[সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেই দুই বোন দরজায় এসে দাঁড়ায়। আঁচল দরজা খুলতে পারে এবং সে কৃতিত্বের জন্য তাকেই কোলে নিতে হয় আগে । চারু হাত দুটো উঁচু করে আঁ আঁ করতে থাকে। কোলে নেই তাকেও। করপরেট খাটুনীতে বলহীন শরীর থাকে আরো দূর্বল। কিন্তু এই সুযোগ প্রতিদিন হয় না। বাসায় ফিরে দেখি বেশীর ভাগ দিন দুই বোন ঘুমিয়ে পরেছে। আঁচলের তিন বছর হওয়ার পরে আমাদের সংস্কৃতির অন্তত কিছুটা ছোঁয়া দিতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে। ভারতের পতাকাকে বাংলাদেশের ভেবে আঁচল বলে উঠল বাবা দেখ বাংলাদেশ। আয়োজকরা হায় হায় করে উঠলো আঁচল কথা বলেছে দেখে। সেখানে কথা বলা মানা। ধ্যান ভঙ্গ হয়। সেই থেকে মেয়েকে নিয়ে আর কোথাও যাওয়া হয় না। গত বছর এলো নাচের জন্য সোহিনী, গানের জন্য সুদক্ষিনা, আর তবলায় আমার গুরু। মেয়েকে নিয়ে যাব! এই আনন্দ-উত্তেজনা-ভয়-বিহবলতা এতদিন কোথায় ছিল! ইউরোপিয়ানরা এই সব কনসার্টে সাধারণত তাদের সব চেয়ে ভাল পোষাকটি পরে যায়। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগে। তাদের সংস্কৃতির প্রতি এটা এক ধরণের শ্রদ্ধা বলে মনে করি আমি। দুটো সংস্কৃতির সঙ্গেই আমার অল্প বিস্তর পরিচয় আছে। তাকে অভিজ্ঞতা বলে মেনে নিলে বলতে পারি; অন্তত আমাদের সংগীত তাদের চেয়ে ছোট নয় কোন অংশেই। কাজেই আমাদের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। এদিকে মেয়ের সব ভাল পোষাক ছোট হয়ে গেছে। কাজেই সেই নৃত্য-গীত সন্ধ্যায় যোগ দিতে মেয়ের জন্য নতুন পোষাক কিনতে হল। আমাকে ঢুকানো হল কুলুঙ্গি থেকে বের করা স্যুটের ভেতর। শীতের কারণে আমাদের দেশীয় পোষাক পরা গেল না।
গিয়ে দেখি দর্শক-শ্রোতাদের প্রায় সবাই পরিচিত। প্রথম পর্বে খেয়াল শুনলাম। দ্বিতীয় পর্বে শুরু হল কথক। নান্টু ভাই আমার এবং আঁচলের জন্য তাঁর পাশেই দুটো আসন রেখেছিলেন। তার একটায় বসে এতক্ষণ খেয়াল শুনেছি। সোহিনী দেবনাথ-এর নাচ শুরু হতেই মেয়ে এসে বসল আমার কোলে। সে কী ব্যস্ততা মেয়ের; বাবা ছবি তোল। ভক্তের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে উঠল স্বয়ং মা স্বরস্বতী। অনুষ্ঠানের শেষে সবাই মিলে গেলাম আনিস ভাইয়ের বাসায়। নৃত্য-গীত শিল্পীর সাথে আঁচল আনিস ভাইয়ের বাসায় যাবে, তাদের সাথে আনিস ভাইয়ের গাড়িতে করে। শিশু নিরাপত্তা আসন আমাদের গাড়ি থেকে খুলে লাগাতে হল আনিস ভাইয়ের গাড়িতে। সোহিনী আর সুদক্ষিণা বৌদীও আঁচলকে এমন কোলে-কাছে রাখল যে, মেয়ে মায়ের কাছেই যেতে চায় না।
সপ্তাহে বা মাসে দু’এক সন্ধ্যায় আমি আঁচলকে ঘুম পারাতে যাই। শুরুর দিকে “আঁচল ঘুমাল পাড়া জুড়াল, বর্গী এলো দেশে” গেলেই কাজ হতো। কিন্তু এখন গল্প বলতে হয়। গল্পের বই থেকে পড়ে শোনালে হবে না। সে গল্পে আবার আঁচলের পছন্দ মত চরিত্র থাকতে হবে।]
>বাবা, পাঁচটা গল্প বলতে হবে।
> না মা, পাঁচটা পারব না। একটা গল্প বলব।
> আচ্ছা বাবা, তিনটা গল্প বল।
> না মা, তিনটা পারব না। একটা বলব।
> ঠিক আছে বাবা। দুটো বলবে।
> মা, বাবা খুব ক্লান্ত। একটাই বলব।
> ঠিক আছে বাবা একটাই বল। জিজ্ঞেস কর, আঁচল কোন গল্পটা শুনবে?
আমি জিজ্ঞেস করি;
>আঁচল কোন গল্পটা শুনবে?
> ঐ যে, একটা রাজা আছে। একটা ডাইনী আছে। আর একটা সুন্দর ছেলে। আর একটা সুন্দর মেয়ে।
আমি শুধরে দেই;
>সুন্দরী মেয়ে।
>ঠিক আছে, সুন্দরী মেয়ে।
এক রাজ্যে প্রজারা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো।
>কেন বাবা?
সে রাজ্যে ছিল এক ডাইনী। ডাইনী মানুষ খেয়ে ফেলতো। প্রজাদের মনের ভয় তাড়াতে কী করা যায় কিছু ভেবে না পেয়ে রাজা জিজ্ঞেস করলেন মন্ত্রীকে;
>এখন উপায় কী মন্ত্রী?
মন্ত্রী ভেবে চিন্তে বললেন;
>মহারাজ, নাচ গানের আয়োজন করুন। প্রজারা একটু আনন্দ ফূর্তী করুক। এতে প্রজাদের মনের ভয় দূর হবে।
মহারাজ বললেন:
>আমিও তাই ভাবছিলাম, ঠিক আছে মন্ত্রীমহোদয় প্রাসাদে নাচ গানের আয়োজন করুন।
নৃত্য-গীত-বাদকের দল এলো। গান ধরেছে...
>বুল্টা কাকী (সুদক্ষীণা মান্নার ডাক নাম), বলে দিল আঁচল। এবার এলে কাকীমাকে মায়ের সুন্দর শাড়িটা দিয়ে দেব।
>আচ্ছা দিয়ে দিও।
তবলায় বেজে উঠল ধা...
>সুব্রত কাকু
ঝন ঝন শব্দে বেজে উঠল ঘুঙর।
>সোহিনী নাচ করছে বাবা। এবার এলে আমার লা-লা-লা জামাটা সোহিনীকে দিয়ে দেব।
লা-লা-লা জামা হচ্ছে আঁচলের প্রিয় ফ্রক।
>সুব্রত কাকুকে কিছু দেবে না মা?
> তোমার তবলা বাজানোর জামাটা সুব্রত কাকুকে দিয়ে দেব।
সবাই মুগ্ধ হয়ে গান-বাজনা শুনছে আর নাচ দেখছে।
নেচে নেচে সোহিনী ক্লান্ত হয়ে গেছে। সবাই হাত তালি দিচ্ছে। সোহিনী বাথরুমে ঢুকেছে।
>ওর পিসু ধরেছে বাবা।
আঁচল সব জানে।
সোহিনী বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে; দেখতে ঠিক ওরই মত একটা মেয়ে নাচ শুরু করেছে। এখন তাকে পালাতে হবে নইলে ডাইনীটা আজ ওকেই খাবে। রাজবাড়ির অনেক ঘর। কিন্তু সব ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক চেষ্টা করে খোলা পেল রান্না ঘরটা। সেখানে ঢুকে জুবুথুবু হয়ে সে বসে রাইল একটা কোণায়।
>বাবা, সোহিনী ভয় পায়নি।
>না মা, ভয় পায়নি।
এদিকে নাচ শেষ করে হাত তালি শুরু হতে সোহিনীর বেশে ডাইনীটা বেড়িয়ে পরল সত্যিকারের সোহিনীর খোঁজে। রান্না ঘরে সত্যিকারের সোহিনীকে দেখে খাওয়ার জন্য লাফ দিয়ে সাপ হয়ে গেল ডাইনীটা। নাচের পোশাকটা থলের মতো করে ধরে সাপটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে কাগজের পুটলীর মতো মুখটা বন্ধ করে ফেলে চিৎকার দিল সোহিনী;
>কে কোথায় আছ, জলদী আস, ডাইনীটা ধরে ফেলেছি।
সবাই এসে দেখে দড়ির মতো পেচিয়ে নড়ছে সাপটা সোহিনীর নাচের পোষাকের ভেতর।
রাজা আদেশ দিলেন রাজকুমারকে;
>কুমার যাও, এই সাপকে লোহার সিন্ধুকে ভরে রাজ্যের ত্রিসীমানার বাইরে ফেলে দিয়ে আস।
লোহার সিন্ধুকে সাপ ভরে সিন্ধুক তোলা হল ঘোড়ার গাড়িতে। রাজকুমার চালিয়ে দিল ঘোড়ার গাড়ি। সারা রাত গাড়ি চললো। এখন সকাল। সামনে বন। রাজ্যের সীমা শেষ হবে বনটা পার হলেই।
এমন সময় লোহার সিন্ধুক থেকে বের হয়ে আসতে লাগল কোন মেয়ের কান্না। ডাইনীটা তার বোকামী বুঝতে পেরেছে। ঐ মেয়েটাকা ও ভাবে খেতে যাওয়া ঠিক হয়নি। এখন নতুন কোন ফন্দি এঁটে রাজকুমারকে ভুলি-বালিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে প্রাসাদে। সে জন্য ডাইনীটা আবার সোহিনীর বেশ ধরে কাঁদছে।
রাজকুমার কৌতূহলী হয়ে তরবারী দিয়ে লোহার সিন্ধুক ভেঙ্গে দেখে সোহিনী বসে কাঁদছে। দ্বিধায় পড়ে গেল কুমার।
>কুমার ঐ ডাইনীটা যাদু-মন্ত্র করে আমাকে সাপ বানিয়ে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি প্রাসাদে ফিরে চলুন। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কুমার ভাবল; প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজ্য আর রাজ সিংহাসনের আমার কোন দরকার নেই। এই সুন্দরীকে নিয়ে আমি বনেই থেকে যাব।
(আঁচলের জন্য একটু বেশী নাটকীয় হয়ে গেল। বেচারী ঠিক বুঝতে পারছে না। তাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।)
বনের গাছ কেটে একটা ঘর বানাল। পাশে আগুন জ্বালাল, যাতে বাঘ-বাল্লুক আগুন দেখে পালিয়ে যায়। সেখানে সোহিনীকে রেখে গেল কিছু খাবার জোগাড় করতে। বনে অনেক রকমের ফল পাওয়া যায়। সে সেগুলোই নিল।
বাবা, বনে এর্ডবেয়ার পাওয়া যায়?
হ্যাঁ মা, এর্ডবেয়ার (স্ট্রোবেরি), আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, আরো অনেক ফল নিয়ে, আসার সময় ধরে আনল একটা খরগোস। আগুনে ঝলসে খরগোশটা খাওয়া যাবে। কিন্তু সে কথা এখনই সোহিনীকে বলবে না সে। খরগোশটা রেখে গেল আগুনের কাছে।
ফল গুলো সোহিনীর সামনে রাখল রাজকুমার। কিন্তু ফল দেখে সোহিনী তেমন আনন্দিত হল না। রাজকুমার ভাবল; এবার খরগোশটা দেখাই সোহিনীকে। এবার সে নিশ্চই খুশী হবে। কাছে গিয়ে সোহিনীর সামনে উঁচু করে ধরল সে খরগোশটা। আর অমনি সাপ হয়ে লাফ দিয়ে খরগোশটাকে কামড়ে ধরল সোহিনীর বেশ ধরে বসে থাকা ডাইনীটা। রাজকুমার খাপ থেকে তরবারি বের করে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেললো সাপটা। তারপর টুকরো গুলো আগুনে ফেলে দিল সে।
দিয়ে ভাবল; যাই, এখন প্রাসাদে গিয়ে সবাইকে বলতে হবে ডাইনীটা মরেছে।
>সোহিনীর কী হল বাবা?
>কী তুমি এখনো ঘুমাওনি!
শুভর ক্ষেপা কণ্ঠ।
>যাও তুমি কম্পিউটার দেখ গিয়ে।
ক্ষেপা কণ্ঠে আমাকে বিদেয় করে আঁচলকে ঘুম পাড়ানোর দায়ীত্ব নিয়েছে শুভ।
বসার ঘরে গিয়ে কম্পিউটার ছেড়ে অপেক্ষা করছি। শোবার ঘর থেকে ভেসে আসছে শুভর কণ্ঠে; আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে,,,,
মন্তব্য
পড়ে ভাল লাগল!
ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
কি সুন্দর গল্প!
আঁচল আর চারুর জন্য অঢেল শুভেচ্ছা। আপনাদের সব্বার জন্যই
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমার ছেলেটাকেও ঘুম পাড়ানোর জন্য প্রথমে গল্প তারপর গান গাওয়া লাগে।
আঁচলের জন্য অনেক শুভেচ্ছা। লেখাটা ভীষণ মিষ্টি!
-আনন্দময়ী মজুমদার
খুব ঝরঝরে গল্প। এক টানে পড়ে ফেললাম। অনেক ভাল লেগেছে।
-রায়হান শামীম
সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গেলাম আবার। খুব ভাল লেগেছে। আচলের জন্য শুভ কামনা।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত
অনেক সুন্দর।
পরতে ভালো লেগেছে।
ভালো থাকবেন পুতুল।
আপনার জন্য শুভকামনা।
----------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
ঘুমপাড়ানী গল্পের অংশটা বেশ মিষ্টি।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
নতুন মন্তব্য করুন