ডিসেম্বর আর ফেব্রুয়ারি এক এক বছর আসে আর বাবাজিদের মনে ভাষা, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের মুল্যবোধ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে গলাবাজির খায়েশ চাগান দেয়।
বাবাজিদের জন্ম স্বাধীনতার পর। তাদের বাপ-চাচারা গুড বয়জ বলে যুদ্ধে যেতে হয়নি, অনেকে তো দেশেই ছিলেন না। স্বাধিনতার পর বাবাজিদের পিতামহেদের দখল করে নেয়া এনেমি প্রপার্টির (এর মধ্যে হিন্দুদের কারখানা, হোটেল, আড়তই এগুলোই বেশী) অপর গড়ে তোলা বাবার কারখানা নয়ত এন-জি-ওর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। রাজধানির সরকারি স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি (কেউ কেউ আংরেজি মাধ্যমে) ডিঙ্গিয়ে এখন হয় দেশেই মোবাইল ফোন নয়ত ক্রিম-সাবান বেচার চাকরি করছে। অথবা এসে বসেছে দাদুর রেখে যাওয়া গ্রুপ অব কোম্পানিতে বাবার পাশের কেদারায়। কোন কোন বাবাজি চলে গেছে বিদেশে সেটেল করতে।
ফেব্রুয়ারি ডিসেম্বর মাস দুটি এলেই বাবাজির পিত্ত উর্ধমুখি হয়। কি এক ট্রান্স এর মধ্যে চলে যায় সে। বার্গার এ কামড় দিয়ে, আইপডে ভাওয়াইয়া গান বাজিয়ে ঝুঁকতে ঝুঁকতে ইন্টারনেটের দেয়ালে দেয়ালে ‘তুই রাজাকার’-‘পাকিস্তানীমুক্ত পৃথিবী চাই’ জাতীয় চিকা মারতে থাকে, উপর্যুপরি। গুগল-ইউটিউব ঘাঁটিয়ে যা-কিছু চোখে লাগে, তা হেথা হোথা পোস্ট করে যেতে থাকে। এক বাবাজি অন্য বাবাজির প্রতিযোগি হয়ে ওঠে। কাঁদার মত এ ওর গায়ে নতুন নতুন ইশটাইলে একই তথ্য ছুঁড়ে মারতে থাকে। কিছু বাবাজি দূর থেকে হাত তালি দেয়। অন্য বাবাজিরা ইন্টারনেটের দেয়ালের চিকার লিঙ্ক দেখে আর মনে মনে ডাইরেক্ট-একশানের স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারি আর সতেরই ডিসেম্বর আসা মাত্রই যেই কে সেই। জ্বলজ্বলে ইঙ্কিলাবের আগুনে এক বালতি পানি। বাবাজি আবার তার পুরানা ফর্মে। ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। বাবাজির বেলুচিস্তানি নাগড়া বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে, শুক্রবারে চুল কাটতে গিয়ে বিহারি নাপিতের সাথে আড্ডা চলে হিন্দি/উর্দুতে মিশিয়েই, আর গাড়ির সিডি প্লেয়ার আবার উঠে আসে স্ট্রিংস, জুনুন নইলে নুসরাত ফতেহ আলি।
***
যদি রাজাকারির সংজ্ঞা হয় একাত্তরে হানাদারবাহিনি কে সহায়তা করা, তাহলে একাত্তরে পাকিস্তানের সবচাইতে বড় সহায়ক যুক্তরাষ্ট্র সবচাইতে বড় রাজাকার নয় কেন?
একাত্তরে মা-বোনের বলাৎকার কারি রাজাকারের সাথে ওঠাবসা, তাদের সমাজে উচ্চস্থানে ওঠার সু্যোগ করে দেয়া মহা অন্যায়; একি যুক্তিতে হানাদারদের সরাসরি অস্ত্র, সরঞ্জাম আর পরোক্ষভাবে কূটনৈতিক সহায়তা দানকারি আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার ডলার ঢেলে ডিগ্রি নিতে যাওয়াটাও তাহলে অন্যায় নয় কেন?
বুঝলি বাবাজি ব্যপারটা অত সোজা সাপ্টা নয়। সাদা-কালো ছাড়াও আছে ছাই রঙ।
***
কলাবাগানের টিনেজার রিক্সাচালক ফিরোজ, বাগেরহাটের চিংড়ির ঘেরের চ্যাংড়া পোলা মুন্সুর আলি, হালিশহরের গার্মেন্টসে নোয়াখালি থেকে কাজ করতে আসা আমেযা-আসিয়া দুই বোন, এদেরকে দেখেছি ২০০৫ এর ফেব্রুয়ারিতেও, ডিসেম্বরেও। বছরের আর দশটা মাসের চাইতে কোন ফারাক নাই। তাদের দিন আসে দিন যায়। ওরাও যুদ্ধপরাধিদের শাস্তি চায় নিশ্চই, কিন্ত বলে ওঠার ফুরসত নাই। কিন্তু হকটা তাদের পাক্কা। ওরা দেশটাকে এগিয়ে নিচ্ছে নিজের কাঁধে চাপিয়ে। গতি ধীর, কিন্তু গন্তব্য নিশ্চিত।
ওদের নুয়ে পড়া কাঁধের উপর চড়ে বসে আমাদের বাবাজি ডাইরেক্ট-একশানের স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছে।
মন্তব্য
যথার্থ। আমরা মধ্য ও উচ্চবিত্ত অনেক সুবিধাবাদীই একদেশদর্শী। ছাই রং টার কথা ভুলে যাই। আবার এও সত্য যে, সব বদল তো আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়, তখন সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেম বদলের চেষ্টা-অল্প করে!
শুভাশীষ।
পোস্টটা পড়ে ভালো লাগলো। বারোমাস প্রতিরোধ চাই। চিন্তায়, কর্মে, বাক্যে।
হাঁটুপানির জলদস্যু
রাজাকারির সংজ্ঞা তো বিশ্বাসঘাতকতার সাথে সম্পর্কিত, যুক্তরাষ্ট্র শত্রু দেশ হতে পারে। আর আপনি মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে পুরো দেশটাকেই জড়িয়ে ফেলছেন, এই দেশকে গালি দেয়াটাও অতো সাদাকালো না। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থনও ছিল যথেষ্ট।
নতুন মন্তব্য করুন