গত রাতে ঘুমটা ভাল হয় নি। আঁচলকে নিয়ে পায়চারি করতে গিয়েছিলাম কবরস্থানে। বাড়ির পাশেই। কবরস্থানটা খুব শান্ত। মরা মানুষের ঘুম কখনো ভাঙ্গে না। তাই জগিং করা স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ চক্কর খাচ্ছে। জেল সোলের জুতা থপ থপ করে চাটি দিচ্ছে মাটির বুকে। আঁচল কবরস্থানের মাঝের ক্রশটায় দোল খাচ্ছে। আমি একটা সিগারেট ধরাই। জীবন এবং মৃত্যুর ঠিক মাঝ খানে কী আছে? ভাবতে চেষ্টা করি। অচেনা তরুণ তরুণীদের হ্যালো বলে থামিয়ে আঁচল অবোধ্য ভাষায় বলে যায় তার পাখির সাথে বনিবনা না হওয়ার গল্প। কেউ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু শোনে। কেউ পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়।
বরকত ভাবী আফসোস করেছিল আঁচলকে দেখে। ইশ! মেয়ের রংটা যদি আট্টু খোলা হতো! বরকত ভাবীর একটা ছেলে আঁচলের কয়েক মাসের বড়। হয়তো আঁচলকে ছেলের বউ করে নিতেন তিনি। মেয়েটা কালো। বিণয় করে তিনি তা বলেন নি। আক্কাস ভাই কোলে নিয়ে আদর করে ছেড়ে দিয়ে আফসোস করেন -মেয়ের রংটা যদি আর একটু কম চাপা হতো!
শুভ সব খেয়াল করে। বাসায় এসে বিড় বিড় করে। মেয়েটা কালো! চোখে টলটলে জল। আমি বলি আমার কলিজার মতো কালো। রাস্তায় বের হলে মনে হয়; ছোট ছোট হাত পা গজিয়ে পেটের ভেতর থেকে কলিজাটা এক লাফে রাস্তায় মানুষের জঙ্গলে হারিয়ে যাবে বুঝি! সাদা কালো ছাড়া কতো রং আছে জগতে! যারা তা দেখতে পায় না, লোকে বলে তারা বর্ণান্ধ। আহা কী হতভাগা সেই সব মানুষ। করুনা নয়, মায়া হয় তাদের জন্য।
রাত কাটে আধো ঘুম আধো জাগরণে। স্বপ্ন কিংবা জাগরণে অথবা তাদের মাঝখানে মানুষের মতো দাঁত ঘসি। কফি খাই। কালো। কাজে যাই। লাশকাটা ঘরে ডোমের কাজটা আমি এড়িয়ে চলি। ভয়ে নয়, ঘৃণায় নয়, হতাশায়। পিসিআর, সিকোয়েন্সিং-ও আজকাল তেমন টানে না। মাইক্রোস্কোপে লিউকেমিয়ার সেলে চোখ আটকায় কালে ভাদ্রে । কিন্তু মাইক্রোস্কোপেই বসবো। পাকা সিদ্ধান্ত। গতকালের একটা স্লাইড ব্রীজে রেখে লেন্সটা মিলিয়ে নিচ্ছি। রং-এর কৌটা সাজানো হয়েছে।
-সুপ্রভাত। পেছন থেকে কে বললো সেটা শুনে মুখস্ত প্রতিবাদের মতো আমিও বলি; সুপ্রভাত। সাদা এপ্রোনটা সরছে না। হয় তো কিছু বলবে দরজার দিকে তাকাই।
-লাশকাটা ঘরে তুমি আজকে আমাকে সঙ্গ দেবে?
বেহুশ মানুষের মুখে ঠাণ্ডা জলের ছটার মতো, প্রশ্নটা আমাকে আধোঘুম আধোজাগরণ থেকে দাড় করায় কাজের সামনে। ডঃ মাক্সের বিণীত প্রশ্নের একটাই উত্তর। আমি উঠে দাড়াই। অন্তঃসার শূন্য মানুষের ভেতরটা দেখে আবার হতাশ হবার জন্য প্রস্তুত করি নিজেকে।
-বুঝলে মানুষ কাটতে আমারও ভাল লাগে না। কিন্তু উপায় কী বল। কাজ তো! খুব বেশী মৌন থাকলে কাজে অনীহা দেখানো হবে। সেটা আমার জন্য শুভ নয়। তাই জিজ্ঞেস করি,
-কোন কেবিন খুলবো? ডঃ মাক্স বলেন;
-এক নম্বর আমি আগেই খুলে রেখেছি। আহা বেচারার কষ্ট। নেংটু মানুষটা চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে আছে স্টিলের টেবিলে। শীতে সাদা। ক্রশ, চন্দনের ফোটা, রুদ্রাক্ষির মালা, পৈতা কিচ্ছু নেই শরীরের কোথাও।
-নাও। হেল্ম, দস্তানা এগিয়ে ধরেন ডঃ মাক্স। আমার লিকলিকে শরীরে শক্তি কম। ছুরিটা আমার হাতে দিয়ে বলেন;
- চুলের নীচে ঘাড়ের দিকে একটা পো্চ দাও। কানের পেছন দিকে একটু উপরে নিলেই চলবে। সোয়ানো অবস্থায় চোখে যেন কোন কাটা দাগ দেখা না যায়। স্বজনরা শুধু মুখটাই দেখে দাফনের আগে। মুখটা অক্ষত থাকলেই চলবে।
আমি বাধিত হই। খৌরকর্মের মতো হাল্কা কাজটা ডঃ মাক্স আমাকে দিয়েছেন। ইলেকট্রিক করাত কররররত করে ঘুরছে। চামড়া কেটে দাঁড়িয়ে আছি। দেখে, ডঃ মাক্স সুইচ অফ করে বলেন;
- চামড়াটা টান দিয়ে মুখের উপড় নিয়ে এসো। হলদে চর্বির বলটা ঠিক আধাআধি ভাগ করতে করাত চালাচ্ছেন ডঃ মাক্স। তীব্র মানুষ পোড়া গন্ধ। লক্ষণদের পুকুর পারে জলে ডুবে মরা যদুর দুই বছরের ছেলের শরীর পোড়াচ্ছিল লক্ষণের বাপ। লক্ষণরা ঠাকুর। পূজা-অর্চণার সাথে এই সব কাজ লক্ষণ হয়তো এখনো করে। হয়তো করে না। মাথার খুলিটা আমার হাতে, সেটা রেখে আজলা ভরে হাতে নিলাম জনাব মরার মগজটা। আমি জানি ওজন, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ মেপে দশ হাজার কোটি নিউরণের কোথাও রূপ, রস, গন্ধ, সৌন্দর্যের বর্ণও পাব না। একটা নিউরণে সঞ্চিত মানব বির্বতনের সব ইতিহাস লেখা। সব গুলো ক্রমোজেমের দৈর্ঘ্য পৃথিবী থেকে চাঁদে গিয়ে আবার ফেরৎ আসার সমান লম্বা। সব কটা জিনের সব বর্ণে কোথাও এসবের কোন জবাব লেখা নেই। কী করে তবে মানুষ সুন্দর অসুন্দরের সন্ধান পেল! করররত। গলার নীচে করাতটা একবার নেমেই আবার উঠে গেল। বক্ষ পিঞ্জরের দু’দিকে উঠা নামা করার পরে ডঃ মাক্স করাতটা রাখলেন টেবিলে।
-চল্লিশ বছর বয়স্ক পুরুষ। গায়ে ক্ষতের চিহ্ন নেই। অক্ষত মগজ। -এবার বুকটা উদাম করে হৃদপিণ্ডটা খোল দেখি। পায়ের নীচে মাইক্রোফোন বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ওজন দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপা শেষ। হৃদরোগের লক্ষণ খুঁজতে আমি অলিন্দয় নিলয় ঘেটে সব কটা বাল্বের পর্দা খুলি। সুহৃদ, সাহসী, অন্তরে অমৃতের কোন গন্ধ নাই! কোথায় থাকে মানুষের হৃদয় বৃত্তিক গুনাবলী তবে?
ডঃ মাক্স সাবধান করেন: -বৃহদান্ত ক্ষুদ্রান্ত যেন কেটে ফেলো না। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।
কালো কলিজায় কালচে সবুজ আভা। লিভার সিরোসিস? পাঁচ মাইক্রোমিটার বেধে কাটতে হবে কলিজা। আমি জানি সেখানে কিছু ক্যান্সার সেল ছাড়া বড় কলিজার আর কোন মাহাত্ম্য লেখা নেই। কিডনী কাটলে আদ্রেনালীন-এর গহব্বর ছাড়া আর কিছু পাব না। পাব না জেনেও আমি খুলে নেই মূত্র নালী, মূত্রাশয়, বীর্যনালী সহ পুরো চারটি কিডনী। মানুষের সৌর্যবীর্যের লেশমাত্র বীর্যনালী বা শুক্রাধারে নেই। মানুষ তবে অবজ্ঞা-অহংকার করে কী নিয়ে? আমি জানি না। কিন্তু জানবনা জেনেও আমাকে এই মাসটা মানুষের রন্দ্রে রন্দ্রে আলো ফেলে খুঁজতে হবে।
ফরমালিনে অর্গান গুলো ফেলে চলে গেছেন ডঃ মাক্স। ইচ্ছে করে সবগুলো অর্গান দলাই-মালাই করে বড় গামলায় নিয়ে মন্থন করি, যদি কোন কিছু বের হয়, সাদা কালো উঁচু নীচু ধর্ম বর্ণ ধনী দরিদ্রের ব্যবধান। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আমি কাজ করছি। বেচারার খালি পেটে বাসি খবরের কাগজ ঢুকিয়ে ইয়া বড় সুই দিয়ে সেলাই করছি। মাথার মগজের খালি জায়গাটায় ঢুকিয়ে দিলাম ডঃ মাক্সের হাত মোছার কাগজের তোয়ালে। আগে পিছে ডানে বায়ে পিন মেরে মুখের উপর থেকে টেনে দিলাম চামড়াটা। এখন দেখে কেউ বুঝতে পারবে না যে ভদ্রলোকের ভেতরটা গতকালের খবরের কাগজে ঠাসা।
মন্তব্য
ব্লগরব্লগর ভালো লাগল।
আদ্রেনালীন-এর গহব্বর কোনটা বলুন তো? মনে পড়ছে না...
ধন্যবাদ বস,
আদ্রেনালীন বোধহয় (neben Nieren জার্মান ভাষায়) কিডনীর উপরে যে হলুদ টুপির মতো ছোট কিডনী থাকে, সেখানে তৈরী হয়। ইংরেজী নামগুলো ভাল জানা নাই, তাছাড়া গ্লোমেরোলস, ডিস্টলে, সিয়াস্টলে এই ধরণের দাঁত ভাঙ্গা শব্দ দিয়ে লেখাটা ভারী করতে ইচ্ছে হল না।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
গা শিউরানো। মানুষ হিসেবে কত তুচ্ছ, ভঙ্গুর, পচনশীল সেটা আবার মনে করিয়ে না দিলে হতো না? উদাস হয়ে গেলাম, এত সব করে কি হবে জীবনে ??
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
উদাস হতে আমার মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না। কিন্তু আপনাকে উদাস করার জন্য দুঃখিত। পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ইচ্ছে করে সবগুলো অর্গান দলাই-মালাই করে বড় গামলায় নিয়ে মন্থন করি, যদি কোন কিছু বের হয়, সাদা কালো উঁচু নীচু ধর্ম বর্ণ ধনী দরিদ্রের ব্যবধান।
অসাধারণ !!!
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা
আমি তো বেকার পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
থেংকু বস।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
এ যাবৎ কাল আপনার সবচে' ভালো লেখা পড়লাম। অসাধারণ। বিশেষণে কুলোচ্ছে না।
উৎসাহের জন্য ধন্যবাদ গুরু।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
লেখাটা এতো এতো সুন্দর। মন কেমন হয়ে গেল।
এইসব বরকত ভাবি আর আক্কাস ভাইয়ের বাসায় না গেলে হয়না?
যারা একটা বাচ্চার গায়ের রং নিয়ে মা বাবাকে বলতে পারে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা কি এতোই জরুরি? এই দুজনের ওপর যে কী মেজাজ খারাপ হলো।
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এই ধরণের বরকত ভাবী আক্কাস ভাইদের সাথে পথে ঘাটে দেখা হয়। ব্যাক্তিগত সম্পর্ক রাখা আমাদের মতো অসুন্দর চেহারার মানুষের জন্য একটু কঠিন বৈ কী। লেখাটা আমার রানাপুর ভাল লেগেছে শুনে খুব আনন্দিত।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
চমৎকার!
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
দমুদি, মেলাদিন বাদে আপনাকে দেখে খুশী হলাম।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
খুব...খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ,
কিন্তু ইয়ে মানে, খাতার লেখাটা কৈ?
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অনেকদিন ধরে সচল ও লেখালেখির জগতে নেই। কিন্তু আপনার এই লেখাটি এতো বেশী মন ভেজালো যে, সেটি না জানিয়ে পারলাম না। শুভকামনা....।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!
**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব
ধন্যবাদ তীরুদা।
এই না লেখালেখির সময়টা নিয়েই একটা লেখা দিন। অনেক দিনতো হল। আর কতো বিশ্রাম নেবেন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন