[এই গল্পের যদি কোন ভাল দিক থেকে থাকে, তবে তা ষষ্ট পাণ্ডবের। তিনি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ কী। আমি একে গল্প বানাতে চেষ্টা করেছি মাত্র। হয়নি বা কতটুকু হয়েছে বা হবে নির্ভর করছে আপনাদের মূল্যবান মতামতের উপর। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত কাহিনীর গল্পে উত্তরণ সহায়ক হবে। আমাদের জাতীয় কোন বিষয় নিয়ে কিশোর কিশোরীদের উপযোগী কোন গল্প কবিতা নেই বললেই চলে। এই সব বিষয় নিয়ে ভাল কোন গল্প লেখার কোন যোগ্যতাই আমার নেই; তবুও চেষ্টা করলাম। আশা করি যারা ভাল লিখতে পারেন, তাঁরা এই গল্পে আমার লেজেগোবরে অবস্থা দেখে, নিজেরা লিখতে আগ্রহী হবেন। কারণ; শিশু বা কিশোর সাহিত্যের মতো কঠিন বিষয় নিয়ে গল্প লেখা আমার মতো অর্বাচীনের কাজ নয়। তার জন্য শক্তিধর মেধাবী লেখক দরকার। গল্পের নায়িকার বয়স এখনো পাঁচ হয়নি। আর গল্প লেখা যখন শুরু করি তখনও অনুপস্থিত নায়িকার জন্মই হয়নি। আমার মেয়েরা যেন এই গল্পের নায়িকা হয়ে উঠে, সে কামনায় আঁচল এবং চারুর জন্য।]
-এই যে দেখ, এইটাই শহীদ মিনার। ছোট বেলায় তুমি এটাকেই বাংলাদেশ মনে করতে।
বাস থেকে নেমেছি শাহবাগ । রিক্সা নিয়ে এলাম শহীদ মিনার পর্যন্ত । রোদ। প্রচণ্ড রোদ। এসি বাসে শীত শীত একটা ভাব ছিল। তাই রোদটা এখন আরামই লাগছে। শখ করে মেয়ে, মামার দেয়া লাল সালোয়ার আর সবুজ কামিজ পরে এসেছে, লাল ওড়না দিয়ে। পোশাকটা খুব সুন্দর। গরম নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোন অভিযোগ করেনি আঁচল। করবেই বা কেন! শীতের দেশে থেকে জমাট বাঁধা বরফ থেকে বের হতেই তো এসেছে “বাবার বাংলাদেশে” । ওর যতক্ষণ ভাল লাগবে, ততক্ষণই হাঁটব। এখান থেকে হেঁটে যাব টিএসসি পর্যন্ত।
আঁচল শহীদ মিনারের দিকে তাকিয়ে পায়ে পায়ে পেছনের দিকে যাচ্ছে। আবার ডানে বামে তাকিয়ে যান-বাহন চলাচলের দিকে লক্ষও রাখছে। অবশ্য আমাদের দেশে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হর্ন এত বেশী বাজে যে; অসতর্ক হওয়ার উপায় নেই। তার পরেও রিক্সা-গাড়ী আসতে পারে এমন একটা ভীতি মুখে নিয়ে ওকে সতর্ক করতে এগিয়ে যাচ্ছি, একটু ত্রস্ত ভাবে।
-তুমি ভেবনা, আমার চোখ-কান খোলা আছে বাবা। ছোট বেলায় শহীদ মিনারের ছবিটা বইয়ে যেমন দেখেছিলাম; তার সাথে বাস্তবের শহীদ মিনারের কোন মিল পাচ্ছি না কেন বাবা!
বার-চৌদ্দ বছরের ছেলের মতো বালাই পৃথিবীতে আর নেই। বলেছিলেন রবি ঠাকুর। মনে হয় বার-চৌদ্দ বছরের মেয়ের যন্ত্রণা তিনি দেখেননি। দেখলে বলে যেতেন; বার-চৌদ্দ বছরের মেয়ের মত বালাই পৃথিবীতে আর নেই। কাজ-কথা-আদেশ-উপদেশ-বিধি-নিষেধ সব কিছু; কেন এমন করা যাবে না, বা কেন এমন ভাবে করতে হবে? যুক্তি-তর্ক করে বুঝিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে ভাবি; বড় হলি কেন! ছোটই থেকে যেতি। যা বলতাম তাই করতি (মাঝে মাঝে), আর কাঁধে উঠতে চাইতি। শারিরীক কষ্ট হলেও, এই যুক্তি-তর্কের চেয়ে অনেক সহজ ছিল কাঁধে নিয়ে হাঁটার সময়টা।
সাহস করে এই সব কথা বলতে পারি না। কখন কী কারণে আবার ক্ষেপে যায়, তার ঠিক নেই। কথা বলেছে, সেটাই একটা ভরসা। বাড়ি থেকে বের হয়ে মন-মেজাজ ভালই ছিল। জ্যামে পরে যাত্রাবাড়ী থেকে গুলিস্তান আসতে লাগল পাক্কা দুই ঘণ্টা। সেখানেও এটা ওটা দেখিয়ে গাল-গল্প ভালই চলছিল। মন কষা-কষি শুরু হয়েছে পিজির সামনে থেকে রিক্সায় উঠে। তিন-চারটা রিক্সা পাশা-পাশি। গাড়ি একটু কমলে পিজির দিক থেকে জাতীয় জাদুঘরের দিকে যাবে। আমরা বাপ-বেটী উঠেছি একটা বুড়ো মানুষের রিক্সায়। রিক্সার আগে-পিছে-ডানে-বাঁয়ে মানুষের অভাব নেই। গাড়ী চলাচল একটু কমলেই অনেক তরুণ-যুবক দ্রুত দৌড়ে এপার থেকে ওপার বা উল্টোটা করছে। কিন্তু রিক্সাওয়ালার সেই সুবিধা নেই। সিগন্যাল পড়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই সিগন্যাল পরার সাথে সাথেই সে টান দিল। রিক্সার সামনে দিয়ে, যে পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হতে চাচ্ছিল; তার পায়ে লেগে গেল রিক্সার সামনের চাকা। কোন কিছু না বলে; পিছন ফিরে রিক্সাওয়ালার গালে কষিয়ে বসাল একটা চড়। আমি একটু ভীতু টাইপের মানুষ। মারামারির দেখলেই দৌড়। কিন্তু এখন দৌড় দেয়ার উপায় নেই। চড়টা মেরে ভদ্রলোকের মতো হেঁটে চলে গেল সেই তরুণ। রিক্সা ওয়ালাও গালে একটা ঘসা দিয়ে, যেন কিছুই হয়নি, সেভাবেই টান দিয়ে রিক্সাটা একটু চালু হবার পর; সিটে বসে প্যাডেল মারা শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম যা; বাবা কোন ঝামেলা হয়নি।
কিন্তু ঝামেলা শুরু করলো আঁচল।
-বাবা তুমি ঐ লোকটাকে কিছু বললে না কেন?
-কী বলব বল! এই সব অভদ্র লোকের সাথে কোন কথা বলা যায়!
আমার জবাব আঁচলের পছন্দ হয়নি। লোকটা রিকশাওয়ালাকে মেরেছে, দোষটা যেন আমার, এমনই আঁচলের মুখের ভাব।
-লোকটার সাথে ভাব করে কথা বলতে হবে সেটা তো আমি বলিনি। তুমি তো বলতে পারতে যে সে কাজটা সে ভাল করে নি বা সব সময় আমাকে যেমন বল: কাজটা ঠিক হয়নি।
-তার আর সময় পেলাম কোথায়! চড় মেরেই তো ঐ মাস্তান বেটা চলে গেল!
কিছুটা কৈফিয়তের সুর চলে এসেছে আমার গলায়।
-তোমরা এমন করে চুপচাপ সব কিছু মেনে নাও বলেই ঐ লোকটা মাস্তান।
জানিনা আঁচলের কথা কতটুকু সত্য। তবে আমাদের প্রতিবাদের শক্তি সত্যিই কমে গেছে। তার পর রিক্সা থেকে নেমে আমাদের এই প্রথম কথা।
আঁচল পিছাতে পিছাতে ফুটপাথে গিয়ে ঘাড় এদিক ওদিক করে দেখে, এখন উঠে এসেছে শহীদ মিনারের সামনের গাছগুলোর নীচের বাঁধানো চত্বরে। বেশ ভাল উঁচু রাস্তা থেকে গাছের কাণ্ড ঘিরে বানানো দ্বীপগুলো। সেখানেই আঁচল পা ঝুলিয়ে বসে শহীদ মিনার দেখছে। সম্ভবত কৃষ্ণচূড়া গাছ। ঘন সবুজ পাতার ভেতরে কোন ফুল নেই। আঁচলের দুই বেণী ফুল করে বেঁধে দিয়েছে ওর মা। লাল ফিতায়। ঐটুকুই এখন আমার কাছে কৃষ্ণচূড়ার ফুলের মতো লাগছে। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে গেলাম। ঐ উঁচু সড়ক দ্বীপের মত গাছের গোড়ালির শান বাঁধানো জায়গাটায় বসে আছে আঁচল।
কাছে যেতেই গলা জড়িয়ে ধরে বলল - সরি বাবা, বুড়ো মানুষটাকে মেরেছে দেখে একটু কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছি তুমি কোন প্রতিবাদ করনি বলে।
-মা-রে চাইলেই কী আর সব কিছুর প্রতিবাদ করা যায়।
-কিন্তু তুমি যে বল: শহীদ মিনার হচ্ছে প্রতিবাদের প্রতীক?
আঁচলের মায়ের সঙ্গে কথায় পারি না কখনো। এখন আঁচলের সাথেও হয়তো পারব না।
-অন্তত আমার মতে তো তা ঠিক।
-তোমার মতে ঠিক, বুঝলাম। কিন্তু কী কারণে ঠিক?
-তখন বাংলায় কথা বলতো সাড়ে সাত কোটি মানুষ। আর উর্দুতে কথা বলতো মাত্র চার কোটি মানুষ। তা হলে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হওয়া উচিৎ, নাকী উর্দু!
-ওমা! ক্ষেপে যাচ্ছে কেন! আমি তো এ সবের কিছুই জানি না।
আমার গলায় একটু কর্কশতা ছিল হয়তো। সেটাই ধরেছে মেয়ে।
একটু থেমে বলল;
-রাষ্ট্র ভাষা একাধিকও থাকতে পারে। বাংলার পাশা-পাশী উর্দুও রাষ্ট্রভাষা হতে পারতো। খুব সহজ সমাধান তার।
-কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেছে; একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
-ওমা এটা তো ঠিক নয়। বাংলার সাথে উর্দুও রাষ্ট্র ভাষা থাকতে পারে। কিন্তু একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হয় কী করে!
অবাক হয়েই বলল মেয়ে।
-তাইতো। আর তার প্রতিবাদে ছাত্রদের মিছিলে গুলি করল পুলিশ। এই এখানেই। এই জন্যই শহীদ মিনার তৈরী হয়েছে এখানে।
-আচ্ছা! কিন্তু বাংলা ভাষা এবং জাতির এমন একটা গৌরব ও শোকগাঁথা জায়গাটি তোমরা সংরক্ষণ করলে না!
-করেছি তো মা, যখন শহীদ মিনার তৈরী হয় তখনও পাকিস্তান সরকার সব ক্ষমতা দিয়ে এর বিরোধিতা করেছে।
আমার জবাব পছন্দ হয়নি মেয়ের;
-কিন্তু বাবা, একটা জাতির এমন গৌরব গাঁথা জায়গার উপর দিয়ে গাড়ি চলার রাস্তা! লোকজন এমন ভাবে গাছের ছায়ায় বসে ঝিমুচ্ছে যেন চিত্ত- বিনোদনের জন্য কোন পার্ক! অথচ এখানে থাকার কথা ঐ সময়ের ছবি, চ্চলচিত্র, তথ্যচিত্র, ঐ সময়ের খবরের কাগজের কাটিং, এসব তথ্যপূর্ণ একটি জাদুঘর! এবং বছরে কমপক্ষে একবার এই দেশের সব স্কুলের ছেলে মেয়ে একটি দিনের জন্য এখানে আসবে। তাদের জাতির অহংকার এবং বীরত্বে গর্বিত হবে। ইতিহাস পাঠের এমন সুবর্ণ সুযোগ সব জাতির থাকে না। জার্মানরা অপরাধী জাতি, তার পরেও নাৎসীদের দুর্বিষহ নির্যাতনের প্রতীক আমাদের দেখাতে নিয়ে গেল ডাখাউ কনসানট্রেশন ক্যাম্পে! এবং সেটা বাধ্যতামূলক সব ছাত্রছাত্রীর জন্য!
-কিছুটা তো করেছেরে মা! এই যে দেখ, তুমি গাছটার গোঁড়ার বেধিতে উঠলেই দেখতে পাবে বাংলা একাডেমী। বল তো জার্মানে এমন কোন নিদর্শন আছে? ভাষা শহীদদের পাশেই এই ভাষার সব চেয়ে বড় গবেষণাগারটি। আমার গলায় কিছুটা অহংকার।
-তোমরা এমন কেন বাবা! দেখ এখানে এই ভাষা, এই সংস্কৃতির সব চেয়ে ত্যাগী মানুষগুলোর স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনারকে দেয়াল তুলে বাদ দিয়ে এই ভাষা-সংস্কৃতির সব চেয়ে বড় গবেষণাগারটি বানালে! অথচ এই দেয়ালে একটা ফটক থাকলেই এই শহীদ মিনারটি বাংলা একাডেমীর অঙ্গ হয়ে উঠে। তা না করে একে রেখেছ কৃষকের লাঙ্গল টানা বলদের ভাগারের মতো বাড়ির পেছনে, সবার দৃষ্টির আড়ালে। অথচ; এই শহীদ মিনারটিই সবার আগে থাকার কথা!
বিস্ময় ঝড়ে পরে মেয়ের কণ্ঠে।
একটু সময় চুপ থেকে এদিক সেদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে আঁচল! আর মনে মনে অজানা কোন সুরে গুন গুন করছে। কিন্তু সেই অচেনা সুরের কোন গান আমার মনে আসছে না। সুর মনে না এলে কথাটাও মনে আসে না। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে অসহায়ের মতো লক্ষ্য করছি ওর গতিবিধি।
-আচ্ছা বাবা এখানে কোন ফুলের দোকান নেই কেন!
যেন এর চেয়ে দরকারি আর কোন জিনিস এখানে থাকার কথা নয়!
বললাম: -কী জানি মা!
-ঠিক আছে, এই সবুজ পাতার থোকাটাতেই চলবে। ওটা আমি ছিঁড়লে কেউ কিছু বলবে নাতো!
মেয়ের মাথায় কখন কী খেয়াল চাপে তার ঠিক নেই। নানা ভাইকে ধরেছে; একটা গন্ধরাজের ডালায় কলম দিতে। সে এটা জার্মানিতে নিয়ে যাবে। আর এইটা হচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার অনেক পাতা ওয়ালা একটা ডালা। এটা জার্মানিতে নিয়ে গিয়ে কোন লাভ নেই। কখন আবার কী নিয়ে অভিমান করে! তাই বলে দিলাম: -নাও, কেউ কিছু বলবে না।
ডালটা ঝুলে ছিল তার হাতের নাগালে। সে যত্ন করে ডালটা হাতে নিয়ে পাতাগুলোতে হাত বুলাতে লাগল। শিশুরা যেমন করে প্রিয় পুতুল বা খেলনাকে আদর করে, অনেকটা সে ভাবে। কিন্তু সেই অচেনা সুর আর অজানা কথার গানটা বোধহয় এখনো খুঁজে পায়নি।
-আচ্ছা বাবা, মা-র গাওয়া কোন গানটা যেন তুমি খুব ভাল বাস! যেটা সাধারণত স্বাধীনতা দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারিতে গাওয়া হয়।
মেয়ের হাবভাব বোঝা একটু কঠিন হয়ে পড়েছে। কয়েকটা দেশের গান মেয়ের মা বেশ দরদ দিয়ে করে। কিন্তু এখন মনে আসছে কেবল “আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। সেটাই মেয়েকে বললাম। কিন্তু তাতে তাকে খুব সন্তুষ্ট মনে হল না।
-এটা না তো বাবা, ঐ যে, মালা শব্দটা আছে যে গানটায়!
মালা নিয়ে আমার কোন গানের কথা মনে না আসায় চুপ করেই রইলাম।
-পেয়েছি বাবা! খুশীতে মেয়ের মুখ উজ্জ্বল।
-কোন ছবি তুলবে না বাবা, বুঝলে। এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোন কথা বলবে না।
-ঠিক আছে বাবা বলব না। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এবার আঁচল মূল শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি-রিক্সা একটু কম থাকায় তার গুনগুনিয়ে গাওয়া গানের কথাটা শুনতে পারলাম।
“আমায় গেঁথে দাওনা মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা। আমি জনম জনম রাখব ধরে ভাই হারানোর জ্বালা”।
আঁচল খুব মন দিয়ে কখনো গানটা শেখার চেষ্টা করেনি! হয়তো সে জন্যই সুরটা ঠিক আমি যেভাবে শুনে অভ্যস্ত তার সাথে সম্পূর্ণ মিলছে না। কিন্তু মনে সেই গানের উদ্দেশ্য এবং কারণটা থাকায়; খুব দরদটা আছে তার সুরে। আমি অভিভূত, আপ্লুত হয়ে গেলাম।
শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে স্যান্ডেলটা খুলে পাশে রেখে পা রাখল সিঁড়িতে। কৃষ্ণচূড়ার ডালটা রাখল যেমন করে মায়েরা ঘুমন্ত শিশুকে শুইয়ে দেয় বিছানায়, তেমনই যত্নে, স্মৃতি স্তম্ভের পায়ের কাছে। এক অদ্ভুত ভাল লাগায় আমি বিহবল। এইটুকু চাওয়া আমার ছিল মেয়ের কাছে। এবং আমি তা পেয়েছি। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে যতটুকু দেখা যায়; দেশে থেকে সব মানুষ দেশকে সেটুকুই দেখছেন এমন অন্যায় অভিযোগ আমার নেই। কিন্তু হয়তো আমার মতো জীবনের তরে দেশে আসার সুযোগ রহিত মানুষের কাছে, দেশের দরদ একটু বেশী থাকে। বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রবর্তক, ভাষাভাষী মানুষ, তাদের ভাষা শহীদদের প্রতি একটু বেশী সম্মান থাকাটা স্বাভাবিক। আমার মেয়ের মনে সে সম্মান এতটুকু হলেও জাগাতে পেরেছি। খুব আনন্দ হল।
খুশী হয়ে বললাম; -চল মা, এখান থেকে বাঁ দিকে গেলে শিশু একাডেমী, তোমাকে একবার আমাদের শিশু একাডেমীটা দেখিয়ে আনি।
-বাবা, চারুকে নিয়ে আসলে ও খুব মজা পেত, শিশু একাডেমীতে গিয়ে।
আঁচল এখন আর শিশু না। শিশু হচ্ছে ওর ছোট বোন চারু। আকারের ইঙ্গিতে সব সময় সে যে এখন আর শিশু নয়, সেটি বোঝাতে বেশ ব্যস্ত। ঝগড়া-ঝাটি যাই করুক, কথা-বার্তা বলার মতো বুঝ আঁচলের হয়েছে। কিন্তু চারু এখনো এই সব বিষয়ে নিজের মতামত দেয়ার বয়স হয়নি। কিন্ডারগার্টেন শেষ হল, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হবে এ বছর। এখনো বেচারির বর্ণ পরিচয়ই হয়নি। তাই তাকে সাথে আনা যৌক্তিক মনে হয়নি আমার কাছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে একটা ভুল করেছি। ইতিহাসের এই সব পাদপীঠ মাড়িয়েই বেড়ে উঠা উচিৎ সব শিশুর।
শিশু একাডেমীর সামনে মৃৎ শিল্পের বিরাট আয়োজন। ছোট ছোট ফুলের টব। আঁচল সব নিরীক্ষা করে, আবার বিক্রেতার ঝুড়িতে রেখে দিচ্ছে।
-ইশ, বাবা দেখ কতো সুন্দর সুন্দর সব ব্যবহার উপযোগী মৃৎপাত্র! কিন্তু ব্যাগে করে নিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই! সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। আমাদের যদি এই দেশের থাকার সৌভাগ্য কখনো হয়, তা হলে এই সব ব্যবহার্য শিল্পকর্ম দিয়ে ঘর সাজাতাম। তবে বাঁশ-বেতের কিছু জিনিস (বাক্যটা শেষ করার আগেই বাঁশের তৈরী বইয়ের তাকে চোখ গেল তার), বাবা এই বইয়ের তাকটা নেয়া যাবে?
উপায় নেই। তাই চুপ করে রইলাম।
-ঠিক আছে বাবা। বলে হাতে নিল একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরী টেবিল ল্যাম্প। এইটা কিন্তু নেবোই বাবা। আমার পড়ার টেবিলে, এইটা থাকবে।
বাল্ব লাগানোর মুখটা জার্মানে গিয়ে বদলে দিতে হবে। আমার পক্ষে কাজটা কঠিন, তবে অসম্ভব না। মেয়ের আবদার অন্তত একবার রক্ষা করতে হয়। টেবিল ল্যাম্প নিলাম।
খুব সুন্দর ছায়া সুনিবিড় শিশু একাডেমীর প্রবেশ পথের দু’ধারে বড় বড় গাছের সারি। তার ছায়ায় শিশুদের বই টেবিলে সাজিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় পেছনে বসে আছে দোকানী। আঁচল নেড়ে চেড়ে দেখছে। বেশীর ভাগ বই বর্ণমালা শেখার। লিখতে পড়তে শিখে এখন সে মুরব্বী। প্লাস্টিকের বাঁধাই ওয়ালা একটা বই হাতে নিয়ে, তার পাতার সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করছে টেনে-টুনে। সম্ভবত বইটা ছোট বোন চারুকে উপহার দেয়ার জন্য নিতে চাইবে।
কিন্তু চারুর মতো শিশুর কাছে বই হচ্ছে একটা খেলনা মাত্র। এমন খেলনা বই আঁচলের অনেক আছে, যেগুলো এখন উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছে চারু। বই গুলো ভীষণ শক্ত মলাট বা সেলাই করা কাপড়ের। চারুর মতো শিশুরা টেনে ছিঁড়তে পারে না। বেশীর ভাগ বইয়ে ফল, মূল, পশু, পাখির ছবি। ছবিটা দেখে আঁচল জানতে চাইতো বাবা এটা কী? নাম বলতাম। এই ভাবেই শহীদ মিনারের সাথে ওর পরিচয়। জাতীয় পতাকা, মানচিত্র সব কিছুই ও মনে করত বাংলাদেশ। তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, কোনটা কী কারণে তৈরী হয়েছে। তবে বাংলায় এমন শক্ত, মজবুত বই নেই। বাংলাদেশ থেকে নেয়া বই ও দুদিনের মধ্যে পাতা ছিঁড়ে সেগুলো জমিয়ে তার উপর লাল সবুজ রং মেখে বলতো, এই দেখ বাবা; তোমার বাংলাদেশ।
চারুর এখন খেলনা বইয়ের দরকার। রঙ্গিন সব বড় বড় ছবি দেখে বই হাতে নিয়ে; তার স্থায়িত্ব কেমন হবে সেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে বইয়ের দুই পাতা দুই হাতে নিয়ে বোকার মতো দোকানীর অগ্নিদৃষ্টির সামনে অপরাধীর ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে আঁচল। পশরা দেখেই বোঝা যায় দোকানী বেচারা গরিব মানুষ। তার সাথে কোন কোন দিক বিবেচনা করে শিশুদের জন্য বই বানাতে হয়, সে তর্ক বৃথা। বাধ্য হয়ে ছেঁড়া বইই কিনতে হলো।
সমস্যা হল একাডেমীর ভেতরে ঢুকে।
-শিশুদের জন্য তো এখানে কিছুই নেই বাবা! এর নাম শিশু একাডেমী বা শিশুদের পাঠাগার হল কেন! শিশুদের জন্য তো এখানে কিছুই নেই!
বিস্ময় না, ওর গলায় এখন বিরক্তি।
আমি একটা ঝকঝকে রঙ্গিন ছড়ার বই তাক থেকে হাতে নিয়ে বললাম, -
-এই যে দেখ! কী সুন্দর ছড়ার বই!
-বাবা, ছড়ার বই পড়তে হলে তো আগে পড়া শিখতে হবে! তারপর ছড়ার বই পড়ে শিশুরা মজা পাবে।
বাবা মার হাত ধরে একটা চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁজছে বইয়ের তাকে তাকে। সেই শিশুটির দিকে তাকিয়ে মেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেয়ে গেল।
-দেখ, এত এত সাজানো বইয়ের ভিড়ে বাচ্চাটা কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কিছুই পাচ্ছে না। এখানে রূপকথার ডালিম কুমার নেই, যা সে তার মায়ের মুখে শুনেছে। নেই কোন আগডুম বাগডুমের মূর্তি। খাড়া শিং ওয়ালা হাট্টিমাটিম টিম। খেলনা বা দৌড়-ঝাপ দেয়ার মতো নিরাপদ জায়গার কথা বাদই দিলাম। রূপ কথার গল্প পড়ে শোনানোর মতো একজন মানুষ পর্যন্ত নেই! শিশুরা পড়ার দিকে যাবে এই সব ছড়া, গল্পের চরিত্রদের খুঁজতে খুঁজতে।
-হ্যাঁ, তাতো সত্যি কথা। কিন্তু, এই সব করার মতো এত টাকা কী গরিব বাংলাদেশের আছে!
-বল কী বাবা! নব বর্ষের আনন্দ মিছিলে কী মজার মজার পশু, পাখী, হাতি, ঘোড়া নিয়ে যায় মানুষ! তখন টাকা আসে কোথা থেকে? আমার মনে হয়; ইচ্ছের অভাব, বাবা। কত টাকা লাগে হাট্টিমাটিম-এর একটা কাগজের মূর্তি বানাতে? কত টাকা লাগে মেঝে কয়েকটা মাদুর পেতে বালিশ রেখে শিশুদের সামনে নাটকের মতো করে তাদের চেনা চরিত্র গুলো অভিনয় করে দেখাতে!
-হ্যাঁ, সে সব করতে পারলে তো ভালই হত। হয়তো এক সময় লোকজন ভাববে।
-ভাবতে ভাবতে অনেক প্রজন্ম তৈরী হয়েছে, হবে; যারা কথা বলা ময়নার মতো, বইয়ের পাতা মুখস্থ বলতে পারবে, কিন্তু নিজের সংস্কৃতির সব কিছুই অজানা থেকে যাবে। দেখ না, বইয়ের তাক গুলো কী ভাবে বিদেশী গল্পের অনুবাদে ঠাসা। যেন বাংলায় শিশুদের জন্য কোন রচনাই নেই!
বিড়বিড় করতে করতে শিশু একাডেমী থেকে বের হয়ে আমার পেছনে পেছনে আসছে আঁচল। উদ্দেশ্য শিখা অনির্বাণ।
-দেখ এইটা শিখা অনির্বাণ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে এই শিখা। এটা কখনে নেভে না।
অনেকক্ষণ হেঁটেছি, একটু ক্লান্ত দু’জনেই। মেয়ে অনুমতি চাইল; -এখানে একটু বসি বাবা
ঠিক আছে, বস মা। বলে আমিও বসলাম মেয়ের পাশে।
-আচ্ছা বাবা, পৃথিবীর অনেক দেশেই গৃহ যুদ্ধের ইতিহাস আছে। কিন্তু এত স্বল্প কালীন যুদ্ধে তিন মিলিয়ন শহীদের মতো এমন বিশাল প্রাণ হানির ঘটনার কথা কোথাও শুনিনি। কী, ভাবে সম্ভব হল এটা?
খুব সহজ এবং সরল প্রশ্ন মেয়ের। এই প্রশ্নের ভয়ঙ্কর শব্দটি হচ্ছে গৃহযুদ্ধ। সেটাই মেয়েকে আগে বোঝাতে হবে;
-শোন মা, গৃহযুদ্ধ হচ্ছে সেই যুদ্ধ যেখানে একটি জাতির একাধিক দল বা গোত্রর মধ্যে সংগঠিত হয়; যেমন ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে সংগঠিত ‘আমেরিকার গৃহযুদ্ধ’। আগে কখনো একই দেশ ছিল কিন্তু এখন আলাদা, এমন জাতি বা রাষ্ট্রের মধ্যকার যুদ্ধকেও গৃহযুদ্ধ বলে। যেমন; ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত গ্রীক ও তুর্কী সাইপ্রিয়টদের মধ্যে চলা ‘সাইপ্রাসের গৃহযুদ্ধ’। গৃহযুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে সেই দেশ বা অঞ্চলে নিজেদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এর বাইরে অনেক সময় সরকারের নীতি পরিবর্তন বা স্বাধীনতা ঘোষণাও এর সাথে যোগ হতে পারে। যেমন, আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তর আর দক্ষিণের সরকারের নীতিগত পার্থক্য ছিল এবং সাইপ্রাসের গৃহযুদ্ধে তুর্কী অধ্যুষিত উত্তর সাইপ্রাস স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।
-বুঝলাম, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলা যাবে না কেন?
প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করে কোন কথাই মানতে নারাজ মেয়ে।
-আমাদের মুক্তি যুদ্ধকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখবে; বাঙ্গালী আর পাকিস্তানীরা কখনোই এক জাতিভুক্ত ছিলনা। পাকিস্তানী জাতিটিই একটি কাল্পনিক, কৃত্রিম ও চাপিয়ে দেয়া ধারণা। সুতরাং এই যুদ্ধটি দলগত বা গোত্রগত লড়াই নয়। পূর্ব বাংলা অথবা বঙ্গ ঐতিহাসিকভাবে কখনোই পাকিস্তানের পাঞ্জাব বা তার আশেপাশের অন্যান্য রাজ্যগুলির সাথে একইদেশর অধীনে ছিলনা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল ছাড়া এরা এক শাসনাধীনও ছিলনা। নৃতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের তোয়াক্কা না করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি রাজনৈতিক ভাবে সৃষ্ট বলে পাকিস্তানীদের সাথে পূর্ব বাংলার মানুষের যুদ্ধ তাই কোন বিবেচনাতেই গৃহযুদ্ধ হতে নয়।
কৈফিয়তের সুরে বলি আমি।
-মুক্তি যুদ্ধ মানে কী, বাবা?
না বলে উপায় নেই।
-শোষণ-বঞ্চনা-অবিচার-অসাম্য, অন্যায়-অমানবিক আচরণ। কাঙ্ক্ষিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা সীমাবদ্ধ করা, যেমন এক সময় রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ছিল। নৃতাত্ত্বিক-ধর্মীয়-ভাষা-জাতি-গোষ্ঠীগত বিচারে দলন-নিষ্পেষণ। চিন্তা-ভাষার স্বাধীন বিকাশের ও চর্চার পথরুদ্ধকরা। মানুষকে মানবিক-নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। এই সব অন্যায় থেকে মুক্তির জন্য সকলের মিলিত, ব্যাপক ও সার্বিক গন প্রতিরোধই মুক্তিযুদ্ধ।
-বুঝতে পেরেছি। বাবা, চারুর জন্মদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জায়গাটা এখান থেকে খুব দূরে?
-না, মা, চল। ঐ তো দেখা যাচ্ছে।
বাপ-বেটি গিয়ে হাজির হলাম শিশু পার্কের সামনে। মেয়ে যেন তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছুতে পারেনি।
-বাবা, আমার কোন আবদার রক্ষা করতে না পারলে, কারণ সহ তা বললে তো আমি বুঝে, মেনে নেই। নেই না, বাবা?
-হ্যাঁ, নাও তো মা। আমি তো তোমাকে কখনো অবুঝ বা নির্বোধ বলিনি। কিন্তু এখন সে কথা উঠছে কেন!
-আমি তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা যেখান থেকে দেয়া হল; সে জায়গাটা দেখাতে। এই শিশু পার্কে আমি আসতে চাই নি। এখন বুঝতে পারছি; বাজার থেকে ভুল জিনিস নিয়ে এলে মা তোমার উপর চটে যায় কেন। তুমি না বলতে পার না বলে, একটার বদলে আর একটা কিছু নিয়ে আস। অথবা অন্য কিছু বলে দাও। আর আমি পুরোটা না বুঝেই, তোমার পক্ষ নিয়ে, রাগ করে মায়ের সাথে কথা বলি না।
আঁচলের মুখে কোন লাগাম নেই। বয়ঃসন্ধিক্ষণের সময়টা এমনই। কিন্তু আমি কী করব! ইচ্ছে করছে রাগে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ি! এমন একটা ইতিহাসের সাক্ষীর উপর বানাতে হল শিশু পার্ক। এই হল মসজিদ ভেঙ্গে তার উপর মন্দির নির্মাণের মতো। শিশু পার্ক একটা উপাসনালয়ের চেয়ে কোন ভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই বলে স্বাধীনতার ঘোষণা যেখান থেকে দেয়া হল; সেখানেই শিশু পার্ক বানাতে হবে! এখন মেয়েকে কী করে বোঝাব যে; আমি সত্যিই তাকে সেই ঐতিহাসিক মঞ্চের সামনেই নিয়ে এসেছি! কিন্তু মাথা গরম করলে চলবে না।
-মা, পাহাড় ক্ষয় হয়। ভূমিকম্পে সমুদ্রের তলদেশ পাহাড় হয়ে যায়। আমাদের জাতীয় জীবনেও এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। যিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, এখানে দাঁড়িয়ে, তাকেই হত্যা করা হয়েছে সপরিবারে। শিশুটিও রক্ষা পায় নি। তারপর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারাই এই ঐতিহাসিক জায়গাটা বেছে নিয়েছে, শিশু পার্কের জন্য।
-বল কী বাবা! এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোন স্বাভাবিক চিন্তার মানুষ! এই পুরো এলাকাটাই তো শিশু পার্ক হতে পারে! এখনো। লণ্ডনে টেমস নদীর তীরে সেক্সপিয়ারের গ্লোব থিয়েটার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল চার বার। প্রতিবারে তাঁরা পুনর্নির্মাণ করেছে; অবিকল আগেরই মতো কাঠ আর দড়ি দিয়ে। আবার আগুনে পুড়ে যেতে পারে বলে; ইট-পাথর দিয়ে বানায়নি। আর তোমরা কী করেছ! ছবিতে মঞ্চটা যেমন আছে, ঠিক তেমন করে আবার বানাও। সামনের পুরো জায়গাটা থাকুক পার্ক। শিশুদের জন্য সব রকমের বিনোদনের ব্যবস্থা রাখ। আর এই মঞ্চে গিয়ে যে কোন শিশু তার যতবার ইচ্ছে ততবার বঙ্গবন্ধু সেজে দিক স্বাধীনতার ডাক। বলুক তাদের অভিযোগের কথা। স্বাধীনতার সব তথ্য দিয়ে সাজানো হোক জায়গাটা।
-হবে মা, হবে। একদিন সব হবে। সান্ত্বনা দেই মেয়েকে। কিন্তু টিকেট কেটে ভেতরে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে মেয়ে বলে; দেখ না বাবা, এখানে সত্যিই শিশুদের আনন্দের কতটুকু, কী আছে! এখানে গিয়ে আমি কী করব! হয়তো চারু আসলে যাওয়া যেত। আমি স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে, দেখতে এসেছিলাম। একটা জায়গা মানুষের কাছে গুরুত্ব পূর্ণ হয় তার ভৌগোলিক অবস্থান বা ব্যবহারের কারণে। এই শিশু পার্ক সেই গুরুত্ব মুছে দিয়েছে। তার চেয়ে বরং চল; তোমার আড্ডার সেই জায়গাটায়। আশা করি সেখানে কেউ শিশু পার্ক বানায় নি।
বিকেল হয়ে এসেছে। রোদের তেজ কমেছে কিছুটা। সেই সাথে মেয়ের ক্ষোভও অনেকটাই নিরুত্তাপ। খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল কপালে। তারপর খিল খিল করে হাসতে লাগল। হাসির কারণটা বুঝতে না পেরে একটু বিব্রত ছিলাম।
-বাবা, তোমার কপালে আমার ঠোঁটের লিপস্টিক লেগে আছে।
মনে মনে ভাবলাম থাক, এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই।
আঁচল খুব আদর করে জড়িয়ে ধরে বলল; -সরি বাবা, এবার আমিই না জেনে তোমাকে কত কঠিন কঠিন কথা বললাম। এখন থেকে পুরোটা জেনে, তারপর বলব। ঠিক আছে বাবা?
ঠিক না থেকে উপায় আছে! মাথা নাড়লাম। আঁচল মায়ের কাছ থেকে শিখে থাকবে হয় তো, ঘটনার অংশবিশেষ শুনে খুব রেগে যায়। তারপর পুরোটা শুনে, নিজের ভুল বুঝতে পারলে, সাথে সাথে ক্ষমা চায়। আঁচল বাবার যৌবনটা দেখতে চায়। যেতে হবে টিএসসি। সেখানে আমাকে এখন আর কে চিনবে! হয়তো আবার হতাশ হবে, বিরক্ত হবে সে। কে জানে।
কিন্তু আঁচল এবার বেজায় প্রাণবন্ত। লাল ওড়নাটা মাথার উপর তুলে দিয়ে গান ধরেছে “বসন্তে ফুল গাঁথল, আমার জয়ের মালা”। গানের সাথে নেচে নেচে পার্কের ভেতর ঘাসের উপর দিয়ে এগুচ্ছে। একটা গান আমি শুনি শত বা সহস্রবার। গাড়ির ভেতর মাস ছয়েক বা বছর খানেক ঐ একটা গানই বাজতে থাকে বার বার। গানটার কথা-সুর মুখস্থ হয়ে গেলে তার পর নতুন আর একটা। এভাবেই এখন এই গানটা বাজছে গাড়িতে। সেটাই শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলেছে আঁচল।
আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা। আঁচল নেচে গেয়ে চলেছে, শিশুর মতো। হয়তো বাবা তার ভুল করেনি, তাই ভেবে। হয়তো এখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়েছিল; তাই বলে। সে আগুন ছড়িয়ে দিতে চায় সে সবখানে। বিজয় পতাকার মতো বাতাসে উড়ছে তার লাল ওড়না।
মন্তব্য
গাব্দু গব্দু কে আদর
ধন্যবাদ সাইদ, আদর দেয়া হল।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
সত্যিই কি ৭ই মার্চের মঞ্চের ওই জায়গাটা শিশুপার্কের ভেতর ঢুকে গেছে? এটা আমার জানা ছিল না।
শিশুদের জন্য এরকম লেখাগুলোর প্রয়োজন অনেক। এরকম লেখালেখির তাগিদটা এক বাবার কাছ থেকে আরো অনেক বাবার কাছে ছড়িয়ে পড়ুক। আঁচল আর চারুকে অনেক আদর আর চকোলেট!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
১ আমি সেরকমই জানি।
২ আঁচল আর চারুকে আদর দিলাম। চকলেটটা পরে দেব।
ধন্যবাদ বস।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
৭ মার্চের মঞ্চের জায়গাটা ইচ্ছাকৃতভাবেই শিশুপার্কের অন্তর্গত করা হয়েছে। অন্তত আমি এমনটাই জানি। অবশ্য আমার জানাটা ভুলও হতে পারে।
গল্প লেখার সীমাবদ্ধতার কথা আপনি বলেই নিয়েছেন, তাই সে নিয়ে কিছু বলার কোন অর্থ হবে না। গল্পে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন সেগুলো দামী। আরো লিখুন, এই আকাঙ্খা জানাই।
- একলহমা
ধন্যবাদ একলহমা,
গল্প লেখার সীমাবদ্ধতার কথা আপনি বলেই নিয়েছেন, তাই সে নিয়ে কিছু বলার কোন অর্থ হবে না।
মানি না। এই নিয়ে বলার নিশ্চই অর্থ হবে। দয়া করে গল্পের দুর্বলতা গুলো ধরিয়ে দিন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
যত বেশী লিখবেন, এই দুর্বলতাগুলো আপনি-ই চোখে পড়বে।
একটা কথা গোড়াতেই বলে নি-ই। লেখাটির ট্যাগলাইন-এ 'গল্প' থাকার ফলে আমি এটিকে গল্প হিসাবেই নিয়েছি। সত্যি ঘটনার স্মৃতিচারণ হিসাবে নিইনি। তার ফলে পড়ার সময় এক ধরণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়েছি। নীচে যে কথাগুলি লিখছি সেগুলি সেই প্রস্তুতি হিসাবে রেখে গল্পটি পড়ার অনুভূতি থেকেই লেখা।
পড়ুয়া হিসেবে আমার যেখানে আটকে আটকে গেছে সেটা হচ্ছে আঁচল-এর সংলাপ। শিশুরা অবশ্যই অনেক ভারী ভারী কথা অবলীলায় বলে দ্যায়। তাদের বলার ঢং-ও অনেক সময় বড়দের মত শোনাতে পারে। কিন্তু তাদের নিজস্বতা তারা অপ্রকাশ রাখে না। এ গল্পে আঁচল আর তার বাবার সংলাপের পার্থক্য করা কঠিন হয়ে গেছে, এতে গল্পের রসগ্রহণে অসুবিধা ঘটেছে।
পান্ডব-দাদা এলে এই বিশ্লেষণ-এর কাজটা আরও অনেক ভালভাবে করে দ্যান। ভাল হয় এই লেখাটি যদি ওনার চোখে পড়ে।
- একলহমা
যদিও গল্প হিসেবে বিবেচনা করলে বলব লেখাটার মধ্যে কৃত্রিমতা আছে। অনেক কিছুই জোড় করে ঢোকানো হয়েছে বলে মনে হয়েছে, তবুও এরকম লেখা আমাদের লিখতে হবে, অনেক লিখতে হবে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই, ঠিক ওভাবে বোঝাতে চাইনি। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে মেয়ের সাথে কথোপকথন অনেকটাই ইউনিডিরেকশানে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব ধরণের প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্তর একটি গল্পের মধ্যে জানানোর একটা প্রবণতা আছে। অনেক কিছু একই জায়গায় আঁটানোর একটা চেষ্টা আছে কেন যেন মনে হচ্ছে। সেইখানে মনে হয় গল্পটা একটু প্রাণ হারিয়েছে।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আহারে, এমন বাপ ঘরে ঘরে জন্মাক।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধন্যবাদ বস।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পড়ে অনেক ভালো লাগল। না পড়লে সত্যিই একটা ভুল করতাম।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ধন্যবাদ, রাসিক রেজা নাহিয়েন।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আব্দুল্লাহ এ এম
ধনইন্যা পাতা।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
চলুক, এমন আরো অনেক।
শুভ কামনা জানবেন।
----------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ধন্যবাদ, লেখাটার জন্য।
কেন যেন মন খারাপ হল লেখাটা পড়ে। আঁচলের একটা কথাও মিথ্যা না, সবগুলোই খুব সত্যি মনে হল।
অনেক বড় হোক চারু আর আঁচল। বাংলাদেশকে হৃদয়ে রাখতে শিখুক।
অফ টপিকঃ ভাইয়া, তীর্থের কাক ৩১ পর্বের পরে কি বন্ধ করে দিলেন? খুব আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম সিরিজটার জন্য।
বয়সের তুলনায় সংলাপ কৃত্রিম মনে হলো না? এতো গুছিয়ে কেউ তাতক্ষনিক কথা চালাতে পারে? তবে, এমন হতে পারে যে- সেই সংলাপ পড়ে মেচিউর বাবার কলমে কঠিন শব্দজালে জব্দ হয়েছে।
কিন্তু, বিষয়বস্তু আর বিষয়বস্তুর অন্তরালের প্রগাঢ় ভালবাসার জন্য অভিনন্দন।
-------------------------------------------------
ভালবাসা কেবল নিজেকে দেয় এবং নিজ থেকে নেয়-
ভালবাসার যেমন নিজেরও কিছু নেই, তেমনি সেও কারো নয়;
কেননা, ভালবাসার জন্য শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধ মানে সাম্য,স্বাধীনতা এবং কারো কাছে মাথা না নুয়ানো ।
নতুন মন্তব্য করুন