শিশু পালন একটা চব্বিশ ঘণ্টার কাজ। তার সাথে অন্য কোন কাজ করতে হলে চব্বিশ ঘণ্টায় আর কুলিয়ে উঠতে পারি না। মনে হয় দিনটি ৮৪ ঘণ্টার হলে ভাল হতো। বড়টাকে ঘুম পাড়িয়ে ভাত নিয়ে বসেছি। ছোটটা মায়ের দুধ খাচ্ছে। ফোন বাজছে। তাড়াতাড়ি ধরতে হবে, না হলে মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যাবে। বাঁহাতের মুঠোয় ধরা কাঁচা লংকা টেবিলে রেখে ফোন ধরে বললাম; কায়সার বলছি...
কী ব্লগার ভাই? কণ্ঠে শ্লেষ না কৌতূহল বোঝা না গেলেও মাহবুব ভাইয়ের গলা চিনলাম ঠিকই। জীবিকার তাগিদে পুরানো শহর ছেড়ে আসলেও মাহবুব ভাইয়ের সাথে একটা অনিয়মিত যোগাযোগ আছে আমার। বড় ছেলে বিএমডাব্লিউতে কাজ পেয়েছে সেটা জানিয়ে, আমাকে ধন্যবাদ দিলেন; পরীক্ষণমূলক কাজের ছয় সপ্তাহ পার্থকে আমার বাসায় রাখার জন্য। আমি জানি, পারিবারিক কুশল বিনিময়ের পরে মাহবুব ভাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো কিছু একটা বলে, তাঁর মূল জিজ্ঞাসায় নিয়ে যাবেন আলোচনা।
রান্না করেছি আমি নিজেই। আঁচল সাথে খায়, চারু খায় ওর মায়ের বুকের দুধ। কাজেই আমাদের তরকারিতে ঝাল হারাম। আলু দেয়া মুরগীর ঝোলের মিষ্টি স্বাদ কিছুটা কমাতে পুটুর পুটুর কামড় দিচ্ছি কাঁচা মরিচে। ফোন স্পিকারে দিয়ে কথা বলছি। শব্দ শুনে ও প্রান্ত থেকে প্রশ্ন; ভাত খাচ্ছেন নাকী! হ্যাঁ মাহবুব ভাই।
তা হলে থাক, পরে কোন এক সময় কথা হবে? আমি জানি, সেই “কোন এক সময়টা” আর সহজে হবার নয়। তাই বললাম: না কোন অসুবিধা নেই ভাই, আপনি কথা বলুন।
কী মনে করেন, শাহবাগ আন্দোলনের ফল কী হবে?
জেনারেশন গ্যাপ বা টেকনিক্যাল হাল নাগাদ না থাকায় সাইবার যুদ্ধ বা ব্লগীয় পরিমণ্ডলে কী হচ্ছে, বিষয়টা মাহবুব ভাইদের মতো জেনারেশন জানে পত্রিকা পড়ে। প্রজন্মচত্তরের সহযোদ্ধাদের সাথে আমারও এক জেনারেশন গ্যাপ হয়ে গেছে। সময় তো বসে থাকে না। ফেসবুকে “লাইক-শেয়ার” বাটন টিপা ছাড়া প্রজন্মচত্তরের আন্দোলনে আমিও আর কিছু যোগ করতে পারিনি! কিন্তু সাথে আছি এবং প্রতিদিন অন্তত একবার বসে পুরো ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি।
হয়তো ভেতরের খবর পাবেন সেই আশায় আমাকেই প্রশ্নটা করেছেন মাহবুব ভাই। কোন প্রশ্ন শুনে আমি সাধারণত চটপট জবাব দিতে পারি না। ভেবে জবাবটা তৈরী করতে হয় আগে, তারপর বলি। একটু সময় লাগে। কিন্তু এবার দেরী হল না। “যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা হবে, জামাত নিষিদ্ধ হবে, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে রাজাকারদের দোসর বিএনপি-র নাম লেখা হবে ইতিহাসের পাতায়” । এবার জবাব দিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
কিন্তু ভাই মানুষের সমর্থন তো কমে যাচ্ছে। গত চল্লিশ বছরে রাজাকারের প্রপাগাণ্ডা মেশিনারি এত বেড়েছে যে; মনে হয় ৭১ রেও জামাত এত শক্তিশালী ছিল না। আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব মিলে শাহবাগের ছেলে-মেয়েদের নাস্তিক প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে! যারা প্রথমে সমর্থন করেছে, তাঁরা শাহবাগ দখলের ফলে যানজট সহ প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন নাগরিক অসুবিধার কারণে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ব্লগার রাজীব (থাবা-বাবা), সংস্কৃতি কর্মীর ছেলে ত্বকী, গীতিকার মুক্তিযোদ্ধা ইমতিয়াজের ভাইকে মেরে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর তাণ্ডব চালিয়ে জনমনে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে জামাত শিবির চক্র।
-কিছুটা হতাশা মাহবুব ভাইয়ের কণ্ঠে।
মাহবুব ভাই, ৭১-এ এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়ে ছিল। জনশূন্য ঢাকার রাস্তায় কাক-কুকুরে খেয়েছে আমাদের স্বজনদের লাশ। দাফন কারর মানুষ ছিল না। চার লাখ মা বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শহীদ হয়েছে তিরিশ লাখ। এত মূল্যের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নাগরিক অসুবিধার কারণে রাজাকারদের হাতে তুলে দেব! রাজাকার জামাত-শিবিরের হাতে শহীদ ভাইদের জীবনটা বৃথা যাবে না!
আপনারা কী করতে পারবেন? মাহবুব ভাইয়ের সংশয় দূর হয় নাই।
মাহবুব ভাই, এটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ বাংলাদেশের অস্তিত্বের যুদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শেষ সৈনিক শহীদ না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে।
শোনেন কায়সার, আপনাদের স্পিরিটকে আমি সম্মান করি। কিন্তু যে কোন যুদ্ধ, যত দীর্ঘ হয় সাধারণ মানুষের জীবনের দুর্ভোগ তত বাড়ে। মানুষ এক সময় সবকিছু বাদ দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায়। স্বজনদের লাশ কবর দিয়ে এসে পক্ষের মানুষকেই বলে; তোমরা এই যুদ্ধ শুরু না করলে আমার ছেলেটা বেঁচে থাকতো। এই দিকে জামাত শিবির ভয়ের সাথে প্রপাগাণ্ডা করছে প্রজন্ম চত্বরের সব লোক নাস্তিক এবং সরকারের প্ররোচনায় তারা শাহবাগ দখল করে জন জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কাঠমোল্লারা এই সব প্রোপাগান্ডায় ক্ষেপে গিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।
মাহবুব ভাই কোন দিক বাদ রাখেন না। আমাদের সব প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে, হয়তো বুঝতে চান আমাদের প্রতিরোধের পদ্ধতি।
আমার খাওয়া শেষ। এঁটো বাসন পাশে ঠেলে রেখে বললাম; মাহবুব ভাই, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মানুষ যদি মনে করে; জামাতে ইসলামের সদর দফতর লাহোর থেকে নির্দেশ পেয়ে গোলাম আযম ফতোয়া দেবে বাংলাদেশে কে আস্তিক কে নাস্তিক। এবং কাউকে নাস্তিক প্রমাণ করতে পারলে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে জনসমক্ষে শিরশ্ছেদ করা হবে। খালেদার আঁচলের নীচের থেকে সাঈদী বের হয়ে বলবে; নাউজুবিল্লা, কী বেগম তোমার হিজাব কৈ! জামাত শিবির ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-চিন্তার মানুষকে হত্যার জন্য যে দর্শন শিবির নামক তরুণ নাগরিকদের শেখাচ্ছে তা রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়া-লেখা করতে পারবে না। ঘরের বাইরে যেতে হলে হিজাব পরে যেতে হবে। জামাতে ইসলামী বলে দেবে কে মুসলমান এবং কী তার করনীয়। এই বাংলাদেশ যদি আমাদের আন্দোলনে বিপর্যস্ত জীবনের নাগরিকরা কামনা করেন। তা হলে কোন কথা নেই। জামাত-বিএনপির মিথ্যাচার বোঝার জন্য সিরাজুল আলম খান হওয়ার দরকার নেই। যে কোন স্বাভাবিক চিন্তার মানুষ বুঝতে পারে যে, সাঈদীর পক্ষে চাঁদে গিয়ে মেরাজ করা সম্ভব না। “তোমরা জেনে শুনে সত্য গোপন করো না, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢেকো না।“ কথাটা কোরানের। কে মিথ্যা বলছে সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ভয়ে, বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন ফিরে পাওয়ার লোভে চুপ করে থাকি। জেনেশুনে সত্য চেপে গিয়ে মিথ্যুক জামাত-শিবির-বিএনপির পক্ষ নিয়ে নিচ্ছি। কারণ মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। বিবেচনা করতে হবে, আমার কোন কাজ-কর্ম-কথা-চলা-বলা জামাত-শিবিরের পক্ষে চলে যাচ্ছে।
কায়সার এই বাংলাদেশ কেউই চায় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ করবে কী! আর, একটা যুদ্ধে দেশের সব মানুষ তো সৈনিক হয় না। তাদের সমর্থন থাকলেই চলে। আমার গলায় কিছুটা ক্ষোভ ছিল হয়তো, সে জন্যই সান্ত্বনা সূচক কণ্ঠ ছিল মাহবুব ভাইয়ের।
কিছুটা সংযত হলাম, আশ্বস্ত ভাবেই বললাম; মাহবুব ভাই, পৃথিবীর কোন পরিবর্তন আল্লার রহমতের মতো আকাশ থেকে পরে নাই। যে কোন পরিবর্তনের জন্য কিছুটা হলেও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। শাহবাগে কমপক্ষে এক কোটি মানুষ সমবেত হয়েছে। তারপরেও কারো মনে সংশয় থাকলে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে যথেষ্ট শক্তিশালী মনে না হলে ঐ এক কোটির পক্ষে যোগ দেয়া হবে তাদের জন্য ফরজে আইন। বেশী কিছুর দরকার নেই। আসছে ছাব্বিশে মার্চ ঢাকা শহরের সবাই রাস্তায় কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাবে। কাসন্দি দিয়ে ঝাল মুড়ি, চানাচুর, চটপটি, চা-সিঙ্গারা যার যা ইচ্ছে রাস্তায় বসে খাবে। শিশুরা খেলবে, ছবি আঁকবে, বেলুন ফাটাবে। ইচ্ছে করলে মোবাইল ফোনে একাত্তরের গান গুলো শুনতে পারে। কষ্টকরে যারা লিখতে পড়তে পারেন তাঁরা দয়া করে এক টুকরো কাগজে লিখে আনবেন “ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই”। বড় কোন ফেস্টুন-প্লেকাটের দরকার নেই। স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের পথ-ঘাট থাকবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের দখলে।
একাত্তরে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিরে ভাই, আর এখন দেশের এমন একটা সময় যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব মানুষকে দরকার, অথচ কিছুই করতে পারছি না এই প্রবাসে থেকে! খাঁচায় বন্ধী বাঘের গর্জনের মতো লাগল মাহবুব ভাইয়ের কণ্ঠ।
আমি প্রশ্ন করলাম; দেশ স্বাধীন করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবেন, সেই চিন্তা করে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন?
নারে ভাই, হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ। যুদ্ধে যেতে হবে সে জন্যই গেসি। কত ছেলে শহীদ হয়েছে!
সেটাই, আপনি আপনার জীবনটা এই দেশের জন্য একবার বাজি রেখেছিলেন। দ্বিতীয়বার দরকার নেই। সেটা এখন করছে প্রজন্ম চত্বর। এটা তাদেরই যুদ্ধ। আমদের কাজ হবে যে কোন রকমের সংশয় থেকে তাদের মুক্ত রাখা। সাহস যোগানো এবং তাদের সাথে আমরা আছি থাকব। তারা আমাদের ভাই-বোন-সন্তান।
মন্তব্য
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
আমরা আছি তাদের সাথে. থাকব মনে কোন সংশয় না রেখেই।
============================
কত আর রবে দেশ রাহু গ্রাস কবলে?
সমূলে উপড়ে ফেলি দূর্নীতি সবলে।
আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা সম্মিলিত ভাবে আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে।
কোন ভাবেই শ্বাপদদের এই বাংলার মাটিতে মেনে নেয় হবেনা।
জয়বাংলা।
তুহিন সরকার।
ভরসা করার মতো মানুষের সংখ্যা কম। তবে ঐ কয়জন একেক জন একশ' জনের সমান। অনায়াসে তো আর কিছু মিলবে না, তার জন্য অনেক কিছুই দিতে হবে।
অটঃ তীর্থের কাক কই?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তাদের সাথে আমরা আছি এবং থাকব।
জয় আমাদের হবেই হবে। জয় বাংলা।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
।
জয় বাংলা।
সেটাই। ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ বীরাঙ্গনার বিনিময়ে আমরা এই মুক্তি স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছিলাম। এখন এই স্বদেশ শুদ্ধ করার সময় এসেছে। আমাদের জীবন বাজি রেখেই এ কাজে এগুতে হবে। এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
নতুন মন্তব্য করুন