শেরালী-চৌদ্দ (তাদের স্মৃতির চরণে)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ১২/০৬/২০০৮ - ৪:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভৈরবী রাগের আলাপের মত, যার শুরুটা হামিং দিয়ে হয়, এমন নিবিষ্ট নিবেদনে অভীষ্ট দেবতার নাম ভজন করলে, সারা মিলতেই হবে! ভ-জ-ন এই একটি শব্দেই পুরোটা গান অনেকক্ষণ ধরে চলছে। পূর্ণিমা রাতে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো হাজার তারার বাতিকে ম্লান করে দেয়নি। সাতমৌজার বিলে চন্দ্রমুখী পদ্মরা রুপোর কৌটোয় স্মৃতির মোম হয়ে কার স্মরণের শায়রে ভাসছে!

সোনার বাংলা যাত্রা পালার রিহার্সেলে এতদিন গ্রামটা মুখর ছিল। বিজয়ী বীর মুক্তি যোদ্ধারা অনেকদিন রিহার্সেল দিয়ে যাত্রাপালার শেষ অভিনয়টুকু শেষ করে দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়েছে। বেশীর ভাগ মুক্তি যোদ্ধাই ছাত্র। তাই লেখাপড়ায় ফিরে গেছে।
মুক্তির আনন্দে স্বাধীন বাঙ্গালী যুদ্বোত্তর সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট মনোযোগী। সংশয়াকূল গৃহবধুরা বাটনা বাটার শিল পাটায় জলভর্তি কাসার বদনা, কাঁদায় লেপে, বদনার কান্দা ধরে উঁচু করে দেখেছে, শিলপাটা বদনার সাথে উঠে আসে। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। উক্ত পরিক্ষায় তা প্রমান হয়ে গেছে।
পাল বাড়ি স্বাধীনতার আগেই পুড়োটা খালি পরে থাকত। সে বাড়ীর সবাই খুব শিক্ষিত এবং সে কারণে ভাল চাকরীর সুবাদে শহরেই থাকে। গান্ধী পন্ডিত, আনন্দের সাথে গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের জায়গা করে দিলেন নিজ বাড়ীতে। গ্রামের লোকের অনুরোধে প্রাথমিক দেখাশনার দায়ীত্বও নিলেন।
যখন সবাই নমিতাকে স্কুলের শিক্ষিকার দায়ীত্ব নিতে বললেন, তখন গান্ধী পন্ডিত একটু অন্যমনস্ক হলেন। বললেন; আমি নমিতাকে আপনাদের কথা জানাব।গান্ধী পন্ডিত নমস্কার জানিয়ে উঠে গেলেন।

নমিতা দুই ছেলে বিরেশ্বর আর অসীমকে নিয়ে, বাবার পিঁড়াপিঁড়িতে, স্বামী ভজনকে সাথে না নিয়েই, আত্মীয়ের কাছে, কোলকাতায় চলে যান। সেটা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগের কথা। গান্ধী পন্ডিত কোলকাতায় যান, ঘর-বাড়ী তালা দিয়ে মার্চের মাঝামাঝি। ভজন গান্ধী পন্ডিতের সাথে দেখা করে, নমিতার জন্য হাত খরচের কিছু টাকার সাথে একটা চিরকুটও দিয়েছিল।

মিতা,
ভালবাসা নিও। দেশটা নিরাপদ করতে না পেরে, তোমাদের নিরাপদে রাখতে, শরনার্থী করে কোলকাতায়, পরবাসী করলাম। ওরা আমাদের আত্মীয়, কিন্তু আমরা বিপদে পড়ে ওদের আশ্রয় প্রার্থী। ওদের আমন্ত্রন রক্ষার্থে সেখানে যাচ্ছি না, কথাটা মনে রেখ। তা ছাড়া কতদিন থাকতে হবে তাও জানিনা। কাজেই জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ীতেই উঠো। খুব প্রয়োজন না হলে দাদা-বৌদীদের কোন প্রকার সাহায্য, সহানুভূতি গ্রহন করো না।

আমার কেন জানি মনে হয় এবার একটা ওলট পালট হবেই। কে জানে হয়তো বিরেশ্বর আর অসীমকে নিয়ে তুমি বঙ্গবন্ধুর ঘোষনা অনুযায়ী মুক্ত-স্বাধীন সোনার বাংলায় ফিরে আসবে। আমাদের সন্তানদের স্বাধীন দেশে মানুষ করতে হলে, আমাকে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

ডাকাত দুটোকে দিন কয়েক একা সামলাও। সময় হলে আমি নিজে তোমাদের আনতে কোলকাতায় যাব। জ্যাঠামশাইকে নমস্কার দিও।

তোমার কার্তিক

১৭ই মার্চ ১৯৭১

নমিতার কাছে ভজনের লেখা আর কোন চিঠি নেই। কেন যে নমিতা রাগ করে এ চিঠি ছিঁড়েনি! একটা কোন ভালবাসার ছিটে ফোঁটাও এ চিরকুটে নেই। ইচ্ছে করেই রেখে দিয়েছিল। দেখা হলে ভজনকে খোঁটা দেবে। বঙ্গবন্ধু তোমার শ্বশুর? তার ডাকে বউকে দুটো ভালবাসার কথা বলতে ভুলে গেলে!

কিন্তু আজকাল অভিমানের জায়গাটা আশংকায় ভরে গেছে। কেন যেন আর জোর পাচ্ছে না। সব মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এল। শুধু ভজনের কথাই কেউ বলতে পারে না।

বলার মত এক ফকিরের সন্ধান পেয়ে, তার পড়াপানি আউশের ক্ষেতে ছিটিয়ে স্বপন কোমর পানিতে নেমে ভজনের নাম ধরে ডাকছে। সে ডাক ভৈরবীর ভজনের মত নিশিথ রাতে গাঁয়ের লোকের কানে বাজছে। যদি ভজন বেঁচে থাকে তবে সারা দেবে। ভজনের সারা না পেয়ে সবাই ভাবে হয়তো ফকিরের কোন নিয়ম ভুলে গেছে। আগামী পূর্ণিমায় আবার ডাকার আগে, ফকিরের নিয়মগুলো আর একবার ভাল করে জেনে আসবে, স্বপন।
অনেক সময় ভাবে; জৈষ্ঠের জলের মিলনকামী মাছের মত জোয়ারের জলে ভেসে বিজয়ীর বেশে ভজন যদি আজই আসে, আর দেখে; মঙ্গল সুত্র আর লাল সূর্যের মত সিঁদুরের টিপ নমিতার কপালে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে না। তাহলে নমিতা লজ্জায় মরে যাবে।

তাই, আজো সিঁদুরের টিপ, অস্তরাগের রক্তলাল সূর্য হয়ে, আগামীর প্রতীক্ষায় নমিতার ললাটকে বাংলার রক্তিম আকাশ করে রেখেছে।
ক্রমশ...


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

জৈষ্ঠের জলের মিলনকামী মাছের মত জোয়ারের জলে ভেসে বিজয়ীর বেশে ভজন যদি আজই আসে, আর দেখে; মঙ্গল সুত্র আর লাল সূর্যের মত সিঁদুরের টিপ নমিতার কপালে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে না। তাহলে নমিতা লজ্জায় মরে যাবে।

তাই, আজো সিঁদুরের টিপ, অস্তরাগের রক্তলাল সূর্য হয়ে, আগামীর প্রতীক্ষায় নমিতার ললাটকে বাংলার রক্তিম আকাশ করে রেখেছে।

সুন্দর! খুবই সুন্দর!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবা গুরু।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

সুন্দর! খুবই সুন্দর! আর কি বলবো!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পুতুল এর ছবি

কীর্তিনাশা, ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্পর্শ এর ছবি

কেমন হইসে এইটা আর বলব না! মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। খালি অভিযোগ করবঃ

পর্ব ছোট হইসে!! এই স্পিডে লিখলে উপন্যাস শেষ করতে করতে সবাই মারা যাবো !! মন খারাপ
বড় করেন মিয়া!!

....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পুতুল এর ছবি

আপনার আগ্রহেই হয়তো লেখাটা এক সময় শেষ করতে পারব। টাইপ করতে হয় এক আঙ্গুলে। একবার চাবির ছক একবার মনিটর করে করে লিখতে অনেক সময় চলে যায়।
পরের ার একটা পর্ব এমন ছোট হবে। তার পর দেরীতে হলেও বড় পর্বই দেব।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

Pagol mon এর ছবি

.... বেশ ছোট করেছেন লেখা ! মন ভরলনা ...

" ... মঙ্গল সুত্র আর লাল সূর্যের মত সিঁদুরের টিপ নমিতার কপালে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে না। তাহলে নমিতা লজ্জায় মরে যাবে। ......তাই, আজো সিঁদুরের টিপ, অস্তরাগের রক্তলাল সূর্য হয়ে, আগামীর প্রতীক্ষায় নমিতার ললাটকে বাংলার রক্তিম আকাশ করে রেখেছে। " -

- যথারীতি চমৎকার ....

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ পাগল মন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

এভাবে যে কত নমিতারা প্রতীক্ষার সাঁকোতে দাঁড়িয়ে
কাটিয়েছে কাল। গিয়েছে যৌবন, এসেছে বার্ধক্য
তবুও য়ে ফুরালো না তার পথ চাওয়া। মৃত্যুর
আহ্বান তাকে বলে যায়- চলো সে আছে তোমার
প্রতীক্ষায়...
.
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

জুলিয়ান সিদ্দিকী, ধন্যবাদ। দুর্ভাগ্রক্রমে তাদের দুর্দষার কথা খুব বেশী বলা হয়নি।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

আজো সিঁদুরের টিপ, অস্তরাগের রক্তলাল সূর্য হয়ে, আগামীর প্রতীক্ষায় নমিতার ললাটকে বাংলার
রক্তিম আকাশ করে রেখেছে।

সুলিখিত। খুব ভাল হয়েছে, ভাল-লাগলো, পুতুল।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ গুরু।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

আবারও বলতে হচ্ছে- পুরো পর্বই উদ্ধৃতিসহ প্রশংসার দাবী রাখে।

পুতুল এর ছবি

নুশেরা তাজরীন, কেকটা কৈ? পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।