেশের পর অবশেষে বাংলাদেশেও বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম বার্ড ফ্লু ধরা পরার পর এ পর্যন্ত দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৭টি জেলায় মোট ৪৮৬টি খামারে বার্ড ফ্লু ধরা পরেছে এবং মোট ১,৫৩৬,৫৪২টি হাঁস-মুরগী নিধন করা হয়েছে। এবং এর ফলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারী যারা এমনিতেই বিভিন্ন এনজিওর দেয়া ক্ষুদ্র ঋণের দায়ে জর্জরিত। সরকারী ভাবে যে ক্ষতিপূরণ অল্প কয়েকটি খামার পেয়েছে তাও অপ্রতুল- যেমন একটা ডিম পাড়া লেয়ারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেয়া হয়েছে ৭০ টাকা করে যেখানে কানাডা থেকে আমদানী করতে খামারীর লেয়ার প্রতি খরচ হয়েছে ২৬৩ টাকা করে। এশিয়ার দেশে দেশে যখন বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই ২০০৫ সালের দিকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক (যে সংস্খাটি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে নারীদেরকে পোল্ট্রি ব্যবসায় নিয়োজিত করে আসছে- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি কর্পোরেশন) এর সাথে পোল্ট্রি খামার, অতিথি পাখীর বিচরণ স্থান এবং তার আশপাশের জৈবনিরাপত্তার জন্য কর্মসূচী হাতে নেয়। বার্ড ফ্লু মহামারীর শুরু থেকেই প্রচার করা হচ্ছে যে বার্ড ফ্লুর জন্য উন্মুক্ত মুরগী পালন এবং অতিথি পাখীই দায়ী। অথচ জৈবনিরাপত্তার এত তোড়জোড় সত্ত্বেও দেশের সর্বপ্রথম বার্ড ফ্লু ধরা পরে ঢাকার অদূরে সাভারে বাংলাদেশ বিমানের মালিকানাধীন খামারে- কোন অতিথি পাখী কিংবা উন্মুক্ত স্থানে পালন করা হয় এমন দেশী হাঁস মুরগীর মাঝে নয়। শুধু তাই নয় যুগ যুগ ধরে এদেশের ঘর গেরস্থালীতে লালন পালন করা দেশী হাঁস মুরগীর গায়ে এর আগে কখনই বার্ড ফ্লুর মতো প্যাথোজেনিক মহামারী দেখা যায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, এত জৈবনিরাপত্তার ব্যবস্থা সত্ত্বেও কেন খামারের পর খামার ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগী এই মহামারীতে আক্রান্ত হতে থাকে?
হাইব্রিড বা সংকর জাত এবং পোল্ট্রি শিল্প
১৯৪০ সালে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়ালেশের আমলে পোল্ট্রি ব্রিডিং এর নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। গবেষণায় দেখা যায় যে, দুটি ভিন্নধারার বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রজাতির মোরগ-মুরগীর প্রজননের ফলে যে নতুন জাতের মুরগীর জন্ম হয় তার উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশী। যেমন, একটি প্রজননক্ষম মুরগীর সাথে একটি অধিক বর্ধনশীল পেশীর মোরগের প্রজননের ফলে উৎপাদিত জাতের মোরগ-মুরগী। এভাবেই পোল্ট্রিশিল্পে আবির্ভূত হলো ডিমপাড়া লেয়ার আর মাংস উৎপাদনকারী ব্রয়লার। এর সাথে যুক্ত হলো বিশেষায়িত পোপ্ট্রিখাদ্য আর পোল্ট্রি ভ্যাকসিন শিল্প- কেননা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে স্বল্প সময়ে বেশী মাংস উৎপাদনের জন্য চাই বিশেষ খাদ্য আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাইরে কৃত্রিমভাবে শুধু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের পোল্ট্রির দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার প্রেক্ষিতে নানা জাতের নানা রোগপ্রতিরোধের জন্য অসংখ্য ভ্যাকসিন। পোল্ট্রিশিল্পের তিনটি ভাগঃ ব্রিডিং বা প্রজনন শিল্প, মাল্টিপ্লায়ার বা সংখ্যা বর্ধনকারী শিল্প এবং ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজাকরণ শিল্প।
সংখ্যাবর্ধনকারীরা ব্রিডারদের কাছ থেকে ক্রয় করা দুটি ভিন্নজাতের পোল্ট্রির সংকরায়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের পোল্ট্রি উৎপাদিত করে মোটাতাজাকারীদের কাছে বিক্রি করে। যেমন আমাদের দেশের বেশীরভাগ খামার মালিকই এই মোটাতাজাকারীর দলে পরে যারা ব্রিডার উৎপাদিত WHITE CORNISH মোরগ এবং BARRED ROCK মুরগীর প্রজননের মাধ্যমে জন্মলাভকরী বাচ্চা ব্রয়লার মুরগী মাল্টিপ্লায়ারদের কাছ থেকে কিনে লালন-পালন করে বাজারে বিক্রয়করে (উইকিপিডিয়া)। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হলো, দুটি বিশেষ জাতের সংকরায়ণের ফলে যে প্রথম প্রজন্মের সংকর জাতের উদ্ভব হয়, তাদের নিজেদের সংকরায়ণ যদি ঘটানো হয় তাহলে উদ্ভুত দ্বিতীয় প্রজন্মের জাতের মাঝে প্রথম প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুণ্ন থাকে না অর্থাৎ দুটি ব্রয়লার মুরগীর প্রজননের ফলে আরেকটি ব্রয়লার পাওয়া যাবেনা, ব্রয়লারের জন্য সর্বদাই WHITE CORNISH মোরগ এবং BARRED ROCK মুরগীর প্রয়োজন! ফলে ব্রয়লার উৎপাদনকারীদের সবসময় ব্রিডারদের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। ব্রিডাররাও খুব সতর্ক থাকে যেন মাল্টিপ্লায়ারদের কাছে শুধু WHITE CORNISH মোরগ এবং BARRED ROCK মুরগী যায়, কোন ভাবেই যেন তাদের হাতে WHITE CORNISH মোরগ ও মুরগী কিংবা BARRED ROCK মোরগ ও মুরগী একই সাথে না পরে।
সংকরায়নের এই বিশেষ ধরণের কারণে সর্বদাই উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার অর্থাৎ অধিক পুঁজির প্রয়োজন হয়, যে কারণে পোল্ট্রিশিল্প ক্রমশ গুটিকয়েক কোম্পানীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। যেমনঃ ১৯৮৯ সালে ব্রয়লারের জন্য প্রয়োজনীয় জাত উৎপাদনকারী ১১০টি ব্রিডার কোম্পানী থাকলেও বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৪টি। একই সাথে লেয়ার ব্রিডারের সংখ্যা ১০ থেকে কমে হয়েছে ২ ট। ফলে সারা বিশ্বের ছোট বড় সমস্ত পোল্ট্রি শিল্পকে ব্রয়লার বা লেয়ারের জন্য এই কয়েকটি কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হয়।
সংকর জাত এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা
অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন অধিক উৎপাদন ক্ষমতা- কম সময়ে সবচেয়ে বেশী বেড়ে উঠা কিংবা সবচেয়ে বেশী ডিম পাড়া। ইত্যাদি মুনাফা কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রাখতে গিয়ে পোল্ট্রি শিল্প এখন কেবল গুটিকয়েক প্রাথমিক জাতের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে (FAO এর হিসাবে মাত্র ৪টি) । এই গুটিকয়েক জাতের প্রজননের ফলে উৎপাদিত ব্রয়লারের/লেয়ারে মাংস বা ডিম উৎপাদন ক্ষমতাই ব্রিডারের মূল লক্ষ্য- অধিক মাংস বা ডিম উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে গিয়ে উৎপাদিত জাতের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলো কি থাকলো না সেটা দেখার কাজ ব্রিডারের নয়, তার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানী। ফলে শুধু রোগপ্রতিরোধের বৈশিষ্ট্যকেই অবহেলা করা হচ্ছে তা নয়, জিনগত ভাবে একেবারে একধরনের মুরগী উৎপাদিত হচ্ছে হাজার হাজার যা জৈব-বৈচিত্র্যর হ্রাস করে প্রজাতির টিকে থাকাকেই হুমকিগ্রস্ত করছে। এভাবে ব্রিডারের ল্যাবরেটরীতে বাছাইকৃত জাতের সংকরায়নের ফলে উৎপাদিত ব্রয়লার বা লেয়ারকে যখন ভিন্ন কোন দেশের ভিন্ন কোন পরিবেশে নিয়ে যাওয়া হয় মাংস বা ডিম উৎপাদনের জন্য, তখন সেটি নতুন পরিবেশে খুব সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, যেখানে স্থানীয় জাতের মোরগ-মুরগী বিশেষ ভ্যাকসিন বা বিশেষ খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই বেড়ে উঠতে পারে।
অতিথি পাখিঃ বার্ড ফ্লুর বাহক না ভিকটিম
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহামারী আকারে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পরার কারণ হিসাবে অতিথি পাখি বা সঠিক ভাবে বললে পরিযায়ী পাখির কথা বলা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে QINGHAI লেকের কথা বলা হয়, যেখান থেকে পরিযায়ী পাখির মাধ্যমেই নাকি বার্ড ফ্লু পশ্চিমের কাজাখিস্তান, রাশিয়া এমনকি তুরস্কে ছড়িয়ে পড়ে। অথচ BIRD LIFE INTERNATIONAL এবং অন্যান্য পাখি সংরক্ষণকারী সংগঠন বলছে যে QINGHAI লেকের চারপাশেই রয়েছে বিভিন্ন পোল্ট্রি খামার, যেগুলোর বিষ্ঠা আবার ঐ এলাকায় FAO স্থাপিত একটি বৃহৎ মাছের খামারের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া রেল এবং সড়ক পথে QINGHAI লেকের সাথে বার্ড ফ্লু আক্রান্ত অঞ্চলের যোগাযোগ রয়েছে। অথচ এ বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়েই পরিযায়ী পাখির পরিভ্রমণকে দায়ী করা হচ্ছে।
পরিযায়ী পাখি তত্ত্বের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো দুটি-
১। জীবন্ত পরিযায়ী পাখির মাঝে বার্ড ফ্লুর জীবাণু খুব কমই পাওয়া গেছে । আর যাও পাওয়া গেছে তা আবার ঐH5N1 ধরনের নয়। যেসব ক্ষেত্রে ঐ H5N1 পাওয়া গেছে সেসব ক্ষেত্রে পরিযায়ী পাখিটি ছিল মৃত এবং ইতোমধ্যেই বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে গৃহপালিত হাঁস-মুরগীর মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে এমন এলাকা থেকে প্রাপ্ত। নিজেই বার্ড ফ্লুর শিকার মৃত পরিযায়ী পাখিটি নিশ্চয়ই দেশে দেশে ঐ H5N1 ছড়াতে পারেনা!
২। পরিযায়ী পাখির চলাচলের পথ এবং সময়ের সাথে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পথ এবং সময়ের অমিল। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বার্ড ফ্লু ছড়ানোর ব্যাপারে BIRD LIFEএর ড•রিচার্ড বলেন “QINGHAI লেক থেকে কোন পরিযায়ী প্রজাতিই পূর্ব ইউরোপের দিকে যায় না। বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পথের সাথে পরিযায়ী পাখির চলাচলের পথ নয় বরং রেল এবং সড়ক চলাচলের প্যাটার্নের মিল দেখা যায়।”
যদি পরিযায়ী পাখি বার্ড ফ্লু ছড়ায় তাহলে কেন ফিলিপিন বা বার্মায় বার্ড ফ্ল হলো না, লাওসের ক্ষেত্রে কেন পুরো লাওসে না হয়ে শুধু এমন এলাকায় হলো যেখানে পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রির ঘনবসতি- ফিলিপিন, বার্মা ও লাওসের চারপাশের সবকটি দেশেই তো তখন বার্ড ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে ছিল?
বার্ড ফ্লু ও গৃহপালিত হাঁস-মুরগী
বার্ড ফ্লুর জন্য পরিযায়ী পাখির পরই দায়ী করা হয় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে লালিত-পালিত গৃহস্থালীর হাঁস-মুরগীকে। তত্ত্বটি এরকমঃ উন্মুক্ত ভাবে পালিত হয় বলে এসব হাঁস-মুরগী সহজেই পরিযায়ী পাখির সংস্পর্শে আসে এবং বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হয়। আর একবার আক্রান্ত হলে এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করার কোন উপায় থাকে না, যেহেতু উন্মুক্ত ঘুরে বেড়ায়, রাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিষেধক দেয়া কিংবা আক্রান্ত মুরগী নিধন করাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং FAO, WHO ইত্যাদি সংস্থার পরামর্শে অষ্ট্রিয়া, কানাডা, চীন, ভিয়েতনাম, ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে ছোট আকারে গৃহস্থালীতে হাঁস-মুরগী পালনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়া হয়। মূলত বড় বড় পোল্ট্রি কর্পোরেশন পোল্ট্রি সেক্টরটিকে আরও কেন্দ্রীভূত করার ধান্দায় বার্ড ফ্লুকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। “আমরা পরিযায়ী পাখির চলাচল সীমাবদ্ধ করতে পারবনা কিন্তু যত বেশী সম্ভব backyard farm কে বন্ধ করে দিতে পারব”- বললেন Margaret Say, যিনি USA POULTRY AND EXPORT COUNCIL এর একজন ডিরেক্টর। অথচ কয়েকশ বছর ধরে ঘর-গেরস্থালীর আশপাশে প্রায় সব কৃষক পরিবারেই হাঁস-মুরগী পালিত হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে আমিষের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এসব হাঁস-মুরগীর শরীরে নানা ধরনের ফ্লু বা জীবাণু থাকলেও এরা কখনোই ঐ H5N1 এর মত প্যাথোজেনিক হয়ে উঠতে পারেনা। কেননা বদ্ধ খাঁচার বদলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে লালন পালন, প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতির ফলশ্রুতিতে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্বের কারণে এগুলোর উপর virul load কম থাকে, ফলে কোন একটি ফ্লু-ভাইরাস মিউটেশানের মাধ্যমে ঐ H5N1 এর মত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেনা। তাই দেখা গেছে এসব স্থানীয় জাতের হাঁস-মুরগীকে যখন বার্ড ফ্লু আক্রান্ত পোল্ট্রি থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়, ভাইরাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে নিম্ন প্যাথোজেনিক রূপ ধারণ করে।
উদাহরণস্বরূপ লাওসের কথাই ধরা যাক। লাওসের পোল্ট্রি পালন মূলত স্থানীয় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্থানীয় জাতের হাঁস-মুরগীর মাধ্যমে হয়। প্রতিটি গ্রামে গড়ে ৭৮টি পরিবার সব মিলিয়ে গড়ে ৩৫০টির মতো হাঁস-মুরগী পালন করে। প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে যখন বার্ড ফ্লু মহামারী ছড়ায়, লাওসেও তখন এর সংক্রমণ শুরু হয়। তবে এ সংক্রমণ শুধু পোল্ট্রি খামারের (যার সংখ্যা মোটামুটি ১০০) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। লাওস এই পোল্ট্রিগুলোকে নিধন করে এবং থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের সাথে সীমান্ত সিল করে দিয়ে তার স্থানীয় জাতের মুরগীগুলোকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
পোল্ট্রি খামারঃ রোগের কারখানা
আধুনিক পোল্ট্রি খামারগুলোতে হাজার হাজার ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগীকে যে পদ্ধতিতে এবং পরিবেশে পালন করা হয় তা শুধু বার্ড ফ্লু নয়, যে কোন ধরনের রোগ ছড়ানোর জন্য আদর্শ। ছোট ছোচ খাঁচার মধ্যে একটির পর একটি স্তরে গাদাগাদি করে রাখা দুর্বল, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাহীন মুরগীগুলোর কোন একটি খাদ্য, বাতাস বা অন্য কোনভাবে ফ্লু’তে আক্রান্ত হলে খুব দ্রুতই তা চারপাশের প্রাণীগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। যখন একটি আক্রান্ত মুরগী বিষ্ঠা ত্যাগ করে, সেটা থেকে জীবাণু খামারের বদ্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং নিঃশ্বাসের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী প্রাণীটিকে আক্রান্ত করে। WHO স্বীকার করছে যেঃ “বদ্ধ খাঁচায় একটির উপর আরেকটি গাদাগাদি করে রাখা পাখি খুব সহজেই তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে আশেপাশে রোগ ছড়িয়ে চলে।” ডাঃ ওয়াল্টার সনটেগ, একজন অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী যিনি বার্ড ফ্লু নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁর মতেঃ “একটি ক্ষুদ্র আবদ্ধ স্থানে অধিক ঘনত্বে লালন-পালন করা এবং নির্দিষ্ট ধরনের পানি এবং খাবারের মাধ্যমে বেড়ে উঠা ইত্যাদি বিষয় বার্ড ফ্লু বিস্ফোরণকে প্রভাবিত করে।”
পোল্ট্রিখাদ্য ও বার্ড ফ্লু
অধিক মাংস ও ডিম উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন উচ্চ ক্যালরির খাদ্য। আর এই পোল্ট্রিখাদ্যের জন্যও খামারগুলোকে গোটা কয়েক কোম্পানীর উপর নির্ভর করতে হয়। এসব কোম্পানীর তৈরী পোল্ট্রিখাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ‘পোল্ট্রি লিটার’।
পোল্ট্রি লিটার হলো খামারের মেঝেতে পাওয়া মুরগীর বিষ্ঠা থেকে শুরু করে পালক পর্যন্ত বিভিন্ন বর্জের সংমিশ্রণে তেরী একটি খাদ্য। WHO এর মতে বার্ড ফ্লুর জীবাণু মুরগীর বিষ্ঠার মাঝে ৩৫ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। ফলে পোল্ট্রি লিটার থেকে তৈরী পোল্ট্রি খাদ্যকে বলা যায় বার্ড ফ্লু সংক্রমণের অন্যতম নিয়ামক। রাশিয়ার কুরগান প্রদেশের বার্ড ফ্লু মহামারী নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ৪,৬০,০০০ মুরগী নিধন করতে হয় যার কারণ হিসাবে কর্তৃপক্ষ মুরগীর খাদ্যকে চিহ্নিত করেছে।
দুর্দশাকে পুঁজি করে মুনাফা আয়
পুঁজিবাদ এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা মুনাফার প্রয়োজনে দুর্দশা তৈরীতে দ্বিধা করে না আবার সেই দুর্দশাকে পুঁজি করে মুনাফা অর্জনের সামান্যতম সুযোগটিকেও হাতছাড়া করে না। বার্ড ফ্লুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বার্ড ফ্লু পোল্ট্রির রোগ হলেও পোল্ট্রির সংস্পর্শে আসা মানুষের মাঝেও তা ছড়াতে থাকে। শুধু তাই নয়, ঐ H5N1 ধরনের ফ্লু দ্রুত মিউটেশানের মাধ্যমে শুধু মুরগী থেকে মানুষে নয়, মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম এমন জীবাণুতে পরিণত হবে এমন আশংকাও বাড়ছে। ২০০৫ সালের মাঝে প্রায় ২০০ মানুষের মাঝে বার্ড ফ্লুর লক্ষণ দেখা যাওয়ায় WHO যখন উক্ত আশংকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, তখনই শুরু হয় আরেক খেলা। সুইডিশ ঔষধ কোম্পানী Roche বাজারে নিয়ে আসে Tamiflu ট্যাবলেট যার পেটেন্ট মালিক হলো আমেরিকা ভিত্তিক ঔষধ কোম্পানী Gilead Science ; Roche এর কাছ থেকে উৎপাদন এবং বিতরণের লাইসেন্স প্রাপ্ত একমাত্র কোম্পানী। WHO এর ঘোষণার পর Taminflu এর বিক্রি ৪০০% বেড়ে যায়, Gilead এর প্যাটেন্ট আয় বাড়ে ১৬৬%। আমেরিকা সরকারীভাবে ১•৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের Taminflu এর অর্ডার দেয় যা শুধু Roche বা Gilead এর জন্য দারুণ উপহার নয়, সেই সাথে আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব ডোনাল্ড রামস্ ফেল্ডের জন্যও দারুণ সুখবর বয়ে আনে যেহেতু রামস্ ফেল্ড Gilead এর অন্যতম শেয়ার হোল্ডার। যদিও Taminflu এর বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে (যেমনঃ আক্রান্ত হওয়ার ১৮ ঘন্টার মাঝে ঔষধ গ্রহন না করলে Taminflu কাজ করে না, বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি) তবু মানুষের মাঝে বার্ড ফ্লু মহামারীর আশংকায় সারা বিশ্বের ১৫০ টির বেশী সরকার Taminflu যখন উৎপাদনের সাব-লাইসেন্স চায়, Roche তখন সরাসরি অস্বীকৃতি জানায়।
জীবাণু বাণিজ্য ও মিলিটারী-ইনডাষ্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স
যখন কোন দেশে নতুন কোন ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, তখন নিয়ম হলো সে দেশটি থেকে কতগুলো নমুনা WHO এর Global Influenza Surveilance Network (GISN) এর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো। এ ল্যাবরেটরিগুলো বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্মত গবেষণাগার। এ প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা ভাইরাসের নমুনা বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে নতুন এবং জটিলতম নমুনাটিকে প্রতিরোধক্ষম প্রতিষেধক আবিষ্কার। কিন্তু GISN এই উদ্দেশ্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিভিন্ন কর্পোরেট ঔষধ কোম্পানীর কাছে পাচার করে দেয়। কর্পোরেট কোম্পানী নিজেরা তার প্রতিষেধক আবিষ্কার করে পেটেন্টের মাধ্যমে সেই রোগাক্রান্ত দেশেই তা বিক্রির মাধ্যমে একচেটিয়া মুনাফা আয় করে!
জীবাণু নিয়ে মুনাফার এই খেলা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ্যে চলে আসে ৯-ই ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ ইন্দোনেশিয়া যখন WHO এর কাছে বার্ড ফ্লুর ভাইরাস পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ইন্দোনেশিয়ায় বার্ড ফ্লু মহামারী আকার ধারণ করার পর একটি বহুজাতিক কোম্পানী যখন ভিয়েতনামের বার্ড ফ্লুর নমুনা (যা ভিয়েতনাম WHO কে পাঠিয়েছিল) থেকে তৈরী Diagnostic Kit ইন্দোনেশিয়ার কাছে বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়, তখনই ইন্দোনেশিয়ার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় কেমন করে ধনী দেশের ঔষধ কোম্পানীগুলো WHO এর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে WHO কে বিশ্বাস করে রোগাক্রান্ত দেশগুলোর পাঠানো ভাইরাসের নমুনাকে পেটেন্ট করে প্রভূত মুনাফা অর্জন করছে। শুধু বার্ড ফ্লু নয় অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে। যেমনঃ ২০০৬-০৭ সালে চীনে যখন শুকরের মহামারী PRRS(Procine Respiretory Reproductive Syndrome) ছড়িয়ে পড়ে, চীন তখন OIE/WHO এর গবেষণাগারগুলোতে নমুনা পাঠাতে অস্বীকার করে। চীন পরিষ্কার জানিয়ে দেয় Intellectual Property Rights এর কারণে সে বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে এই সাম্প্রতিকতম নমুনা তুলে দেয়ার ঝুঁকি নেবে না কেননা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানী PRRS এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছে যার সম্ভাব্য বাজার মূল্য ২০০ মিলিয়ন ডলার। বদলে সে তার দেশের ক্রমবর্ধমান ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমেই এর প্রতিষেধক আবিষ্কর করবে।
এই PRRS যখন চীন থেকে ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম তখন FAO/OIE কে এড়িয়ে গিয়ে সরাসরি আমেরিকার Merial ফার্মাসিউটিক্যালসের সাথে দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি করে তাদের কাছে নমুনা পাঠায়। এভাবে আন্তর্জতিক পরিমণ্ডলে রোগজীবাণুর প্রতিষেধক আবিষ্কারের গবেষণা ক্রমশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আওতায় চলে যাচ্ছে। WHO/ FAO এর মত সংস্থাগুলো ভাইরাস-ভ্যাকসিনের উপর পেটেন্টের সমস্যাটি সমাধান করতে না পারায় এ বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী ভাবেই গোটা বিশ্বের রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিলিটারী ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কমপ্লে ব্যবহারের মাধ্যমে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশকে রোগজীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করার নামে নতুন নতুন সব ভাইরাসের নমুনা তার দখলে নিয়ে আসছে। যেমনঃ US Naval Medical Research Unit জাকার্তা, কায়রো, লিমা ইত্যদি স্থানে আঞ্চলিক গবেষণাগার স্থাপন করছে, অন্যদিকে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের Biological Threat Reduction Program ( BTRP) কাজ করছে প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লকের আওতাভুক্ত দেশগুলোতে। BTRP প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য জীবাণু বোমা হামলা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে যদিও বর্তমানে এর ধান্দা হলো দেশগুলো থেকে যত বেশী সম্ভব ভাইরাসের নমুনা দখল করে আমেরিকার গবেষণাগারে পাঠানো। আর এই গবেষণাগারগুলোর কার্যক্রম সম্পর্কে খুব সামান্য তথ্যই বাইরে আসে- যা বেশ চিন্তা উদ্রেককারী একটি বিষয়। একদিকে সংগৃহীত জীবাণুর নমুনা পেটেন্ট করে ব্যবসা আর অন্যদিকে জৈব-সন্ত্রাসের আশংকা (যে বিষয়টি ইন্দোনেশিয়া সামনে নিয়ে আসে)। ইন্দোনেশিয়ার মত একটি দেশ কেমন করে নিশ্চিত হবে যে তার দেশ থেকে সংগৃহীত নমুনাকে ধনীদেশগুলো তাদের দেশের সামরিক কারখানার কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করবে না!
পুরো লেখাটি তৈরী করা হয়েছে Seedlings পত্রিকার জানুয়ারী ২০০৮ সংখ্যা অবলম্বনে।
অন্যান্য তথ্যসূত্রঃ
১। পিপলস ডেইলি অনলাইন, ৩১ মার্চ, ২০০৮
২। শেখ সাবিহা আলম, রো ওভার বার্ড ফ্লু কমপেনসেশান, ডেইলি স্টার, ২৮ মে, ২০০৭।
মন্তব্য
অনেক অজানা তথ্য জানা হলো।
খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
(বিপ্লব)
বরাবরের মতই অসাধারণ। আপনার লেখাগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কি? না হয়ে থাকলে এর দরকার আছে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
সুন্দর লেখার জন্য অভিনন্দন!
১. দুটি আলাদা রকম পিতামাতার মিলনে প্রথম প্রজন্মে যে উন্নত বৈশিষ্ট দেখা যায় সাধারণভাবে একে হাইব্রিড ভিগর বলে। এটা অনেক বছর থেকেই উদ্ভিদ-প্রাণি উভয়েই ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রাপ্যতার জন্য কৃষকের ওই কোম্পানীর কাছে বাধা থাকা ছাড়া উপাই নাই। বাস্তবে এমন কোনো উদ্ভিদ-প্রাণি বানানো অসম্ভব যাদের কিনা উচ্চ ফলনশীলতা, উচ্চ রোগ প্রতিরোধীতা...ইত্যাদি সব ভালো বৈশিষ্ট একসাথে থাকবে, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আছে। এর জন্য কোম্পানীগুলোকে দোষ দেয়া যায়না। আমরা অনেক সময় হাইব্রিড কে বিদেশি কোম্পানীর টোপ হিসেবে দেখি, সেটা সব ক্ষেত্রে ঠিক না। আসলে লাভজনকভাবে কৃষি পন্য উতপাদনের জন্য কৃষকের মনোকালচার ছাড়া গতি নেই। সেই জন্য জার্ম্পপ্লাজম রক্ষার দায়িত্ব সরকার বা ঐ রকম কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে যারা সত্যিকার কৃষকের স্বার্থ বুঝবে।
২. ব্যবসায়ীদের কাছে সবাই যে জিম্মি একথা কে না জানে।
[বাংলা টাইপিং এর সীমাবদ্ধতার জন্য বিস্তারিত লিখতে পারলাম না।]
শামীম ভাইয়ের মন্তব্যের সাথে একমত।
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
নতুন মন্তব্য করুন