শেরালী -দুই (মা ছিল না ঘরে)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/০৫/২০০৮ - ৪:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জন্ম দাতায় দিলনা জন্ম, জন্ম দিল পরে,
যখন ছেলের জন্ম হইল, মা ছিল না ঘরে।
জয়ধন মুনির ধ্যান খুব সহজে ভাঙ্গেনা। জগৎ-এর সব কিছু তুচ্ছ জ্ঞান করেই, এজীবনের সার্থকতার সন্ধানে মানুষের কোলাহল ছেড়ে, গহীন অরণ্যে যোগী হয়েছেন। বনের বাঘ, সিংহ, হাতি ভাল্লুক ঐসবের ভয়, জয়ধন মুনিকে বিচলিত করে না। কারণ জয়ধন মুনি জানে, মানুষের চেয়ে ভয়ংকর প্রাণী, ধরতি মাতা জন্মায়নি। এই গভীর অরণ্যে অন্তত মানবের উপদ্রব নেই। এই তার বিশ্বাস।

বিশ্বাস করেছিল জোস্নাও।
এতটুকু মেয়েকে ভাতের অভাবে ঝিয়ের কাজে পাঠিয়েছে জব্বর মাঝি। ভেবেছিল: মনু পোদ্দার পেটেভাতে খাটাক। কিন্তু বয়স কালে মেয়েটার একটা বিয়ে তো দেবে! আমি খাইয়েই বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। মেয়ে হয়ে জন্মেছে কাজ তো স্বামীর ঘরে গেলেও করতে হবে। চুরিতো আর করছে না! মন খারাপ আমারও বউ! আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জব্বর মাঝির বউ স্বামীর ব্যাবস্থা মেনে নিল।

সেই যে জব্বর মাঝি মেয়েকে রেখে গেল, সেই থেকে মেয়ে মনু পোদ্দার হয়ে গেল। মেয়ে দেখতে শুনতে ভাল। কাজও ভাল করে। সবাই খুশী। বাধ সাধল মা ধরতী। পেট ভরে খেতে পায়। এত খাটা খাটনির পরে, যখন ঘুমোতে যাবার আগে মনু পোদ্দার ডাকে: মা জোস্না একটা পান ছেইচ্চা দেতো। জোস্নার প্রণটা পিতৃ ভক্তিতে ভরে উঠে। ভূলে যায় সে এ বাড়ীর চাকরাণী। তাও বিনে পয়সার। কিন্তু ঐ যে মা ধরতী! জোস্নার মন এবং শরীর দুই মার আর্শীবাদে পুষ্ট হল। মা ধরতী জোস্নার এত রুপ দিল যে, মনু পোদ্দারের মাথা ঘুরে গেল।
তার ফল ভোগ করতে জোস্না সমাজ ছেড়ে জঙ্গলে এল। দশ মাস দশ দিন পর মনু পোদ্দারের বীজ জোস্নার পেট ফুঁড়ে মা ধরতীর বুকে অঙ্কুরোদগম করতে চাইল। তা সামলাতে না পেরে জোস্না কেঁদে উঠল।
জয়ধন মুনি মানুষের কান্নায় ভয় পেয়ে মেয়ের দিকে ফিরে চাইল। এই একটি ভুলের কারণে জয়ধন মুনির সাধনা পূর্ণ হলনা। সে যেই পাপী ছিল সেই পাপীই রয়ে গেল। মেয়েটির জন্য তার মায়া হল। অথচ এ মায়ার মোহ মুক্তিই ছিল তার সাধনা। ধরণীর আর সব কিছুর মতই জয়ধন মুনিও মা শিশুর দেখা শোনা করতে লাগল। জয়ধন মুনি জানে না কে মনু পোদ্দার। তার কাছে পৃথিবী খুব সহজ। "ভবে মানুষ রতন, করগো তাহারে যতন"। কিন্তু এতটুকু বুঝেছে যে, মেয়েটি তারই মত বনবাসী হয়েছে। কারণ যাই হোক দুজনে একই বনের বাসিন্দা।
কিন্তু তাই বলে ধ্যান করা জয়ধন মুনি একেবারে ছেড়ে দেয়নি। এক দিন মুনি ধ্যানে বসেছে দেখে মেয়েটি ভাবল, জল নিয়ে আসি। কিন্তু ছেলেটা যেতে চায়না। মুনিকে বলল বাবা ছেলেটাকে রেখে গেলাম। একটু নজর রেখ। মুনি শুনলকি শুনলনা। আবার ধ্যানে মগ্ন হল। কোন অদ্ভূত শব্দে মুনির ধ্যান ভেঙ্গে গেল। কিন্তু ছেলেটাকে কোথাও দেখতে পেল না। কারণ মুনি ধ্যানে বসার পর ছেলেটা মায়ের পিছু পিছু নদীর ধারে চলে গেছে। ছেলেকে দেখতে না পেয়ে মুনি গেল দিশেহারা হয়ে। মা কে এখন কি বলব? কে জানে হয়ত ছেলেকে বাঘে নিয়ে গেছে! তুই আমাকে এত যন্ত্রনা কেন দিচ্ছিস ভগবান! ভগবানের দয়া হল। বলল ছেলে পাবি, অধৈর্য্য হসনে। মুনি বলল হে ভগবান, আমি তোর কাছে কিছুই চাইনে, শুধু মা ফিরে আসার আগে ছেলেটাকে আমার হাতে তুলে দে। অমনি ঝোপের আড়াল থেকে হাঁটতে হাঁটতে ছেলে মুনির পাশে এসে বসল। ছেলেকে কোলে তুলে চুমোয় ভাসিয়ে দিল মুনি। আর বলল: এখন থেকে আমার ধ্যান জ্ঞান সব তুই। এমন সময় মা তার ছেলেকে নিয়ে নদীর ঘাট থেকে ফিরে এল।

আছে মিলে খায়, কতেক দিন যায়
এই ভাবে তিন জনের সংসারে চার জন হল। এক ছেলের জায়গায় দুই জন হল। দুজনেই মায়ের সন্তান। মা দু'জনকেই ছেলের আদরে মানুষ করতে লাগল। দেখতে দুজন একই রকম। যমজ ভাই। সব মানুষ একই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। জয়ধন মুনি ভগবানের লীলা ছেলে দুটির মাঝে খোঁজেন। কিন্তু মা ধরতী বসে নেই। ছেলে দুটি বড় হয়। মুনির ইহধামের সাজা কমে। এখন মুনির চোখ কদাচিৎ খোলে। পানাহারের যন্ত্রনা আর পোহাতে চান না। আজকাল জলটুকু পর্যন্ত মুখে তুলেন না। এভাবে ভবের খেয়া পাড়ি দিয়ে একদিন মাটির ঢেলা মা ধরতিকে ফেরৎ দিয়ে, স্বর্গবাসী হলেন জয়ধন মুনি। মায়ের ভাবনার কারণ নেই। জয়ধন মুনির আশ্রয় এখন আর তার প্রয়োজন নেই। ছেলে দুটি মায়ের খুব দেখা শোনা করে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে তারা বর হচ্ছে। জীবনের সব চাহিদা একাই মেটাতে সক্ষম।

আল্লার আছে মর্জি, খোদার আছে কাম
যাগা বুইজ্যা পইড়া গেছে মালদাইরা আম।

তাদের সোনার সংসার তছনছ করে দিতে এক দিন কামান গর্জে উঠল। বর্ণহীন মানুষ জঙ্গল কেটে মঙ্গল করতে নীল চাষ করল। মা বৃদ্ধা বলে আর "জয়ধন মুনির বর" ছেলেটা চালাক বলে, আদি বাসে ঠাঁই পেল। অন্য ছেলেটা মা ধরতির বুকের মায়া, এই গাছ বৃক্ষ কাটায় বাঁধা দিয়েছিল বলে বর্ণচোরা মানুষ গুলি তাকে দিপান্তর নিয়ে গেল। সেখানে নাকি তাকে লোহার বোঝা বইতে হবে।
আপন ঘরে
লন্ডন হইতে চাইয়া দেখে, মহা সিন্দুর পাড়ে।
আরেক জনা আছে বসে, দিল্লিরও শহরে।
খাটে না তার আইনের বিচার,
আসামে কি কুচ বিহারে,
আপনারে, ধন্য বলি তারে আমি, মানুষ বলি তারে।
আপন ঘরে বইসে যে জন চিনতে পারে আপনারে,
ধন্য বলি তারে আমি, মানুষ বলি তারে।।
জয়ধন মুনির মন্ত্র, তার বর পুত্রের কানে বাজল। বর পুত্র আকূল হয়ে বলল:
ক্রমশ.....


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শেরালী ১ আর দুই কি একই উপন্যাসের দুই চ্যাপ্টার?
দুইটা তো দেখি দুই দিগন্তের কাহিনী

এবং দুটোর কোনোটাকেই চ্যাপ্টার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একেকটা সম্পূর্ণ গল্প

পুতুল এর ছবি

গুরু, শেরালীর দৌড় ঝাপের উঠুন বানাচ্ছি।
মাঝের আর একটা ছোট্ট পর্ব, তার পর মূল ঘটনায় চলে যাব।
পর্ব গুলো এমন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে করিনি্ তবে মূল ঘটনায় গেলে আশা করি সামঞ্জস্য পাওয়া যাবে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

খেকশিয়াল এর ছবি

তৃতীয় পর্বেই আশা করি রহস্য ভেদ হইবেক । চলছে কিন্তু দারুন !


জন্ম দাতায় দিলনা জন্ম, জন্ম দিল পরে,
যখন ছেলের জন্ম হইল, মা ছিল না ঘরে।

অনেক ছোট থাকতে এই ধাঁধাটা শুনি মায়ের মুখে । এই ধাঁধার উত্তরটি ছিল রামের ছেলে কুশ । ওই গল্পে লবকে বাল্মীকি মুনির কাছে রেখে চলে যান সীতা আর পরে লব কে খুঁজে না পেয়ে বাল্মীকি লবের আদলে কুশ কে বানিয়ে রাখেন, আপনি মনে হয় জানেন ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পুতুল এর ছবি

গুরু, স্মৃতি খুব প্রখর, মানতেই হবে। সে ধাধার আশ্রয় নিয়েই লেখা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

আপন ঘরে
লন্ডন হইতে চাইয়া দেখে, মহা সিন্দুর পাড়ে।
আরেক জনা আছে বসে, দিল্লিরও শহরে।
খাটে না তার আইনের বিচার,
আসামে কি কুচ বিহারে,
আপনারে, ধন্য বলি তারে আমি, মানুষ বলি তারে।
আপন ঘরে বইসে যে জন চিনতে পারে আপনারে,
ধন্য বলি তারে আমি, মানুষ বলি তারে।।

চলুক ....
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ গুরু, নতুন লেখা কবে পাব?

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

ইশ, অসাধারণ হচ্ছে! একটা বই হিসেবে পেলে এক টানে পড়ে ফেলা যেতো!! পর্বগুলো আরো বড়ো করতে পারেন। আমার মত কিছু পাঠক কিন্তু আছে যারা বড়ো লেখাও পড়তে ভালবাসে! হাসি

---
স্পর্শ

পুতুল এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

জব্বর হচ্ছে পুতুল। জমাটি আবহাওয়া ঘনীভূত হচ্ছে!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।