নইমারি, ডাংগুটি, দাড়িয়াবান্ধা সব খেলা ভুলে গত তিনটা দিন কেটেছে বজলু মামুর বাংলা ঘরে। এত্তো বড় বোম্বা ঘুড্ডি জীবনে দেখি নি। মাহাল বাঁশ দিয়া গুড্ডির কামানি বানাইছে টুক্কু ছৈয়াল। হাঁট থেকে বালি আর লাল-সবুজ কাগজ এনেছেন বজলু মামু নিজেই। কণককাইচের খাঁড়া কাঠিটা বাঁধা হয়েছে কাল সন্ধ্যায়। এখন গুড্ডিটা ছাওয়া হবে। বার্লির গাম দিয়ে ছাওয়ার কথা ছিল কিন্তু বার্লি তেইল্যা চোরায় খেয়ে ফেলে। টুক্কু ছৈয়ালের কথামতো ওড়িগাব দিয়ে ছাওয়া হবে গুড্ডি। লুঙ্গি গলায় ঝুলিয়ে দলবল নিয়ে বাড়ির উত্তর দিকে বড় ওড়ি গাব গাছটার সব কাঁচা-পাঁকা ওড়ি গাব বিদ্যুৎবেগে এনে হাজির করলাম বজলু মামুর সামনে।
সূতার ডুরি দিয়ে এতো বড় বোম্বা গুড্ডি তো আর উড়ানো যায় না। ছিড়ে যাবে যে! তাই নতুন কিনে আনা মিহি পাটের গুন টেনে আমি প্যাচ খুলছি। ওড়ি গাবের কষ দিয়ে মামু আর টুক্কু ছৈয়াল ছাইছে গুড্ডি। আমিও মামুকে সেখানে সাহায্য করতে পারতাম। কিন্তু লোক বেশী হয়ে যাবে, তাছাড়া ঘুড্ডি উড়াতে ডুরিও তো লাগবে। মামুর কথা মতো আমরা কাজটা ভাগ করে নিয়েছি।
টুক্কু ছৈয়াল বাঁশের কাইমে কাগজের মতো পাতলা করে চাঁছা বেত বেঁধে ধনুকের মতো বাঁকা করা বোম্বায় ফু দিয়ে সুর বেঁধে নিচ্ছেন। ঠিক প্রজাপতির মতো দেখতে গুড্ডিটা। বাদামী কাগজের ছাউনিটা ঢাকা পরেছে লাল-সবুজ কাগজের নকশায়। জুইত্যায় ডুরি আগেই বাঁধা হয়েছে। গুড্ডির ঠোঁটে এখন বোম্বা বেঁধেছেন টুক্কু ছৈয়াল।
ক্ষেতের আমন ধান বিঘত খানেক। এখন ধানের মুড়ায় পা পড়লে ভাঙ্গবে না। আমরা কে কার আগে টান নেয়ার সময় বজলু মামুর কাছে থাকব সেই প্রতিযোগিতায় দৌড়াচ্ছি। গুড্ডি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন টুক্কু ছৈয়াল।
তিন কানি ক্ষেত দূরে ডুরি ধরে মামু। আমার তর সইছে না। টুক্কু ছৈয়াল এতো দেরি করছে কেন! গুড্ডিটা নীল আকাশে উড়ার জন্য ছটফট করছে। এরই মধ্যে মামু প্রানপণে পেছনের দিকে বেঁকে ডুরি টানছে। মৌমাছির মতো বোঁ বোঁ শব্দে ওপরের দিকে উড়ছে প্রজাপতি। ঝলমলে কাঁসার থালার মতো সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমের সবুজ দিগন্তে। দক্ষিণ থেকে এক নাগারে আমনের সবুজ পাতায় প্রাণ জুড়ানো ফু দিয়ে যাচ্ছে মায়াবী বাতাস। প্রজাপতিটা এখন এক ঘেয়ে ঘন নীল আকাশে নীচে একমাত্র রঙ্গিন স্বপ্ন। পাতার ফিসফিসানি, ভ্রমরের গুঞ্জন ছাপিয়ে স্বপ্নের বাঁশি বাজিয়ে চলেছে বজলু মামুর ডুরিতে বাঁধা প্রজাপতিটা।
অনেক ক্ষেতের মাঝ খানে একটা উঁচু জমিতে কিভাবে যে এই নারকেল গাছটা এলো! গুড্ডিটা এখন সে গাছটাতেই বাঁধা। ডুরিটা আমি অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারি নি। মামু আমার চেষ্টা দেখে উঁচু করে আমাকে ডুরিটা ধরতে দিয়েছেন। আমি ঝুলে রইলাম। ডুরিটা এতটুকু নামলো না আমার ভারে! আলো নেই। মাটির মায়া ধরে ঘরে ফেরে গাঁয়ের লোক। আমাকে ডেকে ডেকে শেষে বজলু মামুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে ঘরে ফিরেছেন মা। এখান থেকে আমাদের বাড়ি যেতে পথে আছে কবরস্থানটা। এমন কিছু দূরে নয়। জোর গলায় ডাকলে শোনা যায়।
মামু বলতে আসলে আমার কেউ নেই। আমার নানা বিদায় নিয়েছেন কন্যাদায়গ্রস্থ থেকেই। মা বড় বা বিবাহ যোগ্যা হয়েছেন বজলু মামুদের সংসারে। বজলু মামুর বাবা আমার নানার ছোট ভাই। একেবারে পর না হলেও ঠিক আপন নয়। এই ধরণের সর্ম্পকে জড়িত সব পক্ষই একটু বেশী সতর্ক থাকে। মা ঘন ঘন ডাক হাঁক দেন। যাতে মামু মামীরা এমনটা ধরে না নেন যে, ছেলেটা একেবারে তোমাদের ঘাড়েই তুলে দিলাম। মামু মামীরা একটু বেশী আদর আহল্লাদ করেন, পাছে খোটা শুনতে হয়; পেটের চামড়া পিঠে লাগে না। মজাটা ভোগ করি আমি। কিন্তু মায়ের কাছে কড়াল দিয়েছি আজ বাড়ি যাবই।
কাজেই গুড্ডিটা কী ভাবে নামানো হবে সেটা দেখার লোভ সংবরণ করে উঠতে হলো আমাকে।
-তুই ডরাইছনা কইলাম, আমি চাইয়া রইছি। পেছন থেকে বজলু মামুর অভয় বাণী।
কবরস্থানটা জমি থেকে সামান্য উঁচু। তাল, নারকেল, সুপারি, কড়ই, মান্দাইল মিলিয়ে বড় গাছের সংখ্যা গোটা দশেক। কিন্তু ঝোঁপ-ঝাড় খুব বেশী। ছিপটি, বটকুড়ার আড়াল থেকে উঁকি দেয় ধুতরা ফুলের চুঙ্গি। গোধুলির শেষ লগন। স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না। আন্দাজ করে চলতে হয় এই সময়। অতিরিক্ত সতর্কতা নিয়ে কবরস্থানের দক্ষিন দিকের সীমানার আধাআধি এসে গেছি। ভূত-পেত্নীর আশ্রয় থেকে রক্ষার জন্য বজলু মামুর অগ্নিদৃষ্টি আর অভয় বাণী। পুরুষ-পোলারা ডরায় না এই আত্মবর্ম সম্বল নিয়ে বেশ-অর্ধেক পার হয়েছি। গোয়াল ঘরে গরুর পায়ের তলায় পড়লে যেমন করে ডাকে ব্যাঙ, তেমন একটা আওয়াজ হলো হাত তিনেক সামনে। কালো দড়ির মতো ক্ষুধার্ত সাপটা দ্রুত ঢুকে গেল কবরস্থানে। ব্যাঙটা প্রাণে বেঁচে গেছে, হয়তো আমার আর্ত চীৎকারে। প্রায় ঠিক একই সময়ে বজলু মামুর প্রতিচীৎকার;
-আরে ডরাইছ না, আমি আইতাসি।
কখন মামুর বলিষ্ঠ বুকে নিজেকে সুরক্ষিত ভাবে আবিস্কার করলাম বলা কঠিন। কিন্তু সেদিন আমাকে আর বাড়ি যেতে হয় নি। বজলু মামুর বড় ভাই তোতা মামু পুলিশে চাকরী করে। বাড়ির একমাত্র বউ বলে তোতামামী শ্বশুর-শাশুড়ীর খেদমত করতে বাড়িতেই থাকেন। “যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভুলে না মোরে” ফুল পাখি দের সাথে এমন কথার মালা দিয়ে ভরা বজলু মামুর বাংলা ঘর। ফুল তোলা ফরাসের চাঁদর, বালিশের ওশার। সেই চকিতে বজলু মামুর বুকে ঘুমানোর অধিকার পেয়ে গেলাম সাপের ভয়ে।
সকালে দেখি, উঠানে গাই বেঁধে, দু’হাঁটুতে বালতি চেপে গাই দোয়ায় মামা। বইলা খড়ম পায়ে গাইয়ের সামনে বাছুর ধরে আছেন নানা। মাটির পাতিলে বাসি ভাতে পানি দিয়ে রেখেছিলেন তোতামামি। এখন পানি ফেলে ভাত দিয়েছেন সানকিতে। বালতি থেকে দুধ ঢেলে মামু কয় খা। জ্বাল দেয়া হয় নি দুধ। কিন্তু গরম। কেবল গাইয়ের ওলানি থেকে বের হয়েছে। এখনো আমার প্রিয় খাবার।
গতকাল মা এসে হাঁকডাক দিয়ে গেছেন; দুষ্ট ছেলেটা ভাত খেতে পর্যন্ত বাড়ি যায় না! শত ব্যস্ততার মাঝেও ছোট নানী মায়ের কথায় কানটা না দিয়ে পারেন না।
-ওই ফুলমতি, তোর নাতী কি আমাগো বাড়ি না খাইয়া থাকবো!
তাই এখন থেকে একেবারে পাকাপাকি বন্ধোবস্ত। সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপি নিয়ে বজলু মামুর মতো বড় বড় বই পড়ার স্বপ্ন দেখি। পাঠশালায় পূর্ব বাংলার অরুণীমায়, গাওয়ার সময় আঁড়ালে দাঁড়িয়ে ভেংচী কাটি। মায়ের কাছে খবর আসে
-তোর পোলাটা বজলু লাই দিয়া দিয়া নষ্ট করতাসে।
মা অভিযোগ নিয়ে আসেন;
-কিরে বজলু?
বজলু কয়; আগো বুবু সময় হইক, আমিই কান ধইরা লইয়া যামু ইসকুলে। তুমি চিন্তা কইর না।
বর্ষা কাল গেল। শীত কালও যাই যাই করছে। রোদে দেয়া লেপ তোষক ভাঁজ করে চৌকিতে রাখতেন মামী। ভাতটা খেয়ে লেপের ভেতর বন্দী রোদে ঘুমিয়ে পড়তাম পা না ধুয়েই। যে গাছে ফল হয় না তারাও এখন রংবেরঙ-এর পাতা দিয়ে মুগ্ধ করতে চাইছে প্রকৃতিকে। অনেক গাছে ফল পাঁকতে শুরু করেছে। এই সময় ঘরে থাকা দায়। পাঠশালার আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে পূর্ব বাংলার অরুনিমায় গাওয়ার সময় আমার নেই। ক্ষেতের ধইন্যাপাতা, মামীর বয়ামের লবন-মরিচের গুড়া আর গাছের বাতি তেতুল। কুল-বড়ই খায় কেবল গাছে উঠতে অক্ষম শিশুরা। কাল কোন গাছের আম খাব সেই পরিকল্পনায় মশগুল থাকি আদর্শ লিপিতে চোখ রেখে। বন্ধুদের সাথে বজলু মামুর খোশগল্প শোনার সময় আমার নাই। ক আকার কা, খ আকার খা, এই সব পাণ্ডত্যিপূর্ণ জ্ঞানগর্ভ ভাষণের নীচে চাপা থাকে বজলু মামুদের ফিসফাস।
একদিন সকালে গাই দোহানোর জন্য আর বজলু মামাকে পাওয়া যায় না। আমার পাশেই তো ছিলেন রাতে! দেশে গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এই সব নিখোঁজ সংবাদ গোপন রাখতে হয়। নানা খট খট করে হাঁটে বইলা খড়ম পায়ে, বজলুর বাংলা ঘরের সামনে। সানকীতে ভাত বেড়ে কাঁদে নানী। তোতামামী মুখে কাপড় গুজে দেয়। যতটা না বজলু মামুর নিঁখোজ হয়ে যাওয়ায় তার চেয়ে বেশী নিজের স্বামীর খোঁজ না পাওয়া, নিঃশব্দ কান্নার নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছেন তিনি। অভিভাবকহীন শিশুর মতো দিন কয়েক এ-ঘর ও-ঘর করে মায়ের কাছে ঠাঁই নেই আমি। মাঝে মাঝে মায়ের কাছে জানতে চাই বজলু মামু কৈ গেছে মা? মা বলেন তোর তোতা মামুর কাছে বেড়াইতে গেছে। অনেক দিন মা আমাকে এই সংবাদ দিয়ে গেছেন। গণ্ডগোল শেষ হলে তোর তোতামামুর লইয়া আইব তোর বজলু মামু।
বজলু মামুর লেপের ওম ছেড়ে কাঁথার নীচে অনেক দিন ছটফট করে এখন আমি কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমাই। কিন্তু তোতা মামুকে নিয়ে বজলু মামু আর আসে না! পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে এখন আমি “আমার সোনার বাংলা” গাই স্কুলে। সাপ দেখলে নিজেই লাঠি খুঁজি।
একদিন খবর পেলাম; মুজিব ভাই আইসে করাচী থেকে। রেজি খালার ছেলে। বজলু মামুদের চাচাতো বোন রেজি খালা। স্বপরিবারে আটক ছিলেন পাকিস্তানে। একটু বড় হয়ে গেছি। দেখতে ইচ্ছে করে মুজিব ভাই কতো বড় হইছে। মায়ের সাথে মামার বাড়ি গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। অনেক লোকের ভীড়। আমাদের এক সময়ের দল নেতা মুজিব ভাই এখন রীতিমতো সুপুরুষ!
ভীড় থেকে দূরে বজলু মামুদের ঘর থেকে কাঁপা কুপির আলোর সাথে বের হচ্ছে চাঁপা কান্নার আওয়াজ। নিজেদের শোক অন্যের আনন্দ যাতে ম্লান না করে সেই জন্যই লুকানোর চেষ্টা। শীতের আমেজ এখনো শেষ হয় নি। বজলু মামুদের ঘরে এখনো রোদে দেয়া গরম লেপ আছে, সে ভরসা করতে পারলাম না। মা হয়তো আজ রাত ছোট বেলার সখি রেজি খালার সুখ দুঃখের গল্প শুনেই কাটাবেন। মনে হয় বাবাও এসেছেন। তাসের আসর বসবে কী না জানে। পাতলা সার্টে আমার শীত করছে। শীতকালে সাপ গর্তেই থাকে। তাছাড়া ফুটফুটে জোছনা। পথে সাপ থাকলে পরিস্কার দেখা যাবে। এখন বজলু মামুর অভয় বাণী আর নিরাপদ বক্ষপিঞ্জরের কোন প্রয়োজন নেই আমার। বাড়ি যাই, কবরস্থানটার পাশ দিয়েই। ভয়ের কিছু নেই। রেজী খালার কলেরগান থেকে ভেসে আসছে “হামারি সাশমে আবিতক হে হেনাকী খুশবো মেহেক রাহিহে” সম্ভবত নূরজাহানের কণ্ঠ।
মন্তব্য
লেখাটা অনেক ভালো লাগলেও পড়ে বজলু মামার জন্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল
-অতীত
সুন্দর বলেছেন।
বানানগুলো একটু ঠিক করেন বস্। গানটা ছিল, "পূরব বাংলার শ্যামলীমায়, পঞ্চনদীর অরুণিমায়"। আর বড় গল্প বা উপন্যাসকে ঠেলে ঠুলে ছোট গল্প বানানোর দরকারটা কী? এগুলো তো চারণ গল্প। এগুলোকে নিজেদের মতো করে বাড়তে দিতে হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাহারে! যেন কুমিল্লার সব বাগান-ভিটা-চক-খাডি মানুষের মুখে গল্প শুনিয়ে গেল। ভাল আছেন?
ছোটবেলার বঘুড়ি, ঘুড্ডি, চোঙ, দোল কত কিছু যে বানাইছি। সব এক ধাক্কায় মনে পড়ে গেল।
নতুন মন্তব্য করুন