এক ধরণের চাপা আনন্দে আমার ভেতরটা সব সময় টইটুম্বুর। সোনিয়াকে বসানোর জন্য ঘর দরকার। আর্থিক সঙ্গতির সাথে মানুষের আত্মমর্যাদাও বোধ হয় বেড়ে যায়। এখানে অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকি। তার সমস্যা হচ্ছে; অনেক কথা আসলে আমাকে পরের জায়গায় থাকি বলে বলা না হলেও মন কেবল সে দিকেই নিয়ে যায় বারে বারে। সোনিয়ার সাথে পরিচয় হওয়ার পর ব্যাপারটা আমার পক্ষ থেকে বেড়ে গেল বেশী। আসলে বাসা নেয়ার পক্ষে মন কে তৈরী করা আর কী। তা বাসা হয়ে গেল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রাইভেট বাসা নিয়ে থাকতে দেবে না কিছুতেই। এদিকে রাত ১১টা ছাপ্পান্ন মিনিটে আমার যেখানে থাকার কথা সে খানকার শেষ ট্রেন ছেড়ে যায়। আমার কাজ শেষ হয় রাত বারটায়। কাজের জায়গা থেকে ট্রেনষ্টশনে যেতে লাগে আধা ঘণ্টা। সব দিক বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ জাহিদ ভাইয়ের দ্বিতল খাটে স্থায়ী করে দিলেন আমাকে।
ফুলের টব। টেবিলের চাদর বিছিয়ে সুন্দর করে রাখতে চেষ্টা করলাম আমাদের ঘরটা। ২২৩ নম্বর কামড়ার কথা বলে দিয়েছি সোনিয়াকে। যদি কোন দিন এসে ওঠে। তাই সবার পুরানো কাপড়-জুতা ফেলে দিলাম জোড় করেই। সবাই আমার আনন্দটা খেয়াল করল। জুতা কাপড়ের জন্য কিছু আক্ষেপ থাকলেও আমার সৌন্দর্য বোধের কারণে খুশিই হল। লিচু ভাইয়ের টাকা শোধ হয়ে গেছে। জার্মান বলা রপ্ত করে ফেলেছি। দেশের সব বিপদ-আপদ কেটে গেছে। সব মিলিয়ে মন ভালই থাকার কথা আমার। কিন্তু আমার ভেতরে সুখের যে বাতি সোনিয়া জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তার খবর জানি কেবল আমি। অন্যরা দেখে সে আলোর ছটা মাত্র।
কাজ পেয়ে গেছে সবাই। খান সাহেবও কেন্টুকি ফ্রাই চিকেন-এ কাজ পেয়েছে। শুনেছি জার্মান কর্তৃপক্ষের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ও বাসাও নিয়েছে। ভাড়া নাকী সাতশ মার্ক। গাড়িও কিনেছে একটা। মালিক বাসাটা ভাড়া দিয়েছে গাড়িটা খান কিনবে সেই সর্তে। গাড়ি চালাতে পারে খান। কিন্তু এই দেশে কোন কাজ পারলেই চলে না। সেই কাজ করার সরকারী অনুমতি লাগে। বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স খানের নেই। পথ ভুলে গাড়ি নিয়ে হাই ওয়োতে উঠে ভুল বুঝতে পেরে আবার ফিরে আসতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। হাই উয়ে এবং সেটাতে উঠার রাস্তা ওয়ান ওয়ে। যেখানে ধরা পরেছে সে জায়গা আমাদের সীমানার বাইরে। সব মিলিয়ে জরিমানা প্রায় পাঁচ হাজার মার্ক। না হলে জেলে যেতে হবে। সবাই মিলে কিছু কিছু দিচ্ছে খানকে। আমিও কিছু না দিলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। খানও বদলি হয়েছে এই লাগারে। কিন্তু বাসা ছাড়তে হলে তিন মাস আগে নোটিস দিতে হয়। খামাখা ভাড়া দিয়ে লাভ কী। সে জন্যই খান এখনো সে বাসায় থাকে।
ধীরে ধীরে কাজ করে সব টাকা শোধ করে দেবে সে। খবর পাঠিয়েছেন তিনি আজকে আসবেন। আমি একটা ছবির ফ্রেম পেছন থেকে খুলছি। মিঠু ভাবীর কাছ থেকে চুরি করে একটা ম্যাগাজিনের পাতা এনে ছিলাম, মডেলের সুন্দর ছবিটা দেখে। সবাই দেশে সুন্দরী প্রেমিকা রেখে এসেছে। আমারও একটা প্রেমিকা না থাকলে নিজেকে অযোগ্য এবং ছোট ছোট লাগে। চুপিসারে কোন একদিন ফ্রেম কিনে ঐ মডেলের ছবিটি লাগিয়ে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছিলাম। আমার প্রেয়সী। সেই কল্পিত প্রেয়সীকে মুক্তি দেয়ার সময় এসেছে। সোনিয়া ঐ ছবি দেখে যদি জানতে চায়; ওটা কার ছবি? যদি বলি মডেল। তা হলে ধরে নেবে আমি ঐ টাইপের মেয়েই পছন্দ করি, যার সাথে তার কোন মিল নেই। আর কেউ যদি বলে দেয় তাদের জানা কাহিনী। মহা বিপদ। কাজেই সেই বিষ বৃক্ষের মূলোৎপাটনই সঠিক সমাধান। সোনিয়াকে রাজি করতে পারলে এই ফ্রেমে তারই একটি ছবি রেখে দেব।
দরজায় টোকা। দ্রুত ফ্রেম রেখে গেলাম দরজার দিকে। কিন্তু দেখলাম এক সাদা চামড়ার জার্মান মুখ। একটু সন্ত্রস্ত হয়ে গেলাম। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ভদ্রলোক বললেন; ব্যস্ততার কোন প্রয়োজন নেই। আমি এজাইলামের পক্ষের মানুষ। ঘরে আর কেউ নেই। কেউ এলে কিছু থাক বা না থাক; পান করতে কী দেব, খাবেন কী ইত্যাকার প্রশ্ন তো করতেই হয়। কিন্তু আগন্তুক বিগলিত হাসিতে সব নাকচ করে দিয়ে বললেন;
আমরা একটা পোষ্টার বানাব। আসছে শনিবার জার্মানের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত একটা মানব বন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। আমাদের শ্লোগান হচ্ছে; পৃথিবীতে কোন মানুষ অবৈধ নয়। সাদা চামড়ার মানুষ সারা পৃথিবী জবর দখল করে রেখেছে। এখন রুটি রোজীর বা একটু ভাল আয়ের আশায় তথাকথিত ধনী দেশে এসাইলাম হচ্ছে গরীব দেশের মানুষ। শুধু মাত্র আর্থিক কারণে অভিবাসিত হলেও তা অবৈধ হওয়া উচিৎ নয়। বৈধ ভাবে কাজ করতে আসার উপায় নেই বলেই অনেক মানুষ এখানে আসছে অবৈধ ভাবে। অন্য দিকে কাজ দেয়ার নাম করে দুনিয়ার সব দেশ থেকে নাম মাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমরা তৈরী করিয়ে আনছি সব ধরণের বিলাস সামগ্রী। আমাদের সস্তা বিলাসিতার জন্য শিশুশ্রম পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। শিশুরা স্কুলে লেখা-পড়া শেখার বদলে বাধ্য হচ্ছে কার্পেট বানাতে।
মানুষটা ভাল মনে হল, তাই বললাম দেখ; যে শিশু নিজের এবং পরিবারের অন্ন জোটাতে কাজ করতে হয়, সে যদি কাজের বদলে স্কুলে যায়, তা হলে তার পরিবারটির বা তার নিজেরই অন্নের যোগার হবে কী ভাবে। যদি ধরেও নেই যে; স্কুলের বেতন বা বই-খাতা-পেন্সিল বিনে পয়সায় পাওয়া যাবে।
পশ্চিমা প্রপাগাণ্ডা দেখি তোমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছ। দুনিয়াতে এখনো যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপন্ন হচ্ছে তাতে এখনো বিশ্বের সব মানুষকে খাইয়ে আরো উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অতিরিক্ত খাদ্যের সামান্য উদ্বৃত্ত তথাকথিত গরীব দেশগুলোকে সাহায্য হিসাবে দেয়া হয় এই সর্তে যে; তারা তাদের দেশের কৃষককে খাদ্যে ভর্তুকি দিতে পারবে না। সংগত কারণে সে দেশে খাদ্যশস্যের দাম আয়ের তুলনায় অনেক বেশী। খাদ্য যোগারেই তাদের শ্রমের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায়। অথচ তথাকথিত উন্নত বিশ্বে কৃষিতে একশ ভাগ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এতে করে এখানে খাদ্যের পেছনে ব্যয় হয় শ্রমের এক শতাংশ ভাগ মাত্র। মাংস খেতে খেতে আমাদের দেশের মানুষ বৃহদন্ত-ক্ষুদ্রন্তের ক্যান্সারে মরে। মাংস খামার পশু খাদ্য হিসাবে ব্যয় করে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের বিরাট একটা অংশ। আমি বলছিনা যে; আজ থেকে মাংস খাওয়া হারাম করে দিতে হবে। কিন্তু সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পর্যন্ত সব খাবারে মাংস থাকতেই হবে এমন কোন কারণ আদোও আছে কী? দুনিয়ার নিরামিষী মানুষ কী মরে গেছে? নাকী মাংস দেয়া গরু বা দুধ দেয়া গাভী মাংস খায় না বলে তাদের দুধ বা মাংস দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে!
বুঝলাম। কিন্তু ধর যদি মানুষ মাংস খাওয়া কমিয়ে দিল, তার পর কী বাংলাদেশের একটি শ্রমিক শিশু স্কুলে যেতে পারবে।
তুমিই বলেছ; বেশীর ভাগ শিশু কাজে যায় তার এবং তার পরিবারের উদরপূর্তি করতে। যদি খাদ্যশস্যের দাম কম হতো; তাহলে জীবনের সব চেয়ে মূল্যবান সময়টা নষ্ট করে হয়তো অনেক শিশুই শুধু মাত্র পেটে ভাতে কাজে যেত না। সে সব পরিবারের আর্থিক সংকট তো ঐ শিশুটির শ্রমের কারণে চলে যায় নি। ক্ষেত্র বিশেষে বরং বেড়েছে। অনেক বিপদ জনক কাজ করতে গিয়ে অনেক শিশু আহত হয়। কাজ করতে পারে না বলে; মালিক তাকে ছাটাই করে, চিকিৎসার দায় শিশুটির পরিবারের উপর ছেড়ে দেয়। যে পরিবার শিশুটির রোজগারের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারা কী করে শিশুটির চিকিৎসা করাবে! যা হয়, শিশুটি পঙ্গু হয়ে বেঁচে থেকে ভিক্ষুক হয়, যদি ভাগ্য খারাপ হয়। ভাল হলে এই দুষ্ট চক্র থেতে নিষ্কৃতি পায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে।
অন্যদিকে দেখ; তথাকথিত ধনী দেশগুলোতে পৃথিবীর যে কোন ফল-পশু-পাখি যে কোন মানুষ সুপার মার্কেটে কিনতে পারছে। ঐ শিশুদের শ্রমে উৎপাদিত হাতের তৈরী কার্পেটও এই ধরণের একটা বিলাস সামগ্রী। যা আমাদের দেশে এসে পৌঁছাতে অনেক ফসিল জ্বালানী খরচ হচ্ছে। তা আবার দূষিত করছে পরিবেশ। পরিবেশ দূষণের ফলে সামগ্রিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। সমুদ্র সমতলের খুব বেশী উপরে নয় এমন জায়গা তলিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের লোনা জল নষ্ট করছে আবাদি জমি। মানুষ সংকুচিত ভূমিতে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তোমার মতো যারা ঐ জনসমুদ্র থেকে ভেসে আমাদের মতো ধনী দেশে এসে পৌঁছেছে; তারা অবৈধ অবিভাসী। তাদের আক্রমণ থেকে যে কোন মূল্যে আমাদের স্বর্গকে রক্ষা করতে পথে-ঘাটে এমন কী, তোমাদের আশ্রয় স্থলে পর্যন্ত আক্রমণ করছে আমাদের দেশের কিছু কুলাঙ্গার। তাদের বেশির ভাগ আবার বেকার। তাদের বেকারভাতা আসছে তোমার দেয়া টেক্সের পয়সায়। সংযুক্ত জার্মানের সাত পার্সেন্ট টেক্স দিচ্ছ তুমিও।
অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা খুব সহজ এবং জনপ্রিয়। অথচ বৈধভাবে তাদের এদেশে আসার কোন পথ রাখা হয়নি। রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছে; অবৈধ অভিবাসীরা আমাদের সব নিয়ে গেল। তারা বসে বসে জার্মান সরকারের অন্য ধ্বংস করে চলেছে। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে; যুগশ্লাভিয়ান যুদ্ধের কারণে জার্মানীতে সব মিলিয়ে গত বছর চার মিলিয়ন মানুষ এসেছে। তাদের মধ্যে তিন মিলিয়ন যুশ্লাভিয়ান রিফিউজি, যুদ্ধের কারণে। এক মিলিয়ন মাত্র তথাকথিত অবৈধ অবিভাসী। সুন্দর আবহাওয়া আর আরো আরামের জীবনের সন্ধানে একই পরিমাণ জার্মান, নিজের মাতৃভূমিকে পশ্চাৎ দেশ দেখিয়ে চলে গেছে অন্য কোন দেশে। কৈ কেউ তো তাদের কথা বলে না। সবাই বলে আমাদের নৌকাটায় আর জায়গা নেই। অথচ অন্তত গত বছর যদি এতো গুলো মানুষ না আসতো আমাদের দেশে. তা হলে এই দেশে চার মিলিয়ন মানুষ কমে যেত। এমনিতেই বছরে দুই পার্সেন্ট কমছে জন সংখ্যা। শিশুর জন্ম ভয়ঙ্কর রকম কম বলে বৃদ্ধের সংখ্যা বেশী। তাদের আবার পেনসন দিতে হবে। সে টাকাটা আসছে এখন কাজ করে যারা পেনশনস্কিমে টাকা রাখছে, তাদের টাকা থেকে। যে বৃদ্ধনাৎসী তোমার পাশে বসতে চায় না, তার পেনশনেও তোমার টাকা আছে।
বেশীর ভাগ জার্মান মনে করে যে; এলাইলাম সিকাররা বসে বসে জার্মান জনগণের টাকা খেয়ে খেয়ে রাজকোষ শূন্য করে ফেলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে গত বছর এলাইলাম সিকার সহ সব অনাহূত অবিভাসীদের পেছনে খরচ হয়েছে চার হাজার কোটি মার্ক। একই সময়ে তারা সরকারকে কাজ করে বিভিন্ন খাকে টেক্স দিয়েছে তিরিশ হাজার কোটি মার্ক।
কথা বলতে বলতে লোকটা লাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অন্তত একজন মানুষ আমার কাজের কিছুটা স্বীকৃতি দিচ্ছে দেখে ভালও লাগছিল। একটা ব্যাপার কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না; জার্মানরা বিদেশীদের উপর এত ক্ষ্যাপা কেন? সেটাই তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম।
আমি দুঃখিত বেশ বড় বড় কথা বলে তোমাকে অনেক জ্ঞান দিচ্ছি, আমার কথা কিছুটা এমনই শোনাচ্ছে হয়তো তোমার কাছে। তোমাদের কাছে আসলে জার্মান হিসাবে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। তার বদলে পাচ্ছ অবহেলা, এবং দুঃখের ব্যাপার অনেক সময় শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত পর্যন্ত হচ্ছ। তার কারণ বহুবিধ;
মোটা দাগে বেশীরভাগ জার্মান ভীষণ রকম অহংকারী। বিদেশী মানেই গরিব, গরীব বলেই অপরাধী। এবং বর্ণবাদ তো আছেই। আমরা গণতন্ত্র নিয়ে ভীষণ গর্বিত। রাষ্ট্র থেকে ধর্ম পৃথক করেছি। অথচ ক্রিশ্চিয়ানরা মিলে শাসন করছে আমাদের দেশ। বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখছি হেলমুট কোহল আমাদের চ্যান্সেলর। আর সবাই মিলে ভোট পাওয়ার জন্য বেশীর ভাগ জার্মানের ভ্রান্ত ধারণাকে পূঁজি করে নির্বাচিত হচ্ছে। সাধারণ জনগণের মত রাজনৈতিক নেতারাও বলছে; দুনিয়ার কোন দেশে কোন রাজনৈতিক সমস্যা নেই। সবাই আমাদের বাড়াভাতে ছাই দিতে চলে এসেছে আমাদের দেশে। তাদেরকে অচিরেই ফেরত পাঠানো হবে। বিদেশীদের জীবন যাত্রা বা অধিকার আরো একটু কঠিন করা হবে আমরা ক্ষমতায় গেলে এই ধরণের শ্লোগান তো আছেই।
সারা দুনিয়া দখল করে সাদা চামড়ার মানুষ, নিজ দেশে সে সব দেশের মানুষকে কৃতদাস হিসাবে বিক্রি করে একে অন্যের কাছে। আফ্রিকার কিছু জায়গা জার্মানরাও কলোনি হিসাবে দখল করেছিল। আফ্রিকানদের সাথে তাদের কিছু বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়ে ছেড়ে দিতে হচ্ছিল সব কলোনি। আফ্রিকানদের সাথে মিলনের ফলে কিছু বাদামী বাচ্চাও তখন সাথে নিয়ে এসেছিল জার্মানরা। যাতে ঐ কালো বাচ্চাগুলো জার্মানদের সাথে মিলিত হয়ে আরো কালো বাচ্চা পয়দা করতে না পারে তার জন্য ঐ বাচ্চা গুলোকে যারা ইতিমধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে গিয়েছিল; তাদেরকে বলপূর্বক ভেসেক্টমি বা লাইগেশন করিয়ে নেয়া হয়। এই হল জার্মানদের মানষিকতা। হিটলার এসে বলপূর্বক সন্তান অসম্ভবা/অসম্ভাবী প্রক্রিয়া বিস্তার করে বিকলাঙ্গদের উপরেও। এখন আমাদের দেশে দাপ্তরিক ভাবে কোন নাৎসি নেই। তুমি নিশ্চয়ই জান, একটা জনগোষ্ঠীর বেশীর ভাগ মানুষ মেনে না নিলে কোন প্রথাই চলতে পারে না। তাহলে তখন ইতিহাসের জঘন্যতম অপরাধ গুলি এমনি এমনি শুধু হিটলারের গায়ের জোড়েই হয়ে গেছে! হয় নি। তখন আমার করার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন তোমাদের উপর যা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিছু করার আছে। আমরা একটা পোষ্টার বানাব যেখানে বিশ্বের বেশীরভাগ ভাষায় লেখা থাকবে; ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একটা শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের সমাজ চাই।
আমাদের কবিগুরুর “যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করহে বন্ধ: কথাটা লিখে দিলাম আনন্দে। লোকটা এতক্ষণ দাড়িয়েই কথা বলছিল। এত কথা বলতে হবে বা সে বলবে তার প্রস্তুতি বোধ হয় কারই ছিল না। তাই আমিও জোড় করে বসতে বলিনি আর সে ও বসতে চায় নি। কিন্তু এখন ইচ্ছে হল তাকে বসিয়ে অন্তত এক কাপ চা খাওয়াই। তাই চেয়ের টেনে দিয়ে বললাম; একটু বস, আমি এক কাপ চা খেতে চাই তোমার সাথে বসে।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। চা-টা খেতে পারছি না বলে দুঃখিত। আরো অনেকগুলো ঘরে ঢুকে আরো অনেক ভাষায় “শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের” শ্লোগানটা যোগার করতে হবে।
যেন একটা ভুল বোঝাবুঝির সমাধান হয়ে গেছে; এমনই হাফ ছেড়া বাঁচার মতো একটা ভাব এনে ঘরে ঢুকল খান। অনেক হিসেব নিকেশ করেও আমি খানের বরাদ্দ তিনশ মার্কে উপরে তুলতে পারলাম না। কয়দিন থাকতে পারবে তার নাই ঠিক। কবে শোধ করতে পারবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। বেশী টাকা দিলে ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও হয়তো খান শোধ করতে পারল না। আমাকেও যখন তখন ঘরে পাঠিয়ে দিতে পারে। আমার স্বার্থপর মন তিনশ মার্কের উপরে উঠতে পারল না। খান সব সময় বলে যে; দেশে ওর টাকা পাঠাতে হয় না। তার চলাফেরা সেটাই প্রমাণ করে। দুইশ মার্ক দিয়ে মানিব্যাগ কিনেছে সে। সে সব আমাদের বাঙ্গালী সমাজে খবর হয়ে যায়। আমি সাত মার্ক দিয়ে মানিব্যাগ কিনেও রাখার মতো টাকা পাই না। তাছাড়া হাতে নিয়ে দেখেছি; দামী চামড়ার মানিব্যাগ বেশ নরম এবং পাতলা চামড়া দিয়ে তৈরী। দোকানে কেনা-কাটা করতে গেলে অনেক সময় সেলাসগার্লের দ্রুত উচ্চারণের জামান বুঝতে পারি না। না বোঝার অক্ষমতা চেপে রেখে বেশীর ভাগ সময় বড় নোট দেই। ফেরত পাই, পাঁচ-দুই-এক মার্কের কয়েন। পঞ্চাশ-বিশ-দশ-পাঁচ-এক পেনির কয়েন তো আছেই সাথে। অনেক পয়সার ভারে মানিব্যাগে বেশীদিন টিকে না। আমাদের মতো গরীবের মানিব্যাগ শক্ত-পোক্ত রেক্সিনের হলেই ভাল। দামও কম, টেকেও বেশী। দামী মানিব্যাগের বহনকারীরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই শেষ করেন লেন-দেন। আমাদের মতো, তাদের অল্প মূল্যের অধিক কয়েনের বোঝা বইতে হয় না। খান এখানে ব্যতিক্রম। দুইশ মার্কের মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে সে নতুন সাইকেল কিনেছে সাতশ মার্কে। খানের দ্বিগুণ আয় করেও আমি চালাই জাহিদ ভাইকে দেওয়া জামান ভাইয়ের পুরানো সাইকেল। তাই বললাম জানেনইতো বেতন পেয়ে সব টাকা দেশে পাঠাতে হয়। তাছাড়া লিচু ভাইয়ের টাকাটা শোধ করলাম মাত্র। তাই তিনশর বেশী দিতে পারছি না।
হাবভাব দেখে মনে হলো এতেই সে সুখী। হয়তো আমার কাছে কোন টাকাই আশা করে নি। খুসী মনে টাকা নিয়ে চলে গেল সে। আমি বের হলাম কাজে । মে মাসের শুরুতে বিকেল পাঁচটায়ও এতো প্রখর রোদ! জার্মানরা হাফপ্যান্ট স্কার্ট পড়া শুরু করেছে। সোনিয়ার সাথে পরিচয়ের পর সব জার্মানকে শ্বশুর পক্ষের বড় কুটুম মনে হয়। ট্রাম এসে গেছে। বুড়োটা খুব সুন্দর খাকী হাফপ্যান্টের ভেতর ইন করে পরেছে হাল্কা আকাশী হাফসার্ট। পরিচ্ছন্ন ক্লিন সেভ করা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। পায়ে স্যান্ডেল পরেছে বটে, কিন্তু স্যান্ডেলের ভেতরও মোজা পরেছে। বাঁ হাতে ছড়ি। দেখলে সমীহ হয়। আমাদের দেশের বুড়োদের মতো জার্মান বুড়োরা অতটা ভেঙ্গে পড়ে না। ধীরে ধীরে হেঁটে ট্রামের দরজার কাছে এসে পরেছে। আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটুকু যখন একাই এসতে পরেছে, বাকীটাও আর দুই কাইকেই এসে পরবে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকলে ট্রামের দরজা বন্ধ হবে না। আর দরজা বন্ধ না হলে ট্রাম ছাড়বে না। বুড়ো একটু গতি বাড়িয়েই সিঁড়িতে পা দিল। কিন্তু হাতদুটো কাঁপছিল বলে খুব সহজে ট্রামে উঠার দরজার পাশের হাতলটা ধরতে পাল না। অনুমতি নেয়ার তোয়াক্কা না করে বুড়োর হাত ধরে হাতলে পৌঁছে দিলাম। আর ছড়ি ধরা বাঁ হাত আমিই ধরে ট্রামে তুলে ফেললাম। শহরের দিকে ট্রাম যাচ্ছে বিকেল বেলা। তাই ভিড় নেই। দুজনের একটা সিট খালী পেলাম। এতক্ষণে ট্রাম ছেড়ে দিয়েছে। সাবধানে বুড়োকে নিয়ে বাঁ দিকের দুজনের সিটে গিয়ে আমি জানালার পাশে বসলাম। আর বুড়োকে বসালাম ভেতরের দিকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো উঠে দাঁড়াল। আমি জানতে চাইলাম উঠেছেন কেন? কী হয়েছে? টিকেট কাটতে হবে? সেটা আমিই করে দিচ্ছি। শ্বশুর পক্ষের বড় কুটুম বলে কথা। তাছাড়া এই টুকু কাজ এমন একজন প্রবীণ মানুষের জন্য যে কেউ করে দেবে।
কিন্তু বুড়ো বলল; আমি একজন বিদেশীর পাশে বসতে পারব না। কথাটা শুনে কারেন্টের সট খেলাম একটা। ট্রামের যে ক’জন যাত্রী কথাটা শুনল, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায়। প্রথমে একটু খারাপ লেগেছে বৈকি। কিন্তু কী করার আছে! বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট করে আর একটা সীটে যেতে হবে আমার পাশে বসতে না চাইলে। চলন্ত ট্রামে কাজটা তাঁর জন্য সহজ না। অথচ আমি উঠে গেলে তিনি এখানেই বসে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন। আমি দাঁড়িয়ে বললাম; উঠতে হবে না, আপনি এখানেই বসুন। আমিই বরং অন্য কোথাও গিয়ে বসছি। সোনিয়ার পরিবারে বিদেশীদের এত ঘৃণা করে এমন মানুষ থাকলে খবর আছে।
মন্তব্য
ধন্যবাদ বস।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
অনেকদিন পরে। পড়তেছি এইটুক কইয়া গেলাম।
অজ্ঞাতবাস
হ, মেলাদিন হয়ে গেল। এখন থেকে আবার নিয়মিত হতে চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আসমা খান
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
লিখতে থাকেন।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
লিখতেছি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আপনার লিখার বড় গুন হল এটা একটানে পড়ে শেষ করা যায়।
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন