ঈর্ষণীয় ভরাট গলায় গমগম করছে ঘর। মানুষের উপর প্রকৃতির প্রভাব বড় প্রখর! বাইরের ঝলমলে রোদ মন এমনিতেই ভাল করে দয়। আমার চাকুরী আর সোনিয়ার সফল অপারেশনর পর আজ দেখা হওয়ার কথা। কাল ছিল থালা-বাসন মাজার শেষ দিন। সুরুজ মিয়াকে দিয়ে আসলাম কাজে। সে যে কী খুসী। জসিম, জাহিদ ভাই, নূরুদ্দীনের সাথে রান্না করে খাচ্ছি। ছুটির দিনে বাইরে খেতাম। রান্না-বান্নার ঝামেলা ছিলনা। কিন্তু এখন সেই বিলাসিতা করা সম্ভব না। আমি রান্না তেমন ভাল পারি না। সময় মতো কেটে-কুটে দেই, বাজার সদাই করি। আজও তাই করলাম। রান্না শেষ। গোসল করে ভাত খাব। তারপর সোনিয়া আসলে বের হয়ে যাব।
এমন সময় আসলেন বড় ভাই। কণ্ঠ ভরাট, শরীরটাও ভারী, তাতে বয়সটা একটু বেশী মনে হচ্ছে। অবশ্য এখানে আমাদের মতো মৌসুমি পাখিদের স্থায়ী ভাবে জীবন নিয়ে পরিকল্পনার কোন উপায় নেই। থাকলে এতদিন বড় ভাই বউ-ছেলে-পুলে নিয়ে পুরো সংসারী হয়ে যেতেন। আন্দাজ করছি তিনি চল্লিশোর্ধ। আগে কখনো দেখিনি তাঁকে। তাই আমি ভেবেছিলাম হয়তো নতুন পাবলিক। বড় ভাই কী নতুন আসলেন? কোন লাগারে উঠেছেন ভাই? আমার সরল প্রশ্ন শুনে তিনি গেলেন ক্ষেপে। পকেট থেকে সবুজ পাসপোর্ট বের করে তাসের তুরুপের মতো ছুড়ে মারলেন টেবিলে। তার পর বললেন; আমি আজুইল না, পাসপোর্টে ভিসা নিয়া ঘুরি। ভারী গলায় গমগম করে উঠল ঘর। আমাদের প্রতি যথেষ্ট তাচ্ছিল্য এবং নিজের গর্বে অহংকারী সেই মানুষটার কথায়, অপমানিত বা রাগ হওয়ার বদলে, আমি হয়ে গেলাম মুগ্ধ। কী যাদুকরী গলার আওয়াজ। নাটক করলে খুব ভাল করতেন ভদ্রলোক।
তোয়ালে দিয়ে নিজের শরীর মুছতে মুছতে ঘরে ঢোকার সময় শুনেছে কথাটা নূরুদ্দীন। বেশী কথা বলি, তাই সে আমাকে দেলোয়ার হোসেন সায়ইদী বলে ক্ষেপায়। প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, রসিকতা করেও এই জানোয়ারের সাথে যে কোন মানুষের তুলনা করা ঠিক না। কিন্তু লাভ হয় নি কোন। অবশ্য এখন শুধু মাওলানাই বলে বেশীর ভাগ সময়।
অন্যের পক্ষ হয়ে আমি যত কথা বলতে পারি, তার সিকি ভাগও নিজের হয়ে বলতে পারি না। কেউ অপমান জনক কিছু বললেও চুপ করে থাকি। অন্য কেউ যদি প্রতিবাদ না করে; তার মানে হল, আমাকে যা বলা হয়েছে, তা যথার্থই ছিল। না হলে তো কেউ প্রতিবাদ করতোই। অবশ্য যদি কেউ সামনে থাকে। না থাকলে, গুমরা মুখে চলে যাই নিজের পথে। কিন্তু নুরুদ্দীন বা জাহিদ ভাই ভীষণ চালাক।
কী মাওলানা সব, ভাত-টাত রাইন্দা আনলাম, একটু বেড়ে-টেরে না দিয়ে গপ শুরু করলেন দেখি! কথাটা আমার উদ্দেশ্যে বলল নুরুদ্দীন। কিন্তু এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বড় ভাই। হাসিতে মুখ ভরে নুরুদ্দীনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন; আমি মিউনিখ থাকি, এই দিকেই এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই আপনাদের সাথে। যেন তিনি নুরুদ্দীনের অনেক দিনের চেনা লোক।
আচ্ছা মিউনিখে থাকেন আপনি, নামটা কী বড় ভাইয়ের?
নুরুদ্দীন নিজের গায়ে নেভিয়া লোশন মাখতে মাখতে কথা বলছে বড় ভাইয়ের সাথে।
নামতো মোহাম্মদ আতাউল করিম। মিউনিখে সবাই বড় ভাই হিসাবেই চেনে। বুঝেন তো, নতুন নতুন পোলাপান আসলে, অনুবাদকের কাজ করতে হয়, অফিস আদালতে নিয়া যাইতে হয়। সব কাজে-কর্মে বড় ভায়ের ডাক-খোঁজ পরে আর কী। বেশ খানিকটা গর্ব নিয়ে জানালেন বড় ভাই।
ও, আইচ্ছা। উঠলেন ক্যান, বসেন, ক্ষুধা থাকলে চারটা ভাত খান, আমাদের সাথে।
জানিনা লোক-জন বিদায় করার জন্য এই সব বলল কী না, নূরুদ্দীন। কিন্তু বড় ভাইয়ের জবাব না শুনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বেশ খোস মেজাজে বলল; মাওলানা সাব; খবর কী, নায়িকা আসবে না কী আজকে?
এবার দেখি বড় ভাই আর সাধাসাধির অপেক্ষা না করে আমার দিকে মুখ করে চেয়ারে বসে পারলেন। তারপর বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন; বান্ধবী হয়ে গেছে নাকী?
হাসি মাখা মুখটা উঁচু-নিচু করলাম।
টেবিলে ভাত আর মুরগীর মাংসের পাতিল রেখে সবার জন্য বাসন দেয়া হল। বড় ভাই আমার দিক থেকে মুখ না সরিয়েই বাসন টেনে নিলেন।
সোনিয়া এই লাগারে আসার পর আমি বেশ পরিচিতি পেয়ে গেলাম। সবাই সমীহও করে দেখি। কিন্তু বড় ভাইয়ের মতো এতো উপকারী উপদেশ আর কেউ দেয় নি। খাওয়া শেষ করে তিনি উঠে গেলেন। ব্রাসেলস যাবেন। তাঁর ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। আমরাও একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দিঘীর পারে দেখেছি যুবক যুবতীর প্রায় নগ্ন শরীরে ক্রিম মেখে দেয়। আমিও আজকে সোনিয়ার শরীরে ক্রিম লাগিয়ে মালিশ করে দেব। কী ক্রিম লাগায়। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি রোধক ক্রিম। কিনলাম একটা ক্রিম। সাথে বিশাল সাইজের এক তোয়ালে। আর একটা সাতার কাটার জাঙ্গিয়া আমার জন্য। গরীব লোক হঠাৎ ধনী হয়ে গেলে যেমন হয় আর কী। আমি সোনিয়াকে পেয়ে বেশ গর্বিত। সেটাই লোককে দেখাতে হবে। আগে থেকেই সব কিছু ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি। গাড়িতে উঠে সেটাই সোনিয়াকে বললাম; চল আজ সাতার কাটকে যাই। সে জানাল; এই সময়ে ওখানে ভীষণ ভিড় থাকার কথা গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া যাবে না। আমি দেখলাম; পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল! কেউ যদি নাই দেখল যে, আমারও বান্ধবী আছে, এবং আমিও তার গায়ে ক্রিম মেখে মালিশ করছি, তাহলে আর সাতার কাটার মজাটাই রইল কৈ।
কিন্তু আমার সব লোক দেখানো পরিকল্পনা মাটি করে দিয়ে সোনিয়া উপস্থিত হল সেই স্বর্গে। যেখানে আদম প্রথম হাওয়াকে দেখে ছিল। আমার মনে হল একটা নতুন জনপদ সৃষ্টির পক্ষে জায়গাটা বেশ উপযোগী। প্রকৃতির অন্য সব প্রাণীর অল্পবিস্তর উপস্থিতি থাকলেও সেখানে মানুষ বলতে আদম-হাওয়ার মতো আমরা দুজন। আদম ক্ষেতির দিকে না গিয়ে সোনিয়া বিরাট খাম থেকে সাদা-কালো ছবির নেগেটিভ বের করল একটা। অপারেশনের পরে করা এক্সরে। খাদ্য থলী বেষ্টন করে আছে একটা রিং। আমার কাছে তেমন বিশেষ কিছু মনে হল না। সব মেয়েই ক্লাউডিয়া সিফারের মতো কাপড় ঝোলানোর হ্যাঙ্গার হতে চায়। হয়তো আমার শরীরে চামড়ার নীচে হাড্ডি ছাড়া কোন মাংস নেই বলে; আমি নাদুস-নুদুস মেয়েই পছন্দ করি। আর সোনিয়া চিকন হওয়ার জন্য পাকস্থলীতে রিং পরেছে। একদিকে পোশাক ডিজাইনাররা সব মেয়েকে বলছে; তোমরা ক্লাউডিয়া সিফার হও। অন্যদিকে খাদ্য সরবরাহের কোম্পানি সব খাবারে মেশাচ্ছে চিনি আর ফেট। কসাইরা জবাই করার পশুকে খাওয়াচ্ছে দ্রুত বর্ধনশীল হরমোন। সেটাই মানুষ খাচ্ছে। খেয়ে মোটা হচ্ছে। চিকন হওয়ার জন্য থেরাপি বের করেছে ঔষধ কোম্পানি। সবাই কিছু করে খাচ্ছে। মানুষ গুলো যেন কোন গবেষণাগারের গিনিপিগ!
আগ্রহ কম দেখেই বোধ হয় বের করল আরো কয়েকটা ছবি। তার একটা আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলাম। একটা হেলিকপ্টারের নীচে দড়িতে ঝুলে আছে দুজন মানুষ। তার একজন হচ্ছে সোনিয়া।
তোমার এই অবস্থা কেন?
পরিবারের সবার সাথে পাহাড়ে উঠতে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলেছে। খবর পেয়ে এম্বুল্যন্স তো আর পাহাড়ে উঠতে পারে না, তাই পাঠিয়েছে হেলিকপ্টার।
আমি উঁচুতে উঠলে ভয় পাই। মই বেয়ে আমাদের ঘরের টিনের চালায় উঠে ছিলাম। পিছলে পরে গিয়ে হাত-পা ভাঙ্গে নাই, তবে ভয়টা পেয়েছিলাম ভীষণ। অনেক ছোট বেলার কথা। কিন্তু ভয়টা এখনো আছে। বললাম; আজ থেকে তোমার পাহাড়ে উঠা নিষেধ।
তুমি কে হে, আমি কোথায় উঠবো না উঠবো, তার আদেশ নিষেধ করার!
হয়তো কেউ না, কিন্তু তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখলে আমি ভয়ে মূর্ছা যাব।
সোনিয়া জড়িয়ে ধরল। আলতো করে চুমো খেল।
আমার জন্য কষ্ট হয় খুব? ফিসফিস করে বলল।
কষ্ট হবে কেন! এখন তো তুমি আমার সাথেই । কষ্ট পাব যদি ঐ পাহাড়ে উঠ। সেখানে তো আমি তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারব না। কারণ আমি উঁচুতে উঠতে ভয় পাই।
দুর বোকা! সে তো অনেক ছোটবেলার ছবি, আমার বাবা তুলে রেখেছেন। আমি কী আর এখন পাহাড়ে উঠতে পারবো!
যাক! একটা চিন্তা কমলো।
বুকের দিকে পেটের কাটা অংশটা দেখাল সে। একটু গভীর গোলাপী একটা রেখা। মনে হয় পেন্সিল দিয়ে এঁকে দিয়েছে কেউ। এর পেছনে আমি আর কোন ভয়ানাক কিছু খুঁজে পেলাম না। সব জার্মান ডাক্তারদের তেলেসমাতি কারবার।
মাথার কাছে ভন ভন করছে একটা মৌমাছি। খুব জোড়ে হাত নেড়ে তাড়াতে গিয়েও পারলাম না। হাতের বাতাস লেগে সেটা গিয়ে পড়ল ঘাসের উপর। স্যান্ডেল উঁচু করে সেটাকে এখন চ্যাপ্টা করতে এগিয়ে যাচ্ছি।
সোনিয়া ক্ষেপে গেল; মৌমাছিটা তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছে ! ওটাকে এমন করে মারতে যাচ্ছ!
তোমাকেই না কামড়ে দিতে চাইল? আমার অবাক প্রশ্ন।
তাই বলে ওকে মেরেই ফেলতে হবে? তাড়িয়ে দিয়েছ, ও চলে গেছে, ব্যাস। একটু বিরক্তই হল সোনিয়া।
মেয়েটাকে নিয়ে ভাল ঝামেলায় পড়লাম! এই এতটুকু একটা পোকা মারতে গিয়েছি, তাতেই এত ক্ষেপে গেলে তো মুস্কিল!
সেদিন তোমাকে হিন্দু বলায় এত ক্ষেপে গিয়েছিলে কেন?
প্রসঙ্গ পাল্টানোর মতো করে বললো সোনিয়া।
মৌমাছি মারতে গিয়ে তার ধমক খেয়ে একটু বিব্রতই ছিলাম। আলোচনার নতুন প্রসঙ্গ শুনে বিব্রত বোধ বিদ্রোহে পরিণত হল। কিন্তু ক্ষেপে গিয়ে লাভ হবে না, মাথা ঠাণ্ডা করে জবাব দিতে হবে।
কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি আমার ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ হচ্ছে পুরো ধর্মপ্রথার উপরে। বুদ্ধের কথাকে ধর্ম হিসাবে ধরলে, তার প্রতি কিছুটা পক্ষপাত হয়তো আছে। বাকী সব ধর্ম প্রায় একই নীতির কথা বলে। হিন্দু ধর্মের অনেক রীতা-নীতি বরং ভালই লাগে। সব চেয়ে ঘৃণা করি হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা। ভাগ্যের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাস করতে বললেও ইসলাম ধর্ম অন্তত কথার কথা হলেও বলে “সব মুসলমান ভাই”। আর হিন্দু ধর্ম এক অলীক বর্ণপ্রথায় বংশ পরম্পরায় মানুষকে অচ্ছুৎ করে রাখে। কোন সৎকর্ম কিংবা সেবা দিয়ে সেই হরিজন অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় নেই।
উপায়টা যেন আমারই নেই। এমনই মমতায় আমাকে বুকে জড়িয়ে আমার সব অচ্ছুততা শরীর থেকে মুছে দিয়ে নিষ্কাম চুমো দিল ঠোটে। অনেক উপর থেকে ঝাড়বাতি জ্বলছে আমাদের মাথার উপর। ধর্মের সদুপদেশের মতো যার কোন প্রভাব মানুষের উপরে নেই। অথচ কত কল্যাণ আর পরোপকারে বাণীতে পূর্ণ। সেই অযুত-নিযুত দূরের নীহারিকা উত্তাপ-আলোহীন উপস্থিতিই আমাদের একমাত্র ভরসা, হরিজনদের পরজনমে উচ্চতর বর্ণ নিয়ে জন্মানোর স্বপ্নের মতো।
তোমার দ্রোহটা আমি বুঝতে পারি। বলে চীৎ হয়ে আকাশের তারা দেখতে দেখতে বলতে লাগল আমার দিকে না তাকিয়েই সোনিয়া।
জানিনা বর্ণপ্রথায় এমন ভাবে মানুষকে কে বেঁধেছে! কিন্তু ভাল করে চারপাশে তাকালে এর প্রভাব থেকে আমরা যে কেউই মুক্ত নই সেটা বোঝা যায়। আমাদের এই গণতান্ত্রিক সমাজে কিন্তু বর্ণপ্রথা থেকে মুক্ত নয়। এই যে বিদেশী খেদাও আন্দোলন, তার ফলে দিনে দিনে বিদেশী এবং বিশেষ করে শরণার্থীদের প্রতি কঠোর আইন তৈরী হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে জনসংখ্যা প্রতিবছর কমছে। দুজন কর্মজীবী একজনের পেনশনের টাকা দিচ্ছে। যে হারে মানুষ পেনশনে যাচ্ছে এবং উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিতে তাদের বেঁচে থাকা দীর্ঘ হচ্ছে, তাতে একদিকে বেশী সময় যাবত পেনশন দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসার খরচও বাড়ছে। কিন্তু তা মেটানোর মতো জনবল দিনে দিনে কমছে। অথচ সেই মানুষ গুলোই বিদেশীদের প্রতি সবচেয়ে বেশী কঠোর।
সেতো গেল বিদেশীদের নিয়ে একপেশে রাজনীতি। এবার দেশের কথাই ধর। আমাদের সেকেলে পরিবার। সে জন্য আমরা তিন জেনারেশন এক ছাদের নীচে থাকি। জন্ম থেকেই আমরা প্রথমে ভাগ করি বয়স অনুযায়ী। তারপর তথাকথিত মেধা অনুযায়ী। চতুর্থ শ্রেণীর পর পঞ্চম শ্রেণী শুরু হয় মেধা অনুযায়ী তিনটি ভিন্ন স্কুলে। বাধ্যতামূলক অষ্টম শ্রেনীতে যায় তথাকথিত মেধার মাপে সবচেয়ে খাটো বাচ্চারা। এবং তাদের কমপক্ষে নব্বই জনের বাবা-মা ও বাধ্যতামূলক অষ্টম শ্রেনী পাস।
আমাদের ছেলে মেয়ে যাই হোক, আমরা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াব। কী এক অদ্ভুত কারণে মুখ থেকে এমন হাস্যকর কথা বের হল বুঝতে পারলাম না! অন্ধকার বলে সোনিয়ার মুখের বাঁকা হাসিটা দেখতে পারলাম না। কিন্তু হাসির শব্দটা পরিমিতই ছিল মনে হয়।
সম্মানিত বোধ করছি, তুমি আমাকে তোমার সন্তানের মা হবার যোগ্য মনে করছ শুনে।
মনে মনে ভাবলাম: কানা ছেলের পদ্মলোচন নামের মতো, যার সাথে ইউরোপের প্রথা অনুযায়ী তেমন কিছুই এখনো হয়নি, তাকেই সন্তানের মা বানিয়ে, সে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে এনেছি।
সোনিয়া তাড়াহুড়া করে কথা বলে না। কোন বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে একটু পরে থেমে আমার মুখের দিকে তাকায়, মুখ দেখতে না পেলে বা দেখে আলোচ্য বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে বিনা বুঝতে না পারলে আবার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নেয়; আমি আদোও শুনতে চাই কীনা? আমার মতো মনে যখন এসেছে তখন বলবই, শুনবে কীনা তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। এমন জোড় করে কথা বলে না সে। তাই মাঝে মাঝে কথার ফাঁকে একটু হা-হু করতে হয়। কিন্তু এত উন্নত সমাজ নিয়ে উচ্চ ধারণা যা ছিল কা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছিল তার কথায়। চুপচাপ ভাবছিলাম; আমার পড়ালেখা যে ভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে জার্মানে জন্ম হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বলতে গেলে অসম্ভবই ছিল। ওয়ান থেকে টুতে উঠতে গনিতে শূন্য পেয়েছিলাম। তারপরেও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসার আবদার রক্ষিত হয়েছিল। সিক্স থেকে এইট পর্যন্ত এসেছি পরীক্ষার ফল: ফেইল্ড ইন থ্রি সাবজেক্ট শুনে শুনে। নাইনে উঠে গায়ের জোড়ে বিজ্ঞান নিলাম। পড়ালেখায় ভাল কিছু বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। মূলত তাদের সহযোগীতায় আমার অতীতের ফেইল্ড ইন থ্রি সাবজেক্ট ইতিহাস হয়ে গেল। নাইন থেকে টেনে উঠলাম তথাকথিত মেধাবী ছেলেদের তুলনায় সামান্য কিছু নম্বর কম পেয়ে। প্রমোদ বাবু নিউটনের সূত্র এমন যৌক্তিক ভাবে বলতেন যে শুনেই মনে রাখতে পারতাম। আর ফাঁক-ফোকরে সাহস করে কিছু জিজ্ঞেসও করে ফেলতাম। ততোধিক উৎসাহ নিয়ে তিনি বোঝাতেন। আর আমি গিলতাম। যা কিছু শিখেছি, তা সেই সময়েই। এই সব ভাবনায় মগ্ন থাকায় আবার বক্তার বক্তব্যও শুনতে থাকায় এইবারে ঠিক জায়গায় কীর্তনে মন্দিরার টুকটাক-এর মতো হু-হা হয়নি।
কিন্তু একবার নিজে উদ্যোগী হলে মন্দ হয় না। আবার যুতসই প্রশ্ন না করলেও আগ্রহের বদলে নিজের বোকামিই প্রকাশ পায়। বললাম আমি তো শুনেছি; এখানে মায়েদের মাতৃ কালীন ছুটি আছে। ছুটির সময় মাতৃ সম্মানী বাবত কিছু টাকাও পাওয়া যায়। আর শিশুদের তো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া অব্দি শিশু ভাতা দেয়া হয়।
তা দেয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। ধর আমাদের বাচ্চা হল। তাতে সরকারী সব সুবিধি নিয়েও আমরা দুজন মিলে কাজ করলে যত আয় হত, তার সমান হবে না। এবং শ্রমিকের বেতন সব সময়ই শিক্ষিত চাকরিজীবীর তুল নায় কম। তুমি অন্তত এখনও শ্রমিক। কাজেই বেতন পাবে কম। বাচ্চা হলে বাসা সহ সব কিছুই বড় এবং বেশী বেশী লাগবে। একটি শিশুকে পূর্ণবয়স্ক করতে যত টাকা লাগে তা দিয়ে একটা ছোটখাটো বাড়ি কেনা যায়। আর অল্প আয়ের মানুষ সে টাকা রোজগার করতে বেশী সময় কাজ করতে হয়। কারণ একজন প্রকৌশলীর বেতন ঘণ্টায় ধর পঞ্চাশ টাকা। একজন শ্রমিকের বেতন সেখানে সর্বোচ্চ পনর টাকা। অথচ চাহিদা দুজনেরই সমান। শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে যা আয় করছে তাতে তার চাহিদা মিটছে না। সে কী করে? একটা পার্টটাইম কাজ করে। বাচ্চাটা সারাদিন কী করে কাঁটাল, সেটুকু শোনার সময়ও তার থাকে না। অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত লোকটা তার বাচ্চাকে বিছানায় নিয়ে কোন একটা বই থেকে পড়ে শোনাতে পারে না। আর বেছে বেছে যতসব সস্তা খাবার খেলনা কেনে। খাবার যত সস্তা তার ভেতর তত বেশী ফেট এবং চিনি। কাপড় যত সস্তা তার তুলা ততবেশী কীটনাশক পেয়েছে। খাবারটা পেয়েছে কীটনাশক। আর মাংস দেয়ার শুকরটা বেড়েছে বর্ধনশীল হরমোন নিয়ে। সে খাবার সেবন করা শিশুটি শারীরিক ভাবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমার মতো অতি বর্ধনশীল হলেও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে ততই পিছিয়ে থাকে। কারণ যতই বুদ্ধিমত্তা মস্তিষ্কের কৃতিত্ব হোক, তারও একটা সুস্থ- স্বাভাবিক শরীর দরকার।
মনে মনে বললাম; তাইলে হালায় যুদ্ধেই যমুনা। নিজের বংশ রক্ষার জন্য আমার পিতামহ সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন বলে ধরে নিলেও পিতামহের পিতার নামতো আমি কখনো শুনিনি। আমার সন্তানের সন্তান আমার নাম মনে রাখলেও তার সন্তান তো আর আমাকে স্মরণ করবে না। কী লাভ দুনিয়ায় মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে। যে সব জার্মানরা সন্তান নিচ্ছে না, তারা হয়তো আমার মতই ভাবছে। কিন্তু, এই সব বালখিল্য চেপে রেখে বললাম; তা হলে এই শ্রেণী ভেদের বাইরে কী মানুষ কখনো যেতে পারবে না!
অন্তত আমাদের জীবনে তা ঘটার সম্ভবনা নেই। দু’জন ভিখেরীও একজন কোন না কোন দিক থেকে অন্যের চেয়ে ভাল কিংবা বড়, এমনটা প্রমাণ করতে সদা ব্যস্ত। যদিও সেখানে তাদের শারীরিক অক্ষমতাই বেশী ভিক্ষা পাওয়ার পক্ষে যুতসই। তারপরেও তাদের মধ্যে তারা নিজেরাই কোন না কোন ভাবে অন্যের চেয়ে বড় এই নিয়ে অন্তত মনে মনে অহংকার করে। মানুষের শিক্ষা যত বেশী, বড় হওয়ার প্রতিযোগীটায় তারা তত সফল। এবং তাদের বড় হওয়ার প্রতিযোগীটাও তেমন চমকপ্রদ। যা দেখে, এটা যে আসলে বড় হওয়ার প্রতিযোগীতা মাত্র, তা তুমি ভুলে যাবে। তুমি যদি একজন হরিজন এবং খৃষ্টান ভিখেরীকে জিজ্ঞেস কর; কার ধর্ম সব থেকে বড়? সেই হরিজনই বর্ণ শ্রেনীতে সর্ব নিম্ন হয়েও তার জানা সব কথা দিয়ে হিন্দুধর্মকেই বড় এবং ভাল করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। যদি কখনো হরিজন বুঝতে পারে যে; এই সবই আসলে কোন মানুষের কল্পনা প্রসূত, আসলে ভগবান বলে কিছু নেই। তাহলে অতি অবশ্যই সে আত্মহত্যা অথবা বিদ্রোহ করবে। বিদ্রোহে তার জেতার কোন সম্ভবনা নেই। কারণ; বিদ্রোহে বিজয়ী হওয়ার মতো কোন শক্তি তার নেই। প্রাকৃতিক কিছু বিষয় বাদ দিলে, যা কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রায় সবই শক্তির বলে। গুনগত মানের কারণে নয়। কলোনিয়ালিজমের সময় ব্রিটিশরা বলত, বেঁচে থাকার জন্য তাদের জায়গা দরকার। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকার কারণে তারা অন্য জনপদ দখল করে নিজেদের দেশ বানিয়ে ফেলেছে। আমরা প্রতিবেশী সব দেশ এমন কী পৃথিবী পর্যন্ত দখল করতে চেয়েছি। তার সব কিছুই তখন সঠিক ছিল।
আসলেই গুরু বলে গেছেন সার্ভাইবেল অব দ্যা ফিটেষ্ট। এই বিষয়ে আমাদের আর আলোচনার কিছু ছিল না। প্রকৃতিই হয়ত মানুষের এই শ্রেণিবিভাগ করে দিয়েছে।
কিন্তু সোনিয়া ত্রস্তে না হলেও তল্পিতল্পা গোছাতে লেগে গেল। একটু অবাকই হলাম। এমন কিছু গভীর রাত হয়ে যায়নি। আমি কম্বল থেকে নেমে স্যান্ডেল খুঁজছি। সোনিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে বলল; চল সাতার কাটতে যাই।
পানির তাপমাত্রা দিনের বেলাই প্রখর সূর্যের তাপে আমাদের দেশের মতো গরম হয় না। কিন্তু শরীর ঠাণ্ডা হলে তীরে উঠে একটু রোদ পোহানে যায়। এবং বেশ আরাম দায়ক উপভোগ্য দেশে শীতের সকালে রোদে বসার মতো। কিন্তু এখন গভীর রাত না হলেও রাত কমপক্ষে এগারটা। তার উপরে অন্ধকার। ধেণুদিঘীর পারে এখন জনমানুষের চিণ্হ থাকার কথা নয়।
সেটাই প্যানপ্যান করে তাকে বললাম।
সে বলে কীনা! সেটাই তো মজা। শুধু তুমি আর আমি।
কথা ফেলে দেয়ার মতো নয়। কিন্তু অবস্থাটা আমাদের দেশে মাঘমাসের রাতে পানিতে নামার মতো। তাই বললাম; চল আজকে মানুষের শ্রেণী বিভাগ নিয়েই আলোচনা করি, কাল সাতার কাটতে যাবা একটু বেলা থাকতে গেলেই হবে। কী যে বল না! দিনের বেলায় মাদি হাতির মতো আমার শরীরটা দেখলে মানুষ মূর্ছা যাবে না! একটু শীত শীত লাগলেও সব দিক বিবেচনায় এখনই মঙ্গল।
বেত জাতীয় তন্তু দিয়ে তৈরী দেখতে অনেকটা ডুলার মতো ঝুড়িটা হাতে নিয়ে সোনিয়ার পেছনে হাঁটছি আর ভাবছি। সভ্যতাটা এত উন্নত যে বিয়ে না করে স্বেচ্ছায় ছেলে মেয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন=যাপন করে। প্রকাশ্য দিবালোকে আবালবৃদ্ধ-বণিতা উলঙ্গ হয়ে পাশা-পাশি শুয়ে থাকে। গিলে ফেলার প্রতিযোগিতা নিয়ে এক জন আর একজনের ঠোট চোষে। আর এই মেয়েটি গড়পড়তা জার্মানদের চেয়ে সামান্য মোটা যা আমার ভাল লাগে, এই কারণে এই উন্নত সমাজের উন্নত মানুষের সামনে যেতে সাহস পায় না। কী আজব সভ্যতা। আমার মনে হল; এখন এই শীতেই সে সব চেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। তাকে বিব্রত করা অন্যায়। শীতের কাপনিতে আমার মরার কোন সম্ভবনা নেই। তাছাড়া বিশ্ব তন্ন তন্ন করে একশ আটটা নীলপদ্ম আনার চেয়ে মাঘ মাসের শীতে জলে নামা অনেক সহজ।
কিন্তু পানিতে নেমে শরীরের তাপমাত্রার সাথে বীরত্বও কমতে লাগল! দাঁত-কপটি লাগার অবস্থা। সোনিয়ার পরামর্শ মত একটু বেশী করে হাত-পা নেড়ে সাঁতার কেটে মনে হল; শরীর আরো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমার অবস্থা দেখে বেচারি শেষ পর্যন্ত উঠে আসল পানি থেকে। সর্দি লেগে যেতে পারে, সেই ভয়ে অন্য দিনের তুলনায় একটু দ্রুত শেষ হল বিদায় পর্ব। আমিও শরীর গরম করার জন্য পা চালালাম। এতক্ষণে সবাই নাকডাকা শুরু করেছে হয়ত। কিন্তু করিডোর থেকেই দেখলাম; আমাদের ঘরে আলো জ্বলছে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে মানুষের জটলা। উত্তেজনার কারণ কিছু অনুমান করতে পারলাম না।
আমার এলার্ম ঘড়ি ঝুলিয়ে রেখেছি জানালার পাশে আমার দ্বিতল খাটের উপর। তার হিসাব মতে এখন রাত দুটো বেজে পনর মিনিট। আলোচ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে, বিশেষ করে ঋণাত্মক আলোচনা, হঠাৎ যেমন থেমে যায় সেভাবে সবাই একটু নীরব হয়ে গেল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার অনিশ্চয়তা আঁচ করেই যেন কথা বলল জাহিদ ভাই বিয়ারের বোতল টেবিলে রেখে;- বড় ভাইয়ের কীর্তি-কলাপ হুনসেননি তে? এবার সবাই আমার দিকে তাকাল যেন; এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা জানা-নাজানার উপর নির্ভর করছে আমার জ্ঞান-গরিমা। কিন্তু সত্যিই দুনিয়ার বিশেষ খোঁজ-খবর কিছু রাখতাম না। আমি আলোচনার বিষয় না, জেনে একটু স্বস্তি পেলেও; বড় ভাই কী করেছেন তা না জানার জন্য একটু অপরাধীই মনে হল নিজেকে। হয়তো তিনি বিশেষ কিছু ভাল কাজ করেছেন। যার জন্য বাঙ্গালী হিসাবে আমার গর্ব হওয়া উচিৎ। অনেকটা আমাদের শম্ভু মিত্রের মতো গলা। হয়তো ব্রেখটের কোন নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। আর আমরা তার যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারি নাই। লোকটার কণ্ঠ শুনে, আমার কেবল নাটকেই তাঁকে বিশেষ মানায় বলে মনে হয়।
মাহবুব ভাই আইসিল সন্ধ্যায়। আমি খুব সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছি দেখে পরিস্থিতি হাল্কা করার জন্যই কথা শুরু করল নূরূদ্দীন। কিয়ের লাই আইয়ে এই হম্মদীর হুত হগলে বিদেশ! জসিমের আশ্চর্য বোধক বাক্যের পেছনেই আজকের আলোচ্য ব্যক্তির কীর্তির ইঙ্গিত বিদ্যমান। হয়তো তা, এতক্ষণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা হচ্ছিল। আমার কৌতূহল যেন বেড়ে গেল। কিন্তু তা প্রকাশ করার আগেই কথা বলতে শুরু করলেন জাহিদ ভাই।
দক্ষিণ জার্মানের বিখ্যাত দৈনিক সুদডয়েচে সাইতুঙ্গ নিয়ে এসেছিলেন মাহবুব ভাই। তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টের শিরোনাম ছিল গোলাপ মাফিয়া (রোজেন মাফিয়া)। মিউনিখে ফুল বিক্রি বৈধ। কিন্তু সবাই সে বৈধ ব্যবসার অনুমতি পায় না। জার্মানের গণতন্ত্র বেশ জটিল। প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদের নিজস্ব কিছু আইন আছে। কেন্দ্রের বা ফেডারেশনের আইনের বাইরে। অবশ্য ধর্মগ্রন্থের বাণীর মতো সাংবিধানিক আইনও জার্মানরা অনেক সময় বদল করে। যেমন এক সময় আইন ছিল, যে কোন মানুষ যখন-তখন জার্মানের যে কোন জায়গায় জাতায়ত-কাজ-বসবাস করতে পারবে। শরণার্থীদের সে আইনের বাইরে রেখে একটা নির্দিষ্ট এলাকায় এবং নির্দিষ্ট ঘরে বসবাসে বাধ্য করার জন্য সে আইন থেকে মানুষ শব্দটা প্রতিস্থাপিত করা হয় জার্মান দিয়ে। কিন্তু কমিউনিটি গুলো তাদের প্রয়োজন মতো আমাদের নির্দিষ্ট বাসস্থানগুলোতে ভাড়া যোগ করে দিল, মাথা পিছু তিনশ মার্ক। কাজ না করলে বা কাজের পারমিশন না থাকলে আমরা পাই খাবার প্যাকেট। মিউনিখে দেয়া হচ্ছে ক্যাশ টাকা। তেমনি ফুল বিক্রি এখানে অবৈধ। কিন্তু মিউনিখে অবৈধ নয়। তবে সাধারণ কাজের পারমিশন থাকলেও ফুল বিক্রির পারমিশন সবার নেই। যারা বৈধ ভাবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন তাঁরাই ফুল বিক্রির মতো স্বাধীন ব্যবসার অনুমতি পাবেন। যারা এখনো শরণার্থী তারা স্বাধীন ভাবে ব্যবসার অনুমতি পাবেন না। জার্মানদের বিদেশী এবং অভিবাসী আইন এমন জটিল যে; তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয় উকিলদের।
তো সেভাবে অনেকেই বৈধ ভাবে ফুল বিক্রি করে মিউনিখে। কাজটা আসলে অনেকটা ভিক্ষা করার মতো। রেষ্টুরেন্টে বিশেষ করে যুগল দেখলে মুখ কাঁচু-মাচু করে অবয়বে গরিবি একটা ভাব এনে ফুলটা যুগলদের মহিলা সদস্যের সামনে ধরা হয়। এবং এই সভ্য দেশে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং শোক থেকে আনন্দ পর্যন্ত একটাই কবিতা। আর তার নাম ফুল। তো ঐ সময়ে কেউ ফুল কেনে, কেউ কেনে না। কিন্তু রাত পার করে ঘরে ফেরে সবাই একটা ঈগল নিয়ে। ঈগল হল একশ মার্কের নোটের ছবিটা। ঈগলের লোভে যাদের ব্যবসার পারমিশন নেই তারাও বের হয়। পুলিশ ফুল নিয়ে যায়। কোন কোন দিন মারা-মারি না হলে বা করলে পুলিশ ফিরেও তাকায় না। বড়দিনের দু’সপ্তাহ আগে এবং পরে ফুল বিক্রির মতো কাজে বৈধ-অবৈধতা পুলিশ কখনো যাচাই-বাছাই করতে যায় না। বড় দিন উপলক্ষে মানুষের মনেও আমাদের রোজার মাসের মতো মায়া-দয়ায় পূর্ণ থাকে। সব মিলিয়ে আত্ম-অহংকার হীন মানুষের কাছে ফুল বিক্রি একটা ভাল আয়ের রাস্তা। এবং বৈধ কাজের চেয়ে ইনকাম বহুগুণ।
টাকা মধুর চেয়ে মিষ্টি। সেখানে মৌমাছি না আসাটাই অস্বাভাবিক। তো বড় ভাইদের লাগারে সেই স্বাভাবিক মৌমাছির নাম আজিম। আজিম আজিম পুরের মাস্তান। মিউনিখে এসে সে ফুল বিক্রেতাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা শুরু করল। তার পক্ষে বিপক্ষে দুটো দল হয়ে গেল। আজিমের বিরোধী দলের নেতা হচ্ছেন আমাদের আলোচ্য বড় ভাই। আমাদের সময়ে দেশে এমন একটা প্রবাদ ছিল; “কোন তরুণ একটা সভায় চেয়ারে বসে আছে এবং সেখানে অন্য কোন চেয়ার খালী নেই। দ্বিতীয় তরুণ চেয়ারে বসা তরুণকে গিয়ে প্রথমে জিজ্ঞেস করছে, ভাই আপনি কী মাস্তান? তরুণ জবাব দিল না। এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন; আপনার কোন ভাই কী মাস্তান? এবারও জবাব না। তৃতীয় প্রশ্ন; আপনার কোন বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কী কেউ মাস্তান? এবারও না। দড়ানো তরুণ বসা তরুণকে বলছে; এই খানকীর পোলা জায়গা ছাড়, যা। ফাও হিসাবে একটা ধাক্কা। এই শক্তের ভক্ত এবং নরমের যম নীতিতে আমরা বড় হয়েছি। কিন্তু তা আমরা কাজে লাগাতে পারি কেবল আমাদেরই বিরুদ্ধে। অন্য কোন দেশের কেউ আমাদের একবার মেরে দিলেও আমরা দ্বিতীয় বাঙ্গালীকে জানাই না। অনেক সময় আমাদের দেশীয় কারো উপরে প্রভাব খাটাতে আমরা ডাকি অন্য কোন দেশের বলশালী কাউকে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পাকিস্তানী বা ভারতীয়।
মিউনিখের আজিম প্রভাব খাঁটাতে বড় ভাইদের দলের কাউকে ধোলাই দিয়েছে। বড় ভাইয়েরা পাল্টা ধোলাই দিয়েছে আজিমকে একা পেয়ে। এমন ধোলাই দিয়েছে যে; জার্মান চিকিৎসকদের বিশেষজ্ঞ দলও আজিমকে বাঁচাতে পারে নাই। সে খবর নিশ্চিত হয়ে বড় ভাই মিউনিখ ছেড়ে পালেতেই আমাদের লাগারে এসেছিলেন। কিন্তু তেমন কোন লাভ হয়নি। জার্মান পুলিশ তাকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু মানুষটা কত স্বাভাবিক ছিল আমাদের সামনে!
মন্তব্য
কথা ছিল গত বই মেলায় ছাপা হবে তীর্থের কাক। কিন্তু আবার বাবা হওয়ার আনন্দযজ্ঞে তীর্থের কাক-কে অপেক্ষা করতে হল প্রায় ১ বছর। এখন লেখা শেষ কিন্তু সব এক পর্বে দিতে পারলাম না। আশা করি এই অনাকাঙ্খিত বিলম্ব ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সচল সমাজ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
প্রথমে বাবা হওয়ার অভিনন্দন নিন।
লেখা বরাবরের মত অনন্যসাধারন। ভাল লাগল লেখাটা শেষ হয়ে গেছে শুনে। বইমেলায় হয়তো নিজে গিয়ে কিনতে পারব না, তবে যেকোন ভাবে পুরোটা একসাথে পড়বার আশা রাখি
ধন্যবাদ বেচারাথেরিয়াম,
কামনা করি পুরোটা একসাথে পড়ার আশা যেন পূর্ণ হয়।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
কোন প্রকাশনী থেকে পাবো, জানাইয়েন ভাইয়া।
বাবা হওয়ার জন্য অভিনন্দন।
ভালো থাকুন খুব, বাবু এবং বাবুর মা-কে নিয়ে
-এস এম নিয়াজ মাওলা
শষ্যপর্ব থেকে বের করার আশা আছে। দেখা যাক কী হয়।
আপনিও ভাল থাকুন এস এম নিয়াজ মাওলা।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
১. অভিনন্দন
২.পড়তেছি
৩.দিতে থাকেন
অজ্ঞাতবাস
ধন্যবাদ সুমন ভাই।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
লেখা চলুক।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
চলছে পাণ্ডবদা।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
কিন্তু মানুষটা কত স্বাভাবিক ছিল আমাদের সামনে!
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
সেটাই অবাক করা বিষয় কবি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
প্রথম বাবা হবার অনুভূতি অনন্য, আপনাকে অভিনন্দন। আপনার বই দেখি কোনভাবে সংগ্রহ করা যায় কিনা, পুরোটা তাহলে একসাথেই পড়বো।
শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩
ধন্যবাদ শব্দ পথিক। আপনার নিকটা খুব পছন্দ হল।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই বহু দিন ধরেই ভাবছিলাম "তীর্থের কাকের" কি হলো? আগামী বই মেলার সময় টাতে দেশে যাবার ইচ্ছা আছে, বই মেলায় বেরুলে অবস্যই জানাবেন।
কিছুদিন আগে শাহরিয়ার কবিরের "হাত বাড়ালেই বন্ধু " বই টা পরছিলাম, কাকতালীয় ভাবে সেখানেও ওই জার্মানি তে রেস্টুরান্ট এ ফুল বিক্রির একটা ঘটনা ছিল
নতুন মন্তব্য করুন