উত্তুইরা হলট

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বুধ, ১৮/০৬/২০০৮ - ১১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চানপুইরা হানকি-ত তিন হানকি ভাত খালি হুলারা-মইচ (শুকনো কাঁচা মরিচ) দিয়াই আরুইব্বা কেরাইয়া (মাঝি) খায়। হের লগে আইজ হিদল-হুটকির বর্তা। পাঁচ হানকি ভাত খাইয়া, হানকি ধোয়া পানি-ত কুলি কইরা আরুইব্বায় হুক্কা ধরায় টিক্কা দিয়া।

গুড়গুড়াইয়া হুক্কা টানতে টানতে আরুইব্বার নিজেকে বড় একা লাগে। মনে হয় যদি এসময়ে কেউ পাশে থাকতো! আরুইব্বার ঘর-বাড়ি এই ছইয়া ওয়ালা ডিঙ্গি। গাঙ্গের পারে বসত ছিল, আরুইব্বার কৈশোরে। মাঝি-মাল্লার কাম আরুইব্বাদের রক্তে, সেই ছোটবেলা থেকেই। রঘুনাতপুর বাজার থেকে গস্তি নাওয়ে মাল বোঝাই করে, রামচন্দপুর বাজারে পৌঁছে দিতে এক হপ্তা লেগে যেত। এমনই এক হপ্তার ক্ষেপ দিয়ে এসে পরিবারের অন্য সব সদস্যদের সাথে বাপ-দাদার ভিটে-মাটিও আর পায় না আরুইব্বা। রাইতের হোয়ারে সব গাঙ্গের পেটে গেছে। সেই থেকে আরুইব্বার বসতবাটি জলে ভাসা ডিঙ্গি।

নিজের বাড়ির উপর পারা কুইপ্পা আরুইব্বা রাত পার করে। সহায় সম্বল বলতে এই ডিঙ্গি। তো এমন নাদানের কাছে মেয়ে দেবে কোন পাষান বাপে! আরুইব্বা বিয়ের চলন, নাইওরী আনা, বেড়াতে যাওয়া এবং মালটানা এ সবই করে। কিন্তু সিনা দিয়া তুহান ঠেকাইতে পারে এমনি বুকের পাটা। তাই আগে থেকে বায়না না করলে আরুইব্বাকে পাওয়া কঠিন।

এ তল্লাটে আরুইব্বারে চেনে না এমন মানুষ খুব বেশী পাওয়া যাবে না। অনেক রুগী বা লাশও আরুইব্বার ডিঙ্গি চড়ে হাসপাতাল বা গোরস্থানে গেছে। মালের চালান চলনদারের হাতে দিয়ে, চাল আর রাব নিয়ে রান্না, তামাক কাটা-মাখা ঘাটেই করেছে। কিন্তু খাবে ঠিক বাড়ি এসে; মানে যেখানে বাড়ি ছিল।

গুড়গুড়িয়ে হুকু টানতে টানতে ছইয়ের ফাঁক দিয়ে বাইরের জোৎস্না দেখে আরুইব্বার মনটা কেমন করে উঠে। মনে পরে যায় অনেক দিন আগে কোন এক পরিবারের মাঝি হয়ে বেড়াতে যাবার কথা। সে রাতটাও এমনি জোছনায় প্লাবিত ছিল। তখন আরুইব্বার উঙ্কুর কাল।

প্রতিবেশী পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া:
স্বামী: হেগ গরে মেজন (মেহমান) আইছে, তুই ঠাট করি বইরইছত কিল্লাই?
স্ত্রী: আন্নে এক্কান কতা কইলেন, আঙ্গ বাইত মেজন আইছে। হেরা বেকতের মেজন। আন্নের হালান গামছা হিন্দি (পরা) মেজনের কাছে জাইয়াম?
স্বামী: ছিনাইল্যা মাগীর কতা হোন! কাহরের (শাড়ীর) তলে ছায়া (পেটিকোট) হিন্দি, সিনার উরফে তুলা বান্দি বুজি, মেজনের খেদমত করন লাগে?
স্ত্রী: আন্নে এগুন কি কন! ছায়া আর বেক জিনিস আন্নে আরে আইন্না দিছেন। আই হিন্দি দোষ কইচ্চি?
স্বামী: না, আন্নে হেগুন হিন্দি সিনা টান করি বেগানা বেডাগো দেহাইবেন, আই জুইত করি চাই থাহুম। আন্নেরে শাদি করি আই দোষ কচ্চি, আন্নে কতা বেশী কইয়েন্না। আন্নেরে আই রাইকতান্নো।

এতক্ষন ইমাম সাহেব চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এবার মৌনতা ভাঙ্গতেই হল। স্বামীর "আন্নেরে আই রাইকতান্নো" এ বাক্যে স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। এখন যতদ্রুত সম্ভব স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করতে না পারলে অনাচার ঠেকানো দায়। পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যস্থতায় শরীয়তমত এক রাতের হিল্লার ফতুয়া ,ইমাম সাহেব বয়ান করলেন।

এখন হিল্লার লোক পাবে কোথায়? অনেক খোঁজা-খুঁজির পর সবাই আরুইব্বাকে হিল্লার উত্তম সমাধান ভাবলেন।

আরুইব্বা কোন অবস্থাতেই হিল্লা হতে রাজি নয়। একটা নতুন লুঙ্গি আর জামাইর আদরে আরুইব্বার মন নরম হল। শর্ত একটাই, সকালে শরীয়ত মত তালাক দিতে হবে। যাতে স্ত্রী সুখে -শান্তিতে আগের স্বামীর ঘর করতে পারে। এ আর এমন কি! আরুইব্বা রাজি হয়ে গেল।

বিপত্তি ঘটল বাসর নিয়ে। আরুইব্বা শরীয়তমত মহিলার স্বামী। স্বামী-স্ত্রীর মত একবিছানায় রাত্রি যাপন করতে হবে। আলাদা ঘর না পেয়ে আরুইব্বার ডিঙ্গিতেই বাসর করার সিদ্ধান্ত হল; বাড়ি থেকে ক্ষানিকটা দূরে, ডিঙ্গি, আমনের ক্ষেতের আইলে পারা দিল আরুইব্বা। লাজ নম্র নব বধূর মত, ছৈ-এর ভেতর গুটিশুটি বসে আছে বউ। আরুইব্বা কি করবে বুঝতে না পেরে ফাঁপর কাটাতে নতুন লুঙ্গির সাথে উপহার পাওয়া বিড়ির প্যাকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের সাহায়্যে একটা বিড়ি ধরায়।
কৌতূহল বসে বধুটি ছালার চট সরিয়ে আরুইব্বারে এক নজর দেখতে চায়। গলুইয়ে বসে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে আরুইব্বা ছৈয়ের ভেতর উঁকি দিতে উদ্যত। আর এমন সময় জোছনার আলোয় বধূর মিষ্টি মুখটি আরুইব্বার হৃদয়ে হয়তো আজীবনের জন্য গাঁথা হয়ে যায়।

সাহস করে বউ জিগায়: আন্নেগো বাড়ি কোনায়?
আরুইব্বা কয়: উত্তুরে।
বউ: আন্নে হুইতেন্নো?
আরুইব্বা: আইরাম।
আরুইব্বার ডিঙ্গিতে তেলচিটচিটে একটা কাঁথা আর একটাই বালিশ। সে কথা ভাববার সময় আরুইব্বা পায়নি। অন্য করোও মনে হয়নি। কাঁথা বালিশ জুড়ে বউটি শুয়ে আছে। একান্তই দয়া পরবশ হয়ে বউ আরুইব্বাকে এক পাশে একটু জায়গা করে দেয়। কাঁথার খানিকটা নিজের দিকে টানতেই বউয়ের উরুর সাথে আরুইব্বার শিশ্নর ঘষা লেগে যায়। লেজে পা পড়া সাপের ফনার মত খাড়া হয়ে গেল আরুইব্বার অংগ। সেটা লুকোতে আরুইব্বা বধূর থেকে একটু দূরে সরতে চেষ্টা করে। বধূ ভাবে আহা, আমার জন্য মানুষটির কত কষ্ট হচ্ছে! যাইনা আমিই বরং একটু কাছে এগিয়ে।
আর বধূর সেই এগিয়ে আসাটাই হল আরুইব্বার কাল। জীবনে প্রথম মিলনের তৃপ্তি হজম করতে আরুইব্বা আবার বিড়ি ধরায়। বধূ ভাবে হবে বোধ হয় আরেক "হলট"!
হলটের পর হলটে রাত্রি শেষ। এক রাত্তির সংসার ভাঙ্গতেই বোধ হয় মুয়াজ্জ্বিনের আযান ধ্বনিত হয়। আরুইব্বা আর একটা বিড়ি ধরায়। সেটা দেখে বউ ভাবে অরেক হলট দেবে নাকী! জড়তা অনেকটা কমে গেছে বলেই নিজে থেকে জিজ্ঞেস করল: আরেক্কান হলট দিবেন্নি? আন্নেগো উত্তুইরা হলট গুন আর কাছে খুব মজা লাগে। আন্নে আরে ছাইড়েন্নো!


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

আপনের লেখা পড়ি আর টাশকি খাই, উপন্যাসটা পরে দিয়া আর পড়া হইতাসে না, পড়তে হইব ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ শেয়াল পন্ডিত।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

দ্রোহী এর ছবি

ওরে রে.................................................................

সিরাম একটা উত্তুইরা হলট হইছে!!!!!!!!!!!!!!!!

পুরা আগুন লেখা!!




কি মাঝি? ডরাইলা?

পুতুল এর ছবি

দ্রোহী ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

হিল্লার ফতুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের সমাজে। আরুইব্বাদের সামান্য হলেও দুঃখমোচন হবে। তৎসঙ্গে আরুইব্বার একরাতের বউয়ের মত কারো কারো "হাওয়া" ( সূত্র: দ্রোহী) বদল ঘটবারও সুযোগ মিলবে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

আমিও তাই কই।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

আকতার আহমেদ এর ছবি

জটিল লিখছেন তো ! দুর্দান্ত গল্প !

পুতুল এর ছবি

আকতার আহমেদ ভাই ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্নিগ্ধা এর ছবি

সবচাইতে ভালো লাগলো আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। স্বামী স্ত্রীর কথোপকথন পড়ে মনে হলো যেন শুনতে পাচ্ছি!

পুতুল এর ছবি

খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ স্নিগ্ধা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

ধুসর গোধূলি এর ছবি
পুতুল এর ছবি

এই লাও গুরু, সিদ্ধি খাইলে বুদ্ধি বাড়ে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

গুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লিগুল্লি

এই গল্পের জন্য বিলাইর গুলি ছাড়া আর কিছু দেওয়ার নাই। আরেকটা গুলি টেরাই কইরা দেহি অয় কিনা।

auto

----------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পুতুল এর ছবি

গুল্লিতে বুক ঝাজড়া হইয়া গেল। গুলির জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অমিত আহমেদ এর ছবি

দুর্দান্ত গল্প।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

পুতুল এর ছবি

অমিত আহমেদ অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

রানা মেহের এর ছবি

অতি চমতকার গল্প পুতুল।
আপনার শেরালী টা পড়ছি না আপাতত।
পুরোটা শেষ হলে একেবারে পড়বো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

পুতুল এর ছবি

রানা মেহের, ঠিক আছে। পুরোটা শেষ হলে যে কোন উপায়ে এক সাথে দেব। গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

আসলেই আগুন লেখা, আগুন গল্প! সাবাস পুতুল!

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।