(বাংলাদেশের তেল গ্যাস নিয়ে একান্ত নিজস্ব কিছু অনুযোগ আর আবদার লিখে রাখছি। ভাটি মানে ডাঊনস্ট্রিম; তেল-গ্যাসের দুনিয়ায় পরিশোধন আর বিপননকে সবাই ডাঊনস্ট্রিম বলেই জানে। উজান বা আপস্ট্রিম হল অনুসন্ধান, খনন আর উত্তোলন; এ নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছা আছে।)
বাংলাদেশের আর সব খনিজের মত তেল, গ্যাস আর কয়লার মালিক এর জনগন আর এর ভাটি’ র খবরদারির মালিক করা হয়েছে বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম কর্পোরেশন বা ‘বাপেক’ কে। বাপেকের মোট সাতটি প্রতিষ্টানের মধ্যে একটি রিফাইনারি, দুটি লুব্রিক্যান্ট ব্লেন্ডিং কারখানা আর চারটি বিপনন প্রতিষ্টান রয়েছে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে বিমানবন্দর বা পতেঙ্গা যাওয়ার পথে দেশের একমাত্র ইস্টার্ন রিফাইনারিটিকে অনেকেই দেখে থাকবেন। ১৯৬৮ সালে চালু হওয়া এই রিফাইনারিটির নকশা করা হয়েছিল তখনকার প্রচলনমত, সেই সময়ে মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পানির দামে পাওয়া মধ্যপ্রাচ্যের হাল্কা ক্রুড (আরব লাইট বা কুয়েত এক্সপোর্ট) আর ততকালীন দেশের ক্রমবর্ধমান পেট্রলের বাজার দেখে। স্বাধীনতার পর পর আমাদের উপর যে বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা চড়ানো হ্য় তার পয়লা কিস্তিতেই আমরা ক্রুডের সেই পানির দর হারিয়েছি। পাকিস্তান আদ্যাবধি সৌদিআরব আর কুয়েত থেকে প্রায় মাগ্নায় তাদের দেশের ৮০% ভাগ ক্রুড পায়। যে জিনিসের দাম ধাই ধাই করে ওঠা নামা করার সম্ভাবিলিটি থাকে, তা কেঊ বাজারদরে কেনে? অন্তত অর্ধেক চুক্তিদরে আর অর্ধেক বাজারদরে কিনতে হয় – আর একটি মাথা খাটিয়ে কঠিন হিসাব করার মত জ্ঞান, আর হাতিয়ারের অভাব আমাদের দেশে নেই। কিন্তু মজার কথা হল আমাদের বাপেক তাদের ১০০% ক্রুড বাজার দরে কিনে থাকে।
দেশের পেট্রলের চাহিদার প্রায় ৪০% এখান থেকে আসে। তা পেট্রল ছাড়া এই রিফাইনারি থেকে আর কি কি বের হয়? ইস্টার্ন রিফাইনারি আসলেই সিম্পল – এর এই মাথায় এক সের আরব লাইট ঢাললে, ঐ মাথা দিয়ে এক পোয়া নাফথা, আধা পোয়া কেরোসিন, এক পোয়া পেট্রল (MOGAS), আধা পোয়া ডিজেল, আর আধা পোয়া আলকাতরা বের হবে, আর রিফাইনারি নিজে আধাপোয়া খেয়ে নেবে। সেই ষাটের দশকে বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বেই ব্যাক্তিখাতে ডিজেলের কদর তেমন ছিলনা, আর বিমানে ব্যাবহারযোগ্য জেট এ-১ কেরোসিনেরও এখানে তেমন স্থানীয় প্রয়োজন ছিল না। তাই এই রিফাইনারি থেকে যে ডিজেল বের হয় তা গাড়িতে ব্যাবহারোপযোগী নয় আর জেট এ-১ কেরোসিন এখান থেকে তো এক ফোঁটাও বের হয় না।
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল, রাস্তাঘাট বেড়েই চলেছে; দেশের টুটাফাটা একটা আভ্যন্ত্ররীন নৌযোগাযোগ ব্যাবস্থা আছে। তাই আলকাতরার ঠিকানা হয়ে যায়। কিন্তু নাফথার, যার গন্তব্য মুলত পেট্রোকেমিকেলে, তার আর ব্যাবস্থা হয় না। আশ্চর্য হলেও সত্য, বাংলাদেশের ক্রুড না থাকতে পারে, কিন্তু নাফথার বিশ্ববাজারে সে বিরাট পিলিয়ার! প্রতি বছর বাপেক লাখ লাখ টণ নাফথা রপ্তানী করছে। বিশ্ব বাজারে ক্রুডের দাম উর্ধ্মুখী, সেই সাথে ২০০৫ এর পর বিশ্বব্যাপী কেমিক্যালসের খাঁই বাড়াতে নাফথার দামটাও উর্ধ্মুখী। ক্রুড বাজার দরে কিনলেও বাংলাদেশ কিন্তু নাফথার ক্ষেত্রে এ ভুলটি করেনি - ১০০% নাফথাই রপ্তানি হচ্ছে ২০০২ এর দিকে করা চুক্তিদরে।
তাহলে খাড়াইল টা কি? খাড়াইল এরকম। ফি বছর ১.৩ মিলিয়ন টন ক্রুড বাজারদরে আমদানি কর, তারপর এর এক সিকিভাগ দেশের গাড়িওয়ালাদের কাছে ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি কর আর আরেক সিকিভাগ কম দামে বিদেশে রপ্তানি কর। মজা না?
আরব লাইট হল দুনিয়ার সবাচাইতে দামী ক্রুডের মধ্যে একটি; কারন? প্রথমত আরব লাইট থেকে সের প্রতি বেশী ডিজেল বের করা যায় আর দ্বিতীয়ত পয়সাওয়ালা দেশগুলিতে ব্যাক্তিখাতে ডিজেলের কদর বেড়েই চলেছে। আমাদের ইস্টার্ন রিফাইনারির কনফিগারেশন সফটওয়ারে কিছু পরিবর্তন এবং তাপসঞ্চলনে অল্পকিছু হেরফের করে অন্যান্য কমদামি ভারি ক্রুড (ইন্দোনেশিয়ার মিনাস বা ইরানি হেভি) চালানো যাবে, এতে করে পেট্রল আর আলকাতরা উতপাদন বেড়ে যাবে আর নাফথার উতপাদন কমে যাবে।
পরের প্রজন্মের রিফাইনারিগুলিতে নাফথা আর আলকাতরার অর্ধেকটাকেই আরো প্রক্রিয়াজাত করে পেট্রলের পরিমান সের প্রতি তিন পোয়া করা যায়। বাকি নাফথাটাকেও অনুঘটকের দ্বারা বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে কেরোসিনের পরিমান বাড়ানো যায়। ক্লোন কম্পিঊটারের যেমন মডুলার নকশা – একটি রিফাইনারিও তেমনি মডুলার। আজকের দুনিয়ায় এক দুই লাখ ডলারে এই রকম অনুঘটক প্রযুক্তির লাইসেন্স কিনে নিয়ে দেশের প্রকৌশলিরা এরকম বিশেষ প্রক্রিয়াকরন মডুল বসাতে পারেন।
তেলের দাম তো সবে ১৩০ এ। এর মধ্য তেলের দাম আরো বাড়বে বলে আশা করা আশঙ্কা করাটা অমুলক নয়। এমতাবস্থায় নিরেট বাজারদরে ক্রুড কিনতে থাকাটা বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। সেদিন শুনলাম বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক নাকি পন্যদ্রব্যে হেজিং-এর পথ খুলে দিয়েছে ক্রুডে স্পেকুলেশনের পথাটাও যদি খুলে যায়, আর বাপেক যদি যথাযথ কমিশণ প্রদান করে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে ক্রুড কেনে, তাহলে এই ক্ষেত্রে দেশে উদ্দোক্তার অভাব হবে না।
মন্তব্য
বস, এই খাতে এইরকমআরো "আরব লাইট" লেখা ছাড়েন। বহুদ্দিন ধরে ফাঁকিবাজি করসেন, আর না।
হাঁটুপানির জলদস্যু
গুরুত্বপূর্ন লেখা । এইখাতের টেকনিক্যাল বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ ।
তাই ভিন্ন বিষয়ে জানতে চাচ্ছি ।
আপনার লেখা থেকে জানা গেলো পাকিস্তান আমলে 'আরব লাইট' পানির দরে পাওয়া যেতো । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরব দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করায় ঐ সুবিধা বঞ্ছিত হয় বাংলাদেশ ।
'৭৫ এর পনের আগষ্টের পর মেরুকরন ঘটে । আরবরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং পরবর্তী সরকার গুলো সৌদী-কুয়েতের সাথে সুসম্পর্ক ও বজায় রাখে ।
কিন্তু পানির দরে ' আরব লাইট' প্রাপ্তির সেই সুবিধা কি আর ফেরত পায়নি বাংলাদেশ?
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
আমার জানা মতে বেশ কয়েকবারই দেন দরবার করা হয়েছিল। ২০০৬-এ গদি ছাড়ার আগে খালেদা জিয়া শেখদের সাথে রাতের খাবারও খেয়েছিলেন একবছর বাকীতে তেল কেনার কথা পাড়তে, কিন্তু বাঘ কি আর ঘাস খায়?
অনেক কিছুই জানলাম। এরকম লেখা আরো চাই।
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
এটার তথ্যসূত্র দিতে পারলে ভাল হয়। একটা সময়ে পাকিস্তান বিনামূল্যে তেল পেত (তাও পাকিস্তানের অর্থনীতির ঋণাত্বক বৃদ্ধি আটকায়নি তাতে) ... তবে এখন পায় না বলেই মনে হয়। এই খবরটাও আমার বক্তব্যই সমর্থন করছে।
আমার যতদূর মনে পড়ে বাংলাদেশও কুয়েত থেকে সস্তায় তেল পায়। তবে এটা মনে হয় ২০% ডিসকাউন্টের তেল। এটা সঠিক জানি না।
হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
আপনার কথাই মেনে নিলাম। আশঙ্কা করছি জিলানীকে শেখেরা ফেরাবে না, কারন আফগানিস্তানে ন্যাটোবাহিনীর তেল সরবরাহের কলটা জিলানীর হাতে।
আপনি বোধ হয় ২০০৬ এর ডিসেম্বরে দিকে মোর্শেদ খানের বড় গলায় প্রচার করা সেই আশ্বাসের কথা বলছেন। সেই আশ্বাসের ফলে চট্টগ্রামে ডিস্কাউন্টেড তেল নিয়ে কোন ট্যাঙ্কার এসেছে বলে শুনিনি।
আমার জন্য এই জগৎ ও এর কারিগরি ব্যাপারস্যাপার একেবারেই নতুন। জটিল লাগল। আরব লাইট, ক্রুড-- এসব টার্ম সংক্ষেপে ডিফাইন করে দেয়া গেলে আমার মতো পাঠকদের জন্য ভালো হতো।
লেখার 'বাপেক' মনে হয় 'বাপেক্স' হবে।
Bangladesh Petroleum Exploration & Production Commpany Limited (BAPEX)
................................................................
আমার সমস্ত কৃতকর্মের জন্য দায়ী আমি বটে
তবে সহযোগিতায় ছিল মেঘ : আলতাফ হোসেন
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী
তেলবিষয়ে কিছু প্রাথমিক তথ্য আপনি এখানে পেতে পারেন। তেল গ্যাস নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত টীকা দেখুন এখানে।
আমার এই লেখাটা ভাটি নিয়ে, যেখানে বিপিসি বা বাপেক জড়িত। বাপেক্স উজান নিয়ে কাজ করে।
খুব ভাল তথ্যবহুল লেখা । দুঃখের বিষয় যেই লোকেরা এগুলো পড়লে কাজের কাজ কিছু হলেও হতে পারত তারা মনে হয় না ইহজীবনে কোনদিন এগুলো দেখবে ।
অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...
নতুন মন্তব্য করুন