মুখ ও মুখোশ

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: রবি, ০৮/০৫/২০১১ - ২:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

The brosche (Die Brosche) নামে এই লেখাটা লিখেছিলেন একটা অলংকার নক্সাকারী দলের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানের জন্য। অলংকার নক্সায় দর্শনের ভূমিকা ছিল প্রভুদার বিষয়। এর আগে একবার তাঁর লেখা একটা বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার চেষ্টা করেছিলাম। সমস্যা হলো লেখায় এতো বেশী উপমা থাকে যে, সেই উপমার ব্যাখা না জেনে লেখাটা বোঝা কঠিন। প্রভুদার মতে দর্শন হলো চিন্তার স্বাধীনতা। স্বাধীন চিন্তা করা কতো দূরহ কাজ, সেটা তাঁর লেখা পড়লে কিছুটা টের পাও যায়। অনেক দিন জার্মান সংস্কৃতির সাথে পরিচয় থাকায় কিছুটা আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু পুরোপুরি বোঝা কখনো হয়ে উঠেনি। এই লেখার বাংলা শিরোনাম মুখ ও মুখোশ স্বাধীন চিন্তার সুবিধা নিয়ে আমি বের করেছি। The brosche (Die Brosche) শব্দটির সঠিক বা কাছাকাছি কোন বাংলা প্রতিশব্দ আমি খুঁজে পাইনি।

প্রভুদা বছরে অন্তত একটি বই লিখেন। দর্শন শাস্ত্রে সে বিশাল ভারী ভারী বই অনুবাদ করা আমার সাধ্যের বাইরে। অথচ এমন একজন মানুষের চিন্তার ফসল বাংলা ভাষা-ভাষী পাঠকের অগোচোরে থেকে যাবে; সেটাও চাই না। তাই তাঁর ছোট দু’টো লেখা নির্বাচন করেছি। একটি এখানে দিলাম। সময় করে দ্বিতীয়টি আর একদিন।

ফরিদপুরে বাপের বাড়ি আর মামার বাড়ি বিক্রমপুর, জন্ম কোলকাতায়। দু’মাসের জন্য জার্মানীতে বেড়াতে এসেছিলেন বছর চল্লিশেক আগে। তখন ভিসার এতো ঝামেলা ছিল না। ভর্তি হয়ে গেলেন জার্মান ভাষায়। জার্মান শিখে প্রথমে ভর্তি হলেন পদার্থ বিজ্ঞানে। কিন্তু ভাষা শেখার সময় জার্মান সাহিত্য এবং দর্শনের সাথে যে ঘনিষ্ঠতা হলো তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। কাজেই বিষয় বদল করে নিলেন দর্শন। মিশেল ফুকো বিশেষজ্ঞ প্রভুদা দর্শনে পি.এইচ.ডি করেছেন।

পতন

পাতা ঝড়ে
শুরু হয় ঘটনা-
হয় না কোন পৃথিবী
রচনা,
গুটি চলে
অথবা নামে কোন ফেরেস্তা।
আসলে
পটের পতন,বাঁধা বিহীন
সাথে নেয় একটি জগৎ ,
অথবা কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন
যা আঁকা ছিল সূচাগ্র মেদেনীতে।
এখন ইতিহাস
এবং পলক-ঝড়ের দৃষ্টি বিহীন
পড়ে আছে
পাতালে।

ব্যক্তি ও বাস্তবতা
যে যার অবস্থানে অনড় থাকলে ঠিক থাকবে পৃথিবী। হাত-পা কাণ্ডের গায়ে লেগে থাকে, নাক-চোখ-কান মুখে জড়াজড়ি করে অবয়বের বিন্যাস একে অন্যের পরিপূরক হলে পাওয়া যায় ব্যক্তির ছবি; পৌঁনঃপুনিক, অভ্রান্ত, সনাক্ত। দেহঘড়ির অন্তর্বাসের উপর বস্ত্রের পাট, পদবী অথবা কাজ ব্যক্তির শরীরে লেপ্টে পদমর্যাদার দিকে নির্দেশ করে দৃষ্টি; পদক্ষেপ, কণ্ঠস্বর পরিপূর্ণ করে সমাজের ছবি, সহজ পাচ্য আর আপাত অবিনাশী সব সৃষ্টি। অক্ষয় ভালবাসার বেষ্টনী আর পদকের সজ্জ্বা, কামনার অবশিষ্ট কিছু আর বাকী নেই এমনই অবস্থা। সে অবস্থায় অলংকৃত ব্যক্তি পদের অধিক যোগ্য, কাজেই মনে আসে আসনের নিশ্চয়তা।

ভূমিকম্পের সর্বনাশী স্পন্দন ছাড়া, ঝুলে থাকার এই বিন্যাস্ত ব্যবস্থা থেকে পতনের কোন সম্ভবনা নেই। স্খলিত খণ্ডাংশ সূচনা করতে পারে পুরো ব্যবস্থার অগস্ত্যযাত্রা। শেষ পর্যন্ত শুধু দিগম্বর হয়ে নিস্তার না ও মিলতে পারে, ছড়িয়ে পড়তে পারে সমস্ত হাড়ের ঘর টুকরো টুকরো ব্যবচ্ছেদে।

মুখ দর্পন

জীবনে অংশগ্রহন করতে চাইলে দর্শনযোগ্য হতে হবে আমাদের। আমরা দর্শনযোগ্য হতে চাইলে দরকার হবে একটা মুখ। মুখটা প্রথমত আমাদের ছবি। ডান-বামের মিল, রেখা আর অনুভূতির সমন্বয়ে দৃষ্টি শক্তিতে সৃষ্টি সে ছবি; কোন না কোন অন্তস্থঃ অভিব্যক্তি ঠিকরে বের করে দিতে পারে। ব্যক্তিসত্তার অবস্থান এবং অনুভূতি প্রকাশের যন্ত্র আমাদের মুখ। নিজের প্রতিচ্ছবি প্রকাশের দর্শনযোগ্য মাধ্যম হয়ে মুখমণ্ডল জানাবে জীবনে আমাদের প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া। এই লক্ষ্যে মুখমণ্ডল আমাদের প্রথম অলংকার। আমরা সব সময় সানন্দে না হলেও আজীবন ধারণ করি বা করতে বাধ্য এই অলংকার।

অনুকূল পরিবেশে আমাদের অলংকৃত মুখমণ্ডলের কাজ জানালার মতো, যার ভেতর দিয়ে আমাদের ভেতরে উঁকি দেয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশে মুখচ্ছবি রূপান্তরিত হয় মুখোশে, যার মাধ্যমে আমাদের ভেতরে উঁকি দেবার সুযোগ আর থাকে না। আবৃত অবয়ব উপনীত হয় অদৃশ্য গোপনীয় কোঠরে। মুখোশটা খসে পড়লে দাঁড়িয়ে থাকি নগ্ন হয়ে, মনে হয় মেলে দিচ্ছি উলঙ্গ সত্য। মুখোশ খসে পড়ায় মনে হতে পারে অনেক চেষ্টায় লুকিয়ে রাখা বহুদিনের সত্যের মোড়ক উম্মোচনের মঞ্চে উঠছি আমরা। কিন্তু যে কোন সময় উম্মোচিত সত্য নতুন মুখোশ হিসাবে উদ্ভাসিত হতে পারে এবং তার পেছনে থাকতে পারে আরো মুখোশ। হতে পারে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতির জন্য আমরা বদলে চলি অনবরত ক্রমিক অনুযায়ী আমাদের মুখোশ।

মুখোশ যখন ছবি

আমাদের মুখোশটা পিছলে বুকের পাঁজরে লটকে গেলে তা ঝরা পাতার মতো। হয়তো তাতে অংকিত আছে একটা পাতার কাজ। মুখের মতো, পাতার আকারে ঝরে যাওয়া মুখোশ আমাদের নিজেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু মুখের বদলে মুখোশ বা ঝরে পড়া পাতা আমরা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখি স্বেচ্ছায়। তার মানে; স্বজ্ঞানে এবং স্বানন্দে। এর মাধ্যমে আমরা আমাদের আলোকোজ্জল দিকটা বেঁধে রাখি চৌকাঠে। আমাদের ভেতরের এই চৌকাঠ আমরা প্রয়োজন মাফিক প্রদর্শন এবং ক্রিয়াশীল করতে পারি। মুখোশের এই অলংকরণের নিজস্ব একটা বহুবিধ ব্যবহারের সুবিধা আছে। যা গলার হার বা কানের দুলের নেই।

কিন্তু মুখোশটা আলো ঝলমল ছবি হতে চৌকাঠের আলোকিত অংশের চেয়ে বেশী রং দাবী করে। তার দাবী অনুযায়ী আমরা পোশাক পরি। পরিচ্ছদের ভাঁজ থেকে স্খলিত হতে চায় না ছবি। আমাদের রুচি অনুযায়ী তৈরী পোষাকে প্রস্ফুটিত হয় আমাদের দন্ধবিক্ষুব্ধ অবস্থান, যাতে ঝুলে থাকার শক্তি পায় ছবিটা।

যে বাঁকা চাহুনীগুলো জীবন নাট্যের মঞ্চে দাঁড়ানো আমাদের ভেতরটা নিরিক্ষার মানদণ্ডে ওজনের চেষ্টা করে, সে দৃষ্টিগুলো জড়ো করে আমাদের গায়ে জড়ানো মুখোশের পোষাক নামক ক্যানভাস। মুখের মতো মুখোশের চৌকাঠটাও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রঙ্গমঞ্চে আমাদের জন্য নির্ধারিত চরিত্রের অংশ বিশেষ। সে জন্যই চোখ আর মুখোশের মধ্যে পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হবার একটা টান থাকে, যা একই সাথে আমাদের ভেতরের জানালা এবং মুখোশ হয়ে অন্তরের দহন এবং দৃষ্টিগোচর মুখোশের মধ্যে সমতা রক্ষার চেষ্টা করে। মুখ ও মুখোশের সমতা রক্ষিত হলে আমাদের আত্মার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে চায় চৌকাঠের জমি। সে ছবিতে ধরে রাখতে চাই আমরা আমাদের উপর নিক্ষিপ্ত সব দৃষ্টি।

“আমি নিরাভরণ হতে চাই না”।

মুখোশ এবং খিড়কীর আত্মীয়তা মুখমণ্ডলে ফুটে উঠলে সার্থক প্রকাশ ঘটে সব উপাদানের। এ ভাবে একদিকে আমরা দেখি ছবি হিসাবে মুখোশ আমাদের মনের আয়না, অন্য দিকে প্রদর্শনের উপযোগী পটে আঁকা ছবি। চৌকাঠের জমিনে টানানো ক্যানভাস ধরে রাখে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো আঠা দিয়ে আঁটা কাপড়, ভারসাম্যের সুষম কাঠামোতে রচিত হয় বৈচিত্র্যময় অবয়ব।

পলকে পলকে জীবন্ত হয়ে উঠে ছবির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সূক্ষ কারুকাজ।

(কষ্ট করে এই কোষ্টকাঠিন্য অনুবাদ পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জার্মান ভাষায় কিন্তু সাংঘাতিক ছন্দময় এবং কাব্যিক প্রভুদার লেখা, যতটুকু ছন্দহীনতা তা কেবল আমার-ই ব্যর্থতা।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রভুদা'র পুরো নাম লিখুন। তাঁর ওয়েবসাইট বা ব্লগ থাকলে তার লিঙ্ক দিন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

ইউনি স্টুটগার্টের একটা পেইজে উনার সম্পর্কে কিছু পেলাম। বুঝতে গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিতে পারেন।

পুতুল এর ছবি

http://www.zeit.de/kultur/literatur/2011-02/mazumdar

Pravu Mazumdar

সম্প্রতি প্রকাশিত প্রভুদার বইয়ের একটা রিভিও লিখেছে Die Zeit (সময়) সপ্তাহিক। এ ছাড়া কাজের কোন লিংক অন্তর্জালে খুঁজে পেলাম না। বলাই বাহুল্য লিংকটি জার্মান ভাষায। ইংরেজীতে কোন ওয়েব সাইট পেলাম না। প্রভুদার নিজস্ব কোন ওয়েব সাইট আমার জানামতে নেই।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

হাসিব এর ছবি

ইংরেজিতে বলে ব্রুচ। এভাবেই বলতে শুনেছি বাংলাদেশে।

পুতুল এর ছবি

কোন বাংলা শব্দ কী মনে আসছে হাসিব ভাই। পরের বারে মিউনিখ আসলে অবশ্যই প্রভুদার সাথে একটা আড্ডার আয়োজন করবো। খুব মজার মানুষ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।