মেয়েছেলে গুলোর কাজ নেই। ঘরদোর লেপা-পোছা করে মন্দির বানিয়ে রেখেছে। বেশীর ভাগ ঘরেই ফসলের সব রকমের কাজ শেষ। নিজেদের খোরাকীর টানেই অনেক গৃহস্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, কাজের লোক রাখার বাড়তি বাহুল্য এখন কেউই করতে চায় না। হুরুনি জাউরা মাইয়া মায়াকে নিয়ে, বিলের শুকিয়ে যাওয়া অংশে গোবর কুড়াতে যায়। গোবরের সাথে মাটি মিশিয়ে ঘরের পাট খড়ির বেড়া লেপে। গোবরের গুটি বানিয়ে রোদে শুকায়, বর্ষায় জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারের জন্য। চাতকের চোখে বৃষ্টির আশার সাথে এদের সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তবুও বৃষ্টি আশায় মেঘ-খেইলের আয়োজনে নামে হুরুনী। জম্বিলার মা, কাসেমের মা, দৌলতের বউ মাটির কলসিতে ভরে পানি এনে "আল্লা মেঘ দে" গায়কীদের গায়ে ঢেলে উঠুন আর শরীর ভিজিয়ে কী মজা পাচ্ছে কে জানে! এসব আয়োজনের একটাই উদ্দেশ্য; কিছু চাল যোগাড় করা। অবস্থাপন্ন বাড়িতেই তাদের গলা ভাল খোলে। সেখানেই দুমুঠো চালের আশা করা বৃথা নয়। কিন্তু দিনান্তের সঞ্চয়ে চালের পরিমান দেখে ভাত রান্নার বদলে খিচুরী রান্নার সিদ্ধান্ত নিতে হল। তাতে লাউ আর টেহামান্কি পাতার সাথে ঘাগড়া শাক যোগ হয়। খাবারের পরিমানটা একটু বাড়ে। এসব খাবার তাবারুকের মত, সবাই মিলে খেতে হয়। কাউকে ফেরানো যায় না। এখন পাতের সংখ্যা ভাতের তুলনায় বেশী। তাই সব দিক থেকে খিচুরীই ভাল। যদিও তাতে ডালের পরিমান ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বড়জোর সব্জি জাউ বলা যায়। তাই বা কম কী, অনেক দিন পর চাল দিয়ে রান্না দুঠো শক্ত কিছু পেটে পড়বে। পাড়ার সবাই মিলে এতক্ষন হৈচৈ-এ মেতেছিল বলে হুরুনী মায়ার কথা ভূলে গেছে। মাজুর মা আস্বস্ত করে বলল; মায়া-কে "মেঘের নামাজের" প্যান্ডেলের কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখে এসেছে।
মেম্বারের ক্ষেতে বাদাম টাঙ্গিয়ে নীচে খড় বিছিয়ে লোকের বসার ব্যবস্থা হয়েছে। খুব বড় সাইজের একটা চেয়ারের নীচে দুটো বাঁশ বেধে পালকী-র মত একটা কিছু তৈরি করেছে মেম্বারের লোকেরা। আগে পাছে দু'জন করে মোট চারজন মানুষ জৈনপুরী পীরের আসন পীর সহকারে, কাধে করে প্যান্ডেলে এনে অতি যত্নে মঞ্চের মত পাতা একটা চৌকির উপর রাখল। পীর সাহেব মানুষের কাধে ভর করে এতপথ এসেছেন! আহা কী ক্লান্তি! মেম্বার নিজেই মানুষ সমান উঁচু পাখাটা নাড়তে লাগল। পীর সাহেব আসন ছেড়ে নামলেন। তিনি ওজু করবেন।
জৈনপুরী পীরদের এমন বুজুর্গী লোক মুখে প্রচলিত যে, মেঘের নামাজের মোনাজাত শেষ না হতেই বৃষ্টিতে নামাজীরা ভিজে যায়।
পানিতে চিনি মিশিয়ে, তাতে লেবুর রস দিয়ে বড় হুজুরের জন্য সরবত তৈরী হল। কিন্তু সরাবান্তহুরা যাদের পরকালে নিশ্চিত, তাদের মুখে লেবুর সরবত তেমন তৃপ্তিদায়ক নয়। একচুমুক দিয়ে হুজুর আসনে এসে বসলেন।
এর মধ্য অনেক মাতব্বর বিড়ি ধরিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষাকে বিড়ির মত টেনে টেনে ছোট করতে চাচ্ছিলেন। সেটা হুজুরের চোখে পরেছে। বেয়াদবীর জন্য তওবা করতে হবে। নামাজের আগে পাপের ফল এ খরার অনিষ্ট আল্লাহ মানুষের হেদায়তের জন্য দিয়েছেন। একে খরা না বলে আল্লাহর নেয়ামত হিসাবে দেখাই উত্তম। এতে ঈমান পোক্ত হয়।
হুজুরের খাওয়ার জন্য মেম্বারের বাড়ীতে একটা খাসী জবাই হয়েছে। গ্রামের মোল্লা খাসী জবাই করে আবার হুজুরের আসরে মন দিয়ে দীনের কথা শুনে নিজের এলেম বৃদ্ধি করতে গেলেন। কয়েক জন লোক খাসীর চামড়া ছাড়াতে ব্যস্ত। এর মধ্যে খাসীর রক্ত জমাট বেধে বেশ শক্ত হয়েছে। মায়া কোন প্রকারের বুজর্গীর ধারে কাছে না গিয়ে খাবার যোগ্য কিছু খুঁজছিল অনেকক্ষন ধরেই। অধোবদনে ক্ষুধার কথা জানালেই হুরুনী চৈতালী লাউয়ের মত চুপসে যাওয়া বুনি (স্তন) মায়ার মুখে পুরে দেয়। কিন্তু তা থেকে দুধ বের হয় না। মেয়েটার পেট দেখে মনেই হয়না যে, সে পেটে খাবারের জায়গা আছে! সরু সরু হাত-পায়ের উপর পেট আর মাথাটাই শুধু দেখা যায়। এক ফাঁকে মায়া খাসীর মাংসের কাঁচা গন্ধে সে দিকটায় উঁকি দেয়। দা ছোঁড়া দিয়ে মাংস কাটা দেখে মায়া একটু ভয় পেল? কৌতূহল ভয়ের চেয়ে শক্তিশালী বলেই বোধ হয় মায়া অন্যপাশটায় একটু চোখ বোলায়। খাসীর লাল টকটকে রক্ত জমাট বেধে একটু কালচে হয়ে গেছে। অনেকটা হজলু গাওইল্যার শিশি-বোতল, প্লাস্টিকের ছেড়া-ফাড়া জুতোর বিনিময়ে পাওয়া "কটকুডি" মিঠাই-এর মত। মায়াদের বিনিময়যোগ্য কিছু নেই বলে "কটকুডি" মিঠাই কখনো খাওয়া হয়নি। এখানে এক সাথে এত্তগুলো "কটকুডি" মিঠাই দেখে মায়ার জিবে জল আসে। পৃথিবীর কোন কোন জিনিসের উপর মায়ার কোন অধিকার নেই, তা মায়া এখনো শেখেনি। মায়ার আগ্রহকে বার বার প্রতিহত করে তাকে পৃথিবীর নিয়ম শেখাতে হয়। কোন বাঁধা না পেলে মায়া মনে করে সে যা করছে, তা করার অধিকার তার আছে। সে অধিকার বোধেই হয়তো "কটকুডি" মিঠাই এখন সে খুব মজা করে খাচ্ছে।
জৈনপুরী পীর সাবধান করে বলে; পাপ আরো বেড়ে গেলে একদিন খোদার গজব নাজিল হবে এবং অভাব এত বেশী হবে যে, মানুষ মানুষের মাংস খাবে! মাংস কাটার মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখছে, আর ভাবছে; মাইনষ্যে এহনই পশুর রক্ত খাওয়া ধরছে! তাইলে খোদার গজব আইয়া পরছে!
ক্রমশ...
মন্তব্য
১. "টেহামান্কি" (থানকুনি পাতা। কেউ কেউ পয়সা পাতা বলে।
আর কোনো নাম আছে কি না জানা নেই।)
২. ক্ষুধায় কাতর মায়াকে ছাগলের জমাট রক্ত খেতে দেখে
মনে পড়লো ১৯৭৪ সালে ঢাকায় নাকি চাল কিনতে পাওয়া
যেতো না। যাদের খুব বেশি খারাপ অবস্থা তারা ভিক্ষেও
পেতো না।
আমি তখন ছোট। ঢাকার যে এলাকায় থাকতাম (বর্তমান
ওসমানী উদ্যানে হারিয়ে গেছে) ক্ষুধাক্লিষ্ট ভাসমান মানুষ
অনেক দেখেছি। তাদের কেউ কলাগাছের চুকুর খাচ্ছে
(ভেতরের নরম অংশটি) দেখেছি। দেখেছি মরা মুরগি
কাঁচা খেতে।
- কী যে বেদনা দায়ক! মনে হলে আজও কষ্ট পাই!
ধন্যবাদ পুতুল। বর্ণনা ভালো হচ্ছে।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
অনেকের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা অবর্ণনীয় করুণ ছিল।
অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
এই পীর শুয়োরদের সবার আগে মারা দরকার! তার সাথে তার সাঙপাঙ্গদের। খুব ভালো লাগলো এই পর্বটি। চালিয়ে যান পুতুল!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
এসব পরগাছাদের ভূড়ি বারবিকিউ-র জন্য খুব ভাল।
ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
মাটি খোর নামে একটা গল্প আছে আমার।
অবস্থা এখনো অনেক মানুষের জন্য এরকমই রয়েগেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই, অনন্য হয়েছে এবারের পর্ব। মুগ্ধ হয়ে পড়ে যাচ্ছি আপনার লেখা।
-------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ কীর্তিনাশা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়লাম, ভাল-পর্ব এটা...।
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
ধন্যবাদ শাহীন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অসাধারন হয়েছে পুতুল । বেশ কয়েক খন্ড পর আবার আপনার আসল ক্ষমতা দেখালেন ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
এনকিদু ভাই ধন্যবাদ।
মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে খাল পেরুতে হয়। তার পর প্রসারিত মাঠের ফসল। দুএকটা পর্ব সে খালের মত। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন বাধাটা আসে সময়ের কাছ থেকে। এত কম লেখার সময় পাই! মন্তব্যের জবাবও দিতে পারি না।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন