নারী ও ইসলাম নিয়ে কথা উঠলেই কথা আসে হিজাবের। ইসলামে নারী ও পুরুষ সবাইকে পোষাকের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া আছে। কিন্তু কাজ ভেদে, খেলাধূলার ধরন ভেদে, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা ভেদে, ভৌগলিক অবস্থান ও অঞ্চল ভেদে পোষাক যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাল্টায়। যাতে ঐ বিশেষ সময়ে, বিশেষ অবস্থায় মানুষ তার ক্রিয়াকর্মের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারে। ইসলামে নারীর পোষাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ পোষাকের এই যৌক্তিক কার্যকারণগুলোকে মানে না। তাই এত বিতর্ক। অন্যান্য অনেক ধর্মেও নারীর পোষাক সম্পর্কে একরকম চাপিয়ে দেয়া আইন-কানুন আছে (মাদার তেরেসা বা তার অনুসারীদের পোষাক; মাথায় কাপড় ও লম্বা হাতার বস্নাউস দেখলে তাদেরকে মুসলিম পর্দানশীন মহিলাই মনে হয়)। সেসব ধর্মের নারীরা প্রতিবাদ করে ধর্মীয় রীতি-নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের জন্য স্বাধীনতা আদায় করে নিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল মুসলিম নারীসমাজ সেই অবস্থা এখনও অর্জন করতে পারেননি।
হিজাব শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ হাজাবা থেকে, যার অর্থ লুকানো। কোরানে হিজাব ছাড়াও 'জিলবাব' ও 'খিবার' এর কথাও আছে। কিন্তু ধর্মানুসরণ করে মুসলিম রমণীরা বিভিন্ন দেশে আরো বিভিন্ন রকমের পোষাক পরেন যা ধর্মের চেয়েও মূলত: তাদের সাংস্কৃতিক বা অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্যের বিষয়টিই তুলে ধরে। এ ধরনের পোষাক ও তার ছবি প্রায়শই বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় যে ছবিগুলো দেখলে নারীদের এক ধরনের কয়েদি বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, জেলখানার কয়েদিদের যেমন পরিচিতির সুবিধার্থে এক ধরনের পোষাক পড়তে বাধ্য করা হয় এসব নারীরাও সামাজিক ও ধর্মীয় নীতি-নির্দেশের কারণে একধরনের বিশেষ পোষাক পরতে বাধ্য। তো বিভিন্ন মুসলিম জন-প্রধান দেশে যেসব পোষাক পাওয়া যায় তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হলো। মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় দেখা যায়: হায়েক, সাফসারি, আখনিফ এবং আজার। মিশর, ইজরায়েল, সিরিয়া, ইরাক ও বেদুনদের মধ্যে দেখা যায়: আবায়া, তারনা, ইজার, মিলহাফা, খাবারা, চাম্বার, নিকাব, লিথাম, ও বোরকো। ইরানে দেখা যায়: বোরদা, চাদর, পিচা এবং রৌবন্ধ। তুরস্কে দেখা যায়: ইয়াচমেক, ইয়ালেক, হারমানিয়া, ও এনতারি। ভারত, পাকিসত্দান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, মালদ্বীপে দেখা যায়: বুরকা।
মুসলিম নারীদের মুক্তির সংগ্রামে এই পর্দাপ্রথা হয়ে উঠেছে দাসত্বের একটি প্রতীক। পুরম্নষ আধিপত্যের শেকল-চিহ্ন। মুসলিম রমণীরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন এসব প্রথার বিরম্নদ্ধে। 1923 সালে মিশরে প্রথম একটি প্রতিবাদ হয়, মিশরের ফেমিনিস্ট ইউনিয়নের প্রধান মিজ হুদার নেতৃত্বে। তিনি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে তাদের পর্দা ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। তুরস্কে হিজাবের বিরম্নদ্ধে সরকার থেকে লড়াই শুরু হয় 1927 সালে। তখন কমু্যনিস্ট সরকার ছিল ক্ষমতায়। সেসময়ই 87,000 মহিলা প্রকাশ্যে তাদের হিজাব ছুঁড়ে ফেলেদিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের সাথে শত্রুতা করার জন্য তাদের 300 জনকে হত্যা করা হয়েছিল। আফগানিসত্দানের স্বাধীনতা উৎসবে, 1928 সালে শাহ তার স্ত্রীকে জনসম্মুখে পর্দা ছাড়া উপস্থিত হতে বলেছিলেন। পরে মুসলিম মৌলবাদীর ক্রমাগত প্রতিবাদের মুখে নারী মুক্তির সব ধরনের প্রকল্প তাকে বাদ দিতে হয়েছিল। ক্ষমতাও ছাড়তে হয় তাকে। ইরানের রেজা শাহ 1936 সালে একটি বিশেষ আইন করে 'চাদর' পরা বন্ধের আদেশ দেন। কিন্তু সংস্কৃতির বিপক্ষে তার এই আদেশ জনপ্রিয়তা পায়নি এবং জনপ্রতিবাদের মুখে 1946 সালে তিনি আবার তা পুনর্বহাল করেন।
ইসলামে হিজাবের উৎপত্তির কারণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে কোরানে এ সংক্রানত্দ আয়াত গুলোর (33.53, 33.59, 33.32-33) মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো নীচের আয়াতটি (24:31):
And say to the believing women that they should lower their gaze and guard their modesty; that they should not display their beauty and ornaments except what (must ordinarily) appear thereof; that they should draw their veils over their bosoms and not display their beauty except to their husbands, their fathers, their husband's fathers, their sons, their husbands' sons, their brothers or their brothers' sons, or their sisters' sons, or their women, or the slaves whom their right hands possess, or male servants free of physical needs, or small children who have no sense of the shame of sex; and that they should not strike their feet in order to draw attention to their hidden ornaments. And O ye Believers! turn ye all together towards Allah, that ye may attain Bliss.
হিজাব, পর্দা ইত্যাদির চল এবং মুসলিম রমণীরা বাড়িতে থাকবেন এ ধরনের প্রথা ইসলামের মাধ্যমেই মক্কা-মদিনায় চালু হয়। সমসাময়িক বেদুইন মহিলারা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তারা তাদের স্বামীর সাথে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং নতুন জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে জীবন ধারনের কাজে একত্রে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু অন্যান্য সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রভাবে ইসলামেও বিভিন্ন পর্দা-প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে। হিজাব বা পর্দাপ্রথাটির বিষয়টি আরবরা গ্রহণ করে পারসিদের কাছ থেকে। মহিলাদের ঘরে থাকার আদেশটি আসে বাইজাইন্টাইন ঐতিহ্যের অনুকরণে, যারা মূলত: এটি পেয়েছিল একটি প্রাচীন গ্রিক প্রথা থেকে। অবশ্য মুসলিম ধর্মবেত্তারা অন্যভাবে এটিকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। সেসব বিসত্দারিত আলোচনা অনেকবার এই বস্নগে হয়েছে। আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য পর্দাপ্রথার সাথে জড়িত নারীর পরাধীনতার বিষয়টি।
পর্দা নারীর মুক্ত বিচরণকে রম্নদ্ধ করে দেয় এটি বলার অবকাশ রাখে না। যদিও মুসলিম রমণীদের অনেকে তাদের প্রয়োজনমত এসব নিয়মকানুনকে একটু মোচড়ে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। কিন্তু খুব একটা সরব প্রতিবাদে তার সহজে জড়াতে চান না। যদি প্রশ্ন উঠে যে মুসলিম নারীর কি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে? এর উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে তার নিজের বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটাও হিজাবের বা পর্দা প্রথার অংশ। এ বিষয়ে কোরানের সংশিস্নষ্ট আয়াত হচ্ছে 33.33:
And stay quietly in your houses, and make not a dazzling display, like that of the former Times of Ignorance; and establish regular Prayer, and give regular Charity; and obey Allah and His Messenger. And Allah only wishes to remove all abomination from you, ye members of the Family, and to make you pure and spotless.
এই যে ঘরের মধ্যে নীরবে থাকার নির্দেশ তা কোরানের। যারা ইসলামের সংশোধনে বিশ্বাসী তারা এর সাথে আগের আয়াত যুক্ত করে একে চিহ্নিত করেন শুধুমাত্র নবীর স্ত্রীদের জন্য আদেশ। যারা গোঁড়া তাদের মতে এই আদেশ সকল মুসলিম রমণীদের জন্য। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে নারীকে ঘরের বাইরে যেতে হয় নানা কারণেই। তাছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমাগত প্রচারনার মাঝে মুসলিম ধর্ম-বেত্তাদের পক্ষে নারীকে আর শুধু ঘরে আটকে রাখার বিধান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না (বিশেষত: শিক্ষিত ও ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে)। তো ইসলাম মতে কখন একজন নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবেন: (কোরান ও হাদিসের আলোকে বিভিন্ন মুসলিম মনীষিরা এই নীচের তালিকাটি ব্যবহার করেন)
1. শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মুসলিম নারী ঘরের বাইরে যেতে পারবেন।
2. তার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার স্বামী বা আইনসঙ্গত অভিভাবকের অনুমতি থাকতে হবে।
3. তাকে মুখ সহ পুরো শরীর ভালোভাবে ঢাকতে হবে, যাতে আশে-পাশের কোনো পুরম্নষকে তার রূপ লালসাগ্রসত্দ না করতে পারে, এবং সে অবশ্যই তার মাথা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে সোজা হেটে যাবে। (কোরান: 24:31)।
4. পুরম্নষদের সাথে পথের মাঝ দিয়ে সে হাঁটতে পারবে না। মসজিদ থেকে কিভাবে বের হতে হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে ইসলামের নবী আদেশ দিয়েছেন: "নারীদের পুরুষের মাঝে হাঁটার কোনো অনুমতি নেই -তোমাদের উচিত রাসত্দার পাশ দিয়ে হাঁটা।"
5. হাঁটার সময় পা মাটিতে ফেলে শরীরের গোপন অলংকারের শব্দ করা যাবে না কারণ এতে পুরষ আকর্ষিত হবে। ( ফলে হাইহিল বা পায়েল জাতীয় অলংকার পরা নাজায়েজ।)
6. মহিলারা অবশ্যই গায়ে কোনো সুগন্ধী ব্যবহার করবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, "যে মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে এবং পুরম্নষদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় সে অসতী"।
7. অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠ স্বাভাবিক থাকতে হবে (আয়াত 33.32)।
8. কোনো অফিস বা দোকানের ভেতরে কোনো মহিলাকে একজন পুরম্নষের সাথে একাকী রাখা যাবে না। ইসলামের নবী বলেছেন, " একজন নারী ও পুরম্নষের মধ্যে কখনই এমন কথাবার্তা হয় না যার মধ্যে শয়তান কু-কাজ না করে"।
9. একজন নারী কখনও পুরষের সাথে হ্যান্ডশেক করতে পারবে না।
10. এমনকি অন্যকোনো নারী বান্ধবীর বাড়িতেও সে তার পর্দা খুলতে পারবে না কারণ সে ঘরের মধ্যে কোনো পুরম্নষ লুকিয়ে থাকতে পারে। ইসলামের নবী বলেছেন, "যদি কোনো নারী তার নিজের বাড়ি বা তার স্বামীর বাড়ি ভিন্ন অন্য কোথাও তার পর্দা সরিয়ে ফেলে তবে সে সেই পর্দাটি সরিয়ে ফেললো যা তাকে খোদার সামনে নিজেকে রক্ষা করতো"।
11. স্বামী বা যথোপযুক্ত আত্মীয়-সঙ্গী ছাড়া একজন স্ত্রী ত্রিশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব যেতে পারবে না।
12. একজন নারীর কখনও কোনো পুরম্নষকে অনুকরণ করা উচিত নয়।
নিষেধের এই স্বল্প দৈর্ঘ্য তালিকা দেখে অনেকের নিশ্চয়ই ভানুর সেই কৌতুকের কথাই মনে পড়বে। যার অনুকরণে বলা যায়, " তাইলে হালার ঘরের বাইরেই যামু না।" যে দশা হয়তো অনেক মুসলিম রমণীর। (ঈশ্বর তাদের রক্ষা করুন।)
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন