গলাটা পরিচিত। জসীমকে ডাকছে তাওহীদ ভাই। বেশ জোড় গলায়। খুব সুন্দর আবহাওয়ায় বেড়াতে গেছে সবাই। হয়তো আমিও তাদের খোঁজেই যেতাম যদি হাগা না লাগতো। কাজেই তাওহীদ ভাইয়ের ডাকে সারা দেবার কেউ নেই। আরাম করে হাগা সেরে আমি এখনই বের হয়ে তাওহীদ ভাইকে গিয়ে বলব যে, এখন এখানে কেউ নেই। কিন্তু তাওহীদ ভাইয়ের এই সময়ে কাজে থাকার কথা! তিনিই বা এই অসময়ে কী মনে করে এখানে এলেন! সেই সময় তাওহীদ ভাই আমাকে আর দিলেন না। পায়খানার দরজায় এসে বললেন; কোন বাঙ্গালী ভাই থাকলে বাইরে আইয়েন তে জলদী। কামে লইয়া যামু।
কাজের কথা শুনে হাগার আরাম অতিদ্রুত শেষ করার আগেই জবাব দিলাম; একটা মিনিট ভাই, আইতাসি। বের হয়ে দেখি তাওহীদ ভাই কাজের পোশাকেই। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন; মালিকনী নীচে গাড়িত বইয়া রইসে, জলদি আইয়ে তে। দুপুর বারটা বাজবে। রেস্টুরেন্ট খোলা হয় সকাল এগারটায়। তখনই ঐ রেস্টুরেন্টের ডিসি (ডিস ক্লিনার) ফোন করে জানিয়েছে সে অসুস্থ। কাজে আসতে পারবে না। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব একজন ডিসি দরকার। গোলাপি রংয়ের ছাদ খোলা জীপে উঠে তাওহীদ ভাইয়ের পেছনে বসে ওনার সাথে আমিও জসীমের জন্য আক্ষেপ করছি। তাওহীদ ভাই জসীমকেই নিতে এসেছিলেন। কিন্তু ঠিক সময়ে জসীম ঠিক জায়গায় ছিল না। মালিকের দরকার একজন শ্রমিক। সে কে বা কোন দেশের তাতে তাঁর কিছু আসে যায় না। একজন পাকিস্তানী বা ভারতীয়কে ডাকার আগে তাওহীদ ভাই অন্তত একবার শেষ চেষ্টা করে দেখেছেন একজন দেশী মানুষকে অস্থায়ী ভাবে হলেও কাজটা দেয়া যায় কী না।
পরের দিন কাজে গিয়ে শুনি আমার আগে যে মেয়েটা এই কাজটা করতো সে ছয় সপ্তাহের মেডিকেল লিব নিয়েছে। অন্তত ছয় সপ্তাহের জন্য কাজটা আমার স্থায়ী। কিন্তু মালিক বলে রেখেছে; তাঁরা কাজ করার অনুমতি আছে এমন লোক পাওয়া মাত্র আমাকে জবাব দিয়ে দেবেন। এর আগে অবৈধ শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর অভিযোগে অনেক জরিমানা দিয়েছেন। এদিকে কাজ করার বৈধ কাগজ পত্র পাওয়ার পরে এখানে আর কেউ থাকে না। সব চেয়ে বেশী কায়িক পরিশ্রম অথচ বেতন সব চেয়ে কম। এই কাজ করে কোন গাধা! কাজের অনুমতি পেলে কল-কারখানায় কাজের অভাব নেই।
কাজ তো নয়, হাতে স্বর্গ পেয়ে গেলাম। সেভাবেই কাজ করছি। দ্বিতীয় দিনে তাওহীদ ভাই অবশ্য জসীমকে নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন মালিককে। কিন্তু মালিক বলেছে; আমি যেহেতু যত সামান্যই হোক একটু কাজ শিখে গেছি, আমাকে রাখাই ভাল। মাথার কাজতো নয়, সে কাজ কখনো ভাল পারি না আমি। কিন্তু হাতের কাজে হাত-পা চলে হাওয়ার বেগে।
ভাল লাগে দুপুরের খাবার সময়টা। সব দিক থেকে এই সমাজের সব চেয়ে নীচের মানুষ আমিও অন্য সবর মতো মালিকের সাথে এক টেবিলে বসে খাই। ইটালিয়ান ওয়েটার জিয়াকুমো একটু ইংরেজী জানে। তার সাথে টুকটাক কথা হয়। ভিঞ্চির মোনালিসা সত্যিই ছিল কীনা। বা মার্কোনীর রেডিও সভ্যতাকে কতটা এগিয়ে দিয়েছে; এই সব কথাবার্তায় ইংরেজী না জানা টেবিলের অন্য সবার মতো জিয়াকুমো ও রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খাওয়া রেখে। আমি কতো বুজুর্গ ব্যক্তি! জিয়াকুমো সবার জন্য জার্মানে তর্জমা করে দিল। বাহ্। সবাই আমাকে কতো জ্ঞানী ব্যক্তি মনে করছে। এক সময় এলো ওয়াল্টার ( জার্মান উচ্চারণে ভালটার)। মিমো আরেক ইটালিয়ান, এই রেস্টুরেন্টের বার ম্যান। তার বন্ধু ওয়াল্টার জার্মান। ওয়েলটার ইংরেজীতে জিয়াকুমোর চেয়ে স্বচ্ছন্দ। ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে কুক ভিকি সিং। পিসসা মেকার তাওহীদ ভাই। স্টারটার আর থালা ধোয়ার লোক আমি। এখন জানলাম মালিক চেকোশ্লোভাকিয়ান। কোন পত্রিকায় পড়ে ছিলাম; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজ তন্ত্রের নামে রুশ দখলদার বাহিনীর অত্যাচারে টেনিস ষ্টার মার্টিনা নাভ্রাতিলভা বা মিলান কুন্দেরার মতো অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। কুন্দেরার “অসহ্য সরলীকৃত” (বইটার জার্মান নাম; উন এরট্রেগলিখে লাইখটিক কাইট দ্যাস সাইন) বইটার সামান্য সমালোচনা ছিল সেই আর্টিকেলে। সেটাকেই পুঁজি করে যা মনে হলো বললাম। এবার সেটা অনুবাদ করে দিল ওয়াল্টার চেক মালিকনীর উদ্দেশ্যে। শুনে মালিকনী তো মহা খুসী। নিজের দেশ সম্পর্কে পৃথিবীর সেই তলার দেশের মানুষও এতো কিছু জানে!
আমি একটু তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললাম; আমাদের দেশে যে কোন স্কুল গামী বালকও এসব জানে। বলাই বাহুল্য; কথাটা আমার বিনয় হিসাবেই নিল সবাই। আর আমি হয়ে গেলাম এক মহা পণ্ডিত। ভিকি সিং কতকিছু জানতে চায়! চলছিল ভালই। কিন্তু বিধি বাম। কোন এক পাকিস্তানী নিয়ে এলো কাজের অনুমতি আছে এমন আরেক পাকিস্তানী। ১৭-১৮ দিনের বেতন তেরশ মার্ক হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিব্রতকর চেহারা নিয়ে মালিকনী বলল; আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত, অবৈধ লোক রাখতে পারছিনা। কাজ করার অনুমতি পেলে তুমি আবার এসো। ভাগ্যকে গালমন্দ করা ছাড়া আর কিছু করনীয় পেলাম না।
এতো টাকা জীবনে কখনো এক সাথে দেখিনি। আয় করা তো পরের কথা। যদি কাজের অনুমতি থাকতো, কতো টাকা আয় করতে পারতাম! আফসোস আর আনন্দে একটা টি সার্ট কিনে ফেললাম বার মার্ক দিয়ে। দোকান থেকে বের হয়ে দেখি এখানেও ফুটপাথের দোকান আছে। কিনলাম একটা সানগ্লাস পাঁচ মার্ক খরচ করে। আমরা এমন একটা চাপা অভাবের ভেতর দিয়ে এসেছি; ঠিকমত খাবার জুটে না। কিন্তু যে কোন মূল্য সে অভাবের কথা কাউকে বলাও যাবে না। আবার এতদিন জেনে এসেছি পড়ালেখা করলে অভাব ঘুচে যাবে। কিন্তু যখন পড়তে লিখতে শিখেছি তখন জেনে গেছি; এইটুকু লেখা পড়া দিয়ে কোন কাজ পাওয়া সম্ভব না। ভুয়েট-মেডিকেলে ঢুকতে না পারলে পড়ালেখা করে অন্তত ভাল আয়ের কাজ পাওয়া সম্ভব না। চুরি-ডাকাতি করলে একদিন ধরা পরতেই হবে। সেই দিনের ভয়ে সেই চিন্তাই আর মাথায় আসে না। অত সাহস ও নাই। আমার দেখাদেখি ছোট ভাই-বোন গুলোও পড়ছে। প্রাইভেট শিক্ষক দিয়ে না পড়ালে তাদের অবস্থাও আমার মতো হবে। টাকা দরকার। তার জন্য খদ্দের পেলে শরীরের যে কোন অর্গান বেঁচে দিতে চাই। না ঘরকা, না ঘাটকা। যেটুকো পড়ালেখা শিখেছি সেটা আলেয়ার মতো। সে বিদ্যার ভারে ছোট-খাট শ্রমিকের কাজ করতেও পারি না। আর করলেও সে টাকায় এই অভাবের শৃঙ্খল ছিন্ন করা সম্ভব না। তবলা শেখা, নাটক করা, এমনই কতো সখ অপূর্ণ রয়ে গেল। তার সান্ত্বনা স্বরূপ এই টি-সার্ট, সানগ্লাস!
আলাদা একটা কাগজে ছবি লাগিয়ে সিল-সাপ্পর মেরে সেটাই অস্থায়ী পরিচয় পত্র করে দিয়েছে জার্মান সরকার। ছয় মাস পার হয়ে গেছে। ভিসার জন্য যেতে হবে। নতুন টি-সার্ট আর সানগ্লাস পরে গেলাম ভিসার জন্য মিসেস গাব্রিয়েলার কাছে। অনেক মানুষ অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে মুখে আনন্দের মুখোশ পরে থাকে। কিন্তু সত্যিকারের আনন্দ লুকানো মনে হয় সম্ভব হয় না। আমার নতুন টি-সার্ট আর হাতের মুঠোয় লুকানো সানগ্লাসের পেছনে হয়তো কোন সুখ বা আনন্দ লুকানো ছিল। গাব্রিয়েলার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ হয়ত সেই সুখের ঝলক ধরে ফেলেছে। গিয়েছি ভিসার জন্য, কিন্তু তিনি প্রশ্ন করলেন; তুমি কী কাজ পেয়েছ? অবৈধ কর্ম দাতা এবং গ্রহীতার জন্য একজন সরকারী লোকের কাছে কথাটা স্বীকার করা মঙ্গল জনক হতে পারে না। আবার মিথ্যা বলাটাও ভাল রপ্ত করতে পারিনি। থতমত ভাব কাটিয়ে না-ই বললাম। আমার কথা না শোনার ভান করেই তিনি বলতে লাগলেন; তোমার ইংরেজী যত ভালই হোক না কেন, জার্মান না জানলে তুমি এখানে কোন কাজ পাবে না। সে জন্যই বলছি যদি কাজ পেয়ে থাক, তাহলে করতে থাক। আর কাজের অনুমতি পত্রের জন্য এখন থেকে আর ভাবতে হবে না। আমাদের সরকার আগের পাঁচ বছরের বদলে এখন তিন মাস পরেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের কাজের অনুমতি দিচ্ছে। আমার কাছে এই মর্মে সরকারের লিখিত নির্দেশ পত্র এসেছে। সর্বসাধারণের জন্য এই পত্রের কর্জকারিতা বাস্তবায়িত হতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তুমি আমার ভিজিটিং কার্ড নিয়ে এখনই তোমার কাজের জায়গায় যাও। গিয়ে তোমার মালিককে বল, আমাকে ফোন করতে।
আমার কাছে জিবরাইলের ওহির চেয়ে বেশী মূল্যবান মিসেস গাব্রিয়েলার এই বার্তা। কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে এত দ্রুত বের হচ্ছিলাম যে, পরিচয় পত্র নিতে ভুলে গিয়েছি। দরজায় দাড়িয়ে ভদ্র মহিলা ডাকলেন; ইয়াং ম্যান। কাজটা যদি আবার পাওয়া যায়। একটা পাকিস্তানী আমার জায়গাটা দখল করে ফেলেছে, যদি পূনরুদ্ধার করতে পারি। ট্রামটা মনে হয় আসতে দেরী করছে। দৌর দেব নাকী! তর সইছে না। মধ্যন্ন বিরতি শুরুর একটু আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছলাম। ওয়াল্টার এলো। উত্তেজনায় টিকতে না পেরে ওয়াল্টারকে আগেই বলে রাখলাম ইংরেজীতে। যাতে দুপুরের খাবার টেবিলে মালিকনী আসা মাত্রই ওয়াল্টার তাঁকে কথাটা বলতে পারে।
ওয়াল্টারের মুখে একটা হাসি হাসি ভাব। আমার আশা-ভরসার ছবি তাতে আঁকা। কাজের জন্য একটা লোক মালিক রেখে ফেলেছে। সেই লোকটাকে বিদেয় করে আমাকে আবার কাজে নেবে, এমন কোন বিশেষ যোগ্যতা আমার নেই। থালা-বাসন মাজার কাজ যে কোন একটা লোককে দাড় করিয়ে দিলেই করতে পারবে। কুক ভিকি সিং পাঞ্জাবী ভাষাতেই পাকিস্তানী লোকটার সাথে কথা বলতে পারবে। সেও হয়তো মাতৃভাষায় কথা বলার আরামটা চাইবে। তাওহীদ ভাই কি আমার হয়ে ভিকির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে। বা গেলেই কী লাভ হবে। রান্না ঘরে ভিকির কথাই আইন। সব চেয়ে বড় কথা মালিক তার সিদ্ধান্ত আমার মতো একটা থালা ধোয়ার কামলার জন্য বদলাবে! মিষ্টি হেসে খদ্দেরকে বিদায় দিয়ে মালিকনী এলো। করমর্দন করলো। ভাব বিনিময়ের মাধ্যম কেবল মুখের খুসী বা বিরক্ত চেহারা। টেবিলে বসতে বসতেই ওয়ালাটার আমার বার্তা মালিকীনকে জানিয়ে দিল। তিনি আরো খুসী হলেন। আমার কাজ হয়ে গেল। ভিসা এবং কাজের অনুমতি সংক্রান্ত দাপ্তরিক কাজের জন্য দুই দিন ছুটি পেলাম। আমি আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে আস্তানায় ফিরলাম।
মন্তব্য
খুবি সাবলীল আপনার লেখনী। তবে কিছু টাইপো চোখে পড়লো ভাইয়া, সময় করে ঠিক করে দিয়েন।
----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony
ধন্যবাদ আব্দুল গাফফার রনি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ধন্যবাদ বন্দনা,
বানানে ভীষণ দুর্বল আমি। অভ্র স্পেল চেকারও অনেক বানান ঠিক করতে পারে না। বিবচত হই। আবার নিজের চোখে সব ভুল ধরাও পড়ে না। আরো সতর্ক থাকতে চেষ্টা করব।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আমি একই সাথে বসে আপ্নার সব তিরথের কাক সিরিজ পড়লাম। এক কথায় অসাধারণ। পরের লেখআর অপেখ্খায় রইলাম্
ধন্যবাদ বাবুনী (নাম ঠিক লিখলাম তো)
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অসাধারণ
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন