লোহাখোর

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/০৮/২০০৯ - ৬:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আরে বিদ্যা শিক্ষা না করিতে আগে করছ বিয়া
বিনা দোষে হইছ গোলাম গাইডের টেকা দিয়া রে...

আগুন উদ্ভাবনের পর থেকে লোহার ব্যবহার মানুষের সভ্যতাকে সনাক্ত করেছে। তীর ও তরবারীতে লোহার সফল ব্যবহারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের উপর মানুষের কর্তৃত্ব। নির্মিত হয়েছে দূর্গ ও রাজার প্রাসাদ। বন্দীর শৃংখল বন্দুকের গুলি, দুটোই সমান ভাবে রক্ষা করে বণিতার হাট ও সম্পদের সিন্দুক। লুন্ঠনের নৈরাজ্যে এক মাত্র কঠিন ধাতু লোহার বাহকেরাই নিশ্চিন্ত। পৃথিবীর গর্ভে বিলীন সভ্যতা মন্থন করা ফসিল-শক্তি লুন্ঠন শেষে যুদ্ধাহত অশ্বের মত রণতরী ফেলে যায় আমাদের ঘাটে।

চেরাগের শিখার মত, আঁধারের চাপে ছোট হয়ে আসছে সূর্য। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, ধীরে ধীরে শীতল জলের তলে, প্রাণের প্রতাপ মেটাতে সূর্যটা নেমে যাচ্ছে। সাগরের ঢেউ যেখানে এসে থেমে যায়; ঠিক সেখানেই মাটির নাভীতে সাধুর ত্রিশালের মত, লোহার খুঁটি গেথে একটা দানবীয় কপিকল বাঁধা। সাপের মত লোহার রশি কপিকল থেকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন মানুষ। সাগর পারে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে শতাব্দীর প্রাচীন অজগরটা মহাদেবের কাঁধে। জল আর স্থলের মিলন রেখার একটু দূরের জাহাজটা দড়ি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর সামনে হিমালয়ের চেয়ে কম উঁচু নয়। দড়িতে জাহাজটা বেঁধে যতটুকু পারা যায়, স্থলের কাছে নিয়ে আসবে। সে কাজটা মানুষের অসাধ্য। তাই যান্ত্রিক কপিকল, মানুষের হয়ে তা করে দেবে।

পুরোনো জাহাজ কাটা শেষ হয়েছে। এখনই নতুন জাহাজ এনে না রাখলে কাল ভোরের কাজে ছন্দ পতন ঘটবে। আব্বা খুব ঝানু লোক। তিনি নামাজের ওয়াক্তের মত, কাজের ওয়াক্ত ঠিক রাখেন। আব্বার কথার নড়চড় হতে পারে কেবল প্রাকৃতিক কারণে। মানুষের পক্ষে আব্বার কথার বরখেলাফ অন্ততঃ এখনো হয়নি। জাহাজের টুকরো টুকরো লোহা গুলো কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে ঐ লোহার রশিটার ভারে ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে। কিন্তু বেঁকে বসার কোন সুযোগ আব্বা তাদের জন্য রাখেননি। মাইরের শেষে লাথির মত এই শেষ ঘানিটা টানলে মানবাকৃতির এই কলুর বলদ গুলো আজকের মত মুক্ত হবে। সেই মুক্তির আনন্দেই আব্দু উপরের গানটা গাইছে। দিন রাত্রির মিলন হয়, একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কিন্তু আব্দুদের জীবন থেকে গরিবী কখনো বিদায় নেয় না। সেই আজন্মের সমস্ত অভাবের চিতায় পূজোর মন্ত্রের মত আব্দু মিয়ার নিবেদন। আহা ভক্তিতে গলা ধরে আসে!

বিকট চীৎকারে যান্ত্রিক কপিকলটা জাহাজ নামক মহেশটাকে জল থেকে ডাঙ্গায় তোলার চেষ্টা করে। মানুষ নামক বলদ গুলোর ছুটি হয়। সাবধানে রণক্ষেত্র পেরিয়ে যায়। বিক্ষিপ্ত ভাবে নাঙ্গা তরবারীর মত পরে আছে লোহার টুকরো; অন্ধকার, সাবধানে যেতে হবে। লোহার ধাড়ালো প্রান্ত বা থেমে থাকা ট্রাকের সাথে একটু অসাবধানী পায়ের হোচট, কয়েক দিনের কাজের ব্যাঘাত ঘটাবে। ঔষধ, খোরাকী, ঘর ভাড়া অর্জিত বেতন থেকে কেঁটে রাখবেন আব্বাজান।

একটা চালা ঘরের মেঝেতে শোয় সবাই। এক সাথে রান্না করে, খায়। ঠাট্টা মশকরা সুখ দুঃখের কথা বলে। দিনের শেষটা স্নান দিয়ে শুরু হয়। একেকটা লোহার খন্ড সাত-আট জনে ধরে ঘাড়ের উপর তুলতে মাজা পর্যন্ত কাঁদার ভেতর ডুবে যায়। গামছা, কাপড়ের পুটলী, সব কিছু ভেদ করে লোহার ঘষায় কাঁধের চামড়া উঠে ঘা হয়ে যায়। সাবান দিয়ে শুধু বুক থেকে পা পর্যন্ত ধোয় এরা। মাথায় সাবান দিলে, সেটা কাধের ঘায়ে লেগে ব্যাথা আরো বাড়িয়ে দেয়। গোসল করতে সব চেয়ে বেশী সময় লাগে মাখনের। চালা ঘরটার পেছনে একটা ডোবার মত আছে। গোসলটা সেখানে সেরে সবাই গামছায় গা মোছে।

কিন্তু মাখনের এখনো গা মাজা শেষ হয়নি দেখে বাতেন একটু খোঁচা মেরে বলে; মাখন পানির থেইক্যা উঠলে যেন তরে রামের মত দেহি।

শেষ ডুব দিয়ে উঠে মাখন বলে; আমি যদি রাম অই তরে বানামু সীতা।
সবাই হেসে উঠে। ভেজা গামছা কাঁধে ফেলে পাশের দোকান থেকে চাল-ডাল আনতে সবাই গেল।
সাদেক এক প্যাকেট বিড়ি নিল। অনেকক্ষন থেকেই সাদেকের বিড়ি নেই। এ ওর কাছ থেকে চেয়ে কতক্ষণ আর চলে। তাই এবার এক প্যাকেট কিনেই ফেলল।

সেটা দেখে বারেক বলে; কিরে সাদেইক্যা, পর পোন্দায়া তো বহুত খাইলি! এই বার বিড়ি দে একটা।
সাদেক মৃদু হেসে বলে; পর পোন্দাইন্যারে চিনলি ভাল মত! প্যাকেট থেকে বিড়ি দিতে দিতে পুরনো কথা শেষ করতে বলে: ভাইরে পোন্দায়া বড় লোক হইল আব্বায়।
দূর থেকে ওদের বিড়ির আগুন জোনাকীর আলোর মত দেখা যায়। বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে আব্দু মিয়া বলে; সাদেইক্যা রে ভাই তুই একটা ওজনদার কথা কইলি!
মাখন এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল। বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে এবার নিজের ভাবনা প্রকাশ করলো: দাদারে আমার মনে লয়, খোরকী, ঘর ভাড়া দিয়া, যা বেঁচবো গাড়ি ভাড়া দিয়া বাড়ি যাইতে যাইতে, যা খরচ কইরা আইলাম হেই টেকাও হাতে থাকব না।
কথায় কথায় চালা ঘরের কাছে পৌঁছে গেল সবাই। পেঁয়াজ, রসুন, আলু কাটাকুটি, চাল ধোয়া, চুলো জ্বালানো শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। অর্কেষ্ট্রার দলের মত, সবাই কোন একটা কাজ বেছে নিল। ক্ষিধায় পেট আর পিঠ এক সাথে লেগে গেছে। দ্রুত রান্না সেরে দুটো মুখে দিতে হবে। দুটো কেরোসিনের চুলায় রান্না চলছে। আলুগুলো ভাতের সাথে দেয়া হয়েছে। ডাল আলাদা রান্না হবে। ডালে বাগাড় দেয়ার সময় মাথাপিছু একটা করে ডিম ভেঙ্গে দেবে। নাড়া না দিলে সাধারণতঃ ডিমগুলো আস্ত এবং আলাদাই থাকে। কোন দিন দু’একটা ভেঙ্গে গেলে সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয়। মাছ-মাংস আব্বার দোকানে থাকে না। আর রান্নার সময়ও নেই। ডালের সাথে ডিমটাই রাতের খাবারের মত, দিনের প্রধান আমিষ। সকাল দুপুর পাউরুটি আর চা-ই ভরসা।
চটপট রান্না বসিয়ে সবাই আবার বিড়ির ধোয়ায় ক্ষিধেটাকে কয়েল জ্বালিয়ে মশার মত দূরে রাখতে চেষ্টা করছে। ভাতের ভাপের দিকে তাকিয়ে বারেক আবার পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এল; আব্বায় টেকা দেইক বা না দেইক, আমি কাইল বাইত যামুগা।
মশা মারতে নিজের গালে থাপ্পর মেরে, হাত দিয়ে ঘষে পরিক্ষা করছে মশা মরল কিনা, সেই অবস্থায় থেকেই আব্দু বলল; টেকা না দিলে বাড়ি যাইবি কেইম্তে?

মজলু এতক্ষন একটি কথাও বলেনি। চুপচাপ ভাতের হাড়ি থেকে আলু গুলো তুলছিল। এবার সেও বারেকের সাথে যোগ দিয়ে বলল; আব্বার পুটকী মারা আর কয়দিন খামু! আগে কইছে হপ্তায় টেকা দিব, হের বাদে কইল, মাসে টেকা দিব। মাস খতম, মাস গিয়া দেড় মাস বাদে হেয় কয়, জাহাজ কাটা শেষ অইলে টেকা দিব। আইজ জাহাজ কাইট্টা নয়া জহাজ ভিড়াইল। টেকাতো দিলনা।

মাখন একটু হিসেবটা মিলিয়ে দেখলো: হুন মিয়ারা, আব্বার দোহানের হেইতানে বেক লেইখ্যা রাখছে খাতায়। একশ টেকা বেতন দিনে। ঘর ভাড়া দৈনিক দশ টেকা, বিয়ানের চা দশ , দুপরের নাস্তা বিশ টেকা। রাইতের খাওন? ষাইট টেকা কেজি চাইল। অহন কও, আব্বায় আমাগো কয় টেকা দিব?

মজলু আক্ষেপের সুরে বলে; ছেবও আমাগো পুটকীও আমাগো, আব্বায় খালী মাইরা গেল!

সাদেক বলে, মজলু ভাই এতকনে একটা কথা কইছ। বউ-ঝি বাড়িত বুখা থুইয়া, জেবের টেকা দিয়া গাড়ি ভাড়া দিলাম, চিডাগাং আইলাম আব্বার পুটকী মারা খাইলাম। লও অহন ভিক্ষা করতে করতে বাইত যাই।
(আগামী পর্বে সমাপিতব্য)


মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি

মজলু আক্ষেপের সুরে বলে; ছেবও আমাগো পুটকীও আমাগো, আব্বায় খালী মাইরা গেল!

দুনিয়া বহুত খারাপ জায়গা একদল খালি মার খেয়ে যায় আরেকদল খালি মেরে যায়। গল্প ভাল লাগল চলুক

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

পুতুল এর ছবি

হ, এই মারা মারিতে কোন সমকামীতা নাই।
যারা মারে হেরা মারতেই থাকে, যারা খায় হেরা খাইতেই থাকে।
ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ, বস।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

গল্পটা ভালো লেগেছে। এই বিষয়টা একেবারেই নতুন। কিন্তু আর একটু বড় করলেন না কেন? কেমন যেন দু টান দেবার পরেই নিভে গেল সিগারেটটি।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

পুতুল এর ছবি

আসলে বড় করার উদ্দেশ্যেই শুরু করছিলাম। এই টুক লিখে দেখি পোস্ট করা যায়। তাই কইরা দিলাম। কিন্তু আরেক পর্বে শেষ করব। বড় গল্প লেখতে ভয় লাগে। অনুগল্পের যুগ তো। কিন্তু এই গল্পটা শেষ করব।
পড়ার জন্য এবং ঠেলার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হ... শেষ হয়া গেলোগা মন খারাপ
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পুতুল এর ছবি

ঠিকাছে বস, আগামী পর্বে শেষ করব।
পড়ার জন্য ধইন্যাপাতা।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

স্বপ্নহারা এর ছবি

ভাল লেগেছে; কিন্তু শেষের প্যারাগুলোতে লাইন গ্যাপ দিলে আট্টু ভাল হইত...দেঁতো হাসি

হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

পুতুল এর ছবি

চেষ্টা করলাম। আশা করি একটু ভাল লাগবে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ স্বপ্নহারা(?)।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'মাটিখোর' নামে আপনার আরেকটা গল্প আছেনা?
এবার লোহাখোর- পড়ছি।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

পুতুল এর ছবি

আছে বস, লোহাখোর (ঠিক করে দিলাম) কাল পরশু শেষ হবে।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।