মাসিক আড্ডায় এবার আমরা চারজন। তীরুদা মেলা থেকে অনেক বই এনেছেন। জাহাজী যাযাবর, অন্ধরাতের ঘোড়া উশী ভাবী আগেই দিয়েছেন। বিরানীর পরে যাই যাই করতে করতে আমরা গেলাম তীরুদার পড়ালেখার ঘরে।
দেখালেন মেলা থেকে আনা অনেকগুলো তরতাজা বই। বেবাট, ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প। সচলায়তন সংকলন তৃতীয় খণ্ডে মুস্তাফিজ ভাই প্রচ্ছদে আগের খণ্ডের অরূপকে মনে রেখেছেন দেখে ভাল লাগলো। আমাদের বইয়ের মলাট দিনদিন শিল্প হয়ে উঠছে। কিন্তু ঘন রং-এর ব্যবহার খুব চোখে লাগে। আমি তাক থেকে বই হাতে নেই। প্রভুদা পড়ে দেখে। আবার নতুন একটা নেই। উল্টেপাল্টে দেখি লীনা ফেরদৌসীর কবিতার বই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবি এতো সুন্দর বই হতে পারে!
এভাবেই হাতে আসে শেখ জলিলের কবিতার বই “সভ্যতা, থামাও যাত্রা”। কি দূর্দান্ত প্রচ্ছদ। কবিতা ঠিক বুঝিনা, তবুও পাতা উল্টে দেখি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। উত্তেজিত ভাবে আমি তীরুদাকেই বলি; দেখেন জলিল ভাই বইটাতে আমার নাম লিখে দিয়েছেন। তীরুদা এমন ভাব নিয়ে তাকায় যেনো তিনি ঘটনাটা জানতেন না! কলেজে কবিতা লিখে প্রথম পুরস্কারে আমার নাম শুনে এমনি ভাললাগার উত্তেজনায় কেঁপে উঠেছিলাম। জীবনে অনেক ভাল লাগা আছে। কিন্তু এমনটি আর কখনো ঘটে নি। জলিল ভাই আমি ঋণীই থাকি। এই সারপ্রাইজের শোধ কখনো দেবো না তীরুদা। কথা দিলাম।
আগের আড্ডায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পারমিতাদির স্মৃতিচারণ আপনাদের মনে আছে নিশ্চই। অনেক দিন থেকেই বইটার কথা জানি। শুনেছিলাম পারমিতাদির মুখে। কিন্তু কখনো হাতে পাই নি। নতুন বইগুলোর গায়ে বুলানো আমার হাত গিয়ে ঠেকে “জগজ্যোতি”-র গায়ে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা এটি আমার হাতে দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসটা ছিল ঢাকা শহরের কিছু মুক্তিযুদ্ধের এডভেঞ্চার। হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমনিতে খুন, ধর্ষণ উদ্বাস্তু সমস্যা তেমন করে এসেছে বলে মনে নেই।
কয়েক বছর হলো কথায় কথায় বলেছিলেন পারমিতাদি বইটির কথা। অঞ্জলি লাহিড়ী পারমিতাদির মা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পারমিতাদির পরিবারের মতো আরো অসংখ্য পরিবারগুলোর সাহায্য সহযোগীতার জন্য আমাদের দেশের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত। আসলে তাঁদের সহযোগীতা ছাড়া আমাদের জগজ্যোতিদের পক্ষে যুদ্ধটা করা সম্ভবই হতো না। ভাত-কাপড়-বাসস্থান-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন শরণার্থীদের জন্য। আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে লুঙ্গি-গেঞ্জী পড়ে আসা জগজ্যোতিদের সংগঠিত হবার কাজেও সহায়তা করেছেন অক্লান্ত ভাবে। দিয়েছেন প্রথম তৃষ্ণার জল, ক্ষুধার অন্ন।
অদ্বৈতমল্ল বর্মনের “তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায় কোলকাতার ট্রামে। মাসিমা (অঞ্জলি লাহিড়ী)-র পাণ্ডুলিপি হারায় প্রকাশক থেকে প্রকাশকের হাতে ঘুরতে ঘুরতে। ৭৫-এর ১৫ আগষ্টের পর বাংলাদেশে ৭ই মার্চের ভাষণ অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ ছিল অনেক বছর। কেন কোনো প্রকাশক বইটি প্রকাশ করতে চায় নি তখন, ব্যাপারটা বোঝা সহজ। এই সব হেজেমনিতে জগজ্যোতি হারিয়ে যায়। যেমন হারিয়ে গেছে জগজ্যোতির বীর-উত্তম খেতাবটি। কে জানে, হয়তো তা চিরকালের তরে। আমরা জগজ্যোতির কোন খবর নেই নি।
কিন্তু অঞ্জলি লাহিড়ী নিয়েছেন। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল হকের সাথে যোগাযোগ হওয়ায় অঞ্জলি লাহিড়ী আবার মাঠে নামেন। যোগাড় করেন সিরাজের বাবাকে লেখা চিঠি। ছুটে যান আমজাদের মায়ের কাছে। খোঁজ নেন আমজাদের গুনমুগ্ধ রৌশন আরা-র। ভূপেনের স্বপ্নাকে রাজাকাররা পাকিদের জীপে তুলে দিয়েছে। তাদের বাংকার থেকে স্বপ্নাকে উদ্ধারের সংকল্প নিয়ে লড়ে যায় ভূপেন। টেকের ঘাট থেকে তাহেরপুর, তাহেরপুর থেকে সাচনা, দিরাই থেকে সাল্লার পথে আমাদের ঘুরিয়ে আনেন মুক্তিযুদ্ধের শত্রুবেষ্টিত সংকটের ভেতর দিয়ে।
কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে গেলে আমরা বেঁচে যাই। কিন্তু সহযোদ্ধা সিরাজের মাথায় গুলি লাগলে নিজেই আহত হই, পরাজিত হই, আবার আশায় বুক বাঁধি। আবার ঝাপিয়ে পড়ি যুদ্ধে জগজ্যোতির নেতৃত্বে। অঞ্জলি লাহিড়ী আমাদের এভাবেই যুদ্ধে নামিয়ে দেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন গবেষণালব্ধ উপন্যাস আমাদেরই লেখা উচিৎ ছিল। আমাদের এই দৈন্যতাও পূরণ করেন ওপার বাংলার এক লেখিকা। মাসিমা এই লেখার মাধ্যমে আমার পক্ষ থেকে আপনি প্রণাম গ্রহন করুন।
জগজ্যোতির মতো তরুণদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু তাদের কি দিয়েছি আমরা। জগজ্যোতি বাবু, আমরা জাতিগত ভাবে আপনার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারি নি, কিন্তু ব্যাক্তি আমি আজীবন আপনাকে শ্রদ্ধা করে যাবো।
পাতা উল্টাই আর বলি আর নয় মাসিমা। আর কোন ধর্ষণ, হত্যার খবর আমি শুনতে পারব না। কিন্তু মাসিমার কলম থামে না। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে। পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশে ভরে উঠে হাওরের জল। পাকিদের বাংকার থেকে ভেসে আসা যুবতীর আর্তনাদে কেঁপে ওঠে বাতাস। একটা বৈদ্যুতিক খুঁটিতে জগজ্যোতির ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ বাঁধা। নির্যাতনের বর্ণনা ছবি থেকেই পড়া যায়। আমার হাত নিশপিশ করে। পাণ্ডবদার বিচার প্রক্রিয়ার পোষ্টে দেয়া “বিচার মানি” মন্তব্য মনে মনে প্রত্যাহার করি। কারণ এই বর্বরতার কোন বিচার নেই। বিচার চাই না, চাই প্রতিশোধ।
উপন্যাস: জগজ্যোতি
লেখিকা: অঞ্জলি লাহিড়ী
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রকাশক: মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ, ৩৭/২ পুরানা পল্টন, ঢাকা।
পৃষ্ঠা: ৯৬
মূল্য: সত্তর টাকা
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০০৩।
মন্তব্য
- তীরুদা আমার বইটা আনেন নাই? তাঁরে কইষ্যা মাইনাস।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
তীরুদাকে জিজ্ঞেস করা যায়। হিমুর জন্য একটা প্যাকেট দেখলাম। তীরুদার কাছে শুনলাম হিমু নিজেই আসবে প্যাকেট নিতে। চলে আসুন আপনিও। একটা ফ্রুলিংক্স আড্ডা হয়ে যাক। বদ্দা আর হাসিব্বাইকেও খবর দেবো। কি কন?
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
এই বইটা পড়িনি। এমনকী চোখেও পড়েনি। তথ্য জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা। অচিরেই পড়ে ফেলবো।
তবে আপনার লেখা পড়তে পড়তে মনে হলো এই বইটি আমার অচেনা নয়। অঞ্জলি লাহিড়ীর আরেকটি বই আছে "স্মৃতি ও কথা ১৯৭১" আইন ও সালিশ কেন্দ্র'র প্রকাশনা।
অঞ্জলি লাহিড়ীর ১৯৭১ সালের স্মৃতি নিয়ে বইটি। তিনি মূলত ত্রিপুরা অঞ্চলে শরণার্থীদের সাহায্যে পুরো সময়টা নিবেদন করেছিলেন। এমনকী যুদ্ধ চলাকালে সিলেট অঞ্চলেও এসেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েই বই "স্মৃতি ও কথা ১৯৭১"। জগজ্যোতির যতটুকু আলোচনা পড়লাম, তাতে মনে হলো আসলে নিজের অভিজ্ঞতাগুলোই হুবহু উপন্যাস আকারে লিখে গেছেন। এমনকী নামগুলোও অবিকৃতই।
অঞ্জলি লাহিড়ীর প্রতি শ্রদ্ধা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
বইটা খুব খোঁজ খবর নিয়ে লিখেছেন। যুদ্ধের বর্ণনা পড়লে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। নাম ঘটনা সব কিছুই বাস্তব। নিজের অভিজ্ঞতার সাথে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাখ্যাতকারের ভিত্তিতে সাজিয়েছেন উপন্যাসটা। সিলেটের হাওয়র বিল নদী নালা গ্রামের বর্ণনা খুব নিখুৎ ভাবে এসেছে।
বইটার কথা জানতাম না। পারমিতাদীকে ধরতে হবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ নজু ভাই।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
একটি অজ্ঞাত বিষয়ে জানতে পারলাম বলে আপনাকে ধন্যবাদ।
.
___________________________________________
ভাগ্যিস, আমার মনের ব্যাপারগুলো কেউ দেখতে পায় না!
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
আপনাকেও ধন্যবাদ।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
বইটা জোগাড় করতে হবে। অনেক ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
পড়লে আরো ভাল লাগবে। সময় পেলে আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাবেন।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ভালোবেসে কোনো বইয়ের রিভিউ লিখলে তবেই এমন হয়, পড়ে খুব ভালো লাগলো। ভুল ধরছি বলে কিছু মনে করবেন না, কিন্তু এমন চমৎকার লেখা সম্পূর্ণ নিখুঁত হলে আরো ভালো লাগে, স্রেফ সেজন্যই বলছি, "প্রতিযোগিতা" হবে, আর দৈন্য অথবা দীনতা।
ধন্যবাদ পাঠকদা। এভাবে ধরিয়ের দেয়ার জন্যই এখন আর প্রতি শব্দেই অনেক ভুল হয় না। ভুলগুলো কমছে। সে জন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন। উৎসাহের ধন্যবাদ।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
রিভিয়্যু ভাল লাগলো।
সচলায়তন সংকলন তৃতীয় খণ্ডে কার কার লেখা আছে জানলামই না। কেউ রিভিয়্যু লিখবেন সেই আশাও আর করি না।
ধন্যবাদ শুভাশীষদা,
আসলে আমি রিভিয়্যু লিখতে পারি না। পূণমুঠি নামে একটা ছোট গল্প সংকলন বের হয়েছিল সম্ভবত ২০০৮ , সচলায়তন থেকে। সেটার পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখেছিলাম পদ্যে।
আপনার এবং পাঠকদার স্যাটার (?) দেখলাম। ইচ্ছে করছে তৃতীয় খণ্ড নিয়েও কিছু একটা লিখি। দেখা যাক সময় কি বলে।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
জাহাজী যাযাবর বইটা পড়ছি প্রায় শেষ। হাতে আছে অন্ধবাতের ঘোড়া। বই দুটা উপহার পাওয়া লাবণ্যদির কাছে থেকে। লেখার প্রথমে নাম দেখে ভালো লাগল। কিন্তু ভালো লাগা আর মন্দ লাগার ঘোর প্রকট হলো আপনার রিভিউ পড়ে। জগজ্যোতি বইটা আমি দেখিনি। পড়ার ইচ্ছা প্রকট হলো আগামীতে কিনব আশায় রইলাম। তবে সঞ্চিত বইমেলার বই শেষ করে অবশ্যই।
মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান.....
আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া/রিভিউ শোনতে ইচ্ছে করছে।
বইটা কিনলে ঠকবেন না, গ্যারান্টি দিতে পারি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন