আসা যাওয়ার পথের ধারে বট গাছটার তলায় নূরা পাগলা জুতা সেলাই করে। কত মানুষ, কত রাজার অশ্বারোহী, এই গাছের তলায় হেঁটে গেছে। গাছের ছায়ায় ছাতা না হলেও চলে তবু নূরাপাগলা বাঁশ গেড়ে তার মাথায় ছাতা বেঁধে রেখেছে। বট কলের বিষ্ঠা মাথায় পরতে পারে, তাই অতিরিক্ত সাবধানতা। বসন্তের যৌবন কাল; ফুল থেকে ফল হচ্ছে। ঘন পাতার আড়ালে বটকল, বট গাছের ফল খায় আর হাগে। লোকটার পেটে এত কথা! কত কী যে জানে! যখন কোন লোক থাকে না তখন শেরালী বসে বসে লোকটার কথা শোনে। পাকিস্তান আমলের কথা; সাত মৌজার বিল নিয়ে তখন প্রায় প্রতিদিন লাশ পরে! এমন একটা লাশ ফেলে নূরা পাগলা জেলে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, আরো অনেক জেলীর সাথে বার বছর পর নূরা পাগলা ছাড়া পায়। খুনের অনুশোচনা হিসাবে চটের জামা-কাপড় পরে এখন সে জুতা সেলাই করে।
নূরা পাগলা বলে, দাদার কাছে হুনছি; আগিলা দিনে শত্তুররে মাইরা, তার বাও আতের কনি থেইক্যা কান্দ পর্যন্ত আড্ডি ছুরি বানিয়ে মর্দরা নিজের বাও আতে বাইন্দা রাখতো। এমন একটা আড্ডি না থাকলে হেই কালে মর্দ শাদি করতো না।
বটগাছটার ডালে ও শিকর গজিয়েছে; লতার মত সেগুলো বাতাসে ঝুলছে। তার একটা ধরে শেরালী দোল খাচ্ছে। আগে বিরেশ্বর আর অসীমের সাথে স্কুল ছুটির পর পর শেরালী বাড়ী যেত। এখন মতি কাকুর জন্য অপেক্ষা করে। মাগরিবের আজানের পর মতি কাকুর চুনকাম শেষ হবে। তখন দুজনে একসাথে বাড়ী যাবে। সে জন্য এখানে অপেক্ষা করছে। রাউৎ বাবু জেলে যাবার পর বিরেশ্বর আর অসীম ওদের মামার কাছে চাটগাঁ চলে গেছে।
বটগাছটা এত মোটা যে, শেরালী অন্য দিকটা দেখতে পাচ্ছে না। ওখানটায় দাড়িয়ে একটা লোক একটা ধাড়ালো চোখা লোহার ছুড়ি, চিকন মুলি বাঁশের মাথায় শক্ত করে বাঁধল। তার গোড়ায় আর একটা মুলিবাঁশ বাঁধল। এভাবে একটার পর একটা মুলি বাঁশ বেঁধে ছোড়াটা বটগাছটার একেবারে উপরে বটকল গুলোর নাগালে নিয়ে গেল। দ্রুত গুতো দিয়ে একটা বটকল গেঁথে ফেলল। ঘুর ঘুর করে আহত পাখিটা একটু চেঁচালো, ডানা ঝাপটালো। সাথী পাখিগুলো সতর্ক ভাবে এদিক ওদিক তাকাল। কিন্তু উড়ে গেল না! একটু পর আবার বট খেতে লাগল।
একদম নীচে নেমে পাখিটা শেষ বারের মত ডানা ঝাপটালো। লোকটা সবগুলো মুলিবাঁশের শলা একসাথে বেঁধে তুন-এর মত কাঁধে ঝুলালো। পাখিটা দড়িতে বেঁধে কোমড়ে ঝুলিয়ে দিল। অবশ্য লোকটার কোমড়ে শিঁকেয় বাঁধা কয়েকটা কাসিম পাখিটাকে কোন সাহায্য করতে পারল না। কাসিম গুলোর গায়েও বল্লমের ছিদ্র। বল্লমটা ভর করে লোকটা হাঁটে। বল্লমের ধারালো মাথাটা তখন আকাশের দিকে তাক করা। জল আর স্থলের সন্ধিতে লোকটা বল্লমের মাথা ঘুড়িয়ে মাটির দিকে আনে। ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে গুতো দেয়। শক্ত কিছুতে আটকে গেলে, জায়গাটা পরখ করে। কাছিম দ্রুত সরে যেতে পারে না। লোকটা কাসিম গুলো কোমরের জালে ঝুলিয়ে, আরো কাসিম খোঁজে। আজকে এই বটকলটা লোকটার শেষ শিকার। এখন এগুলো বাজারে বেঁচতে হবে।
লোকটার বউ মাথায় সাপের ঝাপি নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে হেটে সাপ খেলা দেখায়। পিঠের ঝোলায় গরুর শিং আর রং-বেরং-এর চাউলের গুড়োর বড়ি রাখে। কোমরে থাকে শিমুল তুলা। চাউলের গুড়ো বিভিন্ন রোগের মহৌষধ। গরুর শিং দিয়ে বাতের ব্যাথা নামায়। শিং-এর মোটা ছিদ্র ব্যাথার জায়গায় লাগিয়ে চিকন ছিদ্র দিয়ে চুষে বিষ বের করে নেয়। শিং এর ভেতর মুখের পানের পিক জমা করে বিষ রক্ত হিসাবে দেখানোর নিয়ম। তুলা রোগীর দাঁতে গুজে আবার বের করলেই তাতে চালের মত বড় বড় দাঁতের পোঁকা এসে জড়ো হয়। এমনি আরো কত চাতুরী করে এরা চাল, নগদ পয়সা সরলমতি গৃহ- বধূদের কাছ থেকে আদায় করে!
এদের কোন ঘর-বাড়ি কখনো ছিল না। জয়ধন মুনির জংগলেই এদের মা ধরতী। সভ্যতার উষা লগ্নে এদের গায়ে কোন আলো লাগেনি। সভ্য মানুষেরা অরন্যের অধিকার আদায় করার পর, এরা নিজেদের বোকামীর মাসুল দিতে এখন অন্যকে ঠকায়। গোমতীর আশে-পাশের গ্রাম গুলো এ বছর এদের মৌসুমী বানিজ্যের মেসোপটোমিয়া।
নূরা পাগলার হাতে তেমন সময় নেই। আসছে হপ্তায় নুরা পাগলা বান্দরবান যাবে। সরকারের পূর্ণবাসণ কর্মসূচীর আওতায় নূরা পাগলা সেখানে জায়গা-জমি পেয়েছে। দখলদার হিসাবে সেখানে কয়েকটা গাছ আর একটা ঘর তুলেছে। কিন্তু সেগুলো এখনো খালী পরে আছে। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু দেখে আসতে হয়। এখনো তেমন পাড়া প্রতিবেশী হয়নি সেখানে। শান্তি বাহিনীর হামলার ভয়ে এখনো পাকাপাকি ভাবে কেউ বসবাস শুরু করেনি। বিনে পয়সায় পাওয়া সম্পত্তি, একদিন হয়তো কাজে আসবে! সে কারনেই ২/৩ মাস পর পর সপ্তাহ খানেকের জন্য সেখানে যায়।
নীল সার্টের পকেটে ইয়থ কলমের সাথে একটা কাঁঠাল-চাঁপা রেখে দিয়েছে শেরালী। ফল হীন আরো অনেক ফুলের সাথে শেরালীদের স্কুলে একটা কাঁঠাল চাঁপার গাছও আছে। ফুলটা সেখান থেকেই পেরে এনেছে। কত্ত বাহারী ফুলে গাছগুলো সেজেছে! হরেক রং-এর এত পাখীও অন্য সময় দেখা যায় না। বৃষ্টি বাদলা নেই। যাত্রা-জারী, পালা-পাল্টা গানের আসর গুলো এসময়ে খুব বেশী জমে। ওয়াজ মাহফিলের মৌসুমও এটাই। আর একটা অনুষ্ঠান এসময়ে হয়, ভোট।
অবশ্য সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর সব গুলো ভোট শুধু "হ্যাঁ বা না" এভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে জনগনের সুবিধা ছিল; কষ্ট করে ভোট দিতে যেতে হতো না। গ্রাম সরকারের লোকেরাই সে দায়ীত্ব পালন করতো। এখন ভোটের বৈচিত্রই আলাদা। তিন চার রকমের আ.লীগ। মাছ-মশাল-কুঁড়ে ঘরের জাসদ। অবশ্য লোক বল দেখে বোঝাই যায়। ধানের শীষ সবার উপরে। সমস্যা শুধু ইঞ্জিনিয়ার সাব। ওনি বড় বড় মিটিং ফিটিং না করে গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে বেড়ান। বউ-ঝিয়ারীদের সাথে গল্প করেন। ধানের শীষের প্রার্থী ব্যারিষ্টার; খুব জ্ঞানী-গুনি লোক। কিন্তু দেশের মানুষ তেমন চেনে না। তাকে পরিচিত করতে বালুর মাঠে স্বয়ং জেনারেল জিয়া মিটিং করবেন।
শেরালীরা সেখানে হাত নেড়ে জেনারেলকে স্বাগত জানাবে। সে জন্য বালুর মাঠ, সারি বেঁধে বসে শেরালিদের স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রী মিলে পরিস্কার করেছে। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে যে দালান বানিয়েছে, মতি কাকু সেখানে এখন চুনকাম করছে। প্রায় শেষের পথে সে কাজ। সাদা ধব ধব করছে দালানটা। একই সিংহাসনে কত লোক বসে! আর এতো শুধু ক্ষমতারোহণের মঞ্চ মাত্র!
চলবে...
মন্তব্য
আমার সেই চিরপরিচিত দৃশ্যাবলীর দেখা পেলাম এ পর্বে।
একটা সময় হাতে গুলতি আর কাচের মার্বেল নিয়ে বেশ ঘুঘু শিকার করতাম। কিন্তু এই যে বটকল (স্থানীয় নাম। এর আসল নাম জানি না। কবুতর আর ঘুঘুর মাঝামাঝি দেখতে)। একবার একটি বটকল শিকার করে জবাই করে মাকে রান্না করতে দিয়েছিলাম। মা সেটাকে ফেলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বটকল আনিস না। কিন্তু কারণ হিসেবে বলেছিলেন যে, বটকল বিষ্ঠা আহার করে।
তারপর কেবল ঘুঘুই শিকার করতাম। কিন্তু একটা সময় এলো যে, আমাকে যেখান থেকেই দেখা যাক না কেন, ঘুঘুরা দল বেঁধে উড়ে যেতো। আর গুলতিতে আমার হাতের টিপ এতই ভালো ছিলো যে, বেদেরাও আমার মত লক্ষ্যভেদ করতে পারতো না।
আর এই কচ্ছপ বা কাছিম ধরার লোকগুলোকে যখন দেখতাম তখন আমারও ইচ্ছে হতো ওভাবে কচ্ছপ বা কাছিম ধরে আনি। একদিন মাকে বলেছিলাম যে, কাছিম ধরে আনলে রেঁধে দেবেন কি না। তিনি সোজা বলে দিয়েছিলেন যে, এরপর বাড়িতে আমার ঠাঁই হবে না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ধন্যবাদ জুলিয়ান সিদ্দিকী, আপনার মত মনোযোগ দিয়ে আর কেউ শেরালী পড়েনা। অনেক সময় অনেক বর্নণা পাঠকরে ধৈর্যের কথা চিন্তা করে এড়িয়ে বা বাদ দিয়ে যাই।
সবাই জদি আপনার মত ভাল/মন্দটা জানিয়ে যেত!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন