বদরুল ভাই পড়েন: ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য

দীক্ষক দ্রাবিড় এর ছবি
লিখেছেন দীক্ষক দ্রাবিড় (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৪/২০০৬ - ৫:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম জাহানের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আনন্দ উৎসব। এই উৎসব প্রতি বছরের মতো 12 রবিউল আউয়াল মাসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর পৃথিবীতে শুভ আগমনের দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বছরের সবগুলো মাসের মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসের মর্যাদা ও তাৎপর্য তাই অত্যধিক। রবি আরবি শব্দ। এর অর্থ বসনত্দ, সঞ্জীবনী ও সবুজের সমারোহ। আর বরিউল আউয়াল বলতে প্রথম সঞ্জীবনের মাস বোঝায়। এই নামকরণের তাৎপর্য হচ্ছে মক্কার কোরাইশ বংশীয় কাফের সমপ্রদায় অনাবৃষ্টি ও অভাবের ফলে কঠিন বিপদের মাঝে কালাতিপাত করছিল। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (স.) যে বছর জন্মলাভ করলেন সে বছর মক্কার শুষ্ক জমিন সঞ্জীবিত হয়ে উঠলো। শুষ্কবৃক্ষ সজীব ও ফলবনত্দ হয়ে ওঠলো এবং চারদিকে একটা আনন্দ উৎফুল্লতার জোয়ার বয়ে যেতে লাগলো। এই বছরকে বিজয় ও আনন্দের বছরও বলে। তাই এই মাস রবিউল আউয়াল হিসেবে সুপরিচিত। এই আনন্দ ঘনঘটা প্রকাশ পেয়েছে নবীকুলের শিরোমণি অসহায়দের সহায় মহানবী (স.)-এর আগমনেরই ফলে। কেননা এই রবিউল আউয়াল মাসে তার জন্ম না হলে মাসটির কোনো মূল্য হতো না।
মুহাম্মদ (স.) এর পৃথিবীতে আবির্ভাব আদর্শ মহামানব রূপে, সৃষ্টিজগতের তিনি সর্বোত্তম সৃষ্টি। তাঁর আগমনে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে আলোর উত্তরণ ঘটে, তাওহীদের পয়গাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, রিসালাতের আলোকরশ্মি দিক দিগনত্দে বিচ্ছুরিত হয়। তিনি এলেন গোটা মানব জাতির মহান পথপ্রদর্শক রূপে, মহান আল্লাহর মনোনীত দীন ইসলামের পরিপূর্ণ রূপদান করতে। তিনি 632 খ্রিস্টাব্দে আবার 12 রবিউল আউয়াল সোমবার ইসলামের পরিপূর্ণতা প্রদান করে মহান আল্লাহর সানি্নধ্যে চলে গেলেন। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট দিনে ফিরে আসে নবীপ্রেমে সবাইকে উজ্জীবিত করার জন্য। এ এক মুবারক দিনের মুবারক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে মহানবীর প্রতি সালাত ও সালাম পেশ করা হয়। তাঁর আদর্শ জীবন ও সিরাত পর্যালোচনা করা হয়। মহান আল্লাহ এই উচ্চ মর্যাদার রবিউল আউয়াল বিশ্বের সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহানমানব, নবীকুল শিরোমনি মানবতার মুক্তির দিশারি রাহমাতুলি্লল আলামীন মুহাম্মদ (স.)-এর স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক 12 রবিউল আউয়াল তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর মাস। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, '(হে নবী) আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।' এই রহমতের কারণে খুশি উদযাপন করার ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ আরো বলেন, 'হে নবী আপনি উম্মতগণকে বলে দিন আল্লাহর ফজল ইসলাম বা আল-কুরআন এবং রহমত মুহাম্মদ প্রাপ্তিতে তারা যেন খুশি বা ঈদ, আনন্দ প্রকাশ করে।' তাই মিলাদুন্নবীর রাত কদরের রাত অপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং দুই ঈদের চেয়েও বেশি মর্যাদাপূর্ণ। কেননা মিলাদুন্নবীর রাত স্বয়ং মহানবী (স.)-এর আগমনের রাত, আর শবে কদর তো তাঁকেই প্রদান করা হয়েছে। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আমরা পেতাম না যদি মহানবী (স.)-এর জন্ম না হতো।
মহান আল্লাহ সমগ্র জগতের প্রতিপালক, পালনকর্তা, বিধানদাতা, আহারদাতা ও সকল সমস্যার সমাধানকারী। আর তাঁরই প্রিয় নবী মুহাম্মদ (স.) সমগ্র জগতের জন্য রহমত, বরকত, মাগফিরাতের মাধ্যম ও সুপারিশ করার অধিকারী। যেখানেই মহান আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় সেখানেই তাঁর প্রিয় নবীর নামও উচ্চারিত হয়। যেমন- আজান, একামত, দরুদ, সালাম ও দুয়ার তথা মুমিন-মুসলমানদের সকল কাজে। এই সম্মান ও এই অনন্য মর্যাদা স্বয়ং মহান আল্লাহ প্রদত্ত। আল্লাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর ওপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ আল্লাহর নবীর জন্য মাগফিরাত কামনা করেন; ওহে ঈমানদারগণ, তাঁর ওপর তোমরা সালাত (দরুদ) পাঠাও এবং ভক্তি ভরে সালাম দাও।' মহান আল্লাহ স্রষ্টা হয়ে যে সৃষ্টির নামে দরুদ ও সালাম পাঠান, তাঁর গুরুত্ব, পদমর্যাদা ও সম্মান বর্ণনা করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও ভালোবাসা প্রদর্শন ঈমানের অন্যতম অংশ। তাই মহানবী (স.) বলেছেন, 'তোমাদের কেউ ঈমানদার হবে না, যতোক্ষণ না আমি তার সনত্দান, পিতা-মাতা, সকল মানুষ থেকে অধিক ভালোবাসার পাত্র না হই।'
মূলত আজ থেকে 1480 বছর আগে এই দিনে মহানবী (স.)-এর এ পৃথিবীতে আগমনের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনটি মানবজাতির ইতিহাসে একটি রহমত, বরকত ও পরিপূর্ণ দিবস। সৃষ্টির প্রথম থেকেই স্বভাবগতভাবে মানুষ সুন্দর, আনন্দদায়ক, কল্যাণকর কোনো বস', ব্যক্তি ও ঘটনায় আনন্দিত হয়। সুন্দর, মনোরম ও সুদর্শনীয় বস' দেখলেই মানুষ তার প্রশংসায় ও স'তি বর্ণনায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। সে সুন্দর বস'টি যদি সত্দর ও পদমর্যাদার পর্যায়ের দিক থেকে উন্নত হয়, তখনই তাকে অনায়াসে সম্মান ও মর্যাদাদানের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর সত্দর ও পর্যায়ের দিক থেকে সম্মান হলে তার প্রতি শুভেচ্ছা, শুভাকাঙ্ক্ষা এবং ছোট হলে স্নেহ আদর করার জন্য মনপ্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে। যে চাঞ্চল্য, অস্থিরতা দেখা বোঝা ও পাওয়ার কামনা-বাসনা মনের গহিনে দানা বেঁধে তারই নাম 'হাববুন' বা দানা, আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মহব্বত বা ভালোবাসা। এ ভালোবাসা যখনই প্রেমিকের মনে বদ্ধমূল হয়, তখনই তার প্রিয় ব্যক্তি বা বস'র প্রশংসা, গুণাগুণ মুখে, কাজে তার শিরা-উপশিরায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। প্রেমিক যতো সুন্দর, যতো মনোরম, যতো মহিমান্বিত এবং যতোই গুণান্বিত হন তার প্রশংসা ও গুণাগুণ প্রিয়জনের কণ্ঠে ততোই উন্নত ও আকর্ষণীয় হয়। এ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আনন্দানুষ্ঠানের মাধ্যমে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে এ ধরনের অনুষ্ঠানের সন্ধান মেলবে অসংখ্য। অন্যদিকে মানুষ স্বভাবত অসুন্দর, দুঃখজনক ও অকল্যাণকর অবস্থায় ব্যথিত হয়। তা থেকে বের হয়ে আসতে সে প্রতিনিয়ত চেষ্টাও করে। যখনই মানুষ অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের যাঁতাকলে নিস্পেষিত হয়েছে, তখনই মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণপণে খুঁজছে একজন মুক্তিদাতা-ত্রাণকর্তা, যাকে কেন্দ্র করে এবং যার নেতৃত্বে ঘটাবে সে সকল দুঃখের অবসান, চিরতরে বিলীন করতে সকল অশুভ শক্তিকে।
মানুষ যখনই প্রিয়জনের সানি্নধ্য লাভ করেছে বা দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বসত্দির নিঃশ্বাস ফেলেছে তখনই স্বধর্মীয়, স্বগোত্রীয় লোকদের নিয়ে আনন্দানুষ্ঠান করেছে। এ আনন্দানুষ্ঠানকে আল-কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ঈদ বা আনন্দ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্মের সময় কাবাগৃহে তিন শতাধিক মূর্তি স্থান পেয়েছিল। আরবসহ সারা বিশ্বের আইন-বিচারক ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে চলছিল বর্বর শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যখন চলছিল যুগের যুগ যুদ্ধ, জীবনত্দ কবর দিচ্ছিল বাবা নিজ কন্যা সনত্দানকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের উপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ, অসহায় অনাথ বঞ্চিত মানবতা যখন গগণবিদারী আর্তনাদ করছিল। নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলার বস', আদর্শিক-নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না_ সে সময়, অর্থাৎ 570 খ্রিস্টাব্দের আজকের এই 12 রবিউল আউয়াল তারিখে সুখময় বসনত্দকাল হিসেবে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) জন্মগ্রহণ করলেন। তাঁর আগমনে যেমন প্রাকৃতিক বসনত্দ আগমন করেছে, তেমনি নৈতিকতা ও আদর্শের ভুবনেও আগমন করেছে নববসনত্দের জোয়ার। তিনি ছিলেন জাগতিক বসনত্দের চেয়ে লাখো-কোটি গুণ অধিক আলোদানকারী নূর। বহু অলৌকিক ঘটনা নিয়ে তিনি এই মর্তের পৃথিবীতে আগমন করেন। শৈশবের ঘটনাবহুল দিনগুলো পেরিয়ে কৈশোরে প্রতিষ্ঠিত হলেন কিশোর মুহাম্মদ (স.) আল-আমীন মুহাম্মদরূপে। দেশের সামাজিক, চারিত্রিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের করুণ অবস্থা দেখে সমবয়সী যুবকদের সমন্বয়ে তিনি গঠন করলেন হিলফুল ফুজুল নামক শানত্দি সংঘ। ফলে অসহায়, অবহেলিত ও দুর্গত মানবতার সেবা, এতিম-বিধবা ও দুর্বল জনতাকে অত্যাচার-অবিচার থেকে মুক্তিদান, পথিক-ভিনদেশীর নিরাপত্তা বিধান, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, শানত্দিশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে সাম্যমৈত্রীর এক অকৃত্রিম বন্ধন গড়ে তুলতে তিনি সম্পূর্ণ সফল ও সক্ষম হন। যুবক মুহাম্মদ (স.) নিজের সততা, আমানতদারি, বিচক্ষণতা, অনুপম ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং হালাল উপায়ে উপার্জিত অর্থে উন্নত জীবন গঠনের জন্য আদর্শ ব্যবসায়ী হতে হলে তার বাসত্দব উদাহরণ হলেন যুবক ব্যবসায়ী মুহাম্মদ (স.)। তাই মক্কাসহ গোটা পৃথিবীর নিমজ্জিত শিরক থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তাঁর ওপর মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল হলো। এর ফলে সকল স্বার্থন্বেষী, সুবিধাভোগী আমলা ও দুনর্ীতিবাজ শ্রেণীর মাথায় এক বজ্রপাত হানা হলো। অত্যাচার, নিপীড়ন অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসারটনা এবং পাগল-জাদুকর, কবি, দেশদ্রোহী গণক, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যানহ সকল প্রকার বাধা-বিপত্তির মুখে তিনি দৃঢ়চিত্ত ঈমান নিয়ে তাঁর সঙ্গীদেরকে আল-কুরআনের আদর্শে গড়ে তোলেন। এই মহামানবের জীবন চরিত্র আলোচনা ও তা বাসত্দবে রূপদান করাই হলো আজকে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্য।
বাংলাদেশে-ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষ্ঠান হচ্ছে ফাতেহা দোয়াজদাহম বা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান উদযাপন করা। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবী অত্যনত্দ ভাবগাম্ভীর্জের সঙ্গে উদযান করা হচ্ছে। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সর্বক্ষেত্রে তাঁর প্রবর্তিত আদর্শ অনুসরণের তৌফিক দান করুন।
লেখক: ড. মোঃ আবু বকর সিদ্দীক : প্রফেসর আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।