তীর্থের কাক ৩৪

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: শুক্র, ১৫/১১/২০১৩ - ৪:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা মেয়ে কোন ছেলেকে পছন্দ করলে বা কোন ছেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করলে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বলার আগেই আশে-পাশের মানুষ সেটা টের পায়। আমরা যে ভাবে একজনের উপড়ে আরেক জন রাতে শুই, সে অবস্থায় অন্যের অগোচররে স্বপ্ন দেখাও অসম্ভব। আমার বিরহ গোপন থাকা সম্ভব নয়। কোন কাজে আসুক আর না আসুক, আমাদের যে কোন ব্যাপারে মাহবুব ভাই খোঁজ-খবর নিয়ে পরামর্শটাও দিয়ে যান। জ্বর-জাড়ি হলে রাতে কোন ঔষধের দোকান খোলা থাকে সেটা যেনে নিয়ে ওষুধটাও কিনে আনেন। আমার কাছে অনেক সময় তাঁর এই অবারিত সাহায্য একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়।

শনি-রবি ভাবী কাজে যান। পার্থ-পার্বণীকে নিয়ে মাহবুব ভাই চলে আসেন লাগারে। নতুন কাজ হওয়ার পরে শনি-রবি আমারও ছুটি। দুপুরটা কাটিয়ে সবাই কাজে গিয়ে মাহবুব ভাইয়ের হাত থেকে মুক্তি পেলেও আমি পেলাম না। আজকে মাহবুব ভাই এসে আমাকে পেলেন বিছানায়। দুপুর গড়িয়ে গেছে কখন! আপনি এখনো বিছানায়! জসিম মেকগোনাল্ডে কাজে যাবে বিকেল পাঁচটায়। অনিয়মিত কাজ হলেও তার জীবনে কিছুটা শৃঙ্খলা আছে। আর নিয়মিত কাজ করেও আমি চরম বিশৃঙ্খল। চায়ের জন্য জসিম রান্না ঘরে যাচ্ছিল, তাকে থামালেন মাহবুব ভাই। আমি চা-নাস্তা করে এসেছি; আমার জন্য আপনাদের কিছু করতে হবে না।
কাল রাতে মনে হয় অনেক রকমের অনেক মদ খেয়েছি। আহত রোগীর জ্বরের ঘোর কেটে গেলে ব্যথাটা যেমন ভাল করে টের পাওয়া যায়, আমার অবস্থা কিছুটা ঐ রকমেরই। মাহবুব ভাইকে দেখে কিছুটা প্রসন্নতার ভাব আনতে চেষ্টা করে টের পেলাম মাথা ব্যথাটা। ঠিক ঘাড়ের পেছন থেকে মনে হয় কেউ একটা ছুড়ি বসিয়ে দিয়েছে মাথায়। মাথাটা তুলতে গেলেই সেটা আরো একটু বিঁধে যাচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরে। আর ব্যথাটাও বাড়ছে। কিন্তু বাচ্চাদের সামনে কোন আগডুম-বাগডুম করা যাবে না। বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে এলাম।

আমি ভেবেছিলাম মাহবুব ভাই কাল রাতের সালিশ নিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু সে দিকে গেলেন না তিনি।
শোনেন কায়সার; বড়র পিরিতি বালির বাঁধ। দেবদাস ছিল জমিদারের ছেলে। জমিদারীর গল্প আমাকে শুনিয়ে কোন লাভ নাই। জমিদারের ছেলেরা, ইউরূপে শরণার্থী হতে আসে না। আপনার পেছনে নিশ্চয়ই কেউনা কেউ আছে; যারা অপেক্ষায় থকবে আপনি কবে টাকা পাঠাবেন। ইউরূপে আপনি শুধু একটি কারণে এসেছেন, আর সেটা হল টাকা। যে কয়দিন সময় পান, দু’হাতে কামান। টাকা নিয়ে দেশে গিয়ে প্রেম কইরেন, দেবদাস হইয়েন। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু এখানে আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য যেহেতু শুধু টাকা আয় করা। তাহলে ভালমতো সেটাই করেন। ইউরূপের কোন মানুষের কাছে আপনার এই কয় দিনের পরিচিত একটা মেয়ের জন্য দেবদাস হওটা কেউই বুঝতেও পারবে না।

আগে তিতা পাছে মিঠার মতো মাহবুব ভাই এই বিষয়ে আর তেমন কিছু বললেন না। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু সমস্যা হল; লাভা নির্গত হওয়ার একটা ছিদ্র কোথাও তৈরী হয়ে গেল। সোনিয়া ক্ষণে ক্ষণে এদিক ওদিক দিয়ে উঁকি দিতে লাগল। একবেলা খাওয়া হল মাহবুব ভাইয়ের কল্যাণে। আমার অনিয়মের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার ক্ষমতা অন্য সবার ছিল না। আমার যে দিন রান্না করার কথা সে দিন, আমি বাসায়ই ফিরি না । এভাবে কয়েক দিন যাওয়ার পরে আমাকে ভিন্ন করে দেয়া হল। বেঁচে গেলাম আমি। খেলে খেলাম, না খেলেও কোন ক্ষতি নেই। প্রথমে কয়েক দিন সকালে এসে ওদের পাতিল খালি করতাম। বিয়ার খেলে ক্ষিধে পায় অসহ্য রকমের। কে কী বলল না বলল বা কার কী ক্ষতি হবে না হবে, সে সব ভেবে দেখার উপায় থাকে না। কিন্তু এক সময় অন্যদের প্রতিবাদে তাও ভেবে দেখতে হয়। পরের দিন ভোরে কফি খেয়ে বাসায় ফিরি। বেশী করে চিনি দিয়ে কফি খেলে খিধেটা মরে যায়। রান্নাও করতাম মাঝে-মাঝে। কিন্তু আমার পাতিলের খাবার ঘরে পচে দুর্গন্ধ হওয়াতে সবাই মিলে পাতিলও ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। আমি এখন সম্পূর্ণ ঝামেলা মুক্ত মানুষ। কখনো রুটির ভাঁজে চকলেট দিয়ে খাই। কখনো সালামী বা ভূরষ্ট। এতো সুন্দর করে শুয়োরের মাংস খাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে যে; দেখলে হালাল-হারামের চিন্তা তো দূরের কথা সুয়োর গুলো আবর্জনায় থাকে, সেটাও মনে আসে না। ধর্মে বিশ্বাস না করলেও এই শুয়োরের মাংস খেতে অস্বস্তি হতো কারণ সুয়োর গুলো আবর্জনায় দেখেছিলাম ঢাকার গুলিস্তানে, কোন একটা পয়-নিষ্কাশনের নালা-নর্দমায়।

ভাবী মনে হয় আজকে খুব সকালে কাজে গেছেন। কারণ বিকেলের আগেই মাহবুব ভাই বের হয়ে গেলেন পার্থ-পার্বণীকে নিয়ে। বিঘত খানেক প্রশস্ত একটা আলমারির দরজা আমার জন্য বরাদ্দ। ব্যবস্থা থাকলেও আমি কখনো আলমারিতে তালা গালাই না। টাকা-পয়সা মানি বেগেই থাকে। তা ছাড়া মানুষকে পাহারা দিয়ে রাখা যায় না। অবিশ্বাসও কাউকে করতে পারি না। মহামূল্যবান এমন কিছু আমার নেইও। পাঁচ লিটারের ওয়াইন আর বেড সিক্সটি নাইনের বোতল ছাড়া কয়েকটা প্যান্ট-সার্ট। তাও রিলিফের পাওয়া। নভেম্বরের এই দিনে বিশেষ প্রয়োজনীয় কাপড় হল শীতের জ্যাকেট। বাইরে গেলে সেটা গায়েই থাকে। কী কারণে যেন আমার মনে হয় এখন কিছু পান করা দরকার। মেয়েটা বিরক্ত করছে খুব। অথচ মেয়ে লোক পায়ের জুতো বলেই যেনে এসেছি এত দিন। হঠাৎ করে এই মেয়েটি আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল কেন! দেশেও অনেক মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে তাদেরকে কখনো তা বলি নি বা বলার সুযোগ পায়নি। বললেই বা কী হতো? আর্থিক এবং সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ পরাধীন আমাদের দেশের মেয়েদের অনেক ভেবে চিন্তে প্রেমে সাড়া দিতে হয়। অর্থ-সামাজিক অবস্থা সেখানে অথবা সবখানে বিরাট একটা বিষয়। আমি চাইলেও অর্থ সংকট লুকানো কখনো সম্ভব ছিল না। মনে আছে চীন বাংলা মৈত্রী সেতু উদ্ভোদন করতে চীনা অতিথির সামনে ঢাকাকে সুন্দর করে তুলে ধরতে যাত্রা বাড়ির দিকে কিছু ভাঙ্গা-চূড়া এলাকা টিনের বেড়া দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন মহামতি এরশাদ। টিনের মতো কোন বেড়া দিয়ে আমার অভাব লুকানোর চেষ্টা করার অবস্থাও ছিল না। তা করা হয় নি কখনো। কিন্তু সোনিয়ার কাছে আমার কোন কিছু লুকোতে হয়নি। কোন এক অদ্ভুত কারণে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করেছিল।

অথবা প্রখর সূর্যের খরতাপের মতো ঝলমলে রূপে আমার চোখ ধাঁধিয়ে আসে বলে, সে রূপের দিকে তাকাতেই সাহস পাই না। গুণীর সামনে অন্য সব মানুষ যুক্তি সংগত কারণেই নির্গুণ। জীবনে নির্ভরশীল একমাত্র বন্ধু খুব গুণী হলে, তার সামনে নিজেকে মূর্খ হয়েই থাকতে হবে সারা জীবন। হয়তো এই ভাবনায় দেবীর দর্শন ছাড়া আর কিছু কামনা করে না ভক্ত। কী জানি মানুষ হিসাবে ভীরু বলে এই সব অতি জ্ঞানী-গুণী-ধনি মানুষকে এক রকম ভয়ই পাই আমি। হয়তো কোথাও আমিদের কী যেন মিল ছিল, কিংবা ছিল না। হয়তো এ জন্যই একে অন্যের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার কিছু দেয়ার আশায় হাত ধরে ছিলাম। আমার অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে হয়তো সে দেখিয়ে গেল, দেখ আমিও যেতে পারি।

কিন্তু এই অভাবনীয় পরিবর্তন আমার সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিল। এ যেন তীরে এসে তরী ডোবা কিংবা বিজয় নিশ্চিত এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। ওয়াইনের বোতলটা পাচ্ছি না। খুব বেশী ওয়াইন অবশ্য থাকার কথা নয়। হয় ফেলে দিয়েছে কেউ। কপাল ভাল বাইরের নিভু নিভু আলোতে কালো করে লেখা বেড সিক্সটি নাইন দেখা যাচ্ছে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানি। দেখি সে জলে সোনিয়ার স্মৃতিকে বিসর্জন দিতে পারি কীনা।

অসম্ভব রকমের প্রায় পচা ডিমের মতো গন্ধ। অথচ দেখতে কতো স্বচ্ছ! স্বাদটা চিরতার মতো তিতা! গলা দিয়ে নামছে যেন; অসাবধানে মুখে দেয়া অতি গরম লেবু চা। বাপরে কী করে খায় মানুষ এ সব! কিন্তু কেমন যেন এক অদ্ভুত আবেশে তাজা ফুলের মতো সতেজ লাগল নিজেকে। রাত হয়ে গেছে। জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে বের হয়ে গেলাম। মনের ভেতরের অন্ধকারের চেয়ে বাইরের অন্ধকার কষ্ট দেয় কম। আমার কোন উদ্দেশ্য নেই। কোন কিছু চাইবার নেই। কোন কিছুর সন্ধান নেই। আমি সিদ্ধি লাভ করেছি। আমি সাধু। দুনিয়ার মানুষ চাইলে আমার চরণ ধরতে পারে। আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ধাঁধানো আলো নিয়ে ছুটে আসা গাড়ি গুলো হর্ন বাজাচ্ছে এমন জোড়ে; যেন ঢাকার গুলিস্তান। হয়তো তাদের চলার এই একমাত্র পথ। তাই বলে আমি হেঁটে যাওয়া পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করতে পার না! কবে সাধুর চারণ ধূলি... বলে যে চিৎকার কর, সেই সাধুকে তার নিরুদ্দেশের পথে যেতে দাও না বাবা! এখন খালি তেষ্টা পায়, আর আমি ছিপি ছাড়া বোতলটার তিতা পানি গলায় ঢালি। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! মেয়েদের মতো কোমর বাঁকিয়ে আমাকে পাশে রেখে সাই করে চলে গেল সোনিয়ার গাড়িটা। ওটা ও ই তো ছিল! কিন্তু তাতে আমার আজ কিছুই আসে যায় না। দেবদাস বেঁচে থাকলে কত পার্বতী আসবে যাবে বলে নয়, বরং আমার সাধনা সিদ্ধ হয়েছে বলে। আমার ভেতরে কাম-ক্রোধ-লোভ-ভয় নেই। আহার-নিদ্রা এখনো একটু লাগে, এই যা। আর কিছু না। আমি আর কিছু চাই না। সে বাগানে পৌঁছলাম এতো ঝামেলা পোহায়ে, বাপরে! মানুষের কী যে পাওয়ার নেশা! গতি-পথ-ছায়া-ঝড়-বৃষ্টি। সব পেয়েই আবার অফসোস! অন্যায়। ভয়ানক অন্যায়। আমি চাইনি তবু পেয়েছি। সে পাওয়ার ঠেলাই এখনো সামলাতে পারছি না। আর তোমরা এখনো পাওয়ার চেষ্টাতেই আছো! থাক, বাবা, থাক তোমাদের চেষ্টা নিয়ে।

বাগানটার ভেতর দিয়ে সাধারণত মিঠু ভাবীদের বাসায় যাই। কেন জানি একজন মা, একটা বোন কিংবা কোন প্রিয়জনের কথা মনে হলে পা ঐ দিকেই চলে। কিন্তু আজ চলছে না। ঐ যে, আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই।

আধখানা চাঁদ! তারই আবার এতো ত্যাজ! আর একটু হলে মরুভূমির বালি ভেবে জলেই পরতাম গিয়ে। ভাগ্য ভাল। খালের ধারে লতা-গুল্মের ঝোপে পা পরতেই, তারা বালিতে গিয়ে মাথা নোয়াল, আর সাদা বালির মতো জলের তলে উঠলো ঢেউ। যাহ, বাবা বাঁচা গেল। বোতলটা খালী হয়ে গেলে এখান থেকে পানি ভরে নেব। জার্মানরা বলে বোতল অর্ধেক খালী? নাকী অর্ধেক ভরা? আশাবাদীরা বলে অর্ধেক ভরা। নিরাস বাদীরা বলে অর্ধেক খালী। মা বলেন কখনো “নেই” বলতে নেই। একদম না থাকলে বলবে অল্প আছে। সেই ভাবে বলতে গেলে আমার বোতলে এখনো অল্প জল আছে। কিন্তু আছে।
ব্যাড়াটা হয়েছে দেন্ধা রোশইন্যার দোকানের চায়ের মতো। লোকটা ভীষণ রকমের ভাল ছিল আমার কাছে। সারাদিনের বেচা-বিক্রি শেষ হলে চা বানাতো তার নিজের জন্য আর ওহেদ আলী বয়াতির জন্য। বয়াতির সাথে সব সময় একটা কাপড়ের থলে থাকত। তার ভেতরে দুটো কাঠের টুকরো। সেটাই বাজাত চায়ের পরিবেশক। কখনো গাঁজার কল্কী হাতে নেয়ার জন্য সে কাঠের টুকরো তুলে দিতেন আমার হাতে। আমি আগেই টান দিয়েছি, তালটা ধরতে কখনো কষ্ট হতো না। অনেক সময় গানটা শেষ হয়ে যেত আমার হাতে কাঠের টুকরা থাকতে থাকতে। তখন শেষের দিকে বয়াতি তাকাতেন আমার দিকে। তেহাই দিয়ে শেষ হবে গান। তেহাই-এর শেষ টোকাটাতে যেন আমি থামি, সেই ইশারা দিতেন।

খুসী হতাম চায়ের কাপে একটা চুমুক দিতে পারার আনন্দে। কারণ গাঁজা খেলে ভীষণ তেষ্টা পায়। ইচ্ছে করে রাজ্যের সব পানি পান করে ফেলি এক চুমোকে। এখনো এমন তৃষ্ণা। ইচ্ছে করে পৃথিবীর সব জল পান করে বিশ্বটাকে আমার বুকের মতো নিষ্কাম-অনুর্বর করে ফেলি। কিন্তু মরূদ্যানের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে লাভ কী! শত ধনীর ভাড়া মারা গেলেও, চতুর যারা তারা তো বেয়ে যাচ্ছেন কাম নদীতে। আমি শুধু ব্যর্থতাকে ব্যথা করে সন্ধান করে চলেছি আঁধার ঘরে দিবা-নিশি মানিক জ্বলার মতো কোন অলৌকিক মনের মানুষ। বয়াতি কৈশোরুর্ধো আমাকে তা গেয়ে শুনিয়েছেন। আমিই শুধু বুঝি নি।
মনে হয় এখন পেয়েছি। দিবা-নিশি হীন ক্ষণে তার ধাক্কায় কপাল তো একে বারে ফেটে গেল রে! হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখি গাছের গুড়ি। শরীরের শক্তি বুঝি ফুরিয়ে এলো! অসহায় আমি বললাম; হে বিরাট, হে মহান, হে অনন্ত, হে অসীম, হে দয়াময় তুমি আমাকে তার কাছে নিয়ে চল! কোন ঢেউ উঠল না জলে। কোন প্রতিধ্বনি হল না প্রার্থনার! অন্তর্যামী মনের কথা জানেন বলেই বোধ হয়। টের পেলাম পৃথিবী সত্যিই ঘুরছে। তার সাথে সম তালে ঘুরতে না পেরে শুয়ে পরলাম আমি। হাতের কাছে গ্রহ-নক্ষত্র। ছায়াপথের পথিক আমি পথ হারা।

মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রথম বলক উঠা ভাত জমাতেন একটা মাটির পাতিলে। রান্নার চুলার উপড়েই থাকতো হাড়িটা। নারকেলের অর্ধেক মালা কিনারের দিকে ছিদ্র করে বাঁশের কঞ্চি ঢুকিয়ে চামচের মতো ডুবানী দিয়ে আধা সেদ্ধ চাউল জমাতেন তাতে। হাড়ির ভাত রান্না হতো সপ্তাহের শেষে। নাম তার কাঞ্জির জাউ। খুব ঝাল মরিচ বাটা দিয়ে সবাই মিলে খেত। আমি পারতাম না। ঝাল খেতে পারতাম না। খেতাম ঝাল ছাড়া। তার ভেতরে একটা টক-কটু গন্ধ ছিল। সে গন্ধটা এখন পাচ্ছি। জসিমের রাধা ভাত ছড়িয়ে আছে আমার চারপাশে। তারই গন্ধ। বেড সিক্সটি নাইনের কোন রং না থাকায় তাকে বমির জন্য দায়ী করা যাচ্ছে না। এখানকার কুয়াশার বিন্দু বেশ বড়। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো। জ্যাকেট আর্দ্রতা রোধক। শরীর ভেজে নি। কিন্তু পায়ের দিকে জিন্সে পানি ঢুকেছে। শীতটা শুরু হয় হঠাৎ করে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। বৃষ্টি শীতের নিত্য সঙ্গী এখানে। মাটির পথ অতি অল্প বলে কাঁদাটা তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এখন আমি বেশ কাঁদা-মাটি মেখে কিছুটা লেজে গোবরে অবস্থা করে ফেলেছি। শীতের ভোরের মতো কুয়াশার পর্দাটা আছে এখনো। পাখির কোন কলরব নেই ভোরে।
জনমানবের কোলাহল শুনতে ভারী ইচ্ছে করে। বাড়ির পাশের পায়ে হাঁটার পথেই চলেছি। গুহাবাসীদের কোন কোন ঘরে এখনই আলো জ্বলছে। বেশী দূর দেখা যায় না। মনে হচ্ছে আলোর চেয়ে শব্দের গতি বেশী। কাকেরা ঝগড়া করছে। কাক তো আর পাখি নয়। তারা কাক। তাই তাদের ঝগড়া পাখির কিচির-মিচিরের মতো নয়। কা কা কা। আর একটু এগুতেই সেই গির্জার সমানের চত্বরটা চোখে পড়ল। তার উপর ছায়া দেয়া গাছটার ডাল কাল। একটা গাছে যত পাতা থাকা সম্ভব তার চেয়ে বেশী কাল কাক আর তাদের কা কা। হয়তো শেষ হয়েছে এ তীর্থের প্রসাদ বিতরণ। এখন অন্য কোন তীর্থের সন্ধানে যাওয়ার সলা-পরামর্শ করছে কাক গুলো। কাকেরা জার্মানদের মতো। খুব স্বাধীন এবং সে কারণে একাকী। কিন্তু কোথায় যেন একটা একতাও আছে। কাক গুলো সাধারণত একাই থাকে। অথচ এখন কী প্রাণবন্ত আলোচনা!

আমার আলোচনার কিছু নেই। কেউ নেই। চোখের পাতায় সোনিয়ার শেষ দিনটি। শুনেছি বিষও মিষ্টি হয়। হয়তো শেষ দিন বলেও সে দিনটি শুরু হয়ে ছিল এতো সুন্দর ভাবে।


মন্তব্য

তীরন্দাজ এর ছবি

পর্বটি পড়লাম। কখনো কখনো খুবই অসাধারণ লাগে, আবার কখনো কখনো রসভঙ্গ ঘটেঅতি অসাবধানতার প্রভাবে। অনেকটা শ্যাম্পেন আর চোলাইএর ঠোকাঠুকি। ....বকিগুলোও পড়তে হবে।

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তীরুদা। লেখাটা লিখতে হয়েছে একটু তাড়াহুড়া করে। তার প্রভাব তো থাকবেই। কিন্তু একটা বা দুটো লাইন কোড করে দিলে খুব উপকার হতো। আমার তো মনে হয় আমি সবই চোলাই লিখি। দুএকটা যায়গা হয়তো ঘটনাক্রমে ভাল হয়ে যায়। আর সেটা হয় আপনার পরামর্শে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

রাব্বানী এর ছবি

আপনাদের 'ছাড়াছাড়ি' কখন হল বুঝলাম না। রাতে ঠান্ডায় সাঁতার কাটার পর কখন কি হল?

এক লহমা এর ছবি

হ। চিন্তিত

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

পুতুল এর ছবি

রাব্বানী এবং এক লহমা ধন্যবাদ মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য।
ছাড়াছাড়িটা আমিও ঠিকমতো সেই মূর্হূতেই অনুধাবন করতে পারিনি। পথ চলতে গিয়ে ম্যানিব্যাগ হাড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তে টের পাওয়া যায় না। টের পাওয়া যায় প্রয়োজনের সময়। অন্তত বিচ্ছেদটা আমি সেভাবেই একটু পরে বুঝেছিলাম।

একটু ওস্তাদী করতে গিয়ে মনে হয় তাল কেটে গেছে। ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেই বোধ হয় ভাল করতাম। আমি ভাল করে ভেবে দেখব। পরের পর্বেই সম্ভবত শেষ হয়ে যাবে। আপনারা এতদিন সাথে থেকে উৎসাহ দিয়েছেন, সে জন্য ধন্যবাদ। আর অনুরোধ থাকবে শেষ পর্বে আপনাদের সমালোচনা এবং পরামর্শ গুলো জানানোর। যা আমার খুব কাজে লাগবে। শুভেচ্ছা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মেঘলা মানুষ এর ছবি

প্রশ্নটা আমারও, ছাড়াছাড়ি কখন হল?
প্রথমে ভেবেছি মিস করেছি, এরপর আবার আগের পর্বগুলোতে চোখ বুলালাম, পেলাম না।
তখন ভাবলাম, আগে হয়ত বলেছেন, আমি মিস করে গেছি।
এখন দেখি অনেকেই আমার মত খুঁজে পাচ্ছেন না।

শুভেচ্ছা হাসি

পুতুল এর ছবি

মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। প্রশ্নের জবাব উপড়ে দিয়েছি।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শাহীন হাসান এর ছবি

পড়লাম লেখাটা। অনেক পর্ব আমার পড়া হয় নি। মন্তব্য করাও সহজ নয়। পড়ছি ।

....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ কবি।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।