সরকারের খাল কাটা কর্মসূচীর কাজ পেয়ে রকমত আলী এখন, কনটেকদার। লোকমান হাজীর শালির সাথে মহা ধুমধামে শুভবিবাহ সম্পন্ন হল গত বছর। ছোট ভাই সব আয় রোজগার সৌদী থেকে রকমত আলীর কাছেই পাঠায়। তাতেই রকমত আলির নাও এখন শুকনা জমিনে চলে, এমন অবস্থা! খাল কাটার ঠিকাদারী কেবল জন সেবা। রকমত আলির খালে মাটি ঠিক কাটা হয় না। শুকনো খালে যে ঘাস গজিয়েছে, সে টা চেছে একটু দূরে দূরে স্তূপ করে রাখা। কাজ তেমন কঠিন না; কিন্তু আয় ভাল। সদর থেকে আসা অফিসার বড় রাস্তায় মোটর সাইকেল থামিয়ে বুড়ো বটগাছের ছায়ায় সেভেনআপ খেয়ে পথের ক্লান্তি দূর করেন। উন্নয়ণের ধাঁধাঁয় চোখ বিস্ফরিত হওয়ার ভয়ে চোখে গগজ লাগিয়ে ইঞ্জিনে কিক দেন। সদরে অন্য উপহারের সাথে ধানের শীষ মার্কা টাকার তোড়া নিয়ে লোকমান হাজী আর রকমত আলি অফিসারের বাসায় হাজির হন।
অনেক দিন হল কেউ আবু করের খোঁজ পায়নি। আসলে কেউ খোঁজ করেও নি। আজকাল মানুষ নিজের খবরই রাখতে পারে না, আবু করের খবর কে রাখবে! মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেলে গুলি না থাকায় আবু করকে আর গুলি করা হয়নি; তার দরকারও ছিল না। পরিবারের সবার মরন দেখে আবুকর তখনই মারা গেছে। হয়তো মাটির দেহে প্রাণ পাখিটা এখনো ছটফট করে! হতে পারে মুক্তির লোভেই, পাখিটার এমন ব্যবহার। বাজারেই থাকতো আবু কর। প্রথম কিছুদিন পুরুষাঙ্গটা ধরে একটু পর পর বলতো "সোনার বাংলা"। তারপর বাজারের এত মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করবে কী করে; সে চিন্তায় মগ্ন থাকতো! নদীর ঘাটে চিকা ঘোষের মিষ্টির দোকানের বারান্দায় শহীদ কারিগর শুতে দিত। যখন যা মনে আসত শহীদ কারিগর তাই খেতে দিত আবুকরকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ, চিকা ঘোষের মিষ্টির দোকানে কাজ করতো। যুদ্ধের শুরুর দিকে অবস্থা বেগতিক দেখে চিকা ঘোষ দোকানের দায়ীত্ব শহীদকে বুঝিয়ে দিয়ে ভারত চলে যায়। স্বাধীনতার পর শহীদ, "কারিগর" উপাধী নিয়ে মিষ্টির দোকান বিশেষ দক্ষতায় চালাতে থাকে।
অনেকদিন পর চিকা ঘোষ কোলকাতা থেকে দেশে ফিরে। "ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার"-এর নাম এখন "জল খাবার" দেখে একটু অবাক হয়ে থাকবে বুড়ো! সব কিছু কত দ্রুত পরিবর্তণ হয়ে যাচ্ছে! শহীদ কারিগর এখন চিকা ঘোষের সব সম্পত্তির মালিক। চিকা ঘোষের বাড়ীর ছোট্ট পূজার ঘরটা ভেঙ্গে একটা অস্থায়ী নামাজের জায়গাও তৈরী হয়েছে। কাকতালীয় ভাবে তার প্রায় সময়-সাময়ীক ভাবেই আবুকরের বাড়ীতে, রকমত আলী ঘর তোলে। এর পর থেকে চিকা ঘোষ বা আবুকরকে কেউ দেখেনি। অবশ্য শহীদ কারিগর ক্যাশে বসে কাষ্টমারদের বিল নেয়ার ফাঁকে বলে; আবু কাকা চিকা জেঠার সাথে কইলকাতা যাইব কইয়া আমার কাছে বিদায় নিয়া গেল। অবশ্য সে দিন রকমত আলী আর শহীদ কারিগর রেষ্টুরী-অফিসারের বাসায় মিষ্টি নিয়া গেছিল লোকমান হাজীর সাথে। সেটা ওরা সবাইকে বলে না। অবশ্য এখন লোকের ঔৎসুক্যও তেমন নাই।
আজকেও এত কথা উঠতো না; রকমত আলী মেয়ের বাপ হইছে। খবর শুনে শহীদ কারিগর মিষ্টি নিয়া গেছিল মেয়ে দেখতে। সে টা মেয়ের জন্মের পরের দিনের কথা। তার পরের দিন পাশের বাড়ীতেও কোন সন্ধান না পেয়ে সবাই নিশ্চিত হল; মেয়েকে পেত্নী নিয়া গেছে। এদিকে মেয়ের জন্য রকমত আলীর বউ কেঁদেকেঁটে অস্থির!
এই সব মামুলী বিষয় শেরালীর জানার কথা না। হুরুনীকে সমাজ থেকে বাদ দিয়ে একঘরে করে দেয়ার পর শেরালী বোয়ালমারী বাজারে স্কুলে যায়। হুরুনী হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে উঠে পড়ে লেগেছে। মোল্লা ডেকে মতি হুরুনীরে শাদী করেছে। সংসারের সব দায়ীত্ব গুরুত্বের সাথে পালন করে মতি। গায়ে-গতরে খাটতে পারে তাই কাজের অভাব হয় না। হুরুনী পাল বাড়ির রান্নাবান্না করেই সংসার চালিয়ে নিতে পারে। নমিতা হুরুনীকে দিদি ডাকে। হুরুনীর মনেই হয়না যে, সে এখানে চাকরানী মাত্র। এদিকে বিরেশ্বর আর অসীমের সাথে শেরালীর খুব দোস্তি। নমিতার দাদারা শেরালী আর মায়ার স্কুলের ইউনিফর্ম, ভর্তির টাকা দিয়ে যায়।
বোয়ালমারী বাজারের হাইস্কুলের মাষ্টার রাউৎ বাবু বিরেশ্বর আর অসীমের সাথে শেরালী আর মায়াকেও পড়ায়। তো এমন ভাবে দিন গুলো যায় যে অন্য দিকে সময় ও মন কোনটাই টানে না।
কিন্তু সে দিন শুক্রবার, স্কুল বন্ধ, মা মায়াকে নিয়ে পাল বাড়ী গেছে। মতি কাকু গেছে কাজে। বোয়ালমারী বাজারে বঙ্গবন্ধু যে দালানে দাঁড়িয়ে ভাষন দিয়েছিলেন, সেটা অনেক জায়গায় চুন-কাম করা হচ্ছে। নতুন ঝকঝকে মঞ্চে দাড়িয়ে ভাষণ দেবেন নতুন নেতা। সে কাজে মতি কাকু খুব ব্যাস্ত।
শেরালী কী যেন ভেবে ছিপ নিয়ে বের হয়েছে। এতদিন আবুকরের বাড়ী বলতে গেলে ইজমায়িলী সম্পত্তি ছিল। তাই সে বাড়ীর পুকুরের কথাই সবার আগে মনে আসল। বর্শী ফেলে চোখে পড়ল পরিবর্তনটা, একটু অন্যমনস্ক ছিল বলেই মাছ বর্শী গিলে ফেলেছে সেটা একটু দেরীতে টের পেল। কিন্তু ততক্ষনে ছিপ পুকুরে কঁচুরীপানার তলে। বাধ্য হয়ে নামতে হল। একটু জায়গার কঁচুরীপানা সরাতেই ছোট্ট একজন মানুষের নগ্ন মরদেহ দেখে চিৎকার করে উঠল শেরালী।
গ্রামের মানুষ ভেঙ্গে পড়ল, রকমত আলীর পেত্নীতে চুরি করে নেয়া মেয়ের মরদেহ দেখতে। কথা রাষ্ট হয়ে গেল! পুলিশ আজকাল প্রায় দিন রাত গ্রামে টহল দেয়। জাসদের সেনু-মনু-মন্টুরা অনেক আগেই ধরা পরেছে। ভারতে পালিয়ে যাওয়া আ.লীগ বা ছাত্রলীগের কেউ যদি ফিরে আসে! অথবা জাতির শত্রু বলে চিহ্নিত স্বসস্ত্র সর্বহারার লোক আক্রমন করতে পারে। তাই অতিরিক্ত সর্তকতার অংশ হিসাবে পুলিশের উপস্থিতি। কাজেই অকুস্থলে পৌঁছাতে তাদের তেমন দেরী হল না।
কে, কখন, কবে, কোথায় করতে করতে পুলিশ সবার খোঁজ খবর নিল! সে থেকে পুলিশ নিয়মিত শহীদ কারিগরের দোকানে জল খাবার খেতে আসে। রকমত আলী কন্টেকদারের মেয়ের কপালে মাটি জুটল। এছাড়া আর তেমন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না! কিন্তু শেরালীর নাম পুলিশের খাতায় লেখা রইল। সেদিন পুলিশ যখন রাউৎ বাবুকে ধরে নিয়ে যায়, শেরালী রাউৎ বাবুর অপরাধটা ঠিক বুঝতে পারল না। তাই রাউৎ বাবুর পেছন পেছন অনেকদূর গেল। পুলিশ গুলো চেনাই মনে হল। এরাই শহিদ কারিগরের দোকানে জল খাবার খায়। শেরালীকে দেখে একজন ধমক দিয়ে বলে; যা ভাগ।
রাউৎ বাবু শেরালীর দিকে ফিরে বলে; বাবু বড় হলে বুঝবে, এখন বাড়ী যাও। মন দিয়ে পড়া লেখা কর। রাউৎ বাবু মানুষের গোস্ত খাওয়া কম্যুনিষ্ট! শেরালী রাউৎ বাবুকে এত ভয়ংকর ভাবে কল্পনাই করতে পারে না।
চলবে...
মন্তব্য
অসাধারন লাগলো।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
কীর্তিনাশা মনে হয় সবগুলো পর্ব পড়েছেন। ধন্যবাদ ছাড়া আপাতত আর কিছু দিতে পারছি না।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আগেরগুলো পড়া হয় নি। তবে এটা ভালো লেগেছে।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ
ধন্যবাদ গৌতম বুদ্ধ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
উদ্ধৃতি
বাবু বড় হলে বুঝবে, এখন বাড়ী যাও। মন দিয়ে পড়া লেখা কর।
এখান থেকেই শেরালীর আসামী হওয়া?
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ধন্যবাদ জুলিয়ান সিদ্দিকী, আর একটা পর্ব তার পর শেরালীর প্রথম হাজত বাস । কিন্তু লিখতে পারছি না! সময় ...
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন