মানুষ শুধুই মানুষ হয়ে জন্মে। তার পর ধীরে ধীরে বুদ্ধি আর কৌশলে অন্য প্রাণীর উপর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত আসনটি দখল করে, পর্বূসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরন করে। কিন্তু পর্বূসূরীদের সব সঞ্চয় খুব সুখের নয়। তারা মানুষকে অনেক শ্রেণী বিভাজনে বিভক্ত করে রেখেছে। অনেক ধর্ম, সে গুলো আবার অনেক উপধর্মে পল্লবিত। একের প্রার্থনালয়ে অন্যের প্রবেশ ধর্মমতে অধর্ম। এমন আগাছায় যাদের মনটি এখনো পরিপূর্ণ হয়নি, তাদের একজন আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে।
মঙ্গার কারনে রবিশষ্যের সব ক্ষেত শুকিয়ে গেছে। লাউ-সিমের লতা শুকিয়ে জ্বালানির জন্য স্তুপীকৃত হয়েছে। ঘাগড়া, টেহামান্কী এসব বনাজী শাকসব্জী তেমন অবশিষ্ট নেই। সে সব বিবেচনা করেই বিজ্ঞ গনপ্রতিনিধিরা গ্রামে গঞ্জে লোংগর খানা ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু অনাহারীর তুলনায় আয়োজন খুব সিমীত বলে; মাথাপিছু দৈনিক দুটি রুটি ধার্য্য হয়েছে। সে তো দুপুর বেলা। তবুও যাহোক একটা কিছুতো জোটে।
তিনজন খানেওয়ালা হুরুনীর। ছটি রুটি ভাগাভাগি করে কোন রকমে অর্ধাহারে কাঁটে। মায়ার বারন্ত শরীরে অত অল্প খাবার বাঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। বেচে থাকার জন্যই মানুষের সব আরাধনার সাথে মায়া নিজের আরুতিটুকু যোগ করে।
চুপি চুপি ছনের ঘরের দুয়ারে ফাকদিয়ে বের হয়ে বাড়ীর আঙ্গিনাটুকু পেরুতেই ক্ষেত। বড় একটা উঠোনের মত। উঠানের মাঝখানে আগুর মাসের ধানের স্তুপেরমত একটুকরো বাগান। লোকে বলে কবরস্থান। একটু উচু জমিরমত। সব কবর এলচি আর মটকুড়া গাছে ঢাকা। তার উপড় দ্বাড়িয়ে রাজত্ব করছে আম, জাম, বরই, ওয়ার বরই, ডেউয়া, তেতুল, বৈচি, শেওড়া, নিম সহ আরো অনেক গাছ। খড়ার কঠোরতা তাদের গায়ে লাগলেও এখনো তেমন কাবু হয়ে যায়নি। মায়া এসে মটকুড়ার উপর চুলের মত বিছিয়ে থাকা স্বর্ণলতা কয়েকটা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে ওয়ার বরই গাছটির দিকে তাকালো। বলাই বাহুল্য মায়া সে কাননে একমাত্র কোয়েলিয়া নয়। সবাই এসে পরার আগে আহার যোগ্য ফল আয়ত্বের ভেতর আর কী হতে পারে তাই দেখে নিচ্ছে। ওয়ার বরই গাছটাই সেখানে সব থেকে ছোট। সে কারনেই সেখানে ফল তেমন নেই। ডেউয়া গাছে ওঠার শক্তি সাহস কোনটাই মায়ার নেই। ওয়ার বরই কাঁচা খুব তেতো, পাঁকা খুব টক। যে কটা ফল অনেক চেষ্টায় পারা গেল সে গুলো এখনো সবুজ। খুব তেতো। অনেকটা স্বর্ণলতার মতই।
পূব আকাশে আলোর রেখা। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে সব। টুপ করে একটা কি পড়ল! মনে হয় ঠেউয়া গাছটার নীচে! মায়া সেদিকেই ছুটলো। সোনারমত হলদে রং-এর একটা ডেউয়া! মায়া চকিতে কুড়িয়ে নেয়।
এবার প্রথম দ্বিতীয় কারো ধমক শোনা যায়: এইডা আমার ডেউয়া। খবরদার নিলে এক্কেরে মাইরালামু কইলাম।
কালামের ধমকে খুব কাজ হয়েছে এমনটা দাবী করা কঠিন। মায়া বিচলিত শুধু একটা কারনে; কালাম গাছ থেকে নেমে আসার আগেই ঠেউয়াটা খেয়ে ফেলতে হবে। আসলে খাওয়ারমত অবস্থা ডেউয়াটার এখনো হয়নি। কমপক্ষে তিনদিন মাটির নীচে জাগ দিলে এ ডেউয়া পাঁকবে। যথেষ্ট শক্ত থাকায় মায়া খুব দ্রুত খেতে পারছে না। কালাম ধমকে কাজ হচ্ছে না দেখে বিনয়ে নেমে এল; বইন তুই না বালা, আইচ্ছা তুই টোহায়া পাইছত আমি গাছে উইডা পারছি। তুই অর্ধেকটা খা আমারে অর্ধেকটা দে।
প্রস্তাবে বিনয় থাকায় আর মার খাওয়ার আশংকা নেই। তাছাড়া ডেউয়াটা খেতে তেমন মজাও না। তাই মায়া বিগলিত হয়ে বলে; মোনো রাহিছ। তরে অর্ধেকটা দিলাম। আইজ মালাটোহা খেলায় আমারে লবি।
অর্ধেক ডেউয়ার লোভে কালাম মায়ার প্রস্তাবে গদগদ হয়ে বলে: তরে আইজ রাণী বানামু। মায়া হাত বাড়িয়ে অর্ধেকটা ডেউয়া কালামকে দেয়। কাজল আসতে একটু দেরী হয়েছে। কিন্তু মায়া আর কালামের বন্দোবস্ত পুরোটাই শুনেছে। তাই খুব রাগের সুরেই বলে: হেইলে আমি তগরে আমাগো বউন্না ফুল দিমুনা মালা বানাইতে।
কালাম কাজলকে স্বান্তনা দিয়ে বলে: তুইতো পরতেকদিন রাণী অছ। মায়ারে একদিন রাণী বানাইলে কি অউব। কালাম ডেউয়াটা এখনো মুখে দিতে পারেনি। সেটাই কাজলকে এগিয়ে দিল। কাজল ডেউটা হাতে নিয়ে কালামের পরস্তাব ভেবে দেখছে বলেই মনে হয়। এতক্ষনে অনেকের কলরবে আলোকিত কানন মুখরিত হয়ে উঠল। আগামী দিনের আহারের যোগানে কেবল এদেরই কোন দুশ্চিন্তা নেই। বেলা হয়েছে অনেকেই বাবা বা বড় ভাইয়ের সাথে "গাছ তলায়" যাবে। তাই বাড়ি ফিরছে। মায়া আজ বিকেলে মালাটোহা খেলায় রাণী হবে এই গর্বে আর সব তুচ্ছ করতে পেরেছে বলেই, হয়তো এত অনাদর এত অবহেলা তাকে স্পর্শ করেনি। এও বেচে থাকার একধরনের কৌশল!
কত অল্পে শিশুরা তুষ্ট থাকে! শেরালী শৈশব এখনো পার করেনি। কৈশোরই যার শুরু হলনা তাকে যৌবনের সর্বজয়ী শক্তি দিয়ে সব কিছু মোকাবেলা করতে হচ্ছে! কপালগুনে দালানে পানি ঢালার কাজটা পেয়েছিল। লংগরখানার রুটির পাশে দৈনিক পাঁচসিকা রুজি আজকের বাজারে কিছুই না। কিন্তু তবুও শেরালীর নিজস্ব একটা আয় আছে। আর এ আয়ের কারণে শেরালী বৈষয়ীক অনেক চিন্তায় আক্রান্ত হয়। মায়ের শাড়ী, বোনটির জন্য একটা ফ্রক, একসের আটা। এসবের হিসেব মেলাতেই শেরালীর হিমসিম খেতে হয়। এত হাহাকারের ভেতরেও কিছু মানুষের আনন্দে ভাটা পড়ে না। চার পাশের অবস্থা দেখে তাদের অস্বস্তিটুকু আরো একটু পোক্ত করে নিতে চায়। গোয়ালের গরু, খোয়ারে হাস-মুরগী, ঘরের চালের টিন, ধান বানার ঢেঁকি, এমনকি কাঁসার থালা বাসন কলসি বদনা সব কিছুই এখন বাজারের পন্য। সুযোগ বুঝে অনেকেই এসব কিনে বা বন্দক রাখছে। বিয়ের সময় হুরুনী মুড়ি ভর্তি একটা পিতলের কলসী পিতৃকূলের পক্ষ থেকে উপহার পেয়েছিল। এত্ত বিপদ গেল স্মৃতিটুকু হাত ছাড়া করেনি। কিন্তু এখন স্মৃতিটুকু জ্বালা ধরায়। এত্ত কষ্ট করে স্মৃতি পাহারা দেবার কোন অর্থ আছে!
শেরালীর পৌরষে লাগে! নাকী মায়ের অলংকারহীন জীবনে একমাত্র উল্লেখযোগ্য পিত্র কূলের শেষ গৌরবটুকুর প্রতি শ্রদ্ধা বোঝা মুশকিল। শেরালী পিতলা কলসী মায়ের কাখ থেকে নিতে পারে না। বীর বিক্রমে পিতলা কলসী প্রত্যাখ্যান করে এখন মহা চিন্তায় পড়েছে! এতদিনে জমাতে পেরেছে মাত্র ২১ টাকা বারোআনা।
এসব ভাবতে ভাবতে বাজারের নতুন জেগে উঠা চরের মত জায়গাটিতে কুস্তি খেলার দর্শকদের ভীড়ের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখে নদর কান্তি বীরেরা 'হাড্ডু' বলে প্রতিপক্ষ আহবান করছে। পেশীর ভাজ দেখে মনেই হয়না এদের গায়ে কখনো অভাবের বাতাস লেগেছে! হাড় জিরজিরে দর্শকরা কুস্তির কলা কৌশলের চেয়ে বীরদের সুঠাম দেহের দিকেই বেশী মনোযোগী। এই শক্তি ক্ষয়ের নাম কুস্তি!
বেদেনীরা সার বেঁধে হাতের চুড়ী চুলের ফিতা কোমরের দাগা গলার তাবিজ খোঁপার কাঁটা পায়ের আলতা ঠোটপালিশ দিয়ে পশরা সাজিয়েছে। শেরালি দেখতে দেখতে মায়ার জন্য দুএকটা কেনার কথা ভাবে। কিন্তু একটা ফ্রক কেনার কথা মাথায় আসতেই চেপে যায়। প্রসাধনের বাহুল্য সবার মানায় না।
সপ্তাহের বদলীর দাম নিয়ে বাজারে আসতেই দুপুর হয়ে গেছে। বৈশাখের প্রথম দিনে কিসের উল্লাসে বিপুল উদ্দীপনায় মানুষের যেন খুশীর সীমা নেই! ঝড়া পাতার মত জীবনের একটি বছরকে পার করতে পারার আনন্দই হয়তো। মুখে জিলাপী আর হাতে বাঁশী নিয়ে অনেক শিশু নতুন বছরের আগমনী উপভোগ করছে।
শেরালীর মুখটাও কেমন উজ্জল মনে হচ্ছে! আটার পুটলীর সাথে খিরার ঠোঙ্গা, বগলে মায়ের শাড়ী আর বোনের ফ্রক চাপা দেয়া। ফ্রকটার সাথে একটা হাফপ্যান্টও আছে। নিজের জন্য কিনেছে আড়াই টাকায় একটা গেন্জী। সব গুলো জিনিস আগে মায়ের হাতে দেবে শেরালী। মায়ের হাসি মুখটা কেমন দেখাবে!
ঠাডা পরল মনে হয় কোথাও! বিকট শব্দে শেরালীর চিন্তায় ছেদ পরে। আকাশ হাড়ির মত কালো। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে বাড়ী পৌঁছতে পারবেতো! এত সাধনা করে এতদিন বৃষ্টি নামানো সম্ভব হল না। আর এখন যত সাধনাই করা হোক বৃষ্টি থামানো যাবে না।
আজ মায়ার আফসোসের সীমা নেই। স্বর্ণ লতায় গিঁট দিয়ে গোল রিংটার ভেতর বেন্না ফুলের পাঁপড়িটি গেঁথে দিয়েছে কাজল। মায়া সেটা কানে ঝুলিয়ে নিয়েছে। হিজলের দুটো বোটা একসাথে গিটঁ দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে হিজল দুটো পেঁচিয়ে দিতেই, মায়ার গলায় সবুজ একটা হার হয়ে গেল। ফল সহ কুচুইল্লার লতাটা মাথায় পেচিয়ে নিল মায়া নিজেই। কুচুইল্লা গুলো পাঁকা থাকায় সবুজ পাতার ফাঁকে কেমন সোনালী আভা! বৈচি ফুলের থোকাটা কানে গুজে দিয়ে ঘর সাজানো শুরু করেছে মায়া। কাজল ওকে সাহায্য করছে। মটকুরার ঝেপের নীচে একটা জায়গা একটু পরিষ্কার করে সেখানে কলাপাতা বিছিয়ে দিয়েছে।
মলচা পাতা, কান্ড, ছোট ছোট করে কেঁটে ভাত তরকারী বানিয়েছে। রাজকুমার শিকারে এসে পথ হাড়িয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর থাকবে। মায়া কুমারকে তৃষ্ণার জল আর ক্ষুধার অন্ন দেবে। মায়ার রুপ ও গুনে মুগ্ধ হয়ে কুমার মায়াকে রাণী করে নিজ দেশে নিয়ে যাবে।
আকাশের গুরু গুরু গর্জণে রাজ কুমার কালাম ভয় পেয়ে জংলি রাণীর মোহ ত্যাগ করে ঘরে যেতে চাইছে। আজকের মালাটোহা খেলায় কাজলের তেমন কিছু যায় আসে না। ভীত কালামকে অনুসরণ করে সেও বরং বাড়ী ফিরতেই আগ্রহী বেশী। তাদের উদাসীনতা মায়াকে বৈশাখীর প্রতি বিদ্রোহী করে তোলে। কাল বোশেখীর আর সময় পেলে না! রাণীর বেশ রাগের প্রলয়ে ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে চোখ আর বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে মায়াও বাড়ীমুখী দৌড়, কালাম আর কাজলের সাথে পাল্লা দিয়ে।
ক্রমশ...
মন্তব্য
এই পর্ব পড়ে পুরো উপন্যাস পড়ার আগ্রহ বাড়লো। ধীরে ধীরে সবগুলো পর্ব পড়বো..
যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!
আপনাকে আমার ব্লগে কি দিয়ে বরণ করি!
অনেক অনেক ধন্যবাদ আগ্রহ দিয়ে উৎসাহ যোগানের জন্য।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আমি তো আগে থেকেই ভক্ত পাঠক। লিখে যান পুতুল ভাই।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিষাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ কীর্তিনাশা!
সকল সময় সাথে ছিলেন, আছেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
"মটকুরা"র ঝোপ বুঝলাম না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আমাদের দেশে বড় বড় গাছের নীচে কোমড় সমান ছোট ছোট কিছু গাছ হয়। অনেকটা সিপটি গাছের মত! যে গাছের ফলের রং দিয়ে কালি বানিয়ে ছোটবেলায় জিংলার কলম দিয়ে লিখতাম। নিমের পাশাপাশি উপরের দুটো গাছের ডালা দিয়ে ভাল দাতন হয়।
দাতন=দাত মাজার ব্রাশ।
অন্য এলাকায় এজাতীয় গাছের অন্য নাম থাকতে পারে।
আপনি আমার একমাত্র পাঠক যিনি সব কিছু চেনেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন