শেরালী-আট (দুবলা বনের বাঘ)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: রবি, ০১/০৬/২০০৮ - ৩:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্ষেতে বীজ বোনা শেষ। একটু নীড়ানি দিতে হয়, কাজের মধ্যে, এই যা। হিন্দু পাড়ার সব্জী চাষীরা বাজারে মূলা, ফুলকপি, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, শিম লাউ এসব বিক্রি করছে। তাদের জমি গুলো বেশ উঁচু বলে সবার আগে তাদের জমিতেই এসব ফলে। তবে ব্যাবসায়ও তারা বেশ সফল। রং, দুধ, সোনা এমনকি ধোপা নাপিতের কাজ করেও দিব্যি ভাল আছে। পাড়ার সবাই মিলে দুর্গাপূজোয় গ্রামের সব লোককে নিমন্ত্রন করে । সমস্যা একটাই কলাপাতায় নিয়ে খেতে হয়। আমার কাছে ওদের খাবার খুব ভাল লাগে। তারপর পূজা মন্ডপের সামনে রাতভর কীর্তন হয়। গ্রামটা মেতে থাকে সে কয়টা দিন। অবশ্য এবছর দূর্গাপূজা আসতে অনেক দেরী। হিন্দু পাড়ায় পালবাড়ীর লোকেরাই খুব শিক্ষিত। গৌরাঙ্গ সরকার হাই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন ,গান্ধী পন্ডিত। ছেলেমেয়েরা সবাই বি এ, এম এ পাস। সরকারী চাকুরী করে। ছোট মেয়েটি বাবার সেবা আর গৌরাঙ্গ সরকার হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে। খুব অমায়ীক মানুষ এরা। এক কালে জমিদারী ছিল। তার চিহ্ন এখন রাজ বাড়ীর মত পাকা দালানের আলিশান বাড়ী। অযত্নে অবহেলায় বাগান বাড়িতে আম, জাম, কাঠাল গাছ ছাড়া আর সব আগাছা। বাড়ীর কাচারির প্রবেশ পথের ধারে তুলসীর ঝোপে একা দাড়িয়ে রাজত্ব করছে রক্ত জবার গাছটা। মনে হয় রক্ত জবা, কলার মত বারো মাসী ফুলের গাছ। সব সময় টকটকে লাল রক্ত জবা ফুটে থাকে। ঠাকুর মশাই কামানো মাথার এক গুচ্ছ চুলে একটা রক্ত জবা ঝুলিয়ে পূজোয় বসেন। আমার দেখে হাসি পায়। কিন্তু প্রসাদের লোভে চেপে যাই। এ বাড়ীতে নাকি পৃথিবীর সব ফুল পাওয়া যেত এক সময়! তাদের শেষ চিহ্ন এখন অবহেলায় বেড়ে উঠা দূর্বা ফুলের ঝোপ!

দিন কয়েক হল, শেরালীর ভাগ্যে একটা ছাগল জুটেছে; ভাগী ছাগল। লালন পালন করে বাচ্চা দিলে একটা বাচ্চা রেখে মা সহ অন্য বাচ্চা গুলোর সাথে ছাগল মালিককে ফেরৎ দিতে হবে। রোদের তাপ বেশী দেখে পাল বাড়ীতে এসেছে শেরালী। কলের পানি খেয়ে প্রাণ,আর গাছের ছায়ায় বসে শরীর জুড়াবে। কিন্তু ছাগলটা খুটা ছিঁড়ে,পাশের চিনা ক্ষেতে মুখ দিয়েছে। জমির মালিক দেখলে সর্বনাশ। দৌড়ে ছাগলের পিছু পিছু ছুটছে সে। রেল সড়কের পাশের নালায় কচুড়ী পানা,মানুষ সমান ঊঁচু। ছাগল সব খায়; হয়ত কচুড়ী পানাও খাবে। তাই এখন ছাগল নিয়ে সেদিকটায় যাচ্ছে সে। ছো মেরে বাজ পাখিটা, কাওন ক্ষেতের পতঙ্গ ভক্ষনে ব্যাস্ত শালিকটা ধরে আবার আকাশে ডানা মেলে দিল! আকাশের দিকে চোখ যেতেই উড়ন্ত শকূন গুলো দেখতে পেল শেরালী। ট্রেনের ধাক্কায় মরা কোন কুকুর বা বিড়ালের গোস্ত খেতে এসেছে শকুনের পাল।
কি করে শকূন গুলো মরা পশুর শরীর থেকে মাংশ ছিঁড়ে খাচ্ছে, সে দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল শেরালী। রেল সড়কের পাশে পায়ে চলার পথ আছে। অনাশংকায় সে পথে হাটা যায়, ট্রেন চলাচলের সময়ও। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে সংক্ষেপে হাঁটে যাবার পথ। সাধারণত গাঁয়ের লোকেরাই ব্যাবহার করে। এ পথে শহরের পোশাক পড়া মানুষ দেখে একটু অবাক হল সে। তাও আবার এক- দু'জন নয়। শত নাকি সহস্র! শেরালীর গুনে দেখার উপায় নেই। নিরবে নিঃশব্দে, মিছিলের লোকের মত মৌমাছির ঝাঁক বেঁধে নয়, পিঁপড়ের মত একজনের পেছনে একজন হেঁটে আসছে। শেরালীল অবাক হবার পালা শেষ না হতেই একজন বলল;
এই খোকা! এখানে কাছে কোথাও কোন কল আছে?

এ নামে আজও কেউ ডাকেনি তাকে। অবাক শেরালীর হা করা মুখের দিকে, স্নেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে একজন বলল: খোকা ভয় পেয়না, আমরা শহর থেকে এসেছি, খুব পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খেয়ে আবার চলে যাব।
সাহেবদের স্নেহ মাখা কথা শেরালীর খুব ভাল লাগল। ছাগলকে কচুড়ীপানায় মুক্ত করে, পিপাসিত মানুষগুলোকে পানি খাওয়াতে সে নিয়ে গেল পালদের বাড়ী। কল চাপার চেষ্টা করতে দেখে একজন বলল: তুমি ছোট মানুষ খোকা, কষ্ট হবে;আমিই চাপছি।

নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করল। কিছু বোঝা গেলনা। তবে শহরে গত কাল রাত থেকে অনেক গোলাগুলি এবং এতে অনেক লোকে মারা গেছে বলে মনে হল। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একজন বলল; যুদ্ধে যাচ্ছি কবে ফিরব কে জানে! তবে এসব শিশুরা যেন,একটা মুক্ত স্বাধীন দেশে, স্বাধীন ভাবে বড় হয়।
ক্রমশ...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা বেশ সাবলিল। মনে হচ্ছে একটা জমজমাট উপন্যাস পেতে যাচ্ছি।

কীর্তিনাশা

পুতুল এর ছবি

কীর্তিনাশা, ভাই অনেক অনেক ধন্যবাদ!
এ পর্বটা ঘটনা বহুল নয়, পরের পর্বে শুরু হবে...

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

আপনার বর্ণনা এত জীবন্ত! ছোটবেলায় দেখা নানাবাড়ীর হিন্দুপ্রধান গ্রামটাকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। রায়বাহাদুর-বাড়ীর পূজা, হেডমাস্টার মানুবাবু...
প্রথম শীতের সদ্যতোলা সব্জির গন্ধও পেলাম।
অসাধারণ!

পুতুল এর ছবি

নুশেরা তাজরীন,
আমার বলাটা আপনার দেখা গ্রাম বাংলার সাথে মিলেছে শুনে বণর্নাটা সার্থক হল। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

এনকিদু এর ছবি

খুব ভাল লাগছে । গল্পটা ধীরে ধীরে অতীত পার হয়ে তার বর্তমানে এসেছে । সময়ের এই পথচলাটা সুন্দর করে তুলে ধরেছেন আপনি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

পুতুল এর ছবি

এনকিদু, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খুব কাছে থেকে সব কিছু লক্ষ্য করেছেন। আশা করি বাকী পর্বগুলোতেও এ ভাবে সাথে থাকবেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

যথারীতি ভাল লেগেছে।

বর্ণনা পার্ফেক্ট!! হাসি

[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

ভাই সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

ঠিক কথা, ভাবতেছিলাম - ঘটনা কই? তারপর বুঝলাম - সামনে খেলা আছে - মাঠ তৈরি হয়ে গেছে। আপনি এই রকম বর্ণনা কেমনে দ্যান? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া এ বর্ণনা অতিশয় দুঃসাধ্য।
যতটুকু খেয়াল করেছি, আজকাল 'বাড়ী', 'অমায়ীক', 'চাকুরী' এই শব্দগুলো হ্রস্ব 'ই'কার দিয়েই লিখছে অনেকেই। আপনি ভেবে দেখতে পারেন বিষয়টা। আপনার আগের লেখাগুলো এখোনো পড়ে শেষ করতে পারি নাই। তবে শেষ করে ফেলবো দ্রুত।
লেখা খুব যে ভালো লেগেছে একথা নতুন করে আর কী বলবো, মানে দুর্দান্ত হচ্ছে। তবে যতই পরিণতির দিকে এগোবেন, সাবধান, বাঁধন কোনোক্রমে ঢিলে হতে দেবেন না। Take time but no compromise. আপনার জন্য একান্ত শুভ কামনা। শুভ কামনা শেরালীর জন্য। সামনে যুদ্ধ। ছেলেটার জন্য কেন জানি দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ " মাটি-মানুষের" কবি।

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

তাই এখন ছাগল নিয়ে সেদিকটায় যাচ্ছে সে। ছো মেরে বাজ পাখিটা, কাওন ক্ষেতের পতঙ্গ ভক্ষনে ব্যাস্ত শালিকটা ধরে আবার আকাশে ডানা মেলে দিল! আকাশের দিকে চোখ যেতেই উড়ন্ত শকূন গুলো দেখতে পেল শেরালী। ট্রেনের ধাক্কায় মরা কোন কুকুর বা বিড়ালের গোস্ত খেতে এসেছে শকুনের পাল।
কি করে শকূন গুলো মরা পশুর শরীর থেকে মাংশ ছিঁড়ে খাচ্ছে, সে দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে রইল শেরালী।

একেবারে জীবন্ত করে তুলেছেন চিত্রকল্প। লেখকের জন্যে শুভকামনা...!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

আগের সব পর্ব পড়েছি , এটা পড়লাম । লেখা ভাল হচ্ছে ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

শাহীন হাসান এর ছবি

একটু বিলম্বে হলেও পড়লাম, ভাল-হচ্ছো, পুতুল।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ শাহীন ভাই!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

ইরতেজা এর ছবি

হায় হায় আমি পুরো সিরিজটাই মিস করেছি। প্রথমেই আট থেকে পড়া শুরু করেছি । যাই হোক সময় করে আগের লেখাগুলো পড়ছি। চলুক। খুব ভালো লাগছে তোর উপন্যাস পুতুল বেগম...
____________________
ত্রসরেণু অরণ্যে

_____________________________
টুইটার

অতিথি লেখক এর ছবি

মনে হচ্ছে কাহিনী উড়াল দেবে। আস্তে ধীরে পাখা ছাড়াচ্ছে।
সঙ্গে আছি আমিও।
-জুলিয়ান সিদ্দিকী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।