ভূমিকম্প ও বাংলাদেশ – পঞ্চম পর্ব

দ্রোহী এর ছবি
লিখেছেন দ্রোহী (তারিখ: শুক্র, ২৫/১১/২০১১ - ১:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের পর্বগুলো:

চতুর্থ পর্বে আমরা জেনেছি পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় কয়েক মিলিয়ন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। আমরা জেনেছি যে উৎসস্থলের গভীরতার ভিত্তিতে টেকটোনিক কারণে সৃষ্ট ভূমিকম্পগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। চতুর্থ পর্বে আমরা ভূমিকম্প সনাক্তকরণে ব্যবহৃত সাইজমোগ্রাফ বা ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের মূলনীতি এবং ভূকম্পলেখ (সাইজমোগ্রাম) থেকে P ও S তরঙ্গের আগমনী সময়ের পার্থক্য থেকে কীভাবে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের অবস্থান নির্ণয় করা হয় সে সম্পর্কে জেনেছি।

এ পর্বে আমার ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয়ের পদ্ধতি ও ভূমিকম্প পরিমাপক স্কেলগুলো সম্পর্কে জানবো।

রিখটার মাপ [Richter Magnitude Scale]:

তৃতীয় পর্বে আমরা দেখেছি ভূকম্পলেখ থেকে P ও S তরঙ্গের আগমনী সময়ের পার্থক্য থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। ভূকম্পলেখতে তরঙ্গগুলোর বিস্তার [amplitude] থেকে ভূমিকম্পের ফলে মাটির কম্পনের প্রকৃতি [ground motion] সম্পর্কে জানা যায়। উপরের চিত্রে দেখা যাচ্ছে P ও S তরঙ্গের আগমনী সময়ের পার্থক্য ২৪ সেকেন্ড। আগের পর্বে শেখা সূত্র ব‌্যবহার করে আমরা দেখতে পাই ভূমিকম্প পরিমাপক স্টেশন থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ~ ২৪×৮=১৯২ কিলোমিটার। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে মাটির সর্বোচ্চ কম্পনের ফলে ভূকম্পলেখটিতে তরঙ্গের বিস্তার ২৩ মিলিমিটার। বলে রাখা ভালো এই ২৩ মিলিমিটার মূলত মাটিতে সৃষ্ট কম্পনের ফলে গ্রাফ কাগজের উপর ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রের কলম বা স্টাইলাসের তৈরি করা দাগের বিস্তার। আমরা জানি যে ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রে মাটির কম্পনকে কয়েক মিলিয়ন গুণ বড় করে ধারণ করা হয়। তাই ভূকম্পলেখে ২৩ মিলিমিটার বিস্তার দেখে আমরা যদি ভাবি মাটি ২৩ মিলিমিটার জায়গা জুড়ে নড়াচড়া করেছে তাহলে ভুল হবে।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের কথা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক বস্তুসমূহের উজ্জ্বলতার ভিত্তিতে তাদের দূরত্ব মাপার জন্য Apparent Magnitude Scale নামক একটি পরিমাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তখন Apparent Magnitude Scale ব্যবহার করে ধুমসে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর দূরত্ব মেপে বেড়াচ্ছেন।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কর্মযজ্ঞ দেখে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে কর্মরত ভূমিকম্পবিদ চার্লস রিখটার ভাবলেন ভূমিকম্প পরিমাপ করার জন্য এমন কিছু করা যায় কি না! বিনো গুটেনবার্গকে সাথে নিয়ে তিনি নেমে পড়লেন ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপের পদ্ধতি বের করার কাজে।

নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার স্কেলে দূরত্বের সাথে ঔজ্জ্বল্যের সম্পর্ক দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে চার্লস রিখটার এবং বিনো গুটেনবার্গ ভাবলেন ভূকম্পলেখ থেকে পাওয়া দূরত্ব ও ভূ–কম্পনের (ground motion) ভেতর কোন সম্পর্ক বের করা যায় কি না!

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য দুটো টেকটোনিক প্লেটের রূপান্তরিত সংযোগ সীমানায় (Transform Plate Boundary) অবস্থিত হওয়ার কারণে যথেষ্ট মাত্রায় ভূমিকম্প প্রবণ। সুতরাং, পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য তথ‌্যের কোন অভাব ছিল না তাদের কাছে।

বিজ্ঞানী দুজন একটি বিশেষ ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত ভূমিকম্পের তথ্যগুলোকে দূরত্ব ও ভূ–কম্পনের ভিত্তিতে গাণিতিকভাবে ১০ ভাগে ভাগ করে একটা একটা পরিমাপ পদ্ধতি চালু করলেন। এ পদ্ধতিতে ভূমিকম্পের সর্বনিম্ন মাত্রা ০ এবং সর্বোচ্চ মাত্রা ১০ নির্ধারণ করা হলো। পদ্ধতিটির নাম দেওয়া হলো রিখটার মাপ (Richter Magnitude Scale)।

রিখটার মাপের মূলনীতি খুব সাধারণ। রিখটার মাপ একটি দশ ভিত্তিক লগারিদমিক স্কেল। এ পরিমাপ পদ্ধতিতে ভূমিকম্পের মাত্রা ১ বাড়লে দূরত্ব অথবা ভূ–কম্পনের যে কোন একটি দশগুণ বাড়বে। অর্থাৎ, দূরত্ব যদি অপরিবর্তিত থাকে তবে রিখটার মাপে মাত্রা ১ বৃদ্ধি পেলে ভূ–কম্পনের বিস্তার দশগুণ বড় হবে। আবার ভূ–কম্পনের বিস্তার একই থাকলে রিখটার মাপে মাত্রা ১ বৃদ্ধির ফলে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব দশগুণ বাড়বে।

উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে উৎপন্ন হওয়া ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে ভূ–কম্পনের বিস্তার হয় ২৫ মিলিমিটার। যদি একই জায়গায় একটি ৬ মাত্রার ভূমিকম্প উৎপন্ন হয় তাহলে সেটা ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের তুলনায় দশগুণ বড় [২৫×১০=২৫০ মিলিমিটার] বিস্তারবিশিষ্ট ভূ–কম্পনের গ্রাফ তৈরি করবে।

একইভাবে ধরা যাক রিখটার মাপে ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে ভূকম্পলেখে ২৫ মিলিমিটার বিস্তার বিশিষ্ট ভূ–কম্পন ধারণ করা হল। ভূকম্পলেখ থেকে দেখা গেল ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। তাহলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে যদি একই বিস্তারের ভূ–কম্পন রেকর্ড হয় [২৫ মিলিমিটার] তাহলে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব হবে দশগুণ অর্থাৎ ১০০×১০= ১০০০ কিলোমিটার।

একইভাবে আমরা বলতে পারি রিখটার মাপ অনুযায়ী ভূমিকম্পের মাত্রা ২ বাড়লে উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব অথবা ভূ–কম্পনের যে কোন একটি ১০০ গুণ বাড়বে।

সুতরাং, উপরের উদাহরণগুলো থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে দূরত্ব অথবা ভূ–কম্পনের বিস্তারের পারষ্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ভূমিকম্পের রিখটার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, রিখটার মাপ দেখতে কেমন? স্কেল শব্দটা শুনলে স্বভাবতই স্কুল–কলেজে ব্যবহৃত কাঠের বা প্লাস্টিকের রুলারের ছবি মাথায় আসে।

রিখটার মাপ একটি গাণিতিক সমীকরণ। রিখটার মাপের সমীকরণটি দেখতে এমন: চোখ টিপি

সমীকরণটির মাধ্যমে রিখটার মাত্রা হিসাবে ML(Local Magnitude) নির্ণয় করা হয়। সমীকরণটি তৈরির সময় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার আশেপাশে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর [~১০০ কিলোমিটার] তথ্য ব্যবহার করার কারণে এ সমীকরণের মাধ্যমে ৬০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা সমাধান কল্পে পরবর্তীতে রিখটার ও গুটেনবার্গ ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয় করার জন্য Surface wave magnitude scale [MS] ও Body wave magnitude scale [mb] নামে আরও দুটো পরিমাপ পদ্ধতি প্রণয়ন করেন।

চিত্র: রিখটার মাপে ব‌্যবহৃত ভূমিকম্পের মাত্রা

ভ্রামক মাপ [Moment Magnitude Scale]:

চার্লস রিখটার ও বিনো গুটেনবার্গ যখন রিখটার পদ্ধতি প্রণয়ন করেন তখন তাদের লক্ষ্য ছিলো দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় সংঘটিত মাঝারি মাত্রার [৩ থেকে ৭ মাত্রা] ভূমিকম্পগুলোর জন্য একটি কার্যকরী পরিমাপ পদ্ধতি তৈরি করা। এ কাজে তারা একটি বিশেষ ধরনের ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্রে ধারণকৃত ভূমিকম্পের তথ্য ব্যবহার করেছিলেন। এ কাজে তাঁরা যে ভূমিকম্পগুলোর তথ‌্য ব‌্যবহার করেছিলেন সেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল ভূমিকম্প পরিমাপক স্টেশন থেকে ~১০০ কিলোমিটার দূরত্বে।

পরবর্তীতে দেখা গেল অপেক্ষাকৃত বড় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে [~৭ এর চাইতে বড় মাত্রা বিশিষ্ট] রিখটার পরিমাপ পদ্ধতি ব্যবহার করে সঠিকভাবে মাত্রা নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সত্তরের দশকের ভূ–বিজ্ঞানীরা রিখটার মাপকে পরিমার্জিত করে নতুন একটি পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। এ পদ্ধতির নাম ভ্রামক মাপ বা Moment Magnitude Scale, সংক্ষেপে MMS। এ পদ্ধতিতে ভূমিকম্পের মাত্রা MW দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

ভ্রামক মাপ বা মোমেন্ট ম‌্যাগনিচ‌্যুড স্কেলের সমীকারণটি দেখতে এরকম: চোখ টিপি

ভ্রামক মাপ পদ্ধতি থমাস হ‌্যাংকস ও হিরু কানামোরি নামক দুজন ক‌্যালটেক ভূমিকম্পবিদের অবদান। ভূমিকম্পের ফলে শিলাস্তরে শক্তি নিঃসরণের (amount of energy released) পরিমাণের উপর ভিত্তি করে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। শিলাস্তরের কাঠিন‌্যের (rigidity) সাথে বিচ্যুতির দুই পাশে শিলাস্তরের সরণের পরিমাণ (displacement) ও বিচ্যুতির মোট দৈর্ঘ্যের (fault length) গুণফল থেকে ভূকম্প-ভ্রামক (seismic moment) বের করা হয়। সে এক ভয়াবহ জটিল হিসাবনিকাশ!

মনে প্রশ্নের উদয় হতে পারে, শিলাস্তরের বিচ্যুতির পরিমাণ ও বিচ্যুতির মোট দৈর্ঘ্য জানার জন্য কি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলে যেতে হয়? প্রকৃতপক্ষে শিলাস্তরের বিচ্যুতির পরিমাণ ও বিচ্যুতির দৈর্ঘ্য সাইজমোগ্রাম থেকেই জানা সম্ভব। তবে সেটাও ভয়াবহ জটিল ব্যাপারস্যাপার।

বর্তমানে বড় বড় ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা হিসাবে ইউএসজিএসের বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় যা লেখা হয় তা মূলত ভ্রামক মাপ পদ্ধতিতে নির্ণীত মাত্রা। নিম্নের সারণীতে ক্যালিফোর্নিয়ায় সংঘটিত কয়েকটি বড় ভূমিকম্পের তুলনামূলক মাত্রা রিখটার মাপে ও ভ্রামক মাপে দেখানো হলো।

সুতরাং, পত্রপত্রিকায় বড় বড় ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা হিসাবে আমরা যা দেখি তা মূলত ভ্রামক মাপ পদ্ধতিতে [MW] নির্ণীত মাত্রা। যেহেতু রিখটার পদ্ধতিতে মাত্রা নির্ণয় অপেক্ষাকৃত সহজ তাই প্রায় প্রতিটি ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার পদ্ধতিতেও নির্ণয় করা হয়।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব জানা থাকলে রিখটার স্কেলের মাত্রা হিসাব করা হয় সে স্থানে অনুভূত ভূ–কম্পনের (ground motion) উপর ভিত্তি করে আর ভ্রামক মাপ পদ্ধতিতে মাত্রা নির্ণয় করা হয় শক্তি নিঃসরণের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে। ভ্রামক মাপ পদ্ধতিতে মাত্রা ১ বৃদ্ধি পেলে শিলাস্তরে শক্তি নিঃসরণের পরিমাণ ৩২ গুণ বৃদ্ধি পায়।

সাধারণ হিসাবে বলা যায় ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে য পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয় তা হিরোশিমায় বিস্ফোরিত লিটল বয় নামক নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে নিঃসৃত শক্তির (nuclear yield) সমান (~প্রায় ১৫০০০ টন টিএনটি)। যেহেতু ভূমিকম্পের মাত্রা ১ বৃদ্ধি পেলে শক্তি নিঃসরণের পরিমাণ ৩২ গুণ বৃদ্ধি পায় সে হিসাবে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ৩২ টি লিটল বয়ের বিস্ফোরণের সম্মিলিত শক্তির সম পরিমাণ শক্তি নিঃসৃত হয়। একইভাবে বলা যায় একটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে নিঃসৃত শক্তি প্রায় ৩২×৩২=১০২৪টি লিটল বয়ের বিস্ফোরণের সমান।

মারকেলি প্রাবল্য মাপ [Mercalli Intensity Scale]:

ভূমিকম্পের প্রাবল্যের উপর ভিত্তি করে তৃতীয় যে পদ্ধতিটি প্রণয়ন করা হয়েছে তার নাম মারকেলি প্রাবল্য মাপ বা Mercalli Intensity Scale. এ পদ্ধতিটি রিখটার মাপ বা ভ্রামক মাপ পদ্ধতির চাইতে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের। মারকেলির পদ্ধতিতে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয় করার সময় মাটির ধরন, জনবসতি, ভূ–প্রকৃতি, কৃত্রিম স্থাপনা ইত্যাদি বিষয়কে হিসাবে ধরা হয়।

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ভূমিকম্প নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত ১০ মাত্রা বিশিষ্ট রসি–ফোরেল পদ্ধতিতে বদলে নিয়ে ইতালিয় বিজ্ঞানী Giuseppe Mercalli একটি নতুন পরিমাপ পদ্ধতি তৈরি করেন। তার নামানুসারে পদ্ধতিটির নাম দেওয়া হয় মারকেলি মাপ।

প্রথম দিকে মারকেলি মাপে ভূমিকম্পের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ১০। পরবর্তীতে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এডল্ফ ক‌্যানক‌্যানি মারকেলি স্কেলের মাত্রাকে বাড়িয়ে ১০ এর পরিবর্তে ১২ করেন। পরবর্তীতে অগাস্ট হাইনরিখ সিবার্গ নামে এক জার্মান বিজ্ঞানী পদ্ধতিটিকে নতুন করে ঢেলে সাজান। পদ্ধতিটির নতুন নাম হয় মারকেলি–ক‌্যানক‌্যানি–সিবার্গ মাপ। ১৯৩০ এর দশকে বিজ্ঞানী উড এবং নিউম‌্যান পদ্ধতিটিকে পরিমার্জিত করে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত করেন। পরবর্তীতে রিখটার পদ্ধতির জনক চার্লস রিখটার মারকেলির পদ্ধতিটিকে আরও পরিমার্জিত করেন। বর্তমানে এ পদ্ধতিটি পরিমার্জিত মারকেলি মাপ (Modified Mercalli Scale, সংক্ষেপে MM বা MMI) নামে পরিচিত।

মারকেলি মাপে ভূমিকম্পের মাত্রাকে I থেকে XII পর্যন্ত মোট বারো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নের সারণীতে মারকেলি মাপের ভাগগুলো দেখানো হলো।

মারকেলি মাপ রিখটার মাপ বা ভ্রামক মাপের তুলনার পুরোপুরি ভিন্ন ধরণের পদ্ধতি। রিখটার বা ভ্রামক মাপ পদ্ধতিতে একটি ভূমিকম্পের মাত্রা যেখান থেকেই নির্ণয় করা হোক না কেন সবসময়ই তা একই থাকে। আর মারকেলির পদ্ধতিতে ভূমিকম্পের মাত্রা স্থানভেদে ধ্বংসযজ্ঞের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয়।

মারকেলি মাপের সাথে রিখটার মাপ বা ভ্রামক মাপের কোন সরলরৈখিক সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯ মে ২০১১ তারিখে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় সংঘটিত ০.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের [উৎসস্থলের গভীরতা ৪ কিলোমিটার] মাত্রা মারকেলি মাপে নির্ণয় করা হয়েছিল III অথচ সল্টা, আর্জেন্টিনায় সংঘটিত ৪.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের [উৎসস্থলের গভীরতা ১৬৪ কিলোমিটার] মাত্রা মারকেলি স্কেলে নির্ণয় করা হয়েছিল I.

প্রশ্ন করা যেতে পারে, এইরাম কেন ভাই? তাইলে ক্যামনে কী?

উত্তরে বলা যায়, মারকেলির মাপে ভূমিকম্পের মাত্রা যেহেতু ধ্বংসযজ্ঞের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় তাই কোন ভূমিকম্পের মাত্রা মারকেলি মাপে জানা মাত্র ধ্বংসযজ্ঞের পরিমাণ সহজে আন্দাজ করা যায়। অপরপক্ষে রিখটার মাপে বা ভ্রামক মাপে ভূমিকম্পের মাত্রা জানার সাথে সাথে উৎসস্থলের দূরত্ব, ভূ–প্রকৃতি, জনসংখ্যা, কৃত্রিম স্থাপনা ইত্যাদি বিষয় জানার পরে ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃতি আন্দাজ করা যায়।

সুতরাং, বোঝা গেল দুই ধরনের পদ্ধতিরই প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

এছাড়াও স্বল্প দূরত্বে সংঘটিত ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলোর মাত্রা নির্ণয়ের জন্য ভূমিকম্প সংঘটন কাল মাত্রা বা Earthquake Duration Magnitude (Md) নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

সুতরাং, আজকের পর্বে আমরা জানলাম:

  • রিখটার মাপে নির্ণীত মাত্রাকে ML দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  • রিখটার মাপে বডি ওয়েভ থেকে নির্ণীত মাত্রাকে mb দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  • রিখটার মাপে সারফেস–ওয়েভ থেকে নির্ণীত মাত্রাকে MS দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  • ভ্রামক মাপে বা মোমেন্ট ম‌্যাগনিচ‌্যুড স্কেলে নির্ণীত মাত্রাকে MW দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  • পরিমার্জিত মারকেলি মাপে নির্ণীত মাত্রাকে MM বা MMI দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
  • এছাড়াও ভূমিকম্প সংঘটন কাল থেকে নির্ণীত মাত্রাকে Md দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

ভবিষ্যতে পত্র–পত্রিকায় বা ওয়েবসাইটে ভূমিকম্পের মাত্রা দেওয়া থাকলে তা কোন পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়েছে সেটা দেখে নিতে ভুলবেন না।

[চলবে...]

দ্রষ্টব‌্য:
○ এ পর্বের তথ‌্যগুলো ইউএসজিএস, উইকিপিডিয়া ও SCIGN থেকে মুক্তহস্তে চুরি করে নেওয়া হয়েছে। চোখ টিপি
○ এ পর্বে বহুল প্রচলিত দুটো বৈজ্ঞানিক শব্দের বদলে নতুন বাংলা প্রতিশব্দ ব‌্যবহার করা হয়েছে:

  1. ভূকম্পলেখ = সাইজমোগ্রাম (Seismogram)
  2. মাপ = স্কেল (Scale)


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

চলুক
এতসব মাপ থাকতে টিভিতে শুধু রিখটার স্কেলের মাপের কথাই বলে কেন? দেখা যাচ্ছে যে এর চেয়েও আধুনিক স্কেল তো ব্যবহার করা যায়।

দ্রোহী এর ছবি

আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতিই মূলত ব‌্যবহৃত হয়। তবে রিখটার মাপ নির্ণয় করা যেহেতু সবচাইতে সহজ তাই প্রায় প্রতিটি ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেই রিখটার মাপ বের করা হয়। বর্তমানে রিখটার মাপ প্রায় বাতিল পদ্ধতি বলা চলে।

বর্তমানে আসলে ডিফারেন্সিয়াল জিপিএস প্রযুক্তি ব‌‌‌্যবহৃত হয়। পরের পর্বে বাংলাদেশ নিয়ে লিখতে গিয়ে এ সম্পর্কে লিখব।

রেডিও-টেলিভিশন-পত্রিকায় ব‌্যবহৃত সব তথ‌্য সঠিক হতে হবে এমন কোন নিয়ম তো নাই। চোখ টিপি

তাপস শর্মা এর ছবি

ফাটাফাটি চলুক

দ্রোহী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নীলকান্ত এর ছবি

এক রিখটারের কাহিনী পড়ে ২-১ এ যে অবস্থা হইছিল, আপনে তো পুরা ইতিহাস তুলে দিছেন ইয়ে, মানে...

সিরিজটা পড়ে ভালো লাগতেছে।


অলস সময়

দ্রোহী এর ছবি

পুরা ইতিহাস পাইলেন কৈ? সমীকরণগুলো ব‌্যাখ‌্যা করা শুরু করলে লোকজন ধরে মাইর দিতো তাই বলতে গেলে পুরো ইতিহাস বাদ দিয়া গেছি। দেঁতো হাসি

তারেক অণু এর ছবি

চলুক অনেক কিছু জানা গেল, ধন্যবাদ।

দ্রোহী এর ছবি

কোলাকুলি

অন্যকেউ এর ছবি

আমি এই সিরিজ দাঁতে কামড়ে ধরে থাকা পাব্লিক, এবং আপ্নার টেবলপাঙ্খা। তারপরেও আমি এই পর্বের তেবরো পরতিবাদ জানাই। পড়তে পড়তে আমার দাঁত খটখট করে একটা আরেকটার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং সেটিং নড়বড়া করে দেয় এবং এনামেল ক্ষয় করে ফেলে। কঠিন কঠিন সমীকরণ দিয়ে তারপর আবার আপনি চোখটিপি ইমো দিছেন, এইটা বিশুদ্ধভাবে হৃদয়বিদারক। মন খারাপ

যাই হোক, এই পর্বে আপ্নি যা যা ক্ষতিসাধন কর্ছেন, তার ক্ষতিপূরণস্বরূপ চটজলদি আমি এবং আমরা সিরিজের নতুন পর্ব চাই। যোগ, সিরিজ সমাপ্তির পরে ই-বইয়ের কথা স্মরণে রাখলাম। সিরিজ সমাপ্তির পরে আসল লেখক আগুনের গোলারে বুফে খাওয়ামু। দেঁতো হাসি

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

দ্রোহী এর ছবি

কোলাকুলি

মেয়ে দেখেন তিনটা। আপনার জন্য একটা, আমার জন্য দুইটা। দেঁতো হাসি

দ্রোহী এর ছবি

হই মিয়া, কঠিন দেখলেন কী? আজকের পর্বের মালপত্তর এর চাইতে সহজ ভাষায় দুনিয়ার কোন বইয়েও পাবেন না।

গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার মত করে সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা না করার দোষ চাপা দিতে চোখ টিপি দিসি। সমীকরণগুলো কীভাবে তৈরি হয়েছে তা ব্যাখ্যা করলে স্কেল তৈরির প্রক্রিয়াটা আসলে পানির মতো সহজ করে বুঝতে পারতেন। কিন্তু ব্লগে সমীকরণ ব্যাখ্যা করার দরকার নাই তাই চোখ টিপি দিয়েই ব্যাখ্যার কাজটা সেরে ফেলেছি।

অন্যকেউ এর ছবি

চোখ টিপি দিয়েই ব্যাখ্যার কাজটা সেরে ফেলেছি।

হো হো হো

_____________________________________________________________________

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

শালার আপ্নে এক্টা দারুণ লোক! এইটা একটা ই-বুকের পরিণতি পাইতেছে! শেষ হইলেই মডুমণ্ডলীকে এনজাইম-সাবস্ট্রেট "লক-এণ্ড-কী' মডেলে ধরব!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

গৌতম এর ছবি

আপনাকে তীব্রভাবে মাইনাস দিতে চাই- এতো কঠিন করে লিখলেন!

তারপরও লিখতে থাকেন। লিখতে লিখতে যদি হাত আসে... চোখ টিপি

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

দ্রোহী এর ছবি

বস, এই পর্বের বিষয়বস্তু এর চাইতে সহজ করে দুনিয়ার কোন বইতেও পাবেন না। দেঁতো হাসি

লেখাটা কঠিন লাগার কারণ প্রচলিত ইংরেজি শব্দগুলোর বদলে বাংলা শব্দের ব্যবহার। ইদানীং, পত্রপত্রিকায় বড় বড় মানুষেরা ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার উপর জোর দিতে বলে।

মহাজ্ঞানী মহাজনদের পথ অনুসরণে বড় অনীহা, তাই ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলায় বিজ্ঞান চর্চায় বাধ্য করছি সবাইকে। দেঁতো হাসি

হিমু এর ছবি

আগামী পর্ব লেখার আগে ঝাড়া ছয়টি মাস বার্ট্রাণ্ড রাসেলের বইপত্তর ঠাঠা মুখস্থ করেন। তারপর দেখবেন বাংলায় খই ফুটবে।

সচল জাহিদ এর ছবি

চলুক চলুক চলুক

পড়ছি।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

দ্রোহী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

দ্রোহী এর ছবি

দেঁতো হাসি

চরম উদাস এর ছবি

দারুণ হাততালি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

খুজতেছিলাম সবচেয়ে বড় ধাক্কা কতো বড় স্কেলের ছিল। যাক ১০ মাত্রার কোন ধাক্কা এখনো খায়নি দুনিয়া। দেঁতো হাসি
আর রোজ কেয়ামতেরও দেরী আছে তাইলে। কেয়ামতের দিন পাহাড় পর্বত সহ উড়ে যাবার কথা, ওটা নিশ্চয়ই ১০০ মাত্রার বেশী হবে! ইয়ে, মানে...

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দ্রোহী এর ছবি

ভূমিকম্পের রেকর্ডেড ইতিহাসে ১৯৬০ সালে সংঘটিত চিলির ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্পই সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। ভূমিকম্প রের্কড করা শুরু করার আগেও প্রচুর বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে। তাদের কোনটির মাত্রা ১০ ছাড়িয়েছিল কিনা তা জানার কোন উপায় নাই। মন খারাপ

প্রাকৃতিক নিয়মে কেয়ামত হইতে আরো অনেক দেরি আছে; অন্ততপক্ষে ৫০-১০০ বিলিয়ন বছর বাকি আছে। কিন্তু যদি কেয়ামত সংঘটনের দায়িত্ব মানুষের হাতে ছেড়ে দেন তাহলে বলা যায় মানুষের হাতে আর বড়জোর ১০০ বছর আছে। শিল্প বিপ্লবের পর দুইশ বছরেই পৃথিবীর বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে মানবজাতি।

স্বাধীন এর ছবি

দারুন একটা ই-বুক হবে চলুক

দ্রোহী এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ই-বুকের জন্য লেখাটা নতুন করে সাজাতে হবে।

নিটোল এর ছবি

জটিল একটা সিরিজ। হ্যাটস অফ!

_________________
[খোমাখাতা]

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।