ওস্তাদজী-কে চা দেয়া হয়েছে। সাথে কয়েকটা বিস্কিট। তিনি শিক্ষার্থীর সুর সাধনা শোনার ফাঁকে ফাঁকে চায়ে চুমুক দিলেন বটে, কিন্তু বিস্কিট গুলো ছুঁয়েও দেখলেন না। যাবার সময় ছাত্রীকে বললেন; শুভ একটা কাগজ দাও। ওস্তাদজী কাগজ হাতে পেয়ে তার ভেতর বিস্কিট গুলো মুড়িয়ে নিলেন, রুমালে পয়সা বাঁধার মতো খুব যত্নে। মুখে একটা সহজ ভাব এনে বললেন; আমার মেয়েটার জন্য নিয়ে যাই, ও খুব খুশী হবে।
শুভর সংগীত সাধনায় প্রাকৃতিক বাঁধা হয়ে নেমে এল বন্যা। বায়া, তবলা ভেসে গেছে পানিতে। অতি আর্দ্রতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হারমোনিয়াম। কিন্তু গান শেখার আগ্রহ হারায়নি শুভ। পরিস্থিতি অনুকূল হলে ওস্তাদজীকে খুঁজে বেরিয়েছে সে। পাগলা রেল লাইনের এক বস্তিতে পাওয়া গেল গান পাগল সেই সুরের পাগলাকে। ডিঙ্গি নৌকার ছইয়ার মতো ছাপরায় মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। এই সব সুর পাগল মানুষকে সাধারণত কেউ সম্মান করে না। ছাপরায় থাকার সুবিধি হল; মাথা নত করেই সেখানে ঢুকতে হয়। নাম না জানা সেই ওস্তাদজীর শরীর খুব খারাপ। তার পরেও একজন শিক্ষার্থী তার খোঁজ নিতে এসেছে! এই আনন্দে ওঠে বসলেন। কথা দিলেন শরীর ভাল হলে যাবেন শুভকে গান শেখাতে।
ভাষা সংস্কৃতির বড় বাহক হলেও তাকে ধনী করে সেই ভাষার সুর ও বাণীর সম্মিলিত মালা। তা সেই সংস্কৃতির মানুষের গলায় পরিয়ে দেন গায়ক। গায়কদের হাতে সুর ও কথার ফুল তুলে মালা গাঁথা শিখিয়ে দেন ওস্তাদজী। তাঁরা ফলবতী বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের সংরক্ষণ না করলে ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচে না। আমার চিন্তা ভুলও হতে পারে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে এই সব মানুষদের প্রতি আমার একটা বড় দুর্বলতা আছে।
এই দূর প্রবাসে গান-বাজনা জানে এমন মানুষ খুব বিরল। কিন্তু আছে। সময় সুযোগ পেলে আনিস ভাইকে মাঝখানে বসিয়ে শুনি তাঁর গান। কখনো কোন অনুষ্ঠান হলে অন্য কোন শহর থেকে আমন্ত্রণ করে আনা হয় নতুন কোন গায়ক। সেভাবেই আসলেন দীপন ভাই। সৌখিন শিল্পী হিসাবে খুব সুন্দর গান করেন তিনি। সংগীত আতরের মতো। অনেক সময় গন্ধ শুঁকেই বলা যায় কী ফুলের আতর। সেই রকম একটা কিছু আছে দীপন ভাইয়ের গলায়। পরে জেনেছি তিনি রবিউল হোসেন নামে রাজশাহীর এক ওস্তাদজীর কাছে গান শিখেছেন। একই অঙ্গে অনেক রূপের মতো দীপন ভাই পড়ালেখায়ও খুব ভাল। আমি বলি, আরে ভাই; রাখেন আপনার বুয়েট-ফুয়েট ইঞ্জিনিয়ার। সব বাদ দিয়ে কেবল গান করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীত করেন।
বেশ কিছুদিন পরে দীপন ভাই বাংলাদেশ থেকে আসা একজন তবলা বাদকের খবর দিলেন। অনুষ্ঠান আউগসবুর্গ শহরে। তবলায় কিছুদিন তে-রে-কে-টে শিখেছিলাম কোলকাতার এক ওস্তাদজীর কাছে। দেশের একজন আসবেন অন্তত তাঁর বাজনা শুনি। এখানে বছরে যে ক’বার উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর হয়, ব্যতিক্রমহীন ভাবে শিল্পীরা সবাই কোলকাতার। আমার তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। বাঙ্গালী বলে কথা। কিন্তু ঢাকার একজন আসছেন! কেমন জানি একটা ছোটলোকি পক্ষপাত ঢুকে গেল ভেতরে। বাজালেন সুনীলদার সাথে। সুনীলদা নিখিল ব্যানর্জীর সুযোগ্য শিষ্য। কায়দা, রেলা বাজানোর তেমন তাড়া দেখলাম না। কিন্তু প্রতি আবর্তেই ঠেকাটা নতুন। অথবা কম বুঝি বলে আমার কাছে নতুন মনে হল। খুব ভাল লাগল। পরে জানলাম ইনি ওস্তাদ রবিউল হোসেনের ছেলে স্বরূপ হোসেন। পরে একটা দিনের জন্য তাঁর সাথে বসার সুযোগ পেলাম। বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওস্তাদ জাকির হোসেনের সাথে এক মঞ্চে বাজিয়েছেন। হয়তো সে জন্যই কোন অহংকার নেই ভেতরে।
খবর পেলাম এ বছর ওস্তাদ রবিউল হোসেন আসছেন জার্মানিতে। শুনলাম মিউনিখেও একটা অনুষ্ঠান হবে। খুশী হয়ে গেলাম। আঁচলের ভাল নাম পূরবী। অন্নপ্রাশনে পূরবী রাগ বাজিয়ে শুনিয়েছেন সুনীলদা। এবার ওস্তাদ রবিউল হোসেনকে অনুরোধ করব চারুকেশী রাগ শোনাবার। চারু-র বয়স তখন দুই মাস। শোনার ব্যাপারটা শুরু হয় মায়ের পেটে। বড় হয়ে মেয়েরা কী করবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কিন্তু এখন আমাদের ঐশ্বর্যের কিছুটা শুনিয়ে দেই।
এর মধ্যে আনিস ভাই একটু উশখুশ শুরু করল। তাঁর কাজ একটু বেশী হয়ে গেছে। আমি ব-কলম। তাঁর কাজে কোন প্রকার সহায়তা করার যোগ্যতা আমার নেই। তাও জানতে চাইলাম; কী কাজ? তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের একজন। বহু ঝামেলা। আমি শুধু চাঁদাটাই দেই। দাপ্তরিক কাজ জানিও না, করতেও হয় না। সেটা করেন আনিস ভাই। একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং বক্তব্য লিখতে হবে জার্মান ভাষায়। তাও আমার পক্ষে অসম্ভব। শেষ কাজটা হল বাংলায় একটা মানপত্র লেখা। ওস্তাদ রবিউল হোসেনকে মানপত্র দেবে মিউনিখ বাসী বাঙ্গালীরা। মানপত্র কবে লিখেছিলাম মনে নেই। তাও বাংলা ভাষায় লিখতে হবে শুনে সাহস করে বললাম; আপনি চাইলে মানপত্রটা লেখার দায়ীত্ব নিতে পারি। লিখে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব। ঠিকমতো সাজিয়ে কাজ চালাতে পারবেন হয়তো।
ওস্তাদ রবিউল হোসেনকে সম্মান জানাতে লিখেছিলাম ;
“নাদ ব্রহ্ম” দু"শব্দের ছোট্ট এই সংস্কৃত বাক্যটির বাংলা; সুর থেকে সৃষ্টি। অবশ্য পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায়; সৃষ্টির শুরু শব্দ থেকে। আদি ফাউষ্টে গোথেও (সৃষ্টির) শুরুতে শব্দের কথাই বলেছেন। যদিও তাঁর মতে শব্দ মানে ঐশ্বরিক বাণী। আমাদের পূর্ব পুরুষরা “ব্রাহ্ম” বলতে শুধু পৃথিবী নয়, বুঝিয়েছেন তাদের জানা ও দেখা চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা। আর এই সব কিছুর আদি বা শুরু শব্দ দিয়ে।
পরিচিত বর্ণ বিন্যাস করে কাব্য রচনা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। শব্দ বা ধ্বনিকে সুরের মায়াজালে জড়িয়ে গীত পরিবেশনও ধ্বনি বাহক সবাই পারে না। সৃষ্টি সুখের উল্লাস সে জন্যই মাত্র গুটি কয়েক মানুষ করতে পারছেন এবং পেরেছেন। শব্দকে সুর এবং সংগীতে প্রাণ দিতে পারা সে মহা পুরুষদের নাম আমরা চাইলেও মুছে ফেলতে পারব না। যেমন পারবনা আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ বা ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেনকে মুছে ফেলতে।
শিল্প বা সৃজনী শক্তি অর্পিত, অর্জিত এমনকি আরাধ্যও নয়। বরং সহজাত। কিন্তু সেই সহজাত শিল্প-সৃষ্টির শক্তি নিয়ে জন্মালেই শুধু শিল্পী হওয়া যায় না। সাধনা দিয়ে তাকে পূর্ণ করতে হয়। বলাই বাহুল্য; সে সাধনা সহজ কখনো ছিল না। পূর্ণ এবং অর্ধ বা শুদ্ধ এবং অশুদ্ধ মিলিয়ে বারটি সুর গাইতে পাঁচ বছর লাগে, যদি দৈনিক আট ঘণ্টা করে রেওয়াজ করে। এ তো গেল কেবল সংগীতের বর্ণমালা শেখার পালা। তার পর শুরু হয় সংগীতের আরাধনা। মরহুম ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন তাঁর সুযোগ্য সন্তান ওস্তাদ রবিউল হোসেনকে এই কঠোর ব্রতে উৎসাহী করতে পেরেছিলেন। আজকে ওস্তাদ রবিউল হোসেন একটি সংগীত আদর্শের নাম।
সব শিল্পেরই একটি অসাম্প্রদায়িক আবহ থাকে। মানুষ এক সময়, হয়তো প্রয়োজনেই সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আজকে সম্প্রদায় সৃষ্টির অবতারের চাইতে মানুষে মানুষে বন্ধুত্বের সেতুস্থাপক স্থপতির প্রয়োজন বেশী। সাম্প্রদায়িক অসুর যেন আজকের এই তথ্য প্রযুক্তির যুগেও মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তার বিরুদ্ধে সুরের অমোঘ বাণীর চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। আপনি তা প্রয়োগ করে চলেছেন ওস্তাদ রবিউল হোসেন।
সংগীতে দুনিয়ার সব ভাষার সব মানুষ আমাদের জানা বারটি সুরই ব্যবহার করে। সংগীতে, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সংগীতে ভাষার চেয়ে সুর প্রধান। যোগাযোগের এই বৈপ্লবিক পর্যায়েও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের ভেতরে অবিশ্বাস আর সন্দেহ রূপ নিয়েছে হানাহানিতে। শত রাগিণীর আনন্দ মেঘে ভেসে ভেসে আপনি তাদের কাছে শান্তির বারতা পৌঁছে দিচ্ছেন দেশ দেশান্তরে। আপনি শান্তির দূত ওস্তাদ রবিউল হোসেন।
কেউ মহৎ হয়ে জন্মায়, কেউ মহত্ত্ব অর্জন করে, কারো উপড়ে মহত্ত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়। সুন্দরকে অলংকার পরাতে গেলে; বাহুল্যের আড়ালে ঢাকা পরে। নক্ষত্রকে জ্বালাবার জন্য বাড়তি আগুনের প্রয়োজন হয় না। আপন মহিমায় প্রজ্বলিত বাতিঘর আমাদের খুব বেশী নেই। নেই অনির্বাণ শিখায় উদ্ভাসিত দ্রোহ। ক্ষণস্থায়ী অসংখ্য স্ফুরণের পেছনে আমাদের শুকতারা আপনি “ওস্তাদ রবিউল হোসেন”।
লিখে একটু উৎকণ্ঠিত ছিলাম। ভয় ছিল; প্রচলিত অর্থে মানপত্র তো হয়নি। কী ভাববে সবাই। অনুষ্ঠান শুরু হল রাগ বসন্ত দিয়ে। সূর্য পাটে। এক চিলতে এপ্রিল বৃষ্টি। ক্ষণিকের রংধনু মিউনিখের রক্তাভ আকাশে। বাংলার মাঠ থেকে ঘরে ফেরা রাখালের বাঁশীর মতো কণ্ঠের সুরে ফিরে গেলাম সেই আমার বাংলাদেশের শেষ বসন্তে। দীপন ভাইয়ের হারমোনিয়াম ধরে রেখেছে সুরটা। বাইপাস অস্ত্রোপচার হয়েছে ওস্তাদজীর। হয়তো সে জন্যই আলাপটা বেশী করলেন না। ওস্তাদজী মনে করেন; “লোক সংগীতের গর্ভে উচ্চাঙ্গ সংগীতের জন্ম।“ দাদরায় কয়েকটা লোক সংগীত শুনলাম। দীপন ভাই অন্তরাটা শেষ করলে যেখানে স্থায়ী হবার কথা সেখানে ওস্তাদজী গানটা যে রাগাশ্রয়ী, সে রাগে দাদরা করেন। হয়তো খেয়াল করে খেয়াল শোনার শ্রোতা আমরা ছিলাম না।
অনুষ্ঠান শেষ হল আলোর ঝলক দিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার মতো। হয়তো ওস্তাদজীর স্বাস্থ্যগত অবস্থার জন্য। শুরু হল ভাবীদের ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া। অনুষ্ঠানের তারিখ ও স্থানের কথা নিশ্চিত ছিলাম না বলে সপরিবারে যেতে পারিনি মিউনিখে।
কিন্তু আউগসবুর্গে আমন্ত্রণ পেলাম ডাক-তার ও তরিৎপত্রে। মাহবুব ভাইকে নিশ্চিত করলাম; আমরা আসছি। খেয়াল শোনার মতো দর্শক-শ্রোতা সেখানে তেমন ছিল না। পার্বণী পিয়ানোতে একটা ইউরোপিয়ান ক্লাসিক বাজাচ্ছিল। ওস্তাদজী তার কাছাকাছি রাগটা গেয়ে শোনালেন। আমার কাছে ফারাকটা পরিষ্কার হল না। হয়তো সাথে স্বরূপ ভাইয়ের তবলা থাকায় আমি খেই হারিয়ে দুটোতে মিলে-মিশে যে নতুন রং হল, তাতে এতই মুগ্ধ ছিলাম যে; হাত তালি শুনে বুঝলাম অনুষ্ঠান শেষ।
আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীতে নতুন কিছু যোগ করবার নেই। যে ঐশ্বর্য ভাণ্ডার আমাদের পূর্বপুরুষরা রেখে গেছেন; তা ঠিকমতো গাইতে বা বাজাতে পারলেই যথেষ্ট, বলেন; স্বরূপ ভাই। কী ঐশ্বর্য তা আমার পক্ষে দেখা সম্ভব হয় নি। কখনো হবে বলে মনে ও করি না। কিন্তু যারা প্রায় কোন প্রকার লাভের আশা নেই জেনেও সেই ছায়াপথের পথিক হন তাদেরকে খুব শ্রদ্ধা করি। কেমন যেন স্বর্গীয় কিছু তাঁর কাছে আছে বলে আমার মনে হয়। চারু-কে চারুকেশী রাগ শোনানোর অনুরোধ আমি আর করিনি। ওস্তাদজী কোলে নিয়েছেন চারুকে। সেই স্মৃতিটুকু ধরে রাখলাম। তিনি আমন্ত্রণ জানালেন; দেশে আসলে রাজশাহী এসো। গাড়িতে হারমোনিয়াম তবলা তুলছেন দীপন ভাই আর স্বরূপ ভাই। আমি ওস্তাদজীর আমন্ত্রণে মুগ্ধ। যেখানে প্রতিদিন গানের মেলা হয় সবাই মিলে সেই পরিবেশে কাটিয়ে আসব কিছু সময়। ওস্তাদজী কথা বলেন খুব আপনার হয়ে। হয়ত একটা সময় সব মানুষ পিতার দৃষ্টিতে দেখেন সবাইকে। অথবা তাঁর কাছে এমন কিছু আছে যে ঐশ্বর্য কখনো শেষ হবার আশংকা নেই। সেই অশেষ আলোর মায়াভরা চোখে স্মিত হেসে হাত নাড়লেন। আবার দেখা হবে, আমার বলা কথা তিনি শুনেন নি। তার আগেই চলে গেছে দীপন ভাইয়ের গাড়ি। কিন্তু এটাই তাঁর শেষ যাওয়া হবে ভাবিনি কখনো!
মন্তব্য
এরকম একটা স্মৃতি আমিও টেনে বেড়াচ্ছি । মনে হচ্ছে এইমাত্র ফ্রাঙ্কফুর্টের আসরটা শেষ হলো, তাকিয়ে দেখি তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। অনেক ভাল লাগলো, আবার কষ্টও পেলাম, "ওস্তাদ রবিউল হোসেন একটি সংগীত আদর্শের নাম।"
সুলিখিত শব্দস্বর । অনেক শুভেচ্ছা //
....................................
বোধহয় কারও জন্ম হয় না, জন্ম হয় মৃত্যুর !
নারায়ণগঞ্জের এই সঙ্গীত সম্মিলনীটা উদ্বোধন করেছিলেন ওস্তাদজী। আপনাদের অনুষ্ঠানগুলোর কথা আছে এখানে। এবং তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার দুর্ভাগ্য, উনার গান সামনাসামনি শোনার সুযোগ হয়নি। আমার সৌভাগ্য, স্বরূপ হোসেনের বাজানো আমি দেখেছি-শুনেছি।
অটঃ গানটা আপনার জীবনের অংশ নাকি আপনি সঙ্গীতের অংশ সেটা ভাবায়। সম্ভব হলে শুধু সঙ্গীতই করুন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আপনার লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। ওস্তাদজির অভাব কখনও পূরণ হবার নয়।
দীপন আমার মামা হন, শৈশবের অনেক কিছুর গুরু।
ওস্তাদজির মেয়ে উনার স্ত্রী, সেই সুবাদে উনাদের কে বেশ ভালভাবেই চিনি।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো, আমার দাদাগুরু রবিউল হোসেন সাহেবকে নিয়ে লেখার জন্য! উস্তাদ রবিউল হোসেন বা আমাদের ঘরের সবার পরম শ্রদ্ধেয় ওস্তাদজি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর পুত্রবৎ এবং সম্ভবত শ্রেষ্ঠ শিষ্য এস,এম, বাবর আলী সাহেবের কাছে শেখবার। বাবর ভাই আজ নেই। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে বাংলাদেশ এই জিনিয়াসকে হারায়। বাংলাদেশ কী হারিয়েছে তা জানে না কেউ। উনি একাধারে অসামান্য খেয়াল-শিল্পী এবং অতুলনীয় বাউল ও নজরুলগীতির গায়ক ছিলেন। আবার "তুমি রবে নীরবে" গেয়ে আমাদের কাঁদাতেন। সুপ্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে যান।
বাবর ভাই অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে এবং তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শিষ্য ছিলাম আমি। আজকাল অনেকেই কথায় কথায় গুরু পাল্টান। সঙ্গীত নয়, যশই তাদের কাম্য। এটা মার্গসংগীতের সহবত ও তহজীব এর বিপরীতধর্মী একটি কাজ। রীতি হচ্ছে গুরুই শিষ্যকে তাঁর গুরুর কাছে সমর্পণ করবেন। বাবর ভাই যখন ঢাকায় চলে এলেন তিনি বলেছিলেন এক সময় তিনি আমাকে ওস্তাদজির কাছে সমর্পণ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ এবং সৌভাগ্য আমার হয় নি মৃত্যুর নিষ্করুণ থাবার কারণে। আমি শুধু একবার বাবর ভাইয়ের একক সন্ধ্যায় ওস্তাদজির পদস্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ওস্তাদ রবিউল হোসেন সাহেবের তালিম ছিল ওস্তাদ সগীরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। তিনি উস্তাদ আমীর খাঁ সাহেবের সাথে নিয়মিত সারেঙ্গী বাজাতেন। সেই তালিমের সূত্রে আমীর খাঁ সাহেবের গায়কীর প্রভাব ওস্তাদ রবিউল হোসেন সাহেবের মাধ্যমে বাংলাদেশে পৌঁছে। এর সঙ্গে এস,এম, বাবর আলী সাহেব যোগ করেন ভীমসেনজি এবং রশিদজির স্টাইলের তারসপ্তকের পুকার। ওস্তাদজির সুসন্তান সলোক ভাই একজন অসামান্য সুকণ্ঠী শিল্পী এবং পিতার পরম্পরার সুযোগ্য বাহক। সলোক ভাইয়ের বেহাগে বাংলা খেয়াল শুনেছিলাম টি,ভিতে বহু আগে। এখন গলা আরো পরিণত হয়েছে। আমার সাথে অবশ্য ব্যক্তিগত পরিচয় নেই এঁদের কারোরই। দুঃখজনকভাবে বাবরভাইয়ের কোন ভালো রেকর্ডিং নেই। সলোক ভাইয়ের এই ভৈরবী ঠুমরীটি শুনুন।
http://www.youtube.com/watch?v=UCy--ZbxOhY
পরিশেষে “না ধা ব্রাহ্ম”- আপনার এই উদ্ধৃতিটি ভুল, এটা "নাদ ব্রহ্ম" হবার কথা। "ওস্তাদজ্বী" বানানটিও এডিট করুন।
____________________________
১৯৮৮ থেকে ৯০ পর্যন্ত ছিলাম রাজশাহীতে। সেই সময়ে আমার ওস্তাদজীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। এমন গুনী মানুষ অথচ কী ভীষন নিরহংকারী, সদালাপী--ভাবাই যায় না। আমাদের বাসায় বসেছিল ছোট একটা গানের আসর। সেইখানে ওস্তাদজী তাঁর গানের স্কুলের সেরা সবাইকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। রবীন্দ্র, নজরুল, পুরোনো দিনের গান, পল্লীগীতি হয়ে গজল---কত রকম গানের পশরা! সেই অনুষ্ঠানে ভয়ে ভয়ে একটু তবলা বাজিয়েছিলাম---আমার বাজনা শুনে, আর তবলা শেখার আগ্রহের কথা শুনে ওস্তাদজী তখনই বলেন তাঁর স্কুলে চলে আসতে। সেই থেকে আমি তাঁর গান্ডা-বাঁধা শিষ্য। টানা দুই বছর নিয়মিত গিয়েছি তাঁর হিন্দোল সাংস্কৃতিক সঙ্ঘে।দিনের পর দিন সেখানে তবলা বাজানো শেখা তার সাথে জমজমাট সব আড্ডা! যত সময় গিয়েছে তত বুঝতে পেরেছি ওস্তাদজীর মনটা কতটা উদার ছিল, কতটা প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনা লালন করতেন মনের মাঝে।
ওস্তাদজীর প্রয়ানে আমাদের দেশ কেবল একজন গুনী শিল্পী নয়, একজন দেবকোটির লোককে হারালো---
নতুন মন্তব্য করুন