"তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি কোলকাতার ট্রামে হারিয়ে ফেলেছিলেন অদ্বিতীয় “অদ্বৈত মল্ল বর্মন”। তীর্থের কাকের প্রায় সম্পূর্ণ লেখাটা খোয়া গেছে আগের ল্যাপটপ সারাতে গিয়ে। সচলে যতটুকু দেয়াছিল তার পর থেকে আবার নতুন করে লিখতে হচ্ছে। লেখা জমা রাখার নিরাপদ জায়গা সচলায়তনে আজকের লেখা পর্বটি জমা রাখছি। বিরতির কারণ যাই হোক; যারা তীর্থের কাক পড়তেন তাদের কাছে এই অনাকাংক্ষিত বিলম্ব এবং অনিয়মিতির জন্য ক্ষমা চাই।
হাত ভেঙ্গে আহত জাহিদ ভাই একটা সিঙ্গেল রুম পেলেন। মাহবুব ভাই জার্মান ভাষায় একটা চিঠি লিখলেন এই বাসস্থানের কর্ণধারদের কাছে। চিঠির মূল বক্তব্য হল চদ্রি ভাই বাকী বাসিন্দাদের উত্ত্যক্ত করেন। বাসিন্দারা সই করল। চদ্রি ভাইয়ের বদলি হয়ে গেল অন্য লাগারে। আপাতত নিরাপদ লাগাড়ের পরিস্থিতি। নির্ভয় রাত্রি কেটে যায় তাসের পাতায় ভাগ্য আবিষ্কারের নিষ্ফল চেষ্টায়। ঘুম থেকে জেগে দেখি বেলা যায় যায়। জানালার পর্দা গলে তির্যক আলোর বন্যায় চোখ ভেসে যায়। মেঘে ঢাকা আকাশের মৌসুমি বৃষ্টির মতো কুয়াশাচ্ছন্ন চাদর ছিনিয়ে নিয়ে মেঘদূত পাল তুলেছে অন্য গন্তব্যে। বাঁধ ভেঙ্গে জলের স্রোতের মতো খোলা জানালার পর্দা সরিয়ে ঘরে আসছে আলে বাতাস। একটি সুন্দর স্বপ্নের নিষ্ফল জাল বুনে বুনে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে সময় লেগেছে আমার অন্য সবার চাইতে অনেক বেশী। তাই ঘরে আর কারো অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলাম না। ঘরের দরজা খোলা রেখেই মুখ ধুতে গেলাম। কারণ অ-নিবন্ধিত বাসিন্দা বলে আমার কাছে ঘরের কোন চাবি নেই। ঘর থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরত্বের বাথরুমের বাঁয়ে রান্না ঘরটায় পরিচিত কয়েকজনের কথোপকথন কানে গেল। বুঝলাম; দুপুরের রান্না করছে জসীম। এই রান্না আর খাওয়ার ঝামেলাটা না থাকলে জীবনটা কতো নির্ঝঞ্ঝাট হতো! জগদীশ বাবুর কথামতো গাছেরও প্রাণ আছে। কিন্তু অন্য প্রাণীর মতো খাদ্যের জন্য তাদের হন্যে হয়ে ঘুরতে হয় না। নাই চাষ-বাস বা শিকারের ঝামেলা। বাতাসের সাথে ভূপৃষ্ঠের মাটি, বৃষ্টির জল আর সূর্যের আলোই বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট তাদের। যাযাবর প্রাণীর আগেই পৃথিবীতে উদ্ভিদের জন্ম হয়েছিল। একটা গাছ তার দীর্ঘ জীবন এক জায়গায় পার করে দেয় অনায়াসে। আমরা এক জীবনে কতো জনপদ তৈরই আর বিনাশ করি!
ভাঙ্গ-গড়ার লীলাভূমি হচ্ছে পায়খানা। কাল রাতে যা খেয়েছি আজ তার সব আবর্জনা। এই পায়খানা ঘরটায় তিন রকমের ব্যবস্থা আছে। দাঁড়িয়ে জল বিয়োগ। আমাদের দেশের মতো দুই ইটার উপর বসে মলত্যাগ। অথবা ইউরোপিয়ান কায়দায় ছিদ্রযুক্ত মোড়ায় বসে বিশ্বের খাদ্য-ঘাটতি বাড়ানো। ইউরোপিয়ানদের ব্যবস্থায় কোন পানির কল নেই। হেগে কাগজ দিয়ে পাছা মুছতে হবে। ইটায় বসার সুবিধা হচ্ছে; এখানে একটা পানির কল আছে। হেগে পানি দিয়ে সুরু করতে না পারলে মনে হয় হাগাই হয় নি। অবশ্য বিপদে পরে দেশেও অনেক বার পানি না পেয়ে মাটির ঢেলা দিয়ে হাগু মুছতে হয়েছে। কিন্তু তাতে পাছায় গু নিয়ে হাঁটার সতী কমে নি। ঈশ্বর জানে সাদা চামড়ার মানুষ কী ভাবে কাগজে গু মোছে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়! যে যেভাবেই করুক হাপু করার মতো শান্তি পৃথিবীতে আর নেই। এই শান্তিটাই আচ্ছা মতো উপভোগ করতে পারলাম না জসীম হাঁক দিয়ে বসল।
দুপুর হয়ে গেছে। দিন তারিখ বলতে পারব না। মনে হয় উন্নত সভ্যতার একটা মধ্যযুগীয় দ্বীপে ঢেঁকির মতো স্বর্গে বসে ধান বাসছি। আমাদের বাঙ্গালি জটলার বাইরে আর কী হচ্ছে, তা জানার কোন উপায় নেই।ভইসই ভারতীয়রা কী ভাবে যেন ভিসিআর-টিভি যোগার করেছে শ্রী-দেবীর নাচ দেখার জন্য। বিনোদনের সেটাই একমাত্র সম্বল। এর আগে যেখানে ছিলাম, সেখানে টিভি রুম ছিল। সবই জার্মান ভাষায়।রেডিওও টিভিতে যেমন ইংরেজী সংবাদ আছে, তেমনি আছে হলিউডের অনেক ইংরেজী চলচ্চিত্র। ম্যাকগাইভার, নাইট রাইডার, এ টিম সবাই এখানে জার্মান ভাষায় কথা বলে। ইংরেজী পত্রিকাও এখানে পেলাম না।পর্ণীর মতো প্রকৃতিই আমাদের একমাত্র ভরসা। বেলা উঠলে দিন। আর বেলা ডুবলে রাত্রি।
আমি রান্না-বান্তটা এখনো ভাল পারি না। তাই সব সময় পেয়াজ আলু কেটে-কুটে দেই। দেরীতে ঘুম থেকে উঠার জন্য আজ আর তা করতে হল না।সনালের নাস্তা বাঁচিয়ে দুপুরের খাওয়ার এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য একেবারে নতুন নয়। উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকায় এসে টিউশনি করে যা পেতাম, তা দিয়ে উচ্চতর শিখতো পরের কথা; তিন বেলা খাওয়াই সম্ভব হতো না। রাতের খাবার দেরী করে খেয়ে ম্যারাথন ঘুম গিয়ে উঠতাম দুপুরের দিকে। এভাবেই সকালের নাস্তাটা বেঁচে যেত। আর বিকেলে পড়াতে গেলে ছাত্র-ছাত্রীর মা চায়ের সাথে যে দুএকটা বিস্কুট দিতেন সেটাই পুঁজি করে রাত দুপুরে ভাত খেয়ে আবার ম্যারাথন ঘুম।
কী ভাবে যেন দেশে থাকতে আমার মনে হতো ভাত নিচু জাতের মানুষের খাদ্য। উন্নত বা ধনী জাতির মধ্যে জাপানীরা যে ভাত খায়; সেটাকে ভাত হিসাবে গণ্য করলে ভিন্ন কথা। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় পাও যায় বিভিন্ন রকমের বার্গার বা পেটিস। গ্রামের চায়ের দোকান বা যে দুএকটা ভাতের হোটেল আছে সে খানে এসব দেখিনি। তাই আমার ধারণা ভাত খায় গরীব মানুষ। ধনী-গরিবের বিবেচনা এখন আর মাথায় নেই। এখন মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার হচ্ছে ভাত-মাছ। প্রতি সপ্তাহে যে খাবারের প্যাকেট দেয়া হয়; তাতে নুডুলস, চাল, পেয়াজ, আলু, কখনো ফ্রোজেন মুরগী বা গরুর মাংস, এক লিটার দুধ, এক লিটার করে আপেল আর অরেঞ্জ জুস থাকে। যা কিনতে হয় তা হল মসলা। এবং তার দামই সব চেয়ে বেশী। শুনেছি নিজের আভিজাত্য দেখাতে ইউরোপের অনেকেই খাবার পরে দই মিষ্টির মতো গোল মরিচ খেতো। তখন ভারতের গোল মরিচের দাম এখনকার সোনার চেয়ে বেশী ছিল। ভারতের সবুজ সোনার দখল নিতে ইউরোপিয়ানরা লড়াই করেছে একে অন্যের বিরুদ্ধে। গোল মরিচ না হোক একটা কাঁচা লংকা পেলেও জসীমের রান্না করা টমেটো দিয়ে আলু ভাজি অমৃত মনে হতো। ভাজি বলে মরিচ কম দিয়েছে জসীম। আর এখানকার আলু মনে হয় মিষ্টি। টমেটোর যেন কোন নিজস্ব স্বাদ নেই। পেটের ক্ষুধা আর পরিস্থিতির কারণে তাই খেতে ভাল লাগছে। একটানা এক মাস কোন ভাত খাই নি। এখানে আসা অব্দি প্রতিবারেই শুধু ভাতটা দেখলেই মনে হয় কোন প্রিয় বন্ধু।
ভূরিভোজন শেষ করে বের হলাম। এই তো দেখা যায় কৌনিক্সপ্লাট্স। ওখানে যেতেই প্রায় দুই মার্কের টিকেট লাগে। বাপরে! ট্রামের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বরং হেঁটেই পৌঁছানো যায় ট্রাম আসার আগে। অসঙ্গতি ঢাকতে আমাদের যুক্তির অভাব হয় না। এরা আমার আগেই এখানে এসেছে এবং শহরটার সাথে পরিচয়ও আমার থেকে ভাল। আমাকে একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে ধেনু দিঘির পারে। সেখানেও নাকী অপ্সরীরা নগ্ন হয়ে স্নান করে। ঘটনাক্রমে কখনো স্বর্গে গেলে যে হুরকে পাওয়া যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ধর্ম, সে হুর নির্বচনে আমাদের কোন অধিকার ঈশ্বর বিবেচনা করবেন এমন প্রতিশ্রুতি পাওয়া না গেলেও স্বর্গের অপ্সরীরা কেমন দেখতে হবেন তার সম্পর্কে একটা একটাই ধারণা থাকলে ক্ষতি কী! স্বর্গের টানে আমারা হাওয়া বর করে চলি।
অনেক দূর থেকে স্বর্গের কলকাকলি আর আচ্ছাদনে মিতব্যয়ী অপ্সরীদের আনাগোনা ইন্দ্রিয় গোচর হল। আমাদের চলার গতি আরো বেড়ে গেল। এ যেন পুষ্পের বৃন্তের ভেতর না ফোটা কলির আভাস। যা একটি ফুটন্ত ফুলের ইঙ্গিত মাত্র। নূড়িপাথরের ঢাল নেমে জলটা ডালিমের রসের মতই। চাতক বৃষ্টির জলে যেমন করে; সেভাবেই পুণ্যস্নানের তীর্থযাত্রীরা জীবনের সব পাপ ধুয়ে নিচ্ছে জলে। কিন্তু কোন ব্যস্ততা নেই। থাকবেই বা কেন। এরা যে স্বর্গের বাসিন্দা। কেউ জল থেকে উঠে বিছানো তোয়ালের উপর চিত বা উপুড় হয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। রোদ যাদের অসহনীয় হয়ে গেছে তারা নামছে শীতল জলে। মেয়েদের বিকিনিটা যেন শুধু স্তন-যুগল আরো আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। উড়ু-যুগলের সন্ধিস্থলে সুতোর বেষ্টনী অতি কষ্টে ঢেকে রেখেছে জীবন প্রবাহের আবশ্যিক অঙ্গ সমূহ।
আমরা দিঘির অন্য পারের উদ্দেশ্য এগুচ্ছি। এবার কোন তাড়াহুড়ো নেই। আমরা তো স্বর্গেই আছি। এখানে কিছুই পুড়নো হবার নেই। যৌবন থেমে আছে। নারী-পুরুষ সবাই সুঠাম দেহের অধিকারী। শিশুরাও আছে। তারাও অন্য সবার মতো যুবক-যুবতী হবে একদিন। ঠিক বৃদ্ধ বলতে যা বোঝায় এমন কেউ এখানে নেই। অথবা আমার অনভ্যস্ত চোখে ধরা পরছে না। রোদে পুড়ে মেয়েদের শরীর অনেকটা দুধে আলতায় মেশানো রং পেয়েছে। মুগ্ধ হয়ে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে যে কেউ রেগে যেতে পারে। কাজেই জসীম তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে; আরো সুন্দর আরো আকর্ষণীয় অপ্সরীর দিকে। দিঘিটার ভেতরের দিকে কোন গাছ-পালা নেই। যা আছে কেবল বাইরের দিকে। অনেক নাম না জানা গাছের বাগানের ভেতর পার্কিং লনটার পরেই; অনেকটা সবুজ গাছের নীচে সবুজ গালিচার মতো মাঠ পেরিয়ে নুড়ি পাথরের ঢাল, তার পরা জল। ডানে নুড়ি পাথর বাঁয়ে সবুজ গালিচার মাঝখানে পায়ে চলার পথ। বাঁয়ে সবুজ গালিচায় গাছের ছায়ায় প্রায় উলঙ্গ যুবক-যুবতী চুমোচুমি করছে। ডানে কেউ জলে যাচ্ছে আবার কেউ জল থেকে উঠে আসছে। কোনটা রেখে কোনটা খাই; এই রকম অবস্থা আমার। আমার বাকী সঙ্গীরা এখানে এসেছে অনেকবার। তাদের কাছে এই সব পানি ভাত। আমিই কেবল হা করি তাকিয়ে থাকি। আর মনে মনে এমন কোন অপ্সরীর সঙ্গ কামনা করি। এ যেন ধোপার ছেলের ব্রাহ্মণ কন্যার স্বপ্ন দেখার মতো অলিক দিবা স্বপ্ন। যা কোন কাজে মন কে স্থায়ী হতে দেয় না। কাল সারা রাত চেষ্টা করেও শ্রীদেবী আর রেখা ছাড়া অন্য কোন সুন্দরীর কথা মনে করে স্বপ্ন দেখতে পারলাম না। আর এখানে যে কোন একটি মেয়ে রেখা বা শ্রী-দেবীর চেয়ে সুন্দরী। একী দেখার ভুল নাকী না দেখার মূর্খতা! না দেখলে তো কামনাও করা যায় না। অবশ্য কামনার স্বপ্ন দেখে সে অভীষ্ট লাভের নিমিত্তে সংকল্প করে অধ্যবসায়ের বদলে সুখী মানুষের নমুনা খুঁজতে আমরা চতুর্থ-শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে পড়েছি যার কিছু নেই সেই সব থেকে সুখী। বাহ। কী চমৎকার। শিক্ষাটা এখন কোন কাজে লাগছে না।
ইচ্ছে করছে এই অপ্সরীদের নিদেন পক্ষে একজন আমার সঙ্গী হোক। কয়েকজন হলে নিশ্চয়ই আরো ভাল। তবে কমপক্ষে একজন কে চাই। কাউকে না পেলে যে জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে! কেউ পথ আগলে যদি বলে হে ভুবন বিহারী পথিক; দেখ, স্বর্গের রোদে গা-টা কেমন পুড়ে যাচ্ছে! দাও না একটু অতিবেগুনী রশ্মি নিরোধক ক্রিম মেখে! মনে হয় আনন্দে আমি জ্ঞান হারাব। অথবা আমার একমাত্র টিউবের সবটা ক্রিম একবার ঐ অপ্সরীকে স্পর্শ করলেই খালি হয়ে যাবে। তখন কী করব আমি! দেখে দেখে ভেবে ভেবে আমার অবাধ্য তীর নায়লনের তূণ থেকে মুক্তি চাইছে। উপরে জিনস না থাকলে খবর ছিল। দেশে লুঙ্গি পরতাম জাঙ্গিয়া ছাড়া। সে অবস্থায় এখানে এলে কী বিপদটাই না হতো!
দিবা স্বপ্ন দেখতে দেখতে মনে হয় সব কিছু ভাল করে দেখার আগেই স্বপ্নটা ফুরিয়ে গেল। দিঘিটা পেছনে ফেলে আমরা একটা ঘন-ঘাসের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার ঢালুতে যেখানে মানুষের পায়ের চিণ্হ পরে নাই; সেখান ঘাস আমাদের জাতীয় পতাকার মতো ঘন সবুজ। কী লকলকে ঘাসরে বাবা! ছোট বেলায় গরু-ছাগলের ঘাস যোগার করতে রোদে পুড়ে কত কষ্টই না করতে হয়েছে। আর এখানে ঘাসের অভাব নাই। অভাব শুধু ঘাস খাওয়ার গরু-ছাগলের। এখন এতো সুন্দর ঘাস দেখে নিজেরই খেতে ইচ্ছে করছে। গরু তো ঘাস খেয়েই দুধ-মাংস দেয়। সে ঘাসটা একেবারে নিজে খেয়ে নিলেই তো আর গরু-ছাগল পোষার ঝামেলায় যেতে হতো না। খুব কচি দেখে একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে হাল্কা সবুজ আরো হাল্কা হতে হতে যেখানে সাদা হয়ে গিয়েছে সেই মূলের উপরের অংশটা খেয়ে দেখি মিষ্টি লাগছে। এখন মনে হচ্ছে আহা কেন গরু হয়ে এদেশে জন্মালাম না!
আমার চেয়ে বয়সে বড়, বউ-ছেলে-মেয়ে আছে জসীমের। কী এক অদ্ভুত কারণে নাকী অকারণে জসীমের সাথে একটা ভাব হয়ে গেল। মাসুদ ভৌগোলিক ভাবে আমার অনেক কাছের মানুষ। এখানে প্রথম আশ্রয়টাও তার সহযোগিতায় হয়েছে। তবুও নোয়াখালীর জসীম যেন আমার এখানে সব থেকে বড় বন্ধু। সম্পর্কটা আমাদের অজান্তেই তু-তাই-এ নেমে গেল বা উন্নীত হল। আমার সব রকমের দুর্বলতা তার চোখেই আগে পরে। যা নিয়ে সুরুজ বা বেলার বা রফিক হাসি-তামাসা করে। এই দেশে গরু হয়ে জন্মানোর ইচ্ছেটাই তারা আগে লুফে নিল। আমি গরু আর জসীম আমার রাখাল। আমি কেন যেন খুব বিরক্ত হলাম না। মাসুদ আর জসীমের যত মমতাই থাক, ওদের নীরব সমর্থন না থাকলে আমি এখানে থাকতে পারতাম না। অসুবিধায় পরলে মানুষ যেমন সব কিছু মেনে নেয়; ঠিক তেমনি কাউকে অসুবিধায় দেখলে কেউ স্বাভাবিক ভাবেই একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। আর এরা তো একটু হাসি-তামাসা করে কেবল। এসব গায়ে মাখলে চলে না।
আমার ঘাস খাওয়া শেষ হতে না হতেই আমরা একটা পাহাড়ের উপর উঠে গেলাম। ডানে একটা নদী বয়ে চলেছে। বাঁয়ে আর একটা দিঘী। এখানেও স্নানার্থীর ভীর। কিন্তু দিঘীর অপর পাড়ে সত্যিকারের স্বর্গ নাকী নরক! সেখানে সবাই উলঙ্গ। কারো গায়ে সুতোটি পর্যন্ত নেই! এর আগের দিঘীটাতে নামতে পারি নাই। কারণ; স্নানের জন্য কোন কাপড় সাথে ছিল না। এখানে তার কোন প্রয়োজন নাই। গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসা অব্দি কালে ভাদ্রে পুকুরের জলে নেমে ঠিকমত সাতার কেটে গোসল করতে পেরেছি। বালতি থেকে মগ দিয়ে মাথায় পানি ঢেলেই গোসলের সাধ মিটেছে। পানির সরবরাহ আমাদের ওয়াপদা কোন ভাবেই উন্নত করতে পারেনি। কাজেই সব সময় পানি শহরের সব জায়গায় থাকতো না। তখন পানি নেমে গোসল করার জন্য কোন পুকুর বা ডোবার সন্ধান করতাম। অনেক দূর-দূরান্তে কোন পুকুরের খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখতাম; ডাইং ফ্যাক্টরির কল্যাণে এবং আরো এমন কিছু ছোট-খাট কারখানার কল্যাণে সে সব জায়গার পানি কালো। স্নানের কোন উপায় নেই। অথচ এখানে পানি স্বচ্ছ! কাউকে সাবান মেখে শরীর পরিষ্কার করতে দেখলাম না! সবাই পানিতে নেমে সাতার কাটে, ভেসে থাকে, বা ডুব দেয়। মাছও ধরে না, সাবান মেখে শরীর পরিষ্কারও করে না! পানি সত্যিই ডালিমের রসের মতো স্বচ্ছ। নামতে কার না মন চায়! তার সাথে বাড়তি সুবিধে হচ্ছে এখানে স্নান করতে কোন কাপড় লাগবে না। অপ্সরীদের স্নান সঙ্গী হতে আমি কাপড় খোলা শুরু করলাম। তুই হাগলনী কোন! বলে জসীমের সতর্ক বাণী কোন কাজে লাগল না। আমি সত্যি সত্যিই জাঙ্গিয়া ধরে টান দিলাম। ভয়ে সবাই পিছিয়ে গেল। এবার ধীরে-সুস্থে হেলে-দুলে সুন্দরীদের ভিড়ে এগিয়ে চললাম। চিত হয়ে দিগম্বর যুবতী-যুবকের সূর্যস্নানে ব্যাঘাত না দিয়ে পানিতে নামার একটা পথ পেয়ে নেমে গেলাম। একটু দ্রুত। কারণ এখন তীর আর তূণে নেই। যে কোন ক্ষণে নিক্ষিপ্ত হতে পারে এমন সম্ভব না যখন উপেক্ষা করা যায় না, তখন ব্যবস্থা নিতেই হয়। ঝাপ দিয়ে পানি তে নেমে মনে হল; পানি নয় যেন বরফ গলা নদী! রোদের ত্যাজ যত প্রখরই হোক, এই বিশাল জল রাশিকে আমার পাতলা চামড়ায় সয়,সেই পরিমাণ গরম করা এখনও সম্ভব হয় নাই।
বেশ একটু খানি সাতরে দিঘীর প্রায় মাঝখানে এসেও শরীরকে ঠাণ্ডাটা মানাতে পারলাম না। কী আর করা। আবার তীরের দিকেই এগুচ্ছি। দিঘীর দিকে পা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে থাকা যে কোন যুবতীও যদি আমার ফিরে তাকাত, জীবনটা সার্থক হতো। ল্যাংটা হয়েও কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলাম না। কাপড়-চোপড় পরার পরে আমার সঙ্গীদের দিকে এগিয়ে গেলাম। পোশাকের কদর দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এখন আর আমাকে দেখে কেউ দূরত্ব খুঁজছে না! অথচ এই পোশাকের ভেতর সেই ন্যাংটা আমিই।
এখানে দিক চেনার কোন উপায় কোন দিনও খুঁজে পাব না। ধরে নিচ্ছি আমাদের পেছনে সূর্যদেব যে নতুন সমাজকে আলোকিত করতে যাচ্ছেন, সেটাই পশ্চিম দিক। আমরা পূর্ব দিকে ফেলে আসা পথে পা চালাচ্ছি। আমাদের কথা-বার্তায় কোন বৈচিত্র্য নেই। ইন্দিরা গান্ধির স্বামীর নাম রাজীব গান্ধি না মহাত্মা গান্ধি এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তর্ক ভাল লাগে না এখন। তার চাইতে ফ্রি সেক্স মানে মাসুদের মতে; মা-ছেলে নিজ নিজ প্রেমিক প্রেমিকার সাথে গোপনে মিলিত হতে হয় না; এই বিষয় বেশী মজার। জসীম নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলল;
-এগুণ মাইনষের জাত নি কোন! লইজ্যা-শরম নাই, বেকগুণ ল্যাংডা আই জাতা-জাতি টিফা-টিফি করতাসে! মা-বাপ-ভাই-বোন বেকগুণ এক লগে ল্যাংটা, অসভ্য হগল!
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার বৈ কী! কিন্তু আমি অবাক অন্য কারণে। এতগুলো মানুষ ওলঙ্গ! অথচ কেউ কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করছে না! যার ইচ্ছে সে বিকিনি গায়ে রাখছে যার নয় সে খুলে ফেলছে। যাদের সঙ্গিনী বা সঙ্গী আছে, তারা সঙ্গিনী, সঙ্গীর সাথে ঢলা-ঢলি, লুটোপুটি করছে। যাদের নেই তারা বই পড়ছে বা চোখ বন্ধ করে জল বা সূর্যস্নান করছে। কেউ কার দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত, উত্যক্ত করা তো পরের কথা। এটাকে অসভ্যতা বললে সভ্যতা বলব কাকে!
মন্তব্য
চেক করেছি, কিন্তু স্পাম বা মেইল পেলাম না।
যে মন্তব্যের জবাব দিলাম সেটা কী আমিই মুছে ফেললাম! অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয়ত ভুল বাটনে চাপ দিয়েছি। দুঃখিত।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অনেকদিন হলো সচলে ঢু-মারা হয় না! আজকে আপনার লেটেস্ট তীর্থের কাক দেখে আপনার অতীত একটা পোস্টের কথা মনে হলো! আপনি তো দেখি প্রায়ই মন্তব্যের জবাব দেন কিন্তু সেই পোস্ট এ আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিল কিন্তু আপনার পক্ষ থেকে নিরবতা কিছুটা অবাক করেছে! এমনও হতে পারে আপনি হয়ত প্রশ্নগুলো খেয়াল করেন নি! যদিও আপনি উত্তর দিতে বাধ্য নন, কিন্তু খুব খুশী হব যদি আপনার কাছ থেকে সত্য ভাষণ টা জানতে পারি.... এখানে আপনার সেই লেখাটি....
http://www.sachalayatan.com/doll/44942
বা,
http://www.sachalayatan.com/comment/reply/44942/522751
-একজন স্বার্থপর পাঠক!
জবাব দিচ্ছি। ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পাণ্ডুলিপি হারানোর ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লাগল। কিন্তু আপনি যেভাবে আবারও শুরু করলেন, তাকেই হ্যাটস অফ দাদা।
ডাকঘর | ছবিঘর
থেংকু দাদা।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
চলুক। পড়ছি।
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
হুম, পড়ছি। কিছু ব্যাপার একটু কড়া হয়ে গেছে আমার জন্য যদিও।
শেষ লাইনটা ভালো লাগলো।
---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
ধন্যবাদ। কড়া ব্যাপার গুলো বললে সুবিধা হতো। ফ্যাক্টের চেয়ে আমার ভাবনা এখানে বেশী এসে পরেছে। তাই কিছু ভাবনা যেগুলো বাহুল্য সেগুলো ভবিষ্যতে বাদ দিতে পারতাম বা এক ধরণের পরামর্শ হিসেবে নিতে পারতাম। একটা লেখা পড়ে বাহবা দেয়ের চেয়ে জরুরী হচ্ছে সে লেখার সমালোচনা। কৃতজ্ঞ থাকব যদি উৎসাহ দানের সাথে সমালোচনাটাও করেন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অন্য পর্বগুলো আস্তে আস্তে শুরু করছি তবে এই পর্ব বেশ লাগলো । বিশেষ করে
এটাকে অসভ্যতা বললে সভ্য বলবো কাকে!
একেবারে মনের কথাটি বলেছেন ।
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আগের সব পর্ব পড়া হয়নি। এই পর্বটা পড়লাম। শেষ লাইনটা আসলেই
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
ধন্যবাদ কবি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই আইসা পড়ছি
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন