মুক্তিযোদ্ধার "চুপকথা" মুহম্মদ জুবায়েরের উপন্যাস

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ২৯/০৯/২০০৮ - ৪:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাজের ঝামেলা সংসারের যন্ত্রনায় সচলের আঙ্গিনায় নিয়মিত পায়চারীর সময় পাইনি। একদিন জুবায়ের ভায়ের সুস্থতা কামনা করা পোস্টে আরতি রেখেছিলাম। গতকাল সচলে ঢুকে দেখি জুবায়ের ভাই অসীমে পাড়ি দিয়েছেন।
ঘাটা-ঘাটি করে জুবায়ের ভায়ের "চুপকথা" খুঁজে পেলাম। হাটু গেড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে বসলাম। তিনি বলে গেলেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম।
শীতের ভোরে আমাদের পূর্বপুরুষরা জলে ভাসা কাঁশবনের মত সাদা কুয়াশায় ঢাকা নদীর ধারে হেঁটে বেড়ায়। এমন ঘন নিবিড় শান্তির ছোঁয়ায় বেড়ে উঠে, তাদের নাতী-পুতিরা গোল্লাছুট আর হা-ডু-ডু খেলার হল্লা রেখে, যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়!
মাতৃ-মুক্তির মন্ত্রে দিক্ষীত দুর্বার অজেয় দুরন্ত দামাল ছেলের দল শত্রুর বর্ষিত গোলা বুক দিয়ে ঠেকিয়েছেন জীবন পন করে। বুংকারে চিরনিদ্রায় শায়ীত বন্ধু সহযোদ্ধাকে চিরদিনের মত শেষ আলিংগনে সংযুক্ত করেছেন, স্বীয় আত্মায়। শহীদের শোকাহত পিতার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছেন কৈফিয়তের দায়ীত্বে; "বাবা তোমার সব ছেলে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেনি। শত্রু ঠেকাতে তোমার অনেক ছেলে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছে।"
অস্ত্র জমা দিয়ে সে সব দামাল ছেলেরা মায়ের শান্ত-সুবোধ বালকের মত লেখা-পড়ায় মনোযোগ দেন।
অনেত ত্যাগ, বহু তিতিক্ষায় অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই কিছু প্রিয় মানুষদের হঠকারী সিদ্ধান্তে শুভংকরের ফাঁকির মত, হাতছাড়া হয়ে যায়।
স্বাধীন দেশে এক মুক্তি-যোদ্ধা-যুবক ফাকিস্তানী ভাষায় "বাইনচোদ" গালি খায়! উর্দিপরা সৈনিক, মুক্তি-যোদ্ধা-যুবককে, মাথা মুড়িয়ে গ্লানির চূন-কালি মেখে দেয়, মুখে!
লাজ-লজ্জায়, রাগে-অভিমানে, ক্ষোভে-দুঃখে সে যুবক মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমায় অজানায়!
পেছনে দাঁড়িয়ে "মুনিয়া"-র মত প্রেয়সী স্তব্ধ হয়ে সয়ে যায় সব হারানোর ব্যাথা!
পরবাসে বসেও সে যুবকটি তার মাতৃভূমির আজকের দৈন্যদশায় কষ্ট পায়। মনে মনে ক্ষনে ক্ষনে "মুনিয়া" হৃদয়ের আরশীতে কথা কয়; কেমন আছো?

পরবাস! সেখানে নিজেকে অতিথীর মত লাগবেই। হয়তো তাই নিজের দেশের এতো হতাশার আঁধারে এতটুকু আশার আলো দেখলেই আনন্দে বুক ভরে উঠে; হোকনা সেটা ক্রিকেট খেলার মাঠে!

দূর পরবাসেও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী মিথ্যার পসরা সাজায়। প্রশ্ন করে;

"আপনার মত মানুষ গুলি যতসব প্যাচ লাগায়, আপনারা কৈ পাইলেন একাত্তোর সালে তিরিশ লাখ লোক মারা গেছিল, দুই লক্ষ মাইয়ার ইজ্জত গেছে, গুনতিটা করলো কে?"

রাগে, সে আসর ছেড়ে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বেড়িয়ে আসতে হয়! মিথ্যেবাদীরা আসর আগলে বসে থাকে। মিথ্যের পসরা বাড়ে।
তার স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলায় একদিন কোন এক নটরাজের নৃত্যে সব জড়া-ব্যাধির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হবে। আর সে মুক্তি-যোদ্ধা-যুবক মুনিয়ার কোলে মাথা রেখে শান্তির চিরনিদ্রায় শায়ীত হবে।
এভাবেই জুবায়ের ভাই তার "চুপকথা" শেষ করেন। স্বপ্নের রাজ কুমার চলে গেলেন, মুক্তি যুদ্ধের দুএকটা উদাহরণ না দিয়েই। কিন্তু দিলে আমার মত দুএকজন পাঠকের আরো ভাল লাগতো!
আমার কাছে জুবায়ের ভায়ের "চুপকথা" খুব ব্যাতিক্রমী একটা সৃষ্টি। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই লেখক নন কিন্তু মুহম্মদ জুবায়ের লেখক। "চুপকথা" আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে যুদ্ধ পরবর্তী সংঘাত প্রতিঘাত এবং সর্বোপরি আমাদের পরাজয়ের দলিল। একজন মুক্তিযোদ্ধা সে সকল উত্থান-পতন কি ভাবে দেখেন, "চুপকথা"-য় তা পাওয়া যায়।

অর্ন্তজালে এতো লোমহর্ষক মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস এই প্রথম পড়লাম। স্বাধীনতার পক্ষের সব পাঠকের এই "চুপকথা" খুব ভাল লাগবে। একুশের বইমেলায় যেন বইটি বের হয়।
http://www.esnips.com/doc/66353959-2e25-4270-90f1-a50c4884921e/Chupkatha
জুবায়ের ভাই শংখচীল শালিকের বেশে এসেছেন তার স্বাধীন সোনার বাংলায়।


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

উপন্যাসটি পড়িনি। কিন্তু আপনার আলোচনা পড়ে পড়ার আগ্রহ বেড়ে গেলো। সমালোচক হিসেবেও আপনার কুশলী হাত রয়েছে।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

অতিথি লেখক এর ছবি

চুপকথা উপন্যাসটার কি কোন লিইঙ্ক দিতে পারেন ।
নিবিড়

রণদীপম বসু এর ছবি

চুপকথা আমারও পড়া হয় নি। পড়ে ফেলবো। হাঁ, একুশের বইমেলায় বইটি বেরুলে খুবই ভালো হয়।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পুতুল এর ছবি

বইটা কিন্তু আমার খুব ভাললেগেছে!
পড়ে আপনার অনুভূতি শেয়ার করবেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমার কাছে মনে হয়েছে - একজন প্রবাসী দেশপ্রেমিকের অন্তরের অন্তঃস্থলে যে নিরন্তর ক্ষরণ চলেছে আর দাহ চলেছে অক্ষমতার তাই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে এ উপন্যাসে।

উপন্যাসিক মুহম্মদ জুবায়েরের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম (প্রবাসে যাঁরা অন্তরে লালন করতেন দেশপ্রেম) তাঁদের অন্তর্দহনের বিষন্ন বিলাপ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

জুলিয়ার একটুও বাড়িয়ে বলেননি।
দুঃখেরর ব্যাপার হল; মুক্তিযোদ্ধারা খুব কম লিখেছেন, তাদের অভিজ্ঞতার কথা।
েতে করে এক সময় আমরা আর যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্ষী পাব না।
জুবায়ের ভাইতো গেলেন!
ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।
জুবায়ের ভায়ের আরো যে কটা উপন্যাস আছে সেগুলো নিয়ে আপনি একটা রিভিও লিখেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

এই কাজটা জুবায়ের ভাইয়ের বন্ধুদের কেউ করতে পারেন। আমি হলাম গিয়ে নিতান্তই পাঠক। রিভিউ লিখলে পরে অনেকেই হয়তো লাঠি সোটা নিয়ে আসবেন। কাজ করার চাইতে কাজের খুঁত ধরার লোক বেশি। দেঁতো হাসি
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।