হা-ডু-ডু

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ১৭/০৮/২০০৯ - ৩:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাউরা জারুরও খালি দুই পা, দুই হাতই আছে! এক পাউরা জারু আর কয় পয়েন নিব! আলি আজগরের কথায় সবাই যেন একটু সচকিত হয়।

ভাড়াটে খেলোয়ারের চিন্তাটা তবুও বাসেদ-এর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। তার রেশ ধরেই বলে,
-দেহ মিয়ারা ষোল গেরামের লগে জিত্তা ফাইনাল খেলায় ঠগলে গেরামের মান থাহে! হের লাইগ্যাই কই, অহনও টাইম আছে চিন্তা কইরা দেহো। বাঘা রোস্তম একলাই একশ। হেরে আনলে খেলায় আমরা জিতুম। ঢাকারগাঁও গেরামের পক্ষে পাউড়া জারু খেলুক আর কালাচোরাই খেলুক।

-হুন বাসেদ মিয়া গেরামের পোলারা খেইল্যা আমাগো গেরাম ফাইনাল তক নিছে। ফাইনালে যদি হেরা ঠগেও কোন দুঃখ নাই। বেলতলী গেরাম ভারাইট্টা খেলোয়ার দিয়া খেলব না।

-এই সব কথা থুইয়া অহন হুনেন আমাগ গেরামের খেলোয়ারা কি কয়! খেলব হেরা, হেগ কতাই সই। আমরা থল্লার কান্দাত খাড়ায়া খালি হাত তালি ছাড়া কিছু দিতাম পারতাম না। কিরে গেরাপি হক্কা, তুই কি কস? কাসেম মেম্বারের প্রশ্ন।

গেরাপি মানে নোঙ্গর, হক ডু নিয়ে প্রতি পক্ষের খেলোয়ার নিজের কোনায় এলে হাত বা পায়ের যেখানেই ধরুক না কেন, সে আর ছুটে দম নিয়ে নিজের থল্যায় ফিরতে পারে না। সে জন্য নাম গেরাপি হক্কা।

-বেয়াদপী মাফ করবেন মুরুব্বীরা। আমার বায়ে যদি ব্যাঙ্গা হানিফ থাহে, তয় আজরাইলও ছুটতারতো না। আত্মবিশ্বাসী হক্কার সুনিশ্চিৎ জবাব।

হানিফ ব্যাঙ্গের মত লাফ দিতে পারে সে জন্য ব্যাঙ্গা হানিফ। হক্কা গেরাপি মারার সাথে সাথে হানিফ লাফ দিয়ে ডু নিয়ে আসা প্রতি পক্ষের খেলোয়ারটি জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। দলের বাকী সবাই উপরে পরে চাপ দিয়ে রাখে যাতে বিপক্ষ দলের খেলোয়ারটি দম রেখে নিজের ঘরে ফেরৎ যেতে না পারে। মনা আর তজা পালাক্রমে ডু দেয়। ওদের হাত পা বন্দুকের গুলির আগে চলে। প্রতি পক্ষের ঘরে গিয়ে এমন একটা দূরত্বে দাঁড়ায় যাতে ছোঁয়া মাত্র এক লাফে নিজের ঘরে আসতে পারে। একবার ডু নিয়ে গেলে এরা এক পয়েন্টের বেশী আনতে পারে না। কিন্তু ধরা পরে প্রতিপক্ষের এক পয়েন্ট বাড়িয়েও দেয় না।

তজার আসল নাম তজুমুদ্দীন। কিন্তু গ্রামের সবাই সংক্ষেপে তজাই ডাকে। হক্কার কথায় একটু ভরসা পেয়ে তজা বলে; দেহেন, আপনেরা খেলাডা আমাগো থেইক্যা কম বুঝেন না। তয় একটা কথা কইতে পারি; পাউরা জারু ভালা ডু দেয়, কিন্তুক বেশী খাইতে গিয়া অল্পের নাগালও পায় না। হক্কা আর বেঙ্গা যদি পাউরারে দুইবার রাখতে পারে, দেখবেন হেগ বেকতের ক্ষেমতা কেইম্তে কমে! আপ্নেগরে কইতারি; খেলাত নামলে বেকতেরে খেলোয়ারই দেহি। উন্নিশ-বিশ খেলায় থাকতে পারে। কিন্তুক আঠারো-বিশ অইব না।

মনা এবার আরেকটু আগে বাড়ে, সাহস দেয়; এক পয়েন কইরা আনুম। খেলাডা পয়েনের খেলা, মরা-জেতার খেলা না। আপ্নেরা খালি থল্লার কান্দায় খাড়ায়া সাহস দিবেন।

কাসেম মেম্বর সভার অন্যগ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে কয়; অই মিয়ারা আপ্নেরা কি কন? গেরামের মান- ইজ্জত লইয়া কথা।

সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ এই সভায় বকস আলী। হুকো পাশে বসা কিতাব আলীর হাতে দিয়ে বলেন; হুন মিয়ারা, নিজের পোলা কানাও ভালা। চোখে না দেখুক মুখে বাপ ডাক ঠিকই দিব। ছেড়ারা বহুত মেন্নত কইরা এতদ্দূর আগ্গাইছে। বাকীডাও পারব। আমরা গেরামের বেবাক মর্দা হেগ লগে আছি। নাকী মিয়ারা কথা মিছা কইলাম?

সবাই এক সাথে কথা বলায় মিছিলের শ্লোগানের মত শোনাল; হ, আমরা বেকে হেগো লগে আছি।

হাটবারেও সুন্দলপুর বাজারে এত মানুষ হয় না। বাজারের অস্থায়ী এলাকায়, যেখানে হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগলের হাট বসে খেলাটা সেখানেই। মাঠের আশে-পাশের গাছের ডালগুলিতেও বানরের মত মানুষ ঝুলছে। দূর থেকে পাউরা জারুর কাবাডি কাবাডি করে ডু নিয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। রেফারী উচ্চস্বরে হাঁক দেয়; বেলতলী এক পয়েন। মানে পাউরা জারু হক্কার গেরাফি থেকে ছুটতে পারে নাই। বকস আলী ভাঙ্গা গলায় চেঁচিয়ে উঠে, সাবাস বাজানেরা সাবাস!

এদিকে ঢাকারগাঁও গেরামের কালু মাতবর হাক দেয়; ওস্তাদের মাইর শেষ রাইত।

ঘামে খেলোয়ারদের শরীর পিছল হতে থাকে। হক্কা বারবার হাতে বালি মাখে। এখন দুই গেরামের মানুষ ভলান্টিয়াররা আর বসিয়ে রাখতে পারছে না। বেলতলী গেরাম দুই পয়েন্টে এগিয়ে। তিন ডুয়ে নয় পেয়েন্ট নিতে পারলে ঢাকারগাঁও জিতবে। বেলতলী গেরামের পক্ষে মনা আর তজা কে দুই ডুয়ে চার পয়েন্ট আনতে হবে। অবশ্য তিনবার পাউরা জারু দম নিয়ে আসলে তিন বারেই তাকে ধরে বেলতলীর থল্লায় রাখতে হবে। কাজটা খুবই কঠিন। এদিকে পাউরা জারুর হাটুতে ঢুশ লেগে হক্কার ঠোঁট কেঁটে রক্ত ঝরছে। হক্কা বার বার থল্লার বাইরে রক্তমাখা থুথু ফেলছে। ঢাকারগাঁও গেরামের কলিমদ্দীন বিজয়ের হাসি দিয়ে কাসেম মেম্বরের দিকে তাকাচ্ছে। একা ডু দিতে দিতে পাউরা জারু অনেক ক্লান্ত।

শেষ ডুয়ে মনা দুই পয়েন্ট না পেলে বেলতলী গেরামের পরাজয় অবধারিত। লোকে লোকারন্য সুন্দলপুর বাজারের মানুষগুলো দম নিতে ভুলে গেছে। মনা কোন ডুয়ে দুই পয়েন্ট এখনো পর্যন্ত নিতে পারে নাই। এবার কী পারবে? দুই পয়েন্টের ব্যবধানে হেরে যাওয়া খুবই কষ্টের, কিন্তু সম্মানও আছে। আমরা প্রতিপক্ষের চেয়ে কোন অংশে কম নই। নিজের গেরামের পোলাপাইন খেলছে। কাসেম মেম্বর ভাবছে মনা যদি দুই পয়েন্ট আনতে না পারে, উপহারের পিতলের কলসী সে নিজের হাতেই ঢাকারগাঁও গেরামের খেলোয়ারদের হাতে তুলে দেবে কিনা। নিজের গেরামের ছেড়ারা বেফানা একটা খেইলা দেখাইছে। গরু জবাই কইরা বেকটিরে খাওয়াইব। লগে ঢাকার গেরামের খেলোয়ার আর পরধাইন্যাগরেও দাওয়াত দিব।

থল্লায় ডু নিয়ে যাওয়ার আগে খেলার শেষ ডু বলে মনা মাটিতে হাত দিয়ে কপাল আর বুকে মাটি মেখে নিল। সবাই নীরব বলে মনার ডু শোনা যাচ্ছে; “পাত্থরানা মানিক চাঁন দিঘী কইট্টা পানি আন”। থল্লার কোনায় বেলতলী গেরামের বাকী তিন খেলোয়ার হাতে হাত রেখে চরম উত্তেজনাময় মূর্হুতটি দূরু দূরু বক্ষে পর্যবেক্ষণ করছে। মনার উপর এখন তুমুল চাপ।

জান থাকতে মান দেবেনা এমন প্রতিজ্ঞায় মনা ডান কোনায় দাঁড়িয়ে একমনে জপছে “পাত্থরানা মানিক চাঁন দিঘী কাইট্টা পানি আন”। হাতে সময় বেশী নেই। আক্রমনের আশংকা খুব কম। মনা খালি হাতে ফিরে গেলেই ঢাকারগাঁও জিতবে। মনাকেই আক্রমন করতে হবে। বাঁয়ের কোনার খেলোয়াররা বেঁকে এসে থল্লা অর্ধেক করে ফেলেছে। ডান কোনার জহুর আলী সামনের দিকে কিছুটা ঝুকে আছে। পা দিয়ে ছুঁতে গেলে নির্ঘাত ধরা পড়বে। কিন্তু পা দিয়ে ছোঁয়ার ভান করলেই বাঁ কোনার তিনজন এগিয়ে আসবে মনাকে ঘিরে ফেলতে। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্গের মত ফাল দিয়ে নিজের থল্লায় গিয়ে পরা অসম্ভব মনে হচ্ছে না। এছাড়া কোন উপায় মনার মাথায় আসছে না। এক পয়েন্ট নিয়ে ফেরৎ গিয়ে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে দুই পয়েন্টের ঝুকি নেয়াই যুক্তি সংগত। বাঁ পায়ে যথেষ্ট ভর রেখে মনা ডান পায়ে জহুর আলীকে ছোঁয়ার ভান করতেই মনার ফাল দেয়ার পরিস্থিতি তৈরী হল।

এখন মনা শুধু বলছে; দিঘী কাইট্টা পানি আন, দিঘী কাইট্টা পানি আন, শেষবার বলেই সবার মাথা ছুঁয়ে মনা নিজের থল্লায় একেবারে বাকী তিনজনের বুকে এসে পড়ল।
সবাই মনাকে কাঁধে নিয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল।


মন্তব্য

ভুতুম এর ছবি

ভালো লেগেছে গল্পটা।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বস, এতো গল্প নয় - বাস্তব। যারা জীবনে হা-ডু-ডু খেলা দেখেন নি তাদের কাছেও চিত্রকল্পটি পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে। চমৎকার।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

অসাধারন!!! পান্ডবদার সাথে একমত।

কীর্তিনাশা এর ছবি

টান টান উত্তেজনা ভরপুর একটা হা ডু ডু খেলা উপভোগ করলাম। হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

বালক এর ছবি

ভালো লাগলো। হাসি

_____________________________________________
কার জন্য লিখো তুমি জলবিবরণ : আমার পাতার নৌকা ঝড়জলে ভাসে...

____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

শেষ কবে হাডুডু খেলা দেখছি মনে পড়ে না। তবে গল্প পড়ে যেন আসল খেলাই দেখলাম! বস, গল্প হেভি জীবন্ত হইছে।
........................................................................................................

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ ব'সে অপেক্ষা করার সময় আছে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এইটা একটা ডকু গল্প... পুতুলদার লেখার এই ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে... খুব জীবন্ত...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সেরকম গল্প। চলুক

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

জোশ গল্প বস ! ভালো লেগেছে...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

রেজুয়ান মারুফ এর ছবি

এতো চমতকার একটা গল্প পড়তে অনেকটা দেরী করলাম জন্যে খারপ লাগতেছে।

---------------------------------------------------------------
আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কাব্য নিয়ে ঘুরি।

আমার জীবন থেকে আধেক সময় যায় যে হয়ে চুরি
অবুঝ আমি তবু হাতের মুঠোয় কব্য নিয়ে ঘুরি।

পুতুল এর ছবি

মন্তব্যের জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

দিঘী কাইট্টা পানি আন, দিঘী কাইট্টা পানি আন...

মনা পানি আনল তাহলে! .. এখন বোধহয় গ্রামে গ্রামে হাডুডুর বদলে ক্রিকেট খেলা হয়।

খুব ভালো লাগলো গল্পটি....!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

হাডুডু খেলা এত দ্রুত ইতিহাস হয়ে গেল!
সত্যিই এখন গ্রামে কিরকেট খেলা হয়।
গোল্লা ছুট, দাঁড়িয়া বান্ধায়, বৌঁচি, ডাংগুটি কেবল আমাদের জাবুর কাটার পুঁজি।
ধন্যবাদ তীরুদা, আছেন কেমন?
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

দুর্ধর্ষ লেখা! ছবির মতো দেখতে পেলাম সবই। দম নিতে গিয়ে মনার বুকের ছাতি ফুলে উঠছে, উত্তেজনায় টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষগুলো। আপনি ছবি বানালে দারুন উন্নতি করতেন!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।