১৯৮৩-৮৪ এর কথা।
রায়েরবাজার পটারির পশ্চিমে, কালিমন্দিরের আখড়ার নামায় একটু গেলেই লম্বা লম্বা কচুরি পানা, ভরা একটা ময়লা ডোবা ছিল। ডোবার পার ভর্তি ছিল কেয়ার কাঁটাঝাঢ়, চালতা আর মান্দাল গাছে। ডোবার ওইপারে ব্রিটিশ আমলের খয়ে যাওয়া বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ। ডোবা আর বাঁধ এর মাঝামাঝি একটা পুরাতন কবরস্তান। কখনো কারও পারিবারিক কবরস্তান হয়ে যাত্রা শুরু করে থাকলেও, ততদিনে তা বারোয়ারি।
পটারির এইপাশে ছাতামসজিদের পিছনের টিনশেড খুপচিগুলির একটা তে কালাইম্মা আর তার মা থাকতো। কালাইম্মা আগে রিক্সা চালাত, বাজারে মিন্তিগিরি করত,আর ওর মা করত কাঁথা সিলাই। একবার পাড়ার এক বড়ভাই সু্যোগ করে দেয়ায় কালাইম্মা চলে গেল চিটাগাং, কি এক কারখানায় কাজ নিয়ে। কয়েকমাসেই কালাইম্মাদের অবস্থা ফিরে গেল, এখন শুধু মা-কে তার কাছে নিয়ে যাবার অপেক্ষা।
এরই মধ্য, ধুম আষাঢ়ের এক ভোরে প্রতিবেশিরা দেখল কালাইম্মার মায়ের ঘরে দরজা আর খোলে না। এক দিক এক রাত গেলে পর পাশের ঘরের পপির-মা এসে দরজা খুলেই চিৎকার করে সারাবাড়ী মাথা তুলল। কালাইম্মার মা মেঝেতে অসাড় হয়ে চোখ উলটে পড়ে আছে। শেষে কি আর করা। ছাতামসজিদের ঈমাম সাহেব, মোড়ের ফার্মেসির কম্পাউন্ডার, পটারির ম্যানেজার, সবাই মিলে টাকা তুলে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করল। দাফন করা হল বাধের পাশের কবরস্তানেই।
ঈমাম সাহেবই বোধহয় কালাইম্মার কাছে চিঠি লিখে তাকে খবরটা জানিয়েছিল। পাঁচদিনের মাথায় কালাইম্মা হাজির, সংগে দারগা সাহেব। কালাইম্মার একটাই কথা, পাড়ার সবাই মিলে টাকার লোভে ওর মা কে খুন করে মেরে ফেলেছে। সব কটাকে জেলের ভাত খাইয়েই তার পরান ঠান্ডা হবে। দারগা সাহেব প্রাক্টিক্যাল মানুষ, মুখের কথাতে তিনি নড়েন না। খুন প্রমানের জন্য ময়না তদন্ত করতে হবে, নইলে তিনি কালাইম্মার আর্জি নেবেন না।
পাড়ার হেরিংবোন ইটের রাস্তা উপর তখন এক বিঘত চার আংগুল পরিমান প্যাঁচপ্যাচা কাঁদা। বৃষ্টি কখনো টিপটিপ, কখনো ঝমঝম। এরই মধ্য হাজারিবাগের মেথরপট্টি থেকে বিফইদ্দা (বিপ্রদ?) কে ডেকে আনা হল। তারপর কারও মাথায় ছাতা, কারও কলা পাতা, কেই এম্নিতেই উদোম মাথা নিয়ে ছুটল বাধের পাড়ে। জটলা যত এগোয়, তত বড় হয়। পথের শেষে তা ঝোপঝাড় ঠেলে চলল। এত লোক একসাথে এখানে কখনো আসে না। চিনা যোঁকেদের সেদিন ছিল যিয়াফত। কিন্ত গুইসাপেদের যে পরিবারটা সেখানে থাকত, তাদের সবাইকে সর সর করে এঁকেবেঁকে দৌড়ে ডোবায় ঝাঁপ দিয়ে প্রান রক্ষা করতে হয়েছিল।
এই কবরস্তানে নতুন কবর একটাই। কাঁচা মাটি দেখেই চেনা যায়। কালাইম্মা তার মায়ের কবরের পাশে এসে তার গ্যাবার্ডিনের সাদা প্যন্টের মায়া না করেই কাঁদার মধ্যে পা ছড়িকে বসে হউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল। জটলাও আঁটো বুননের বেড়ার মত ঘিরে ধরল কবরটাকে। বেড়ার মধে রইল শুধু কালাইম্মা আর ছাতা হাতে দারগা সাহেব। অতিরিক্ত নির্দেশ ছাড়াই বিফইদ্দা বেলচা হাতে এগিয়ে গেল তার কাজে।
খুব সাবধানে বেলচা দিয়ে মাটির সরাতে শুরু করল বিফইদ্দা। ভেজা মাটির ঢিবির নিচ থেকে যেই বেরিয়ে এল সবুজ-হলুদ-সোনালি কাঁচা বাঁশের চাটাই তক্ষুনি জটলার বেড়াটা যেন এক লাফে কয়েক হাত পিছিয়ে গেল। সবাইকে নাক-মুখ-চোখ এ এসে ধাক্কা দিয়ে গেল গা গোলানো তীব্র মানুষ পচা গন্ধ। কালাইম্মাও কান্না থামিয়ে ভেজা প্যন্টের পকেট খুঁজে একটা রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরল। বিফইদ্দার অবশ্য কোন বিকার নেই, সে মনযোগ দিয়ে আর্দ্র চাটাই সরিয়ে নিতে থাকল একটা একটা করে। কিন্ত হঠাৎ শেষ চাটাইটা সরিয়েই একটা লাফ দিয়ে বিফইদ্দা পিছিয়ে এল। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। দারগা সাহেব হেঁকে উঠলেন, “কিরে ম্যাথরের বাচ্চা কি দ্যহস?” বিফইদ্দা শুধু খ-খ-খ-খ করতে লাগল আর তার কালো চেহারা প্রথমে ছাই তার পর সাদা হতে শুরু করল। দারগা সাহেব ছাতা হাতে এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে অবাক বিস্ময়ে তাঁকিয়ে রইলেন কবরের এক কোনায় জবুথবু হয়ে বশে থাকা কালাইম্মার মায়ের দিকে।
===
কালাইম্মার মায়ের লাশটা পাওয়া যায় কবরের এক কোনায়, হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায়। কবরের ভিতর তখন এক হাত পানি, শুধু তার কাঁধ আর মাথাটাই ছিল পানির উপর। সারা কবরে বা তার লিক লিকে শরিরে কোন কাফন না থাকলেও, তার ঠোটের ফাঁক দিকে বেরিয়ে ছিল সাদা কাফনের একটা কোনা। আর তার মুখটা তোলা আকাশের দিকে, ঘোলা দুচোখ তখনো সম্পুর্ন উন্মুক্ত।
মন্তব্য
স্বাগতম দুর্দান্ত!
হাঁটুপানির জলদস্যু
অশেষ ধন্যবাদ।
খাইছেরে! সত্য ঘটনা??
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
আমি বড় হইছি পাঠশালার গলিতে। এই কাহিনি শুইনা টাস্কি খাইলাম।
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ
অজ্ঞাতবাস
ডরাইছি । ঘটনা সত্যি নাকি?
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
এমন ভয় না দেখাইলেই কি চলতো না ? আমি আবার রাতে একা ঘুমাই
--------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
ভয় দেহান ক্যা ??!! আপনে খুপ খ্রাপ !!
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ষষ্ঠ পাণ্ডবদার মন্তব্যের সূত্র ধরে গল্পটি পড়া হলো। কিন্তু এমন দুর্দান্ত গল্পবাজ কোথায় হারালেন?
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
সাদিয়া-দিদির মত আমিও বলি, এমন দুর্দান্ত গল্পবাজ কোথায় হারালেন?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ভৌতিক কাহিনী নাকি সত্য ঘটনা দুর্দান্ত ভাই ?
নতুন মন্তব্য করুন