শাঁখা, সিঁদুরহীন বিবাহিতা যুবতী মেয়েকে দেখে মায়ের যে অবস্থা হয়, প্রথম দর্শনে সাদা থানে শ্রাদ্ধর অপেক্ষায় নির্মলকে দেখে অলকার তেমনই হল। কেন কে জানে! অথচ অলকার বালিকা মনে দেহের সাথে পাল্লা দিয়ে এসেছে মিলনের জোয়ার। মায়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অলকা নির্মলকে জল-খাবারটা এনে দেয়। কাঁচা বয়স কি আর জাত পাতের ধার ধারে! যৌবনের ধর্মে বিধাতার বিধান অকেজো। ধীরে ধীরে তার নারী হৃদয় মধুলোভী মৌমাছির মত ফুল পিয়াসী অস্থিরতায় নির্মলকে দেখার নিমিত্ত খোঁজে।
যাত্রাপালার রাজকুমার শিকারে এসে বনের কাঠুরিয়ার মেয়ের হাতে জল খেয়ে গান ধরে;
জল খাইতে গিয়াছিলাম
দীন ভিখারীর বাড়ি
যে জন মোরে জল দিয়াছে
মানুষ কিবা পরীরে।।
নির্মলের গরুগুলোর একটাকে সে কল্পনায় ঘোড়া সাজিয়ে রাজ কুমার নির্মলকে তার পিঠে চড়িয়ে শিকারে পাঠায়। নিজে কাঠুরিয়ার মেয়ে হয়ে মাটির গড়ায় জল নিয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন রাজ কুমার নির্মল আসে। কি ক্ষতি হতো নির্মলকে যদি ভগবান অলকার জন্য রাজ কুমার না হোক নিদেন পক্ষে ব্রাহ্মণের ছেলে করে জন্ম দিতো। মানুষের তৈরী বিধানে ভগবানের তো হাত নেই। এতদিনের প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা বিশ্বাসের কাছে সত্য পাহাড়ের গায়ে লাগা ঢিলার মত তুচ্ছ। নব যৌবনা অলকার অবাধ্য মন সংস্কারের পাষানে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আহত পাখীর মত অসহায় ভাবে চুপ করে থাকে।
বসন্তে কালো পাহাড়ের, নাম গোত্রহীন গাছগুলো অপূর্ব রং-এ সেজেছে। যেনো কোন শিল্পী নিপুন হাতে দুনিয়ার সমস্ত রং দিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত একটা ছবি এঁকেছে। এখনো না কামানো দাঁড়ি-গোফে নির্মল সাদা থানে যোগী সেজে ভিখেরীর আসনে এই উৎসবের একমাত্র বেমানান অতিথি। অলকা বুক ভরা জ্বালা মেটাতে সাত সাগরের জল চোখে ধরে রাখে। গভীর জলের মত সেখানে ঢেউ নেই। নির্মলের জন্য অলকার ব্যথাকে বিলাসিতা করে লোকে বলে প্রেম, বিরহ দিয়ে যার শুরু।
এতদিন যারা আড়ং-এ নিমাইয়ের কান ঝালাপালা করে তুলতে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিতো, তাঁরা যথেষ্ট সদয় হয়ে নির্মলকে পিতৃ বিয়োগের শোকটা কাঁটিয়ে উঠতে সাহায্য করলো। মানুষের শ্রেণী বিভক্তি কাঁটার মত বিঁধতো বলেই নির্মল গরু নিয়ে পাহাড়ের আনাচে কানাচে পরে থাকতো। এখন আর সে সুবিধা নেই। সংসারের সমস্ত জঞ্জাল সামালাতে হয় নিজেকেই।
দিনে দিনে দুধের খামার আভিজাত্যের প্রতিক হয়ে উঠেছে। বিলেতি কায়দায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ডেইরি ফার্ম। ছোট ছোট অনেকগুলো টিলার বৃষ্টির জল যে নালাটা দিয়ে তামাবিলে নেমে যায়, তার দু’ধারে মসৃন সবুজ ঘাসের গালিচায় অলস ভাবে নির্মল শুয়ে বসে বাঁশিতে হৃদয় মেলাত। অনেকটা ঝর্ণার মত ছিল সে বাঁক। এখনো আছে। তবে জল আর আগের মত স্বচ্ছ নয়। আশেপাশের ফার্ম আর টিলার গায়ে ব্যাঙ-এর ছাতার মত গজিয়ে উঠা ইট-পাথরের পিঞ্জর থেকে বের হওয়া আর্বজনার মিছিল জলকে করে তোলো নোংরা।
বৃষ্টির পর উপত্যকার মত ঢালু জায়গাটা স্নান করে জল থেকে উঠলে অলকাকে যেমন দেখায় অনেকটা তেমন। সে জন্যই নির্মল খামারের কামলাদের সাথে বাক-বিতণ্ডা এড়িয়ে একেবারে জলের ধারে বসে থাকতো গরু নিয়ে। ধীরে ধীরে ঘাসের জমি বাড়ির আঙ্গিনায় বসত গড়েছে। দেয়াল গেঁথে গেঁথে ফালি ফালি করে কাঁটা হচ্ছে মাটির শরীর। মানুষ শকুনের মত হন্যে হয়ে ঘুড়ছে নতুন আবাসন যোগ্য জমির খোঁজে। “এই জমির মালিক খরিদ সূত্রে অমুক” লেখা সাইন বোর্ড গোত্তা খাওয়া ঘুড্ডির মত ছড়িয়ে আছে বিচ্ছিন্ন ভাবে। বৌচি খেলার মত এঁকে বেঁকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হয় নালার দিকে। বৃষ্টিতে জল জমে বলে এখনো সে সব জায়গা দখল মুক্ত।
গরু নিয়ে বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়। আগে দু’পাশে গাছ-গাছালী আর ঝোঁপ-ঝাঁড়ের ভেতর দিয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরতে গা ছম ছম করতো। এখন সাবধানে থাকতে হয় পুরানো পথের দু’ধারে বাবুদের নতুন বাড়ির বাগানে ফোটা ফুলের কলিতে যেন গরু মুখ না দিয়ে ফেলে। কিন্তু গরু কি আর মানুষ! যে এত বাছ-বিচার করবে! আজ এ বাড়ির গন্ধরাজ খেয়েছে তো কাল ও বাড়ির ডালিম। এই সব হাঙ্গামায় নির্মল এম্নিতেই খুব কাহিল। দুধ নিয়ে আড়ং-এ গেলে উপযাচক হয়ে লোকে শুরু করে বিষয়-সম্পত্তির কথা। ঝামেলা মেটাতে গরুই বেঁচে দিয়েছে নির্মল। কয়েকটা দিন কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এখন সয়ে গেছে। বাঁশিটাও আর আগের মত টানে না। এদিকে এই এতটুকু ভিটের দখল নিতে লোকের ছলচাতুরী দেখে বিব্রত হয় সে। গরু গুলো বেঁচে দেয়ায় লোকে ধরেই নিয়েছে নির্মল ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাজেই এখন আর অবহেলা করা যায় না। যে যখন যেখানে পায়, বাবার জন্য একটু দুঃখ প্রকাশ করে আসল উদ্দেশ্যের দিকে আগায়;
-গাই তো বেচি লাইছো, আমরারে খোন্তা জিগায়লা না। সামনে খিছু খরতে অখটা মাত মাইত্য বা। থোমার বাফে আমরার দোস্ত আছল। আমরার দুই ফোয়া লন্ডন, তরে আমরা ঠখাইতাম ন। হগলে যা দেয় তার তাখি অখটা টেখা কম দিতাম ন।
আলতাফ হাজীর কথা শুনে নির্মলের চোখ ধীরে ধীরে মাটির টানে মাটিতে গিয়ে ঠেকে।
নিমাই বিষয় সম্পত্তির কথা ছেলের জন্য রেখে গেল! এত বিশাল সম্পত্তি নিমাইয়ের কখনো ছিল না। কিন্তু এই যে ভিটার উপর ছনের চালা আর সাথে গরু বাঁধার চাতালটা পেরিয়ে গা ধোয়ার জন্য একটু ডোবার মত, তার অধিকার পেতেই টাকাওয়ালা লোকেরা তদবির করে বিস্তর। কোলকাতায় যাদের থাকার মুরোদ আছে তারা অনেক আগেই চলে গেছে। এখন যারা যাচ্ছে তারা সংখ্যা গুরুদের চাপ সহ্য করতে না পেরে যাচ্ছে। সব চেয়ে দুর্বল যে, আক্রমন তাকেই মোকাবেলা করতে বেশী। নিমাই ছেলের কাঁধে সব দায়ীত্ব দিয়ে বেঁচে গেছে। লোভ, ভয়, সুন্দর ভবিষ্যৎ-এর স্বপ্ন এখন নির্মলকে একাই সামলাতে হয়। এই সব বিক্রিয়ায় নির্মলের মনে হয়; যে সব চেয়ে বেশী দাম দেবে তার কাছে ভিটে মাটি বেঁচে ওপারে চলে যাওয়াই ভাল। অলকাকে জিজ্ঞেস করে দেখবে, যদি নির্মলের সাথে যেতে রাজি হয়! নতুন দেশে গিয়ে সব চেয়ে সুবিধা জনক পদবী নামের সাথে যোগ করে নেবে। সে ক্ষেত্রে অলকার বংশ মর্যাদা নির্মলকে বেশ সুবিধাই দেবে। কিন্তু কে জানে অলকা আদৌও রাজি হবে কী না! (চলবে)
মন্তব্য
কাহিনী জমে উঠছে বেশ! বাক্যগঠনে এবার আগের সেই সমস্যা নেই দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে খুব। চলুক!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধন্যবাদ তীরুদা।
আশা করি আগামী পর্বে শেষ করতে পারব।
ভেবেছিলাম দুই পর্বে শেষ হবে, কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে তিনটা হয়ে গেল।
গল্প এত বড় হওয়া ঠিক না। যাই হোক পরের পর্বে দেখা হবে আশা করি।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
দুই পর্ব একত্রে পড়লাম। ভালো লাগছে।
আগামী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ মৃত্তিকা,
আপনার ভাল লেগেছে যেনে আনন্দিত হলাম।
আগামী পর্বে দেখা হবে আবার।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ভাল লেগেছে ।
চলুক না । পর্ব বেশি হলে কী বা আসে যায়?
ধন্যবাদ গৌরীশ রায়,
না পর্ব বেশী হলে তেমন কিছু না। কিন্তু অনুগল্পের যুগে মেগাগল্প লিখতে একটু ভয় করে। লম্বা লেখা দেখে পাঠক পালাবে না তো! কিন্তু আপনার মন্তব্যে ভরসা পেলাম। পরের পর্বে দেখা হবে আবার।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
হুম ভালো লাগলো। চলুক
দলছুট।
ধন্যবাদ দলছুট।
সে কথাই রইল।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
চলুক বস।
_____________________________________________
তুমি হতে পারো একটি স্বার্থক বিষাদের সংজ্ঞা। স্বার্থক নদী, স্বার্থক ক্লান্তি অথবা স্বার্থক স্বপ্ন।
____________________________________________________________________
"জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক;
আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো
এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।"
ধন্যবাদ বালক,
কিন্তু আপনার লেখা কৈ? নতুন লেখা দেন মিয়া।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
"যৌবনের ধর্মে বিধাতার বিধান অকেজো।"------------আগের পর্বটির চেয়েও এটি বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে। অপরিকল্পিত ভাবে আরেকটু বড় হলেও মন্দ হবে না।
এস হোসাইন
---------------------------------
"মোর মনো মাঝে মায়ের মুখ।"
এস হোসাইন,
ধন্যবাদ, লেখা লম্বা হলে (বিশেষ করে গল্প) নিজের মূর্খ্যতা ধরা পরে যাওয়ার ভয় থাকে। পাঠকের আগ্রহ কমে যায়। সে জন্য একটু ভয়ে থাকি। আপনার মন্তব্যে ভরসা পেলাম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ভালো চলছে। আপনি বস বেশ কিছু শব্দে অপ্রয়োজনীয়ভাবে চন্দ্রবিন্দু দেন। যেমন দেয়াল গেঁথে গেঁথে ফালি ফালি করে কাঁটা হচ্ছে মাটির শরীর।। এখানে আপনি কাটা বুঝিয়েছেন নিশ্চই।
বেশ কয়েকটা লাইন আছে মারাত্মক ভালো।
ঠিক ধরেছেন বস। কাটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। কাঁটা এবং কাটার পার্থক্যটাও এখন বুঝলাম। এই রকম অনিশ্চয়তা আরো অনেক আছে। সব চেয়ে বেশী বিপদ হয় (বই) পড়া, (কাপড়) পরা (আকাশ থেকে) পরা (?) ইত্যাদি শব্দ নিয়ে।
যে লাইন গুলো ভাল বললেন সেগুলো লেখার সময়ও ভয়ে থাকি। বেশী তেনা প্যাচাতে গিয়ে কোন ভুল করে ফেলাম নাতো! আপনার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রকৃতিপ্রেমিক।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়ছি৷ চলুক৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
ধন্যবাদ দময়ন্তী।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
চলুক
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ নিবিড়।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন