আমাদের মতো উদ্ভটতন্ত্রের দেশে আমনাগরিক একটা ফালতু বিষয়। এদের মূল্য কোনোকালেও ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। সেই উদ্ভটতন্ত্রের বিদঘুটে রেজিমে আবাল পাবলিকের কাছে সরকারি চিঠির মূল্য যাই হোক আসে যায় না, চিনির কেজি 60 টাকা, এটাই নিয়তি। আর এই নিয়তির কারণে আম পাবলিকের কথা এ সময় মোটেই সুমিষ্ট লাগবে না। সংস্কার প্রসত্দাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সরকারি দল চিঠি দিচ্ছে, বিরোধী দল উত্তর দিচ্ছে। প্রথমত, খেলাটা এগুচ্ছে ভালো। কিন' এরই ফাঁকে থেমে থেমে বিরতি দিয়ে সরকারের প্রধানমন্ত্রী পুরো সংস্কার প্রসত্দাবকে স্বভাবসুলভ এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন। বিরোধী দলের অজুহাত বা বাহানা বলে তিরস্কার করছেন। বিরোধী জোট ফাঁকফোকর দিয়ে রাজপথের আন্দোলন চাঙ্গা করার কৌশল করে যাচ্ছে। কিন' চৈত্রের খরতাপে আন্দোলন দানা বাঁধতে পারছে না। অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে। অথচ বাজার শুকোচ্ছে না। বাজার যথারীতি রসে টইটম্বুর। ভদ্দরনোকদের খাবার চাল 28 থেকে 30 টাকা। ওতে তেমন যায় আসে না ওদের। বেশুমার পয়সা বানানোর তৌফিক দিয়েছে মাবুদ পরওয়ারদিগার! ছোট লোকদের মোটা চালের দামও 22-এর ওপরে। বেশ, বেতন বাড়লে বাজারদর বাড়বে এটা তো শাস্ত্রের কথা! শাস্ত্র অলঙ্ঘনীয়। কয়েক লাখ লোকের বেতন বেড়েছিল বটে। বাড়েনি মাত্র কয়েক কোটির! হা হতোস্মি! এ দেশে এখন আর 'চাল-ডাল-তেলের দাম কমাতে হবে' স্লোগানটা শোনা যায় না। ওসব বড্ডো পুরোনো আর সেকেলে হয়ে গেছে। এক কেজি বা এক কিলো চিনির দাম 60 টাকা। এক দিনেই 54 থেকে 60। 54ই বা কেন? চিনির একটা অদ্ভুত লবণাক্ততা আছে। লবণ চিনিতে মিশালে কী হয় জানিনে। তবে চিনি যে মিসরির ছুরি তা বুঝতে আবাল পাবলিকের বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না।
গত সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ একবার গর্ব করে বলেছিলেন- 'আমি ইচ্ছা করলে 22 টাকা দরে চিনি খাওয়াতে পারি। কিন' তা করব না, কারণ তাতে করে আমার কয়েক লাখ কৃষক-শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে। ডজন খানেক চিনিকল বন্ধ হয়ে যাবে। শুনতে বেশ লাগে_22 টাকা! তোফায়েল আহমেদ 22 টাকা খাওয়াতে গিয়ে কয়েক লাখ কৃষক-শ্রমিককে বেকার না করেও 28 থেকে 30 টাকার মধ্যে চিনি খাইয়েছেন। কিন' এখন 60 কেন? আনত্দর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে? এই আনত্দর্জাতিক বাজারটা ঠিক কোথায় এবং কীভাবে সেখান থেকে পণ্য কিনতে হয় তা যেহেতু এ দেশের 80 ভাগ গরিব মানুষ ঠাওর করতে পারেন না সেহেতু সরকার ধরেই নিয়েছে, দেশের তামাম জনগণ ওসব ব্যাপার-স্যাপার বোঝেন না।
অবশ্যি সরকারের এমন মারহাবা চিনত্দার পেছনে কারণও আছে। গরিব বলি আর মধ্যবিত্ত বলি, আজকাল কেউই বাজারে হল্লা-চিল্লা করার মতো খুদগারি দেখাতে যান না। কারণ র্যাবাতঙ্ক! র্যাব শাসনের এমনই গুণ যে কোন বিষয়ে তারা মাথা ঘামাবে আর কোন বিষয়ে ঘামাবে না সেটা জানেন একমাত্র অনত্দর্যামী। বলা যায় না, কোনো এক গরিব চিনির, গুড়ের দর নিয়ে কষাকষি করলে নব্য মাসত্দান শ্রেণী (দোকানদার) ওকে টুক করে র্যাবের হাতে তুলে দিয়ে 'ক্রসফায়ারে' ফেলে দিতে পারে। আজকাল শোনা যাচ্ছে খানত্দাসী বউ তার স্বামীপ্রবরকে জব্দ করার জন্যও র্যাব নামক শব্দাবলি ব্যবহার করছে!
কেন কেবল কতিপয় সংস্থা বা কিছুসংখ্যক তালুকদার তাঁবেদাররা চিনি আমদানির মনোপলি করছে, কেন কিউবা-ব্রাজিল থেকে কেনা সসত্দা চিনি এ দেশে আসতে আসতে আক্রা হয়ে যাচ্ছে। সে প্রশ্নে যাবো না। ওটা বিদগ্ধজনদের কাজ। আমরা কেবল এতোটুকুই বুঝতে পারছি যে, সরকার নামক প্রশাসকগোষ্ঠী এখন তখতে-তাউসের পায়া-খাম্বা নিয়ে হিসেবে ব্যসত্দ। চিনি কেন 60? চাল কেন 30? ডাল কেন 56? কেরোসিন কেন 45 সেটা এখন আর সরকারের কোনো পৈত্রিক এজেন্ডা নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তালেব-ই-আলিমরা এখন রং বেরংয়ের মাইক্রোফোনে কথার বুননে ব্যসত্দ। হরেক চ্যানেল, হরেক মাইক্রোফোন, হরেক ব্যাখ্যা, অবশেষে একমাত্র সমাধান_ তুই কিনবি, তোর বাপ কিনবে! শুনতে বেশ শোনালো না? কিনতে পারছিস সেটাই কী তোর জন্য যথেষ্ট নয়? দাম নিয়ে হারিকিরি করতে চাস কেনরে বেজন্মা!
এমন এক মগের মুলুকে আমরা বাস করছি যেখানে তোমার আমার বানানো আইন তুমি-আমি মানব না, পরে তুমি-আমি মানার জন্য পত্রালাপ করবো, চিঠি চালাচালি করবো। আন্দোলন করবো, ঘেরাও করবো, হরতাল ধরনের কিছু একটা করবো, মানববন্ধন করবো, পুলিশ-র্যাব বন্ধন কিন' কিছুতেই সরকার বাহাদুরের গতরে ফুলের টোকাটি লাগবে না। কিছুতেই সরকারের সীসেঢালা কানে পানি ঢুকবে না। কিছুতেই বেকুব গরিবদের ধোঁকা কাটবে না। তারা কেবলই আম্মা-আপা-ভাইয়াদের হাত শক্তিশালী করার জন্য জিন্দাবাদ দিতেই থাকবে। বাজারদর নিয়ে এমন বেজন্মা কারবার এ দেশের 32 বছর বয়সে আর কখনো এমন ধন্বনত্দরী কায়দায় হয়নি। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা মাত্র কয়েকশ মানুষ পত্রালাপ করছেন। দাবি মানতে চাইছেন, আবার দাবি প্রত্যাখ্যান করছেন। এ যেন আধমরা ইঁদুর নিয়ে হুলো বেড়ালের খেলা! কিন' এর মধ্যে আমরা বেকুবরা একটা সহজ অঙ্ক কষে হিসাব বের করে ফেলেছি। চিনির কেজি 60 টাকা হলে সরকারের চিঠির দাম এক টাকাও নয়, কারণ এটা লিখতে, ছাড়তে, অস্বীকার করতে, তুড়িমেরে উড়িয়ে দিতে কোনো চিনিজাত মিষ্টতা দরকার হয় না! র্যাবজাত কঠোরতা দিয়ে ডলে দিলেই চলে। অতএব ডলন জিন্দাবাদ!!
মনজুরুল হক : কলাম লেখক।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন