দূরের কোন গাঁয়-শেষ পর্ব

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: রবি, ২৯/১১/২০০৯ - ৭:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দূরের কোন গাঁয়-১
দূরের কোন গাঁয়-২
আধো ঘুম আধো জাগরণে কোন কিছুই ধারাবাহিক ভাবে অলকার কাছে ধরা দেয় না। মিয়া সাবের মাহফিল দিয়েই বোধহয় দুঃস্বপ্ন গুলো মাথায় কামড়ানো শুরু করে উকুনের মত। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় বাবার মন্ত্র পাঠ; ওঁ নারায়নং নমস্কৃত্য নমচৈত্য নমঃ। অলকার ভাবনার সূতো আবার ছেড়ে। মাথার এলোমেলো চুলে উকুনের উপদ্রব অতিক্রম করে সহ্যের সীমা। দু’হাতের দশ আঙ্গুল চুলের জটায় সন্ধান করে সব অকারণ। ছিন্ন শাড়ীর মলিন আঁচলে অলকা শীর্ণ ক্লান্ত হাতে মুখ ঢাকে আর হৃদয়ে তখন গুতা মারে নির্মলের চোরা মুখ; কইলকাতা যাইতিনি? গেলে আউক্যা।

যেন অলকার যাওয়া আসায় নির্মলের তেমন কিছু আসে যায় না। এমন উপযাচক হয়ে কারো সাথে জীবনের জন্য পালানো যায়! একটা রাত্রি অন্তত সময় দে। না এখন গেলে যাবি না গেলে যাবি না। রাগের আগে অনু যোগ না করেই অলকা বলে দিয়েছে; আমি আফনের বউ ? আফনে কইবায় আর আমি আফনের লগে ঢাকা দিল্লী যাইতাম?

এই রাগের সুর ধরতে না পেরে নির্মল সে রাতেই চলে গেছে। অথচ অলকা অপেক্ষা করেছে। প্রাণ বন্ধুর জন্য জাতি কূল মান সব চুলোয় যাক কোন ক্ষতি নেই। তবু সে যাবে। কিন্তু বোকা নির্মল আরেক বার গিয়ে অলকাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলো না। সে ধরেই নিল, অলকা এত দিনের সংস্কার নির্মলের জন্য বিসর্জন দিতে পারবে না।

নির্মলের চলে যাওয়ার খবর খুব ঘটা করেই ছড়িয়ে দেয়া হল। তুলসী গাছ জলে ফেলে নির্মলদের বাড়ীর পৌত্তলিকতা রহিত হল। রাতারাতি সীমানায় বেড়া দেয়া হল। মোরগের রক্তে রঞ্জিত গাঁথুনীতে বসতে শুরু করলো ইট। তিন মাসের মধ্যে অলকাদের বাড়িটা পরিনত হল চইড়া রাইয়তে।

এদিকে নির্মলকে বিদেয় করে লোকের মনে এসেছে জয়ের জোয়ার। সাধাসাধি লোভ বা ভয়ে কোন কাজ না হলে সত্যি সত্যি কোন কিছু ঘটে যেতে পারে এমন হুমকিও বাদ গেলনা। কিন্তু অলকার বাবার তো আর নির্মলের মত এক পেট এক চেট নয়; বুড়ো মানুষ। দূর্গা পূজা ছাড়া বছরে যে দুএকটা বিয়ে-শাদি, পূজা-অর্চনা, শ্রাদ্ধ হয় তাতে দাক্ষিন্যের চেয়ে দয়ার মাত্রা থাকে বেশী। দয়া দাক্ষিনে সংসার চলে না। চালাতে হয়। তবুও বাপ-দাদার বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে পণ্ডিত বাবু। কিন্তু নাছোড় বান্দার মত লোকেরা পণ্ডিত বাবুর নিরুপায় অবস্থাকে অনড়-অটল প্রতিজ্ঞা ভেবে আরো মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে।

অলকা ভেবে পায়না ওদের বাড়িটাই কেন লোকে কিনতে চায়। আরো অনেক গরীব মানুষ এ গাঁয়ে আছে। তাদের বাড়িতো কেউ এভাবে উপযাচক হয়ে কিনতে যায় না।

আসতে যেতে পাড়ার যুবকদের সামনে পরে গেলে অলকাকেই যেন বেশী অশ্লীল কথা শুনতে হয়। নিজেকে নিয়েই বিস্তর ভাবনায় অস্থির থাকে সে। নির্মল এত চাড়াহুড়া করলো কেন! নিজের সাথে নিজে এত বোঝা পড়ার পর অলকা যে সিদ্ধান্ত নিল, নির্মল সেটা টেরও পেল না! তার উপর এত্ত নোংড়া কথা শুনে মাথা ঠাণ্ডা থাকে কতক্ষণ! সে দিন সেলিম যখন বলল; অই ফুরি তোর চুলাটা দিবায়নি, আমার আলুটা পোড়া দিতাম। রাগে অলকার রক্ত মাথায় উঠে গেল। এসব শুনে অলকা অভ্যস্ত। কিন্তু সেদিন মাথা ঠিক রাখতে পারেনি জবাব দিয়ে দিল; তোর মারটায় নিয়া পোড়া দে।

-অই মালাউনের ফুরি দেখতায়নি করাটায় পোড়া দিতাম?

অলকার বুক ধড়ফড় করে উঠল। কি বিপদ ডেকে আনল সে। হায় ভগবান আমাদের মত অনাথদেরই কেন সব জ্বালা পোহাতে হয়!

বাবার গোঙ্গানী, মায়ের আর্তনাদ ভেদ করে অলকার কানে গেল শুধু- “অই মালাউনের ফুরি দেখ কার চুলায় আলু পোড়ে।“ মেঝেতে শোয়ানো, হাত দুটোতে দু’দিকে দু’জন বসা। মাথাটা চেপে রেখেছে কেউ মাটির সাথে। হাতের মত পা দুটোয় বসে থাকা মানুষ গুলোও পাথরের মত ভারী। অলকা কিছুতেই হাত, পা, মাথা নড়াতে পারছে না। নির্মলের গরুর শিং গুলো অদল বদল করে বিদ্ধ করছে অলকার যোনী। নির্মল তোর গরু গুলো সামলা। মুখের ভেতর গামছা ঢোকানো থাকায় অলকার কথা কেউ শুনতে পেল না। রক্তে ভেসে গেল অলকাদের ঘরের মাটির মেঝে। ওরা কখন গেল সেটা অলকা টের পায়নি। সকালে মায়ের মুখে শোকের ছায়া আর শরীরের যন্ত্রনায় বুঝলো সে যা ঘটেছে তা দুঃস্বপ্ন ছিলনা।

কিন্তু অলকারা সেটা দুঃস্বপ্ন হিসাবেই নিল। এখানে এ বিষয়ে নালিশ করার কেউ নেই। কোথায় আছে অলকাদের তা জানা নেই। একমাত্র ভগবান ছাড়া নালিশ আর কে শুনবে।

ভগবানের লীলায় কাংক্ষীত সময়ে অলকার ঋতুশ্রাব হল না। পুরো পরিবারের কেউ কারো সাথে তেমন কথা বলতে পারছে না। অসহায় ভাবে মা অলকার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা চোরের মত মুখ লুকিয়ে রাখে। অলকাও ঠিক বুঝতে পারে না তার কী করা উচিৎ। এভাবে দিন গড়ায়। ভগবানের লীলা অলকা ধীরে ধীরে টের পায়।

শান্ত, নিরীহ দিন গুলো আকাশের মেঘের মত চলে যায়। অলকা বুক ভরা ব্যথা চোখ ভরা জল নিয়ে শ্রাবনের অপেক্ষায় থাকে। মানুষ শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চায়। কিন্তু গর্তের সাপের মত তাঁকে বার বার দংশন করে যে দুঃস্বপ্নের স্মৃতি তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে কি করে? দীর্ঘ শোকের রাতের মত তাঁর চারপাশে শুধু অন্ধকার। সে আলো আঁধারে অলকা আধো ঘুম আধো জাগরনে ভাবনার সূঁতো ছিড়ে।

আলতাফ হাজীর মসজিদে মিয়াছাব বলেছিলেন; বেনামাজী মানুষ ছোঁয়া পাপ। শাস্ত্র মতে নির্মলকে ছোয়াও অলকার পাপ। মানুষে মানুষে এত বিভেদ, জাত-পাতের এত বাছ-বিচার! তার প্রায়শ্চিত্য অলকা একা করবে কেন! নিজের কর্তব্য সে স্থির করে ফেলে। সংস্কারের এই বন্দীশালা থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে বিনাশ করতে হবে মানুষের ব্যবধানের আশ্রয় কেন্দ্র গুলো । নির্মলের সব চেয়ে বড় বাঁশিটা অলকা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। সেটাতে আঁচলের ছেড়া অংশটা পেচিয়ে আগুন ধরাল। প্রথম আগুন জ্বললো আলতাফ হাজীর মসজিদে। তার পর যে ঘরে বাবা ঠাকুর পুজা করেন জ্বললো সে ঘরটা। দাউ দাউ করে জ্বলছে চারিদিক। জ্বলে- পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাক পাপের পূজামন্ডপ। অলকার গায়ে একটু যেন তাপ লাগছে। মাথার উকুনেরা সব একসাথে মরন কামড় দিল। কিন্তু এদিকে অনুভূতিকে আকৃষ্ট করার কোন ইচ্ছা এখন অলকার নেই। সে চিতার আগুনে বসে জগৎ-এর পাপকে অভীসম্পাত করছে; নির্মল, মানুষের জাত-পাত জ্বালাইয়া দিলাম রে। ধোয়ার কুণ্ডলীতে কন্ঠনালী রুদ্ধ থাকায় কথাটা ঠিকমত শোনা গেল না!


মন্তব্য

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি:

সংস্কারের এই বন্দীশালা থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে বিনাশ করতে হবে মানুষের ব্যবধানের আশ্রয় কেন্দ্র গুলো ।
-ব্যাপারটা আমার মাথায়ও রাখলাম।
.
পুনশ্চ: আমারই বানান ভুল অন্যেরা ঠিক করে দেয়। তবুও বলা উচিত অলকার ক্ষেত্রে তার লেখার সময় চন্দ্রবিন্দু নিষ্প্রয়োজন।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই আশা করি এখন থেকে নিয়মিত থাকতে পারেবেন।
বানান ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। পিডিএফ অভিধানের জন্য শুকরিয়া। মাগনা একটা পিডিএফ পড়ার প্রগ্রাম পেলে আরো ভাল হতো।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।