বিরসা কাব্য। মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার উপন্যাস অবলম্বনে মাসুম রেজার লেখা নাটক। বিরসা মুণ্ডা নাটকের নায়ক। দেশ নাটকের প্রথম মঞ্চ নাটক। “কোথা থেকে কী করে এলাম” সেই প্রশ্নের জবাব জানার জন্য বিরসা মুণ্ডা এসেছে আমার কাছে। আমি হিন্দু ধর্মের পুরোহিত। মন্ত্র কী করে পড়তে হয় সেটা আমাকে বলে দিচ্ছেন তপন-দা। তিনি (তপন-দা) পথ নাটকের পক্ষের মানুষ। আমরাও পথ নাটক করি। কিন্তু মঞ্চ নাটকও করতে চাই। বিরসা কাব্য নাটক পথে করা আমার মতে অসম্ভব। তপন-দা ছাড়া দেশ নাটকের সবাই পথ এবং মঞ্চের পক্ষে। মঞ্চে নাটক না করলেও, সহযোগীতা করতে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি মন্ত্র বলে চলেছেন। আমি তাঁর মতো বলার চেষ্টা করছি।
এরশাদের পতন আসন্ন। টিকি রেখে মাথাটা কামিয়ে নিয়েছি। চরিত্রের সাথে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে আমি ধূতি পরে ঘুরে বেড়াই। রিহার্সেল করতে করতে করতে, বিরসা কাব্যের কাহিনী, সংলাপ দলের সবাই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে। ইংরেজদের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে হিন্দু জমিদার জঙ্গল দখলের জন্যও পেলেন ইংরেজ সৈন্য। তীর ধনুক নিয়ে মুণ্ডারা পরাজিত হবে এটাই স্বাভাবিক। অরণ্যের অধিকার সব সময় নির্ধারিত হয়েছে শক্তির তারতম্য দিয়ে। ন্যায়নীতি দিয়ে নয়।
মুণ্ডারা এখন কী ভাবে কোথায় থাকে আমি জানি না। হয়তো জানব না কখনো। কিন্তু এবার এরশাদের পতন অনিবার্য। আমাদের আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগে। আমরা গণতন্ত্র পাব। আমি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক দলের পক্ষে জড়ো হলাম প্রেস ক্লাবের সামনে। আমাদের বাঁ দিকে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী অবস্থান নিয়েছে। কোন এক ফাঁকে মুখ ফসকে বের হয়ে গেল “একাত্তরের হাতিয়ার”। গর্জন উঠল “নারায়ে তাকবীর”। গর্জনটা আসল জামাতিদের দিক থেকে। আল্লাহুআকবার বলে তাদের কেউ দাড়িয়ে গেছে। দেখে, ত্রস্তে ছুটা আসলেন নিশাত আপা। “থাম থাম, মিথুন, থাম”। আমরা অবস্থান নিয়ে বসেই ছিলাম। জামাতিরাও। একাত্তরের হাতিয়ার বলে দাড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি একাই। বাকী সবাই বসেই ছিল। তাদের বিব্রত মুখের দিকে তাকিয়ে আর নিশাত আপার ঠেলা খেয়ে আমিও বসে পড়লাম।
এক দফা এক দাবী, এরশাদ তুই এখন যাবি। এরশাদ পতনের সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। কিন্তু কোন অদ্ভুত কারণে বা অকারণে কে বা কাহারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলা করল। দোকানের ঝাঁপি বন্ধ হতে লাগল শাঁখারী বাজারে। খবর কী? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের দেশে নতুন নয়। এর কারণ বহু বিধ। ক্ষমতা, সম্পত্তির দখল, পাহাড়ের দখল। এর প্রতিবাদে আমরা বক্তৃতা-বিবৃতি দেই। অনেক সময় মিটিং-মিছিল করি। কিন্তু দাঙ্গাটা শেষ হয় না। এখানে দাঙ্গা শব্দটা ঠিক নয়। আসলে দাঙ্গা হয় পরস্পর বিরোধী দুটি কাছা-কাছি শক্তিধর দলের মধ্যে। হিন্দুরা পালানোর পথই পায় না। প্রতিরোধ তো পরের কথা। তারা এ দেশে আছে কারণে অকারণে বলির পাঠার মতো শুধু মার খেতে।
তার কারণ আমরা হয়তো সেটাই চাই। আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়েছি এবং পেয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছি, তা চলছে। আশা করি পাব। কী যেন নাম ছিল মেয়েটার! পাহাড়িদের দাবী নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল যে; মনে আছে মেয়েটির নাম। তার কোন হদিস পাওয়া গেলে আমাকে জানাবেন দয়া করে। তাকে নিয়ে আমরা অনেক লিখেছি, রাহেলার মতো। কিন্তু এক সময় ভুলেও গিয়েছি। আমাদের শান্তি দরকার। আমরা যে কোন মূল্যে শান্তি চাই। শান্তির জন্য, একাত্তরের হাতিয়ার শ্লোগানটাও যথায় তথায় দিতে পারি না। শান্তির জন্য আমরা দাউদ হায়দারকে রফতানি করে দিয়েছি। কী যেন লিখেছিল তসলিমা নাসরীন? লজ্জা? মনে পরেছে, লজ্জাই। তাকেও নির্বাসনে যেতে হয়েছে। তিনিও জায়গা বুঝে কীর্তন গাইতে পারেন নি।
এরশাদ বিদায় হওয়ার পরেই নির্বাচন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভাই। গ্রামে গিয়ে দেখি বিএনপির পক্ষে ভোটের অভাব নাই। নির্বাচনের আগের রাতে প্রচার বন্ধ। চেয়ারম্যানের অফিসে ডেকে আনা হল আমাদের বাজারের ধোপা রমেশ, নাপিত ভজন-কে। চেয়ারম্যান বাতেন শিকদার বললেন “একটা ভোটও যদি নৌকায় পরে, বুঝমু তোরা দিসত”। আমরা গিয়ে বলি; “হাল কইলাম শক্ত কিরা ধরিস”। তারা শ্যাম রাখবে না কূল রাখবে! তারা সেদিন অন্য কোথাও বেড়াতে যায়। যেখানে কেউ তাদের কাছে ভোট চাইতে আসবে না।
এই অবস্থা আজকের নয়। হয়তো আবহমান কালের। এক সময় আমরা তাদের ভোট আর গনি না। তার পরেও তাদের নিস্তার নেই। যুদ্ধাপরাধীর রায় হলেও প্রথম আক্রমণের স্বীকার হিন্দুরা। বিরোধী দল বলে; সরকারী দলের লোকেরা হামলা করে, দায় বিরোধী দলের উপর চাপাচ্ছে। সংবাদ পত্রে ছাপা হয়। সরকার কঠোর হয়। কিন্তু কেউ আর ধরা পরে না। কারো সাজা হয় না। সাজা হয়েছে ধোপা বিশ্বজিৎ হত্যার আসামীদের। সেখানে ফটো সাংবাদিকদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। ছবিতে এমন ভাবে কেপসুন করে আক্রমণকারীদের ঠিকুজী ছাপিয়েছে যে, হত্যার প্রমাণ হিসাবে খবরের কাজটাই যথেষ্ট। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে এখন আর আক্রমণকারীদের নাম, ধাম, ঠিকানা কিছুই ছাপা হচ্ছে না। এর মধ্যে প্রথম আলো ছাপিয়েছে ভোট দিতে যাওয়া হিন্দু মেয়েদের ছবি। এমন বিরল ঘটনা ছাপাতেই হয়। কী হাস্যকর! হিন্দুরা যাচ্ছে ভোট দিতে। এরা তো মানুষই না। ভোটার হয় কী করে!
একদল বলছে; সব দোষ সরকারের। সরকার বলছে; সব দোষ নির্বাচন বর্জনকারীদের। কলাম ছাপা হচ্ছে; আওয়ামী সন্ত্রাসের বিপক্ষে। কিন্তু বিচারের কথা কেউ বলছে না। গ্রেপ্তারের কথা পরে। হিন্দু মারা আমাদের দেশে কোন অপরাধের মধ্যেই পরে না। আমরা পোড়া-ভাঙ্গা ঘরের মানুষদের সাহায্য করি। শীত বস্ত্র বিতরণ করি। বিচারের কথা কেউ বলি না। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হীন ভাববে না এমন প্রজন্ম আশা করি। মানুষ কে মানুষের কর্ম দিয়ে বিচার করবে, ধর্ম দিয়ে নয়। এমন মহা মূল্যবান বাণী দিয়ে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সহ ধর্মীতা সহ মর্মীতা দিয়ে মুখে ফেনা তুলি।
শুধু বিচারটাই চাই না। আর দাঙ্গাও থামে না। হিন্দুদের জমি হচ্ছে শত্রু সম্পত্তি। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেলে সে সব জমি তো আমরাই ভোগ করি। পলিটিকাল কারেক্টন্যাস এর জন্য এই অমানবিক ঘটনার নিন্দা জানাই ঠিকই। কিন্তু জমি তো আর দোষ করে নাই। বিরসা মুণ্ডার বিচারে ফাঁসী হয়েছিল। কল্পনা চাকমা আশা করি অল্প নির্যাতনে মারা গেছে। হিন্দুদের নাম লিখলে ব্লগে জায়গা হবে না। বিরসা মুণ্ডা বা কল্পনা চাকমার মতো হিন্দুরা জমি রক্ষা করার জন্য যুদ্ধে নিহত হয় না। তারা নির্যাতিত বা নিহত হয় হিন্দু বলে।
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এই দেশে এখন মোসলমান ছাড়া কেউ নাই। যারা নির্যাতনের প্রতিবাদ করছে তাদের কথাগুলোরেও কেমন জানি মেকী মেকী লাগছে। বলতে হয় বলা টাইপ। ভেতরে কোথধাও যেন বিরাট একটা ফাঁকি থেকে যাচ্ছে।
স্বয়ম
অন্যধর্মের কাউকে অকারণে কষ্ট দিয়ে যে কোন অপার্থিব উপকার নেই -এই সহজ সত্যটা প্রচার না হলে এমনটা ঘটতেই থাকবে। পাঠ্যপুস্তকের একটা শক্তিশালী ভূমিকা নেয়া উচিত এই ব্যাপারে। আর, স্থাবর সম্পত্তির উপর লোভও একটা বড় কারণ। পানির দামে জায়গা-জমি-বাড়ি বিক্রি করে কেউ দেশান্তরী হবে-এটা ভাবতেই অনেক প্রতিবেশির(!) মনে শিহরণ জাগে
"শুধু বিচারটাই চাই না। আর দাঙ্গাও থামে না। হিন্দুদের জমি হচ্ছে শত্রু সম্পত্তি। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেলে সে সব জমি তো আমরাই ভোগ করি। পলিটিকাল কারেক্টন্যাস এর জন্য এই অমানবিক ঘটনার নিন্দা জানাই ঠিকই। কিন্তু জমি তো আর দোষ করে নাই। "
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখায়
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন