(বাংলাদেশের তেল গ্যাস নিয়ে একান্ত নিজস্ব কিছু অনুযোগ আর আবদার লিখে রাখছি। ভাটি মানে ডাঊনস্ট্রিম; তেল-গ্যাসের দুনিয়ায় পরিশোধন আর বিপননকে সবাই ডাঊনস্ট্রিম বলেই জানে। উজান বা আপস্ট্রিম হল অনুসন্ধান, খনন আর উত্তোলন; এ নিয়ে পরে লেখার ইচ্ছা আছে। ছবিটি নিয়েছি এখান থেকে)
আগের কিস্তিতে পরিশোধন নিয়ে বলেছিলাম। এই কিস্তিটা বিপননের প্রথম ভাগ। কোন সংস্থার বিপনন কর্মকান্ডকে সরবরাহ ব্যাবস্থা, প্রচার, সামগ্রি ও সামগ্রির মুল্য ও– এই চারটি খোপে ফেলে দেখা চলে।
বাংলাদেশের নিজের তেল খুবই সামান্য (দৈনিক ~২০০ ব্যারেল, হরিপুর)। ক্রুড ও পরিশোধিত মিলিয়ে দেশের চাহিদা ৩.৫ থেকে ৪ মিলিয়ন টনের মধ্যে, যার সবটাই আমদানী করে আনা হয়। এর মধ্যে এল মিলিয়ন টন ক্রুড, দেড় মিলিয়ন টন হল ডিজেল আর কিছুটা জেটফুয়েল। ঠেকায় পড়লে কুপি, হারিকেনের কেরোসিনও আমদানি হয়। তেলের আমদানী সরকারের হাতে।
আমাদের অন্যান্য বড়মাপের অবকাঠামোর মত তেলের সরবরাহ ব্যাবাস্থাতেও সেই ব্রিটিশ আমলের পর বড় কোন পরিবর্তন আসে নি। ব্রিটিশ আমলের লঞ্চরুট ও পাটশিল্পকে জ্বালানী সরবরাহ করার জন্য তৈরি – খুলনার দৌলতপুর ও ঢাকার কাছের ফতুল্লা ও গোদনাইলের বড় বড় এবং ভৈরব বাজার ও উত্তর বঙ্গের রংপুর, পার্বতিপুর, নাটোরের মাঝারি/ছোট ডিপো গুলো। চট্টগ্রামের অবশ্য একটি তেলের মজুদ ও সরবরাহ অবকাঠামো সবসময়ই ছিল, পাকিস্তান হওয়ার পর একে ঘিরেই দেশের অন্যান্য ডিপোগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরবরাহ ব্যাবস্থা গঠন করা হয়। সমুদ্রগামি জাহাজে বয়ে আনা ক্রূড চট্টগ্রামেই থাকে। আর পরিশোধিত পন্যগুলি রেল ও নদী পথে বড় ডিপোগুলিতে পাঠানো হয়। পরে এই ডিপো গুলো থেকে ট্রাকে করে তেল পাঠানো হয় পাম্প অথাবা ডিলারের কাছে। লুব্রিক্যান্টের সরবরাহ ব্যাবাস্থাটি আরেকটু জটিল, তা নিয়ে পরে বলছি।
সরকারি নিয়ন্ত্রনের বাইরে দেশে বেশ কয়েকটি ডিপো আছে। সরকারি রস্তায় যেমন স্থানীয় মাস্তানেরা টোল তোলে, নদীপথে সরকারি ডিপোতে যাওয়ার সময় লাইটারেরা এইগুলিতে কিছু নাজরানা না দিয়ে এগুতে পারে না। চাঁদপুর ও গোয়ালন্দের এরকম ডিপোতে আমি গেছি – তিন চারটি মানুষ সমান ট্যাঙ্ক নিয়ে বসে গেছেন জনাবেরা, এখানে মোবাইল কোর্ট যায় না, বি এস টি আই যায় না – তবে তেল কম্পানীর ও স্থানীয় থানার লোকের এসে নিয়মিত বখরা নিয়ে যাচ্ছে। ছোট লঞ্চ, শ্যালোচালক ও জেলেরা এদের প্রধান ক্রেতা।
পদার্থবিদ্যার আইন মেনেই তেল গরমে আয়তনে বাড়ে আর ঠান্ডায় কমে। আর সব তরলের মত একটি পাত্রে যা ঢালা হবে, তার কিছুটা পাত্রের গায়ে লেগেই থাকবে। এই হিসাবে সব লাইটারকেই চালানপ্রতি ২-৫% ছাড় দেয়াটা এই শিল্পের প্রচলন। কিন্তু বাপেকের ছাড় এক ইস্পিশিয়াল ছাড় – এখানে চালানপ্রতি ২০% ছাড়ের নজির আছে।
এই লাইটারগুলোর নিয়োগ নিয়েও আছে আরেক মজা। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে লাইটারেজের তালুক দিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে কোন টেন্ডার নিলামের ব্যাবস্থা নেই – মহানুভব সরকার এখানে হালুম করেন না।
মন্তব্য
প্রয়োজনীয় লেখা। আমার এ মন্তব্যটা বোধহয় আপনার আগের পর্বে অর্থাৎ পরিশোধনে বেশী মানানসই ছিল। বিশ্বব্যাপী এখন যে তেলের দাম বেড়ে গেছে তা কিন্তু এই পরিশোধনের কারণেই। যেটা সাধারণ মানুষ মনে করছে- তেলের জোগান আছে, তারপরও দাম বাড়ছে হয়ত কোন মহলের কারসাজির কারণে; ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠিক না। ক্রুড অয়েলের পর্যাপ্ত সাপ্লাই আছে ঠিকই, কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী রিফাইনারীগুলোর শোধন ক্ষমতা কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত ৩০ বছরে নতুন কোন রিফাইনারী তৈরী হয় নি। মান্ধাতার আমলের রিফাইনারীগুলো পুরনো টেকনোলজি দিয়ে এখনো ধুঁকে ধুঁকে তেল শোধন করে চলেছে, যার ফলে খরচ সেদিকে বেড়ে গেছে। তাছাড়া ২০০৫-এ হারিকেন ক্যাটরিনার আঘাতে গালফ অফ মেক্সিকো অঞ্চলের রিফাইনারীগুলোর একটা বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সমস্যা প্রকট হবার এটাও একটা বড় কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রে ভারী শিল্প স্থাপনে এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট ইত্যাদি নানা বিষয়ে কড়াকড়ি থাকায় তেল কোম্পানীগুলো যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রিফাইনারী স্থাপনে বিশেষ উৎসাহী না। ফলে ৩০ বছর আগের রিফাইনারী দিয়েই এখন এই দেশে কাজ চলছে। আমার মনে হয় তেল সংকটের এই সময়ে বাংলাদেশ নতুন রিফাইনারী স্থাপনের এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
(যুক্তরাষ্ট্র শেভরনে কর্মরত একজনের সাথে আলাপ করে আমার এ দু' পয়সার অভিমত )
= = = = = = = = = = =
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত
আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত
আমরা ঘুচাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
ভাল বলেছেন।
শেভরন অবশ্য নিজেই ভারতে রিলায়েন্সের সাথে বিরাট রিফাইনারি প্রায় তৈরি করে এনেছে; পশ্চিমে যেখানে নতুন একটি রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা যোগকরতে ব্যারেলপ্রতি ২৫-৩০ হাজার ডলার, আম্বানিরা দেখিয়ে দিয়েছে যে তাদের সম্রাজ্যে ব্যারলপ্রতি ৮-১০ হাজার ডলার দিয়ে ঝকঝকে নতুন রিফাইনারি বানাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন রিফাইনারিতে বিনিয়োগ এতকাল না ঘটলেও এখন কিন্তু বড় বড় বিনিয়োগের খবর আসছে। সস্তা ডলার ও পরিবেশ সচেতন ক্রেতার টানই আলাদা।
নতুন মন্তব্য করুন