!এলো বনান্তে পাগল বসন্ত!

দৃশা এর ছবি
লিখেছেন দৃশা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০২/২০০৯ - ৭:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[প্রিলগঃ বোকা বাক্সে ঘুরে বেড়াবার সময় একদিন এন.টিভিতে হঠাৎ দেখতে পেলাম এক দাড়িওয়ালা লোক গামছা মাথায় দিয়ে নজরুলের একখানা গান গাইছেন তন্ময় হয়ে। ঐদিনই ঠিক করে ছিলাম অ্যালবামখানা কিনে মৌজ করে শুনতে হবে। এরপর বেশ অনেকটা দিন কেটে গেল, অ্যালবামটি বেরও হয়ে যায়, কিন্তু সংগ্রহ করে আর শুনে দেখা হয়নি। এরপর একদিন পত্রিকা পড়ে জানলাম অ্যালবামটি এখন বাজারে চলে এসেছে... শোনার যা মাত্র দেরী।]

তানভীর আলম সজীব... এক সম্ভাবনাময় সঙ্গীত শিল্পীর নাম। যিনি একাধারে গান গাওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনার সাথেও জড়িত। যখন আমরা সঙ্গীতাঙ্গনে ভয়াবহ অদ্ভুত রকমের অস্থির সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, ঠিক সে সময়ে এমন একজন প্রতিভাবান শিল্পীর উদয় স্বস্তিদায়ক তো বটেই, তদ্রূপ আশা-জাগানিয়াও। বাফা হতে নজরুল সঙ্গীতে ডিপ্লোমা এবং টরেন্টো ফিল্ম স্কুল থেকে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ব্যাচেলর করা এই শিল্পীর এ পর্যন্ত দু'টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে বেঙ্গল মিউজিকের সৌজন্যে। প্রথমটি 'বাড়ি কোথায় বলো', এবং দ্বিতীয়টি নজরুল সঙ্গীতের ১০টি জনপ্রিয় গান নিয়ে তৈরি অ্যালবাম 'উচাটন মন'।

যেহেতু আমি নিজে একজন নজরুল সঙ্গীতের ভক্ত তাই এই পোস্টে আমার আশা, হতাশা, পছন্দ-অপছন্দের বিষয় গুলো হবে এই নতুন শিল্পীর ২০০৮’এর অক্টোবরে প্রকাশিত নতুন অ্যালবাম 'উচাটন মন' কেন্দ্রিক। আমি কোন সঙ্গীত বোদ্ধা নই, ইহজনমে হওয়ার কোন সম্ভাবনাও নেই। বরং একজন শ্রোতা হিসেবে আমি আমার মতামত অন্যান্যদের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এই পোস্টের মাধ্যমে। সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সজীব যে একজন প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান শিল্পী এতে অন্য কারো দ্বিমত থাকলেও আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে তিনি কতখানি সফল তা অন্যান্যরা বলবেন, আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যন্ত্রসঙ্গীতের অধিক ব্যবহার কিংবা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার একপ্রকার অস্বস্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয় শ্রোতার মনে, তাতে থাকুক যতই না নতুনত্বের ছোঁয়া। সজীবের গানগুলো শোনার সময় আমি কোথাও কোথাও এ ধরনের হোঁচট খেয়েছি। এর ব্যাখ্যা হিসেবে হয়তো সঙ্গীত পরিচালক বলতে পারেন নতুন প্রজন্মের নতুন শ্রোতাদের ধরে রাখবার জন্যেই এই পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা। আমি নিজেও মনে করি নতুনত্বের প্রয়োজন সবক্ষেত্রেই আছে, তবে তা যদি সঙ্গীত পিয়াসীদের শ্রবণ পিপাসা জাগিয়ে তোলার বদলে অস্বস্তিকর অনুভূ্তি সৃষ্টি করে তবে তেমন নতুনত্ব না আনাই শ্রেয়। আজ যখন আমাদের নতুন প্রজন্ম মিলার 'রূপবানে নাচে কোমর দুলাইয়া', কানিজের 'হে নবীনা', বা তিশমার 'বাঁশীওয়াল' ও 'চাঁদের মেয়ে জোৎস্না আমি বেদের মেয়ে না', কিংবা কণার '9362715' অথবা 'জ্যামিতিক ভালোবাসা' দ্বারা আক্রান্ত এ সময় এহেন 'স্টারদের' সাথে পাল্লা দিয়ে শ্রোতাশ্রেণী ধরে রাখার জন্য নজরুল কিংবা রবীন্দ্র সঙ্গীতে বৈচিত্র্য বা নতুনত্ব আনার প্রয়োজন আছে বৈকি, তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে তা যেন শ্রুতিকটু না হয়।

নজরুল-রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একটি গানের সফলতা নির্ভর করে গায়ক-গায়িকার গায়কীর উপর, যন্ত্রসংগীতের নিত্যনতুন ব্যবহারের উপর নয়। যদি মিউজিকে আনা নতুনত্ব শ্রুতিমধুর হয়ে যায় তবে সেটি উপরি পাওনা। উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে অর্ণবের পরিচালনায় করা 'তোমার খোলা হাওয়া', 'আমার নিশীথ রাতেরও বাদল ধারা', কিংবা 'সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে'র কথা। অথচ একই অ্যালবামের 'মোর ভাবনা রে' গানটি হয়ে গিয়েছিল এককথায় বীভৎস যন্ত্রসঙ্গীতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের দরুণ। তাই আমার মতে নজরুল-রবীন্দ্র সঙ্গীতের গায়ক গায়িকাদের নির্ভর করা উচিত নিজ গায়কী নিপুনতার উপর, কারন অনর্থক নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টা নিয়ে আসতে পারে হতাশাজনক ফলাফল।

১০টি গানের মাঝে প্রথম গানটি হল উচাটন মন। মিউজিকে বৈচিত্র্য আছে এতে সন্দেহ নেই, শিল্পী গেয়েছেনও ভাল। তবে গানটির যে একটা স্বকীয়তা আছে তা যেন ঠিক বেরিয়ে আসছিল না। যারা অজয় চক্রবর্তীর কন্ঠে 'উচাটন মন' গানটি শুনেছেন তারা হয়তো বুঝতে পারবেন আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি। গানটির কম্পোজিশন এতোটাই দারুন ছিল যে আমি যতবার শুনি ততবারই মুগ্ধ হই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে যার দরুণ আমাদের এখানকার সংগীত পরিচালকদের সম্পূর্ণরূপে দায়ী করাও সম্ভব নয়। সীমাবদ্ধতাটি হল ভাল যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীর অভাব। ভাবতেও অবাক লাগে এতো মানুষের একটি দেশে একজন সানাই বাদক নেই, কোন সারেঙ্গী বাদক নেই, সরোদ ভাল বাজান মাত্র একজন শিল্পী আর এস্রাজ বাজান গুটিকয়েক মানুষ, তবুও তাঁদের দক্ষতা অসাধারণ কিছু নয়। মাঝে মাঝে ভাবি এই বিমুখতা কেন? সঙ্গীত প্রেমীর তো অভাব নেই দেশে, তবে এসব ইন্সট্রুমেন্টের প্রতি এতোটা অনীহা কেন? আজ আমরা সকলেই সহজে অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা পেতে চাই, এবং বাস্তবিক অর্থে ঘটছেও তাই, শেখার ধৈর্য্য কিংবা আগ্রহ হ্যাজাক বাত্তি দিয়ে খুঁজেও কারো মধ্যে পাওয়া যায় না আর আগের মত। যার দরুণ এই সমস্ত জনপ্রিয়তার স্থায়ীত্বও ক্ষণকালের, আজ যিনি জনপ্রিয় কাল তাঁর নামও নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না। অ্যালবামের দ্বিতীয় গানটি হল 'তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি'। নজরুলের অসম্ভব জনপ্রিয় একটি গান, যা আমরা মেয়ে শিল্পীদের গলায় বেশী শুনে অভ্যস্ত। গানটিতে সাঁওতালী(ঝুমুর) সুরের প্রভাব বিদ্যমান থাকলেও, আমার মতে গানটির চাহিদা অনুযায়ী এই পাহাড়িয়া সুরটি সেভাবে ফুটে ওঠেনি। মাদল, খোল, বাঁশী জাতীয় ইন্সট্রুমেন্টের হরেক রকমের ব্যবহার খুব মিস করছিলাম গানটিতে।

এই দু'টি গান ছাড়াও আরো আটটি গান নিয়ে সাজান হয়েছে অ্যালবামটি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রুমঝুম রুমাঝুমা কে বাজায়, এ কি অসীম পিয়াসা, গাঙ্গে জোয়ার এলো ফিরে, এলো বনান্তে, অরুণকান্তি, বঁধু তোমার আমার। 'এলো বনান্তে' গানটিতে সজীবের গায়কী বেশ প্রশংসনীয়, এবং 'তেপান্তরের মাঠে' ও 'এ কি অসীম পিয়াসা' গানটিতে বেজ গীটারে ছিলেন বুনো (বাংলা ব্যন্ডের সদস্য)। গীটার ছাড়াও এই অ্যালবামের গানগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে সরোদ, এস্রাজ, একতারা সহ অন্যান্য আবশ্যিক ইন্সট্রুমেন্ট।

সবশেষে আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় শিল্পী হিসেবে তানভীর আলম সজীব কেমন, তাহলে আমি শ্রোতা হিসেবে তাকে ১০০ তে চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ৮৫ পয়েন্ট দেব। এই সম্ভাবনাময় শিল্পী যদি নিজ কাজ সম্পর্কে ফোকাসড থাকেন তবে পয়েন্ট অনায়াসেই ৯০ এর ঘর ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংগীত পরিচালক সজীবকে আমি দেব ৭০ পয়েন্ট, যদিও আশা ছিল এর থেকেও অনেক বেশী। যন্ত্রসংগীতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার থেকে বিরত থেকে যদি সঙ্গত ইন্সট্রুমেন্টের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে গানে নতুনত্ব আনতে পারেন, তবে অচিরেই মান বেশ উপরে উঠে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা দেখি না। সজীবের গান শোনার পর একটা কথাই মাথায় এলো, আশা করি আমাদের বর্তমান পপস্টার মিলা এই শিল্পীর গান শোনার পর নিজেকে 'বেসিক্যালি নজরুল সঙ্গীতের শিল্পী' বলার আগে একবার হলেও ভাববেন এবং শ্রদ্ধেয় কানিজ সুবর্না আন্টি নিজেকে বেসিক্যালি 'উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পী' বলার আগে ১০০ বার চিন্তা করবেন। দেঁতো হাসি

পুনশ্চঃ উপরের লিংক দু'টি দিয়েছি দেশের বাইরে (ফিরিঙ্গি) যে সকল সচল ভাইলোগ এবং বেহেনলোগ আছে তাদের জন্য। তবে আমরা যারা দেশেই আছি তারা কিন্তু অতি অনায়াসে ৭০ টাকা খরচ করে সিডি'টি সংগ্রহ করতেই পারি, আমাদের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি সমৃদ্ধ করা বইলা কথা...নাকি কন?


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

বেহেনজি, ভদ্রলোকের গান শুনিনি এখনও, পরে শুনে দেখব (তবে মনে হয় না ইনার সিডি কিনব) দেঁতো হাসি

লেখায় আপনার অধিকাংশ বক্তব্যের সাথেই একমত। রবীন্দ্রসংগীতের উপর যাদের এক্সপেরিমেন্ট শুনসি, তাদের মধ্যে একমাত্র অর্ণবের কিছু কাজ ভাল লাগসে। ওঁর নিজের গাওয়া "নয়ন তোমারে" গানটাও খুবই ভাল লাগসে আমার কাছে। আর এখন যন্ত্রসংগীত শিল্পীর যে অভাবের কথা বললেন, সেটা আসলেই খুব দুঃখজনক। আর দেখেন না, বেশিরভাগ অভিভাবক কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েদের গান শেখান, কিন্তু যন্ত্র বাজানো শেখাতে কয়জন আগ্রহী? ব্যাপারটা অনেকটা ক্রিকেট খেললেই খালি-ব্যাট-করব-বল-করব-না টাইপের।

আমাদের তিশমা আপাও কিন্তু এখন বেসিক্যালি 'রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী' চোখ টিপি

দৃশা এর ছবি

আপনারে অর্ণব পাইলে তো দ্রোহী ভাইয়ের মত কইবো 'বুখে আয় অতন্দ্র...বুখে আয়'।

হো তিশমা আপাও ভালুবাসি ভালুবাসি কইয়া বেসিক্যালি রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিল্পী হয়া গেল। কি যে করতেছেন মিয়া! ঘটি-বাটি লইয়া নাইমা পড়েন। তয় এই কথা স্বীকার করাই লাগব মিরকি রুগী আফা আশাতীত ফল দেখাইছে ভালুবাছি ভালুবাছি গানটায়, এতোটা ভালু আমি আশায় করি নাই, প্রথমে শুইনা বুঝতেই পারি নাই ইনি তিনি, তবে কিছু জায়গার কাঁপানি শুনলেই টের পাওন যায় ইনিই তিনি!
-----------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

মুশফিকা মুমু এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি একদম ঠিক! পারফেক্ট বলসেন! আমি হাসতে হাসতে পরে গেলাম হিহিহি। আমিও ভাবিনাই প্রথমে ইনিই তিনি, ঐ গানটায় সে আসলেই ভালৈ গাইসে। এটাই আমার ওর গলায় প্রথম পুরাটুকু গান শোনা!
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অনিকেত এর ছবি

হুমম, রিভিউ বেশ লাগল।
এলবামগুলোর লিঙ্ক দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
গানগুলো শুনছি। আশা করছি পরে এই নিয়ে কিছু লিখব।

দৃশা এর ছবি

ভাল লেগেছে জানার পর আমারও ভালো লাগলো।
আপনার মতামত জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

কনফুসিয়াস এর ছবি

অথচ একই অ্যালবামের 'মোর ভাবনা রে' গানটি হয়ে গিয়েছিল এককথায় বীভৎস যন্ত্রসঙ্গীতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের দরুণ।

এই কথাটা নিয়ে ভিন্নমত আছে। আপাতত জানিয়ে গেলাম, সুযোগ পেলে ব্যাখ্যা করবো।

-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

দৃশা এর ছবি

জানলাম এবং ব্যাখ্যা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। হাসি
....................................................................................
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

নিঘাত তিথি এর ছবি

দৃশার পোস্ট অর্ধেক পড়ে আগে লিংক ধরে শুনতে শুরু করে বাকিটা পড়লাম। সজীবের প্রথম গানের প্রথম টান শুনেই যা বোঝার বুঝে গেলাম। এই ছেলের ঈশ্বরপ্রদত্ত কন্ঠ আছে, আছে অনেক দিনের চর্চা। দারুন। কন্ঠ শুনে মনটা ভরে গেলো। কেবল অল্প কিছু কিন্তু জুড়ে গেলো তার সাথে, কম্পোজিশান নিয়ে।

যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার নিয়ে দৃশার সাথে পুরোপুরি একমত। অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসংগিক ব্যবহার গানের আবেদন অনেক অনেক বেশি নষ্ট করে দিতে পারে। সব গান তো এক ঘরানার নয়। কিছু গান লিরিকস নির্ভর, কিছু সুর নির্ভর। আগের গানগুলো বেশির ভাগই তাই হোত। এই সময়ের গানে আনুষঙ্গিক মিউজিক অনেক গুরুত্ব পায়। সেটা আরেক ঘরানা। এই সবগুলো ধরনের গানের নিজস্বতা আছে, ভালো লাগে সবগুলোর সৌন্দর্য। এগুলোর মাঝে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা দোষনীয় নয়, বরং কাজটা ভালো হলে প্রশংসনীয়। কিন্তু কথা সেই, রবীন্দ্র-নজরুলের গানের কথা এবং সুরের এমন একটা মহিমা, যেটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গেলে অনেক বেশি সচেতন এবং যত্মবান হওয়া প্রয়োজন। আমার কাছে অর্ণবের কাজ অনেক ভালো লেগেছিলো, সামগ্রিকভাবে, দুয়েকটা ভুল-ত্রুটি বাদ দিলে। তানভীর আলম সজীব-এর গান নিয়ে বলতে হলে আমি বলব, চমৎকার গলা, গায়কী। মিউজিক কম্পোজিশানে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু কাজ ভালো হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্র অপ্রাসঙ্গিকভাবে বেজে উঠেছে, কিছু ক্ষেত্রে (যেমন তেপান্তরের মাঠে’তে) কিছু প্রত্যাশিত যন্ত্র বরং বাদ পড়েছে, আর কিছুর ক্ষেত্রে হালকা হয়েছে।

“এ কি অসীম পিয়াসা” গানটার কথাই ধরা যাক। অসাধারন একটা গান- কথা, সুর সব কিছু মিলেই। সজীব খুবই ভালো গেয়েছে, প্রতিটা কাজ, অনুভূতি...কেবল সংগের সন্ত্রসংগীতটুকু ছাড়া। এত বেমানান একটা কম্পোজিশান যে কেন করা হলো? এত ভালো গাওয়া গানটা, আমার আফসোস হচ্ছিলো, ইচ্ছে হচ্ছিলো খালি গলায় সজীবের কাছ থেকে গানটা শুনতে। আমার খুব পছন্দের শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলের কন্ঠে একই গানের যে আবশ্যক বিষন্নতা তা সজীবের কম্পোজিশানে যন্ত্রের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে। “গাঙে জোয়ার এলো” সর্বোপরিই ভালো হয়েছে। “এলো বনান্তে” শুনে একঘেয়ে মনে হলো, কেবলমাত্র মিউজিক কম্পোজিশানের কারনে, সেই প্রথম গান “উচাটন মন”-এ যেমনটা ব্যবহার করা হয়েছে একই জিনিস এটাতেও। “ভোরের ঝিলিক”টা আবার ভালো লাগলো খুব। “অরুণকান্তি”র কাজ আমার ভালো লেগেছে। অন্যন্য গানের সাথে এটার একটা বৈপরিত্য পেলাম, এখানে বরং কম্পোজিশানই বেশি ভালো হয়েছে গায়কীর চেয়ে। গানের কাজগুলো আরো পরিষ্কার হলে ভালো হতো, বিশেষ করে চড়ায়। প্রথম এবং শেষ অন্তরায় যথাক্রমে “অম্বরে হেরি আজ” এবং “পার্বতী নহি আমি”তে গলা ঠিক সুরে বসে নি। আরেক স্কেল নিচে গাওয়া যেতো সেক্ষেত্রে। “আমি চিরতরে দূরে সরে যাবো”র কম্পোজিশান আরো অনেক বেশি গাঢ় হতে পারতো। শেষ গান “বধু তোমার আমার এই যে বিরহ” শুনে আবার মনটা ভরে গেলো, দারুন।

সবকিছু মিলে তানভীর আলম সজীব প্রশংসার দাবি রাখেন। তার তৈরি গলা প্রমান করে গানের প্রতি তার ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা। নতুনভাবে নজরুল সংগীতকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টার আন্তরিকতাটাও ভালো। কিছুদিন আগে ফুয়াদের কম্পোজিশানে আনিলার কন্ঠে নজরুল সংগীত “যায় ঝিলমিল ঢেউ তুলে” শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। সজীবকে ধন্যবাদ যে সে গান এবং গায়কী সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রেখে কেবল মিউজিকে এক্সপেরিমেন্টের চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টার সীমাবদ্ধতা ভবিষ্যতে কাটিয়ে উঠবে সে এটাই আশা করি।

দৃশা, অনেক কথা বলে ফেললাম। অনেক দিন পরে গান, বিশেষ করে নজরুল সংগীত নিয়ে এতক্ষন ভাবার, শোনার এবং বলার সুযোগ করে দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

আলাভোলা এর ছবি

তিথিপু, আলোচনা জটিল হইছে।
আপনি নিয়মিত লেখেননা কেন ?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

তিথির সাথে ১মত।

দৃশা এর ছবি

২ কিংবা ৩মত না কেনু?
----------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

দৃশা এর ছবি

অনেক কথা বলে ফেললাম মানে? অনেক বেশী কথা বা আলোচনা পড়ার জন্যই তো বসে ছিলাম। এতে কত নূতন তথ্য জানা যায়, নতুন দিক নিয়ে ভাবা যায়।

খায়রুল আনাম শাকিলের গান শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে, তবে প্রিয় বলা যায় না। উনার গলায় নজরুলের সব গান আমার অতোটা ভাল লাগে না বলা ভাল ফুটে ওঠে না, তবে কিছু গান তিনি আসলেই দুর্দান্ত গেয়েছেন।

আপনে আনিলারটা শুনলেন কিন্তু মিলারটা শুনেন নি ফুয়াদের পরিচালনায় করা? মাশাল্লাহ! মানুষ গাইলো না রোবট গাইলো বুঝতেই পারলাম না!

সবশেষে চমৎকার বিশ্লেষনী মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আর ছোট্ট একটা উপহার( কোনই খরচ করা লাগে নাই যার জন্য), শুনে জানাবেন কেমন লাগল। হাসি

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

অফটপিকঃ অনেক আগে আপনি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি নিয়মিত না কেন বা লিখছি না কেন। একই প্রশ্ন আপনার জন্যও রেখে গেলাম।
-----------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

ধ্রুব হাসান এর ছবি

বেসম্ভব ভালো লাগলো চলুক

আলাভোলা এর ছবি

চমৎকার রিভিউ।
সজীবের গান শোনার ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই ছিল, সুযোগ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

দৃশা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও।
গান গুলো শুনন আর মতামত শেয়ার করুন আমাদের সাথে।
-----------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আমার সম্পূর্ণ অপিরিচিত এক প্রতিভাধর গায়কের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে ধনেপাতা হাসি

অর্ণবের পরিচালনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে আপনার বক্তব্যের সাথে একেবারেই একমত। ওই একটি গান ছাড়া বাকি সবগুলোই চমত্কার আসলে। আজ আবার শুনে দেখলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

দৃশা এর ছবি

ধনেপাতার বিনিময়ে দাদা নিন কিছু কাঁচালংকা। দেঁতো হাসি
যাক একজনকে পেলুম যিনি এ বিষয়ে আমার সাথে একমত।
-------------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

হিমু এর ছবি

বধূ তোমার আমার এই যে বিরহ, এক জনমের নহে ... গানটা চমৎকার লেগেছে শুনতে। তবে "হ" উচ্চারণ নিয়ে হালকা অভিযোগ আছে। "বিরহ" "বিরও" হয়ে যায়, "হায়" হয়ে যায় "আয়"। এইসব টুকিটাকি বাদ দিলে গানটা অপূর্ব হয়েছে।

"উচাটন মন" আর "এ কী অসীম পিয়াসা"য় যন্ত্রানুষঙ্গ মোটেও ভালো লাগেনি।

একটা পর্যবেক্ষণ, তবলাকে তিনি সাথী করেননি, এই তিনটি গানের একটিতেও। উচাটন মন গানটি তবলা ছাড়া অনাথ মনে হয়েছে। গানটির আত্মাও যেন তবলার জন্যেই উচাটন হয়ে ছিলো হাসি

তানভীর আলম সজীবের সাফল্য কামনা করি। আগামী অ্যালবামগুলোতে কম্পোজিশনে ট্র্যাডিশনাল বাদ্যযন্ত্রের কারুকাজ শোনার অপেক্ষায় থাকবো।


হাঁটুপানির জলদস্যু

দৃশা এর ছবি

শুধু তবলা না বাঁশীকেও বড্ড মিস করছিলাম। আর কি জানি আমার শোনার ভুল নাকি, সরোদ আর এস্রাজ কেন জানি ওভাবে ফুটে উঠছিল না।
---------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

রায়হান আবীর এর ছবি

চমৎকার রিভিউ। (চলুক)।

পোলাপান থেকে গান নামাচ্ছি। মাফ করে দিয়েন।

=============================

দৃশা এর ছবি

কি কন না কন... আমার কাছে মাফ চান কেন?
আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছিল ওটা করার অনুরোধ করেছিলাম শুধু। কেনা বা না কেনাটা একদমই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ছুটু ভাইরে একটা কথা কইতে চাই। যারা ভাল বা যাদের ভাল করার সম্ভাবনা আছে তাদের আমরা উৎসাহ না দিলে কে দিবে? পরে এরাই যদি বিপথে যায় তো আমরাই দেখা যাইব কলার চাইপ্পা ধরুম। নাকি কন?
------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

সুমন সুপান্থ এর ছবি

আপনার সৌজন্য আবারো অনেকগুলো ভালো গান শোনা হলো, দৃশা ! ধন্যবাদ তার জন্য ।
অসাধারণ এক কণ্ঠ এই শিল্পীর । কিন্তু সবগুলো গানের কম্পোজিশান যে সঠিক হয়েছে, সেটা মনে হয় নি । ( অবশ্য আমি গানের 'গ' ও বুঝি না । বরং কিছুটা প্রাচীনপন্থী স্রোতা বলেই হয়তো মানিয়ে উঠতে পারি না সবসময় !)

আপনার আলোচনা এবং তিথি আর হিমুর মন্তব্য তো বাড়তি পাওনা । সবাইকে ধন্যবাদ ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

দৃশা এর ছবি

আমার সৌজন্যে না তো দাদা, বেঙ্গল মিউজকের সৌজন্যে শুনতে পেলেন। দেঁতো হাসি
আপনাকেও মারাত্মক ধন্যবাদ।
---------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমার কম্পুতে কেন যেন ঝামেলা করছে। দেখি, কোন ভাবে যোগাড় করে শুনে নেবো।

দৃশা এর ছবি

ডাউনলোড সমস্যা নাকি পিসিতে সমস্যা। ডাউনলোড সমস্যা হলে জানাবেন, অন্য লিঙ্ক দিব।
----------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

মুশফিকা মুমু এর ছবি

তিথি আর দৃশার রিভিউর সাথে একমত, শাকিলের গান আমার খুবি ভাল লাগে, সজিবের গানগুলিও দারুন লাগল, অনেকগুলি আমার খুবি প্রিয়, ডাইনলোড করা গেলে খুব ভাল হত, কয়েকটা গানে যন্ত্রের ব্যবহার কম হলে আরো ভাল লাগত, শেষের গানটায় আসলেই মন ভরে গেল। গানগুলো শেয়ার করার জন্য দৃশাকে অনেক ধন্যবাদ হাসি
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

দৃশা এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য। দেঁতো হাসি
----------------------------------------------------------
দুঃখ তোমায় দিলেম ছুটি...
বুক পাঁজর আজ ফাঁকা।
দুঃখ বিদায় নিলেও সেথায়...
দুঃখের ছবি আঁকা।

দৃশা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।