শেষ ষ্টার সিগারেটটা কখন টানলাম মনে নেই। পাশের লোক লুঙ্গী পাঞ্জাবী পরে বাটার স্যাণ্ডেল খুলে পা তুলে বসেছেন সীটে। বেনসনের প্যাকেট টা বাঁ হাতে ডান হাতে একটা সিগারেট ধরা। সে অবস্থায় আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন,
-আফনের ম্যাচটা দিতায় নি?
ম্যাচটা দিয়ে ভদ্রলোক যখন সিগারেটটা ধরালেন, তখন নেশাটা থামানো কঠিন। বাপের বয়সী একজন মানুষের সামনে সিগারেট খেতেই অস্বস্তি হয়। পরিচিত কেউ হলে তো ফেলেই দেই বা লুকিয়ে রাখি। কিন্তু এখন সিগারেট, চেয়ে খাই কি করে? হাত নিশপিশ করে। সীটে নড়ি চড়ি। ভদ্রলোকের দিকে তাকাই, আবার বাইরে ফিরিয়ে নেই দৃষ্টি।
ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন বোধ হয় আমার ইচ্ছাটা। প্যাকেটটা এগিয়ে ধরে বললেন,
-লউক্যা।
খুব লজ্জিত ভাবে নিলাম একটা সিগারেট। এর পর থেকে আমার দিয়াশলাই আর ভদ্রলোকের সিগারেট। কিন্তু তার চেয়ে কঠিন যে যাতনায় ভুগছি তা আর বলতে ইচ্ছে করলো না। সব খানে ভোদাই সাজতে তো ভাল লাগে না। অভদ্রতা করে ভদ্রলোক করেই ফেললেন প্রশ্নটা,
-যাইবায় কৈ?
ফ্রাংকফুর্ট শব্দটা উচ্চারণ করলাম একটু কায়দা করে। মনে হয় বলার ধরণ শুনে বুঝে গেছেন ভদ্রলোক। আমার চোরা চোরা ভাবটাও তার কারণ হতে পারে। তিনি এ ব্যাপারে আর প্রশ্ন করলেন না। চলে গেলেন দেশে। বাবা মা বেঁচে আছেন কী না। ভাই বোন কয়জন। পড়ালেখা কদ্দূর ইত্যাদি প্রসঙ্গে। শুনেছি পশ্চিমের ভদ্রলোকেরা এতো হাঁড়ির খবর নেয় না। কিন্তু আমার কাছে মানুষটার ভদ্রতার মুখোশহীন আন্তরিকতা খুব ভাল লাগলো। আমিও দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পেলাম কিছুটা।
ঢেউ লেগে যেমন নৌকা দুলে উঠে, ঢেউ পেরিয়ে আবার ঢেউয়ের ফাঁকে নেমে যায় নাও। কোন আভাস ছাড়াই প্লেনটা হঠাৎ তেমন নেমে যায়। গলায় এসে আঁটকে থাকে বুকের বাতাস। মনে মনে ভাবি এই বুঝি গেল! প্লেনটা নিশ্চই কোন সাগরে পরবে। ইমার্জেন্সী দরজা খুলে দিলে আমি এক লাফে সবার আগে ঝাঁপ দেবো সাগরের অথৈই জলে। কোন জাহাজ এসে উদ্ধার করবে আমাকে। কারণ আমার উপর একটা পরিবার নির্ভরশীল। মরার মতো বিলাসিতা আমাকে মানায় না।
ছাইচাপা তুশের আগুনের মতো মেঘের আবরণ ভেদ করে ঠিকড়ে বেরিয়ে আসছে সূর্যের রশ্মি। আবার ঢাকা পরে ঘন মেঘের ঘোমটায়। ঘোলাজলে মাছ যেমন কাদায় ডুবিয়ে রাখে মাথাটা, চোখ বন্ধ করে ভবিষ্যতের অজানা আশংকায় তেমনি ডুবে যাই মাথাটা নীচু করে।
প্লেনটা মনে হয় কাত হলো ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে। আমি ডান দিকে জানালার পাশে। ভদ্রলোক মসজিদের গম্বুজ ওয়ালা একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন,
-এইটা বাকিংহাম পেলেস।
পশ্চিমে হেলে পরা সূর্যের আলোয় দেখলাম লণ্ডন শহর। পাখির চোখে।
গাট্টি গোল করে নামতে হবে প্লেন থেকে। গেট থেকে বের হওয়ার সময় ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ লেখা একটা কার্ড ধরিয়ে দিলো ডানাকাটা পরি।
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। চিড়িয়াখানায় আনা নতুন জন্তুর মতো অস্বস্তি আর কৌতুহল নিয়ে অপরিকল্পিত ভাবে গোত্তা দিচ্ছি, হিথ্রো বন্দরের খাঁচায়। আমার মতোই ভোদাই মার্কা আরো দুটো বাঙ্গাল দেখি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে আমার গতিবিধি। চোখাচোখী হতেই তাদের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেসই করে ফেললো,
-ভাই, ফ্রাংকফুর্ট যাবেন না কী?
আমার মতো দেখে একটু ভরসা হলো। দরগা নষ্ট করার জন্য মিলে গেলাম তিন ফকির। তাদের একজন আবার দালালের ভাগিনা। শুনেছি স্বর্ণকাররা মায়ের নাকের সোনাও চুরি করে। আদম ব্যাপারীরা এখনো সেই পর্যায় না পৌছলেই বাঁচি। নিজের ভাগীনার সাথে বাটপারী জয়নাল আঙ্কেল নাও করতে পারে। একটু ভরসা হলো বৈ কী।
দুই বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতে পড়তে হয়েছে চারটা কলেজে। চতুর্থ কলেজে আমির আলী স্যার রাষ্ট্র বিজ্ঞান পড়াতেন। বিজ্ঞানের ছাত্র থাকায় ওনার কোন ক্লাসে যেতে হয় নি। পাজী ছাত্র আর শিক্ষকদের চেনে সবাই। আমি ওনাকে চিনি শিক্ষক বলে। কয়েক মাসের কলেজ জীবনে অনেক ছাত্রের ভীড়ে ।উনি আমাকে চেনার মতো ফাজলামো করার সুযোগ হয় নি। তবুও ভাল লাগে অন্ততঃ একজন দূরের পরিচিত মানুষের সন্ধান পেলাম। ওনার ভাতিজা শামীমকে তো জুনিয়ার বন্ধুর মতই লাগে। অতি অল্পেই শামীমের সাথে একটা ভাব হয়ে গেলো। দালালের ভাগ্নেটাও বেশ মিশুক। ভাগ্নের পকেটের সিগারেট যে কটা ছিলো অপেক্ষার প্রথম ঘন্টায়ই তা শেষ।
উপায় নিয়ে এলো শামীম। ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ লেখা এই কার্ডের সাথে দেড় পাউণ্ডের একটা কুপনও আছে। এতো ডুবে ছিলাম নিজের ভাবনায় যে, কি দিলো ভাল করে দেখিই নি। আড় চোখে টং দোকানের মতো একটা স্টলে দেখলাম, যে কোন এক প্যাকেট সিগারেটের দাম সাড়ে চার পাউণ্ড। তিনটা কুপন এক সাথে করলে তো সাড়ে চার পাউণ্ড হয়েই যাচ্ছে। সমাধান করে দিলো শামীম। ধূমপায়ী দু’জনের ভাব নতুন জামাইর মতো। কি আর করা কুপন তিনটা নিয়ে শামীমই গেল সিগারেটের দোকানে। ডানা কাটা পরি মৃদু হেসে জানিয়েছে, কুপনগুলো কেবল খানাপিনার জন্য নির্দিষ্ট করা। সিগারেট এই কুপনে পাওয়া যাবে না। ডলার কে পাউণ্ডে ঘন করে আমরা আর কেউই সিগারেট কিনতে আগ্রহী হই না।
শেষ পর্যন্ত শেষ হয় আমাদের অপেক্ষার প্রহর। দেশ নাটকে গিয়ে বুঝেছিলাম, আমি বাংলা বলতে পারি না। ইংরেজিতে গাইগুই করে যা একটু “ইয়েস-নট-ভেরী-গুড” বলতে পারি। কিন্তু এখন বুঝলাম আমার সেই ধারণাটাও ভুল। ইংরেজী ঘোষণার কিছু না বুঝলেও, বিজি শুনে খাড়া হলো কান। বৈদ্যুতিক ফলকে গন্তব্য এবং বিমান সংস্থার পাশে প্রস্থান ফটকের নম্বর দেখে এগোই আমরা। শামীম এবারও দিলো নিজের গলাটাই আগে। গটগট করে ঢুকে গেল ও। একটু একটু করে বাড়ছে সাহস। যার যার জায়গায় বসে পরলাম। যাক বাবা বাঁচা গেলো। এবার দেখা যাক ফ্রাংকফুর্টে কি ঘটে।
(চলবে)
মন্তব্য
বাহ! মজা হবে ।
আচ্ছা, আপনি না আরো কয়টা উপন্যাস শুরু করছিলেন?
আমির আলী নামে আমারো ১ স্যার ছিলো, তবে সেটা স্কুলে.. ওনার গল্প ১দিন কৈতে হৈবো খুবি ইন্টারেস্টিং চরিত্র।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
বস মনে হয় শেরালীর কথা বলছেন। সেটা শেষ। মতামত জানার জন্য পড়তে দিয়েছি কয়েক জন কে। এটা দুই নম্বর।
আমীর আলী স্যারের গল্পটা লেখেন। আমার আমীর আলী স্যারের সাথে মিলিয়ে দেখি। উইকেণ্ডে আর একটা পর্ব লেখার চেষ্টা চলবে।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়ে ভালো লাগল। অফটপিকঃ আপনার মেয়েটা তো বড় হয়ে গেলো।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
********************************************************
আমার লেখায় বানান এবং বিরাম চিহ্নের সন্নিবেশনের ভুল থাকলে দয়া করে ধরিয়ে দিন।
পড়ে ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ বর্ষা।
হ, সেদিন এই টুকুন একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। দুধটা চুশে খাওয়ার জোর পর্যন্ত শরীরে ছিল না। আর এখন আমার সাথে কি বোর্ড নিয়ে মারামারি করে।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
উপন্যাস ভাল মতই এগুচ্ছে। শুধু
এখানে কেমন জানি গন্ডগোল মনে হচ্ছে
বাউলিয়ানা, মনোযোগ দিয়ে পড়ে অসঙ্গতিটা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। উপমাটা ঠিক জুইতের হয় নাই। আপাতত ৯০ ডিগ্রি কইরা দিলাম।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
দারুন বর্ননা!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
সেই সুদুরের সীমানাটা যদি উল্টে দেখা যেত!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ, নীড় সন্ধানী।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আমার চোরা চোরা ভাবটাও তার কারণ হতে পারে।
কী লিখলেন!
শেখ নজরুল
শেখ নজরুল
পড়ার জন্য ধন্যবাদ শেখ নজরুল।
বলে কী বোঝাতে চাইলেন ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আরো কয়েক পর্ব জমুক। একলগে পড়ুম... চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
নতুন মন্তব্য করুন