তীর্থের কাক ১৮

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: রবি, ১২/০৮/২০১২ - ৫:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্ব

তিন মাস পর কাজের পারমিশন নিয়ে; সবাই কাজ পেয়ে গেল। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ। সোমবার দিন ছুটি আমার। সকাল দশটায় উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ছুটি কাজে। ফিরে আসি মাঝ রাত পার করে। ঘরে এসে একটু আড্ডা মেরে ঘুম। ঘুম থেকে উঠে আবার কাজ। নিয়মিত এই লাগারের নীচে কর্তৃপক্ষের অফিসে যাই চিঠি দেখতে। বাংলাদেশী সবার চিঠি যে কেউ চাইলেই দিয়ে দেয়। অনেক দিন পর ছোট বোনের চিঠি পেলাম। কিন্তু খুসী হতে পারলাম না। আসার সময় পথের পাথেয় হিসাবে তার কানের সোনার দুলটা আমাকে বিপদের বন্ধু হিসাবে সাথে দিতে চেয়েছিল। টিউশনির টাকা দিয়ে ওটা ওকে আমিই কিনে দিয়েছিলাম। সামান্যই সোনা ছিল তাতে। বিপদে ঐ টুকু সোনা বিশেষ কাজে লাগবে এমন ভরসা না থাকায় আর আনিনি। এখন মনে হচ্ছে না এনে ভুল করেছি। আমাকে দেয়ার মতো তার কাছে পার্থিব আর কিছু না থাকায় ঐ দুলটাই দিতে চেয়েছিল। ভাইয়ের জন্য কিছু অন্তত ত্যাগ করেছে; এই আনন্দ বা সান্ত্বনা থেকে তাকে বঞ্চিত করেছি। কাজে না লাগুক অন্তত রাখি হিসাবে রেখে দিতে পারতাম!

চিঠিতে শুরুটা ভালই লাগে। আমার পাঠানো প্রথম টাকাটা তারা পায় নি। জার্মান সরকারের প্রথম ১শ ইউরো সাহায্য থেকে ৭০ ইউরো চিঠির ভেতর ভরে পাঠিয়েছিলাম। টাকার সাথে চিঠিটিও পায় নি; সেটা ওর চিঠি পড়েই বোঝা যাচ্ছে। কাজ পাওয়ার পর বাবার নামেই সব টাকা পাঠিয়েছি। কিন্তু চিঠিতে ভরে নয়। মানি অর্ডার করে। এযাবৎ পাঠানো সব টাকাই পেয়েছে। জানি আলাদা করে ওর জন্য বাবা কোন টাকা দেবেন না। তাই শুধু ওর জন্য ওর নামে আলাদা করে ৫ম মার্ক পাঠিয়েছি। সাধারণত দুই সপ্তাহের ভেতর টাকা পৌঁছে যায়। আবার বেতন পাওয়ার সময় হয়ে এলো। অথচ টাকাটা পেয়েছে এমন কোন কথা নেই। হয় তো পাবে।

প্রথম পৃষ্ঠায় আমার কেমন চলছে তাই নিয়ে উৎকণ্ঠার সাথে ওদের ভাল খবর গুলো থাকে। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় শুরু হয় খারাপ খবর। প্রথম দফার টাকা দিয়ে দালালের ঋণ শোধ হয়েছে। এর পর থেকে টাকা পাঠানো শুরু করলাম প্রতি চার মাসে একবার। আমি অস্থায়ী ভাবে জাদের ঘরে আশ্রয় পেয়েছি; তারা তিন জন আর আমি মিলে চার জন। চারজনের বেতনটা এক সাথে করে পাঠালেও অনেক টাকা হয়। সেটাই কাজে লাগবে এমন ভাবে কিছু টাকা পাঠানোর কর্জকরী ব্যবস্থা। আমি অন্যদের থেকে প্রায় দেড়গুণ বেশী বেতন পাই। তাই পাঠানোর পরেও আমার কাছে প্রতি মাসেই কিছু অতিরিক্ত টাকা থাকে। সেটা চার জনের বেতনের সাথে মিলে গত কিস্তিতে প্রায় দেড় লাখ হয়ে গেছে। শুনে ভালই লাগল।

কিন্তুটা ভীষণ কষ্টের। বড় ভাই দাউদকান্দি ফেরিঘাটে একটা ফেরীর খালাসী। তাকে কাজটা দিয়েছিলেন আমাদের এক প্রভাবশালী প্রতিবেশী। আমার বড় ভাই নিরক্ষর কৃষি-শ্রমিক। এখন ঘড়ি ধরে সময় মত কাজে যান। অনেকেই এমন একটা নকরি খুঁজছেন। নতুন এক অফিসার এসে শ্রমিক বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। আমাদের পরিচিত সবাই ভাইকে ধরল । ভাইকে যিনি চাকুরী দিয়েছিলেন তার কাছেই নিয়ে গেলেন ভাই সবাইকে। তিনি বললেন; নতুন সাহেবকে খুসী করার একটা ঝামেলা আছে। তিনি জন প্রতি ৫হাজার টাকা চেয়েছেন। টাকাটা তোমরা সবাই রকিবের (আমার বড় ভাই) কাছে জমা দাও। সব টাকা ভাই সাহেবকে দিলেন। তারপর সাহেব উদাও। বদলী হয়ে সিলেট চলে গেছেন। গ্রামের লোক টাকা দিয়েছে আমার ভাইকে। কাজেই আমার পাঠানো দেড় লাখ টাকায় ভাই লোকের ঋণ শোধ করলেন। কষ্ট হল, ক্ষোভ হল। ভাইকে বকলাম মনে মনে তাঁর বোকামির জন্য। বাট, মানি ইজ লস্ট, নাথিং ইজ লস্ট। সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে। গরীবের আয়ের ক্ষুদ এভাবেই কিড়ায় খায়।

পরের খবর আরো কঠিন। বিদেশ যাত্রার খবর আসে খবরের কাগজে; যদি কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যায়। তাদের একজনকে বিদায় দিতে এসেছিলাম বিমান বন্দরে। বাস ভাড়া করে দিয়েছিল আমার সেই উচ্চ শিক্ষার্থের বিদেশ-গামী বন্ধুর বাবা। উচ্চ আয়ের জন্য চোরের মতো দেশ ছেড়ে এসেছি। বাবার আবাদযোগ্য সব জমি বিক্রি করেও দালালের সব টাকা শোধ করা সম্ভব হয়নি। আমাকে এগিয়ে দিতে সাথে এসেছিলেন বড় ভাই। টাকার যা অবস্থা তাতে বিমান বন্দর থেকে বড় ভাই বাড়ি ফিরবেন কী করে সেই চিন্তায় আমি পেরেশান। কিন্তু ভাইয়ের মনে বল আছে। তিনি সাহস করে বললেন; আরে, কোন রহমে গুলিস্তান যাইতারলেই চলব। ঢাহা (ঢাকা) চিডাগাঙ্গের (চট্টগ্রামের) সব গাড়ি পার করি আমি। দাউদকান্দি পন্ত (পর্যন্ত) যাইতে আমার ভাড়া লাগত না। তুই চিন্তা করিস না। আমিও নিশ্চিন্তে কাকরাইল মোড় থেকে ভাইয়ের পিছনে বিমানবন্দর গামী একটা মিনি বাসে ঝুলে গেলাম। কিন্তু রাত বারটার দিকে ভাইকে এক রকম জোড় করেই গুলিস্তানের বাসে তুলে দিলাম। রাত বেশী হয়ে গেলে বাড়ি যাওয়ার গাড়ি পাবেন না। আর হোটেলে থাকার বা খাওয়ার টাকা তো সাথে নাই।

দুর্ঘটনা ঘটল বাড়ির ঘাটে এসে। নন স্টপ চট্টগ্রামের নাইট কোচ ভাইকে দাউদকান্দি ফেরী ঘাটে নামিয়ে দিয়েছে। ফেরী থেকে নেমে রাস্তায় উঠার সময় পায়ের উপর দিয়ে চলে গেছে একটা মিনি বাস। বোন অনেক ভাবে লিখেছে যে, ভাইয়ের পা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পা ভাল হয়ে গেছে। প্লাস্টার খুলে আরকম আলী ডাক্তার দুবলা ঘাসের বেণ্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। নিয়মিত পরিচর্যার কল্যাণে বেণ্ডেজের ঘাস বেঁচে উঠেছে। কাজেই পা ভাল হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস হল না। দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেল। পা-টা কেটে ফেলতে হবে নাতো! পায়ের একটা ছবি চাইব এই চিঠির জবাব দেয়ার সময়। চার পৃষ্ঠার চিঠি। পড়ে আমাদের গ্রামের একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। সব কাজের কথা শেষ করে হাল্কা মেজাজে গল্পগুজব করার মতো করে লিখেছে আমার জন্য এযাবৎ শোনা সব চেয়ে কঠিন কথাটি;
গ্রামে রটে গেছে আমার বোন অবৈধ গর্ভধারিণী। লোকের দোষ দিয়ে লাভ নাই। প্রাইমারী স্কুল পর হওয়ার আগেই আমার বোনের প্রায় সব সহপাঠিনীদের বিয়ে হয়ে গেছে। যে দুএক হাইস্কুলে উঠেছে নাইনে উঠার আগেই তারাও কবুল করে ফেলেছে। উল্লেখযোগ্য কোন বিয়ের প্রস্তাবও আসেনি আমার বোনের জন্য, আর এলেও বিয়ের খরচ-পাতি যোগার করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। কোন ভাবে স্কুলের বেতন যোগিয়ে স্কুলে যাতায়াতটা বহাল রাখতে রাখতে এক সময় এসএসসি পাশটা করেই ফেলল। এখন বিয়ে হচ্ছে না বলে কলেজে যাচ্ছে। সাথে আছে আমার একপাল বন্ধু। যারা সব সময় আমাদের বাড়িতে যায়। আর আইবুড়ো মেয়েটা নির্লজ্জের মতো তাদের সাথে হাসি-তামাসা করে। এই না জায়েজ পরিবেশে অবৈধ গর্ভধারণের গুজব ডাল-পালা মেলে দিয়েছে যখন সে পেটের ব্যথায় ডাক্তার দেখাতে ঢাকা গেছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেছেন; জরায়ুতে টিউমার। অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে।


মন্তব্য

কাকতাড়ুয়া এর ছবি

আমি এই সিরিজের কঠিন রকম নিয়মিত পাঠক হাসি
একদম ভেতরে ঢুকে যাই পড়তে পড়তে।
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি দেন কায়সার ভাই।
--
কাকতাড়ূয়া

পুতুল এর ছবি

ভীষণ ভীষণ রকম ভাল লাগল আপনার মন্তব্য পেয়ে। কত প্লান-প্রগ্রাম করেছিলাম বড় গাড়ি ভাড়া করে শীতের দেশে যাব আপনাদের দেখতে। সে তো হল না। আপনারাও এলেন না। বাবুটার শুধু ছবিই দেখলাম ফেস বুকে। এবছর হলে খুবই ভাল যদি কোন কারণে না হয় আগামী বছর সামারে আসুন।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কাকতাড়ুয়া এর ছবি

শিঘ্রই আসতেছি হাসি দেখা হবে।

পুতুল এর ছবি

কবে, সম্ভাব্য সময় জানান। ছুটি নিয়ে রাখব।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সত্যপীর এর ছবি

অনেক ভালো লাগে আপনার এই সিরিজ. আপনার এটেনশন টু ডিটেল অসাধারণ পুতুল ভাই.

..................................................................
#Banshibir.

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ সত্যপীর।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তিথীডোর এর ছবি

র্তীথের > তীর্থের কাক।
ভাইয়া, শিরোনামের বানানটা ঠিক করে দিন প্লিজ। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

পুতুল এর ছবি

থেংকু দিদি, ঠিক করলাম।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

লাবণ্যপ্রভা এর ছবি

আপনার খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ লিখাটা খুব ভাল লাগে, যেন এর মধ্যে 'মেকি' কিছু নাই সবই সরল ভাবে মন খুলে বলে যাওয়া আত্মকাহিনী। চলুক

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ লাবণ্যপ্রভা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

এ পর্যন্ত যতটুকুই পড়া হইছে, আপনার লেখনী ক্ষমতার নতুন একটা দিক লক্ষ্য করা গেল, যা একজন পাঠকের কাছে সব সময় প্রত্যাশার। ঠিক ঘটনাটি বা বা দৃশ্যটি যেমন ছিলো তা হুবহু তুলে আনা অনেক কঠিন হলেও একজন পাঠকের কাছে তা প্রত্যাশিত। দৃশ্য বা ঘটনার যতটা কাছাকাছি লেখক থাকতে পারেন, লেখাটি ততটাই পাঠকের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। আপনার আগের লেখাগুলোর সঙ্গে এই সিরিজের মোটা দাগের যেই পার্থক্য তা হইলো বর্ণনার কৌশল। সাবলীল। ঝরঝরে। কথকের ভূমিকা ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত, আমার মনে হয় আপনি তা অর্জন করেছেন এখানে। ভালো থাকেন, আমার কমেন্ট না থাকলেও পাঠক হিসেবে আছি।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ জুলিয়ান সিদ্দিকী। আপনার লেখা কৈ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কল্যাণ এর ছবি

পুতুল ভাই আপনার লেখা পড়তে পড়তে ঘটনাগুলো যেনো দেখতে পাই।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

পুতুল এর ছবি

থেংকু বস।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।